
সম্ভবত রাত তখন ৮টা বেজে কুড়ি।
রাজাবাগ গ্রিন লাইন বাস কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক—বয়স হবে বাষট্টি। মাথাভরা সাদা চুল, মুখে চাপ চাপ দাঁড়ি, পিঠে একটা ট্রাভেল ব্যাগ। পরনে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর লাল রঙের গোল গলা টি-শার্ট, তাতে বড় করে লেখা “Love Me।” লোকটার নাম লতিফ।
এই বয়সে “Love Me” লেখা লাল কটকটা টি-শার্ট পরা—কাজটা একদমই তার মানায় না। তাই অস্বস্তিটাও বেড়ে যাচ্ছে প্রতি মিনিটে, সঙ্গে বাড়ছে মেজাজ। রাগটা গিয়ে পড়েছে তার আজীবনের বন্ধু শিহাবের ওপর।
লতিফ সাহেব রিটায়ার্ড সরকারি অফিসার। এক ছেলে, এক নাতি—জীবন মোটামুটি গুছানো। শিহাব সাহেবও তাই—রিটায়ার্ড সরকারি অফিসার। এক ছেলে, এক নাতি—সেটাও ঠিকঠাক চলছে।
লতিফ আর শিহাবের বন্ধুত্বটা পুরোনো দিনের। ছোটবেলা থেকে তারা একে অপরের ছায়া। একই গ্রামের পাশের বাড়ি, একই স্কুল, কলেজ, এমনকি একই বিশ্ববিদ্যালয়ও। চাকরিটাও দুজনেই সরকারি। এখন থাকে দুজনেই ডিওএইচএসে— শুধু পার্থক্য এইটুকু: একজন মিরপুর ডিওএইচএসে, আরেকজন মহাখালীতে।
লতিফ চিন্তিত মুখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের বাতাসে হালকা ধুলা উড়ছে, তবুও লোকটা নড়ছে না। মনে মনে বলছে—
“এই শিহাব হারামজাদা, তাড়াতাড়ি করে আসতে বলেছি, বেটা এখনও আসছে না। কোনো সমস্যা হলো নাকি? সমস্যা হলে তো আমাকে ফোন দেওয়ার কথা…”
ঠিক এমন সময় পাশে এসে থামলো একজন লোক। সাদা ধোপধোপ পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা, চোখে শান্ত এক চাহনি। লতিফ একবার চোখ তুলে দেখলো, তারপর আবার রাস্তার দিকে তাকালো—ভাবছে, “ শিহাব এখনো আসছে না কেন।”
হঠাৎ সেই লোকটা বললো,
—“কিরে লতিফ, তুই কি আমাকে চিনতে পারছিস না?”
লতিফ ঘুরে তাকাতেই অবাক—এই তো শিহাব! শিহাবকে দেখে লতিফের মুখটা এক মুহূর্তে লাল হয়ে গেল। যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে।
—“কি রে, তুই এভাবে কেন এলি? তোর তো কথা ছিল প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে আসবি! তুই এই সাজে কেন?”
শিহাব ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বললো,
—“আরে, তুই কি বাচ্চা? পাগল হয়ে গেলি নাকি? এই বয়সে ওই ড্রেস-আপ মানায়?”
লতিফ মুখ গোমড়া করে বললো,
—“আরে বেটা, মানায় নাকি না মানায় সেটা তুই বুঝবি না। তোর সঙ্গে কথা ছিল আমরা প্যাংকু ড্রেস পরে কক্সবাজার যাবো।”
শিহাব হালকা বিরক্ত গলায় বললো,
—“বন্ধু, প্লিজ এমন করিস না। ভাবতেই তো কেমন লাগছে। তার উপর অফিসের কেউ যদি দেখে ফেলে, তখন কাণ্ডটা কেমন হবে?”
