২৯ শে এপ্রিল । ১৯৯১ সাল । চট্রগ্রাম পতেঙ্গা শহর । দুপুর বারোটা । আকাশ একদম ঝকঝকা । মাঝে মধ্যে কিছু মেঘ এসে সুর্যের তাপ থেকে খানিক মুক্তি দিলেও সুর্যের তেজের সাথে না পেরে মেঘ গুলা দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