লতিফ এবার হাত নেড়ে বললো,
—“তুই শালা, আগের মতোই হাফ-লেডিস রয়ে গেছিস, একটুও বদলায়নি! দূর শালা, যাবই না।”
এইটা বলে লতিফ ধীরে ধীরে বাস কাউন্টারের দিকে হাঁটা শুরু করলো। হাঁটার ভঙ্গিটা এমন, যেন সে কোনো দার্শনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে—এখন আর তাকে কেউ থামাতে পারবে না।
শিহাব মুচকি হেসে ভাবলো,
“লতিফ যা-ই করুক, শেষ পর্যন্ত ও ঠিকই যাবে। মাঝে মাঝে মাথায় একটু জোঁক উঠলে এমনই করে। তখন বুঝে নিতে হয়—ওর যুক্তি শেষ, শুরু হয়েছে নাটক।”
হাঁটতে হাঁটতে লতিফের গলার স্বর ভেসে এলো—কিছু বিড়বিড় করছে নিজের সঙ্গে।
“এই হ্যাংকু-প্যাংকু স্টাইলেই বরাবর চলি, তাতে কার কী আসে যায়?”
অফিসের লোকেরা ওকে ডাকতো “বুইড়া প্লেবয়।” ওই ডাকটা নিয়ে লতিফের কোনো লজ্জা নেই—বরং একধরনের গর্বই আছে মনে মনে।
শিহাব মাথা নাড়িয়ে হালকা নিঃশ্বাস ফেললো, তারপর পেছন পেছন হাঁটা ধরলো বাস কাউন্টারের দিকে। গ্রিন লাইন-এর একটা বাসে তারা কক্সবাজার যাবে ঘুরতে। দুই পুরোনো বন্ধু, যাদের জীবন এখন শান্ত, কিন্তু মনটা এখনও দুষ্টুমিতে ভরা। তাদের স্ত্রী—দুজনেরই—অনেক আগেই ওপারে চলে গেছেন। কিছুদিন আগেই তারা রিটায়ার্ড করেছে, এখনো এলপিআর-এ আছে। দুজনেরই ছেলে সংসার-সংসার করছে, নিজেদের মতো সচ্ছল, প্রতিষ্ঠিত।তাই হয়তো আজ তারা যাচ্ছিল—কক্সবাজারে, শুধু একটু মুক্ত বাতাস নিতে, আর হয়তো পুরোনো নিজেদের ফিরে পেতে।
লতিফ সাহেব হাসি কপালে, একটু চট করে বললো,
“বন্ধু, পাঁচ প্যাক সিগারেট কিনেছি — আমরা দুজনে মিলে খাইব।”
শিহাব সাহেব খানিক চমকে:
“তুই কবে থেকে সিগারেট ধরলি?”
লতিফ চোখে ঝটপট এক চাহনি মেরে উত্তরে এলো,
“ আরে বন্ধু, কক্সবাজার যাবো এই উপলক্ষে সিগারেট কিনেছি।”
শিহাব ঠোঁট কুঁচকে বললো,
“তোর যা মন চায় কর, আমি সিগারেট খাব না।”
লতিফ একটু রেগে, ঠোঁট ফুঁকে উঠলো,
“তুই খাবি না? তোর বাপে খাবে! তোর গলায় পাড়া দিয়ে খাওয়াবো! বেটা এমনি কথা ভঙ্গ করছোস, হুজুর সেজে আসছোস।”
শিহাব কিছু বললো না। এই লতিফ একটু পাগলের মতো—যদি বকতে শুরু করো, ও জোর করে খাইয়ে দেবে; পুরো ব্যাপারটাই বেতাল করে ফেলবে। তাই চুপ থাকা ভালো।
কিছুক্ষণ পর আবার লতিফ বলে উঠলো,
চোখে একরকম দুষ্টুমি নিয়ে : “বন্ধু, হোটেলে বার আছে, লাল পানির খাবারেরও ব্যবস্থা আছে — মজা হবে বন্ধু! মজা হবে”
হেসে উঠলো লতিফ সাহেব
শিহাব ভীষণ অবাক হয়ে, অর্ধচোখে নেড়েচেড়ে বললো,
“কি বসছিস তুই!? তুই কি সত্যি সত্যি ওইগুলো খাবি ?”
লতিফ নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বললো,
“অবশ্যই খামু, তুইও আমার সাথে খাবি।” তারপর হঠাৎ একটু দম নিয়ে, কণ্ঠে চটক ধরে হাসতে হেসে বললো, “শুন বন্ধু, খাব আর এই দিক ওই দিক তাকাবো — বুঝছিস কি বলছি?”
শিহাব বকাঝকা করে উঠলো,
“তোর যা মন চায় করিস, আমায় এইসবের মধ্যে আনবি না। আমি ওইগুলো খাব না।”
লতিফ একটু উত্তেজিত হয়ে বললো,
“তুই খাবি না, তোরররর…”
শিহাব চট করে লতিফকে থামিয়ে, মুখেই বসল রেগে কণ্ঠে:
“আমার বাপ যদি খায়, তাহলে খাক কিন্তু আমি খাবো না । পারলে তুই তোর বাপকেই খাওয়া! শালার শালা, বুড়ো বয়সে…… মাথায় তেল উঠছে?”
লতিফ আওয়াজে ঝাঁটার সুর,
“ওই শালা! হুজুর হয়েই মুখ খারাপ করোস কেন? এমন…….. দিব না — তোর বাপের নাম ভুলে যাবি।”
শিহাব হেসে, কিন্তু রাগ জমে কণ্ঠে কাঁটা মিশিয়ে বললো,
“যা পারলে আমার………. ছিঁড়া দেখা।”
মাইকে ঘোষণা ভেসে এলো—তাদের বাস ছাড়বে। দু’জনে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, যেন কিছুই হয়নি। এমনটা তারা আগেও বহুবার করেছে—রাগারাগি, ঠাট্টা, তারপর কিছুই হয়নি—এটাই তাদের বন্ধুত্বের ধরন।আসলে ছোটবেলা থেকেই এমন। যতই তর্ক হোক, মন খুলে আবার কথা বলে ফেলে। তবু লতিফ সাহেব আর শিহাব সাহেবের চেহারায় একটা বিষয় সবার চোখে পড়ে— যেটা মানুষ মাঝে মাঝে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসাও করে।
লতিফ সাহেবের কপালে বেশ বড় একটা কাটা দাগ। আর শিহাব সাহেবের নাকটা একটু বেঁকা। দুটোই তাদের ছোটবেলার দাগ—তারা নিজেরাই একে অপরকে উপহার দিয়েছে, একবারের মারামারিতে।
দু’জনেই বাসে চেপে বসল। সামনের সিট—ওদের প্রিয় জায়গা। বছরের পর বছর ধরে নির্ধারিত, কে জানালার পাশে বসবে আর কে বাইরে—এ সিদ্ধান্তটা তারা কলেজ জীবন থেকেই মেনে চলেছে। নিয়মমাফিক এবারও লতিফ সাহেব জানালার পাশে।
ওদের সিটের ঠিক পেছনে বসেছে এক দম্পত্তি আর তাদের তিন-চার বছরের এক ছোট ছেলে। বাস ধীরে ধীরে পূর্ণ হচ্ছে, যাত্রীরা উঠছে, আর সেই বাচ্চাটা ক্রমাগত বাবাকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে— একটার পর একটা, যেন প্রশ্ন ফুরোয় না।একসময় বাচ্চাটা উঠে দাঁড়িয়ে সামনে উঁকি দিল। শিহাব সাহেব আর লতিফ সাহেবের দিকে ভালো করে তাকিয়ে, বাবাকে সরল কণ্ঠে বলে উঠলো,
“বাবা বাবা, ওখানে একটা গন্ডা (গুন্ডা) দাদু বসে আছে!”
বাচ্চাটার কথা শুনে বাবা-মা হকচকিয়ে গেল, তাড়াতাড়ি তাকে থামানোর চেষ্টা করলো। আর ওইদিকে শিহাব সাহেব মুচকি মুচকি হাসছে, আর লতিফ সাহেব রাগে ফুঁস ফুঁস করছে।ছেলেটা একটু একটু করে এগোতে লাগল, সামনের সিটের দিকে—চোখে একরকম বিশুদ্ধ উৎসাহ। লতিফ সাহেবকে কটকট করে তাকিয়ে সে যেন ওয়ান-টু-টু করে সব দেখাতে চায়। সেই উৎসাহ শিহাব সাহেবেরও চোখ এড়াল না; তিনি নিজেই ছেলেটাকে ডেকে কোলে তুলে নিলেন এবং মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমার ছোটো দাদুর নাম কী?”
ছেলেটা গোল করে উত্তর দিল,
“আমার নাম অনাথ।”
নামটা শুনে শিহাব সাহেব খানিক বিস্মিত হলেন; পেছনের সিট থেকে বাবা-মায়ের কণ্ঠস্বর একটা হেসে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ওই পিতামাতা বললেন, “বাবা, তোমার নাম অনাথ না—দাদুকে বলো তোমার নাম অনিক।”
ছেলেটা আবার কণ্ঠ উঁচু করে বলল,
“আমার নাম অনাথ।”
শিহাব সাহেব হাসি ধরে না রেখে বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমার ছোটো দাদুর নাম অনিক। আমার ছোটো দাদু কি পড়াশোনা করে?”
অনিকে জবাবটা দিতে কোন বেগ পেতে হয়নি:
“আমি পড়াশোনা করি না, আমি ফাইটিং করি।”
“ও আচ্ছা,” শিহাব আড়চোখে দেখে বললেন, “তাহলে আমার ছোটো দাদু কীভাবে ফাইটিং করে?”
শিহাবের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই অনিক ধোপাশ করে লতিফ সাহেবের গালে বসিয়ে দিলো এক চটিক ঘুষি। এইটা দেখে শিহাব সাহেব, হেসে ফেটে পড়লেন; পাশের কিছু যাত্রীও হাসিতে মিশে গেলেন। অনিক আবার বাবার কোলে উঠে উঁকি দিয়ে লতিফকে দেখে কেঁদে উঠলো না—বরং মজাই পেল।
লতিফ ঘুষিটা খেয়ে সিট থেকে উফফ উফফ করে উঠলেন, মুখে অচেনা রাগ মাথায় উঠতে লাগলো—গজগজ করে বকতে লাগলেন। শিহাব সাহেব হাসতে হাসতে লতিফকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি রে বন্ধু, কেমন দিলাম?” আর হেসেই উঠলেন পুনরায়।
লতিফ তীব্র কণ্ঠে আওয়াজ দিলেন,
“তুই চলো আগে; হারামজাদা, তোরে মজা আমি বের করে দেবো।”
শিহাব আরেকবার জোরে হেসে উঠলেন। বাসের লাইটগুলো নিভে গিয়েছিল; বাস চুপচাপ তার গন্তব্যের দিকে চলে চলল।
পরিশেষে
অনেক দিন ধরে মাথার ভেতর একটা উপন্যাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো সকালে চা খেতে খেতে মনে হতো—“আজই লিখে ফেলব,” আবার সন্ধ্যায় মনে হতো—“না, এখনো সময়টা ঠিক হয়নি।”
গল্পটা কিছুটা মেডিক্যাল ঘরানার। আমি ডাক্তার না—এই জায়গাটাই আমাকে বারবার থামিয়ে দিয়েছে।ভাবতাম, এতসব টার্ম, এতসব চিকিৎসাবিজ্ঞান—এসব না জানলে কীভাবে লিখব? তারপর একদিন মনে হলো, উপন্যাস তো প্রেসক্রিপশন না, এটা হৃদয়ের লেখা—যেখানে লাগে কেবল অনুভব, আর সত্যিকার মানুষজনের গল্প।
এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু আমাদের দেশের সেই বৃদ্ধরা, যাদের চোখে এখনো আলো আছে, কিন্তু সেই আলো দেখার মানুষ কমে গেছে। যাদের গল্প কেউ লেখে না, অথচ তারা চুপচাপ বেঁচে থাকে— স্মৃতির ভেতর, নিঃসঙ্গ বিকেলে, কিংবা কারও অবহেলায়।
আজ সামুতে যা পোস্ট করলাম, সেটাই এই উপন্যাসের শুরু। শেষটা লিখে ফেললে হয়তো এই শুরুটা আর থাকবে না— অথবা অন্য কোনো শুরু এসে জায়গা নেবে। তবু এই শুরুটুকু রেখে দিতে ইচ্ছে হলো— যেন মনে থাকে, কোনো এক সন্ধ্যায় একজন মানুষ গল্প লিখতে বসেছিল, বৃদ্ধদের কথা ভেবে, ভালোবাসা দিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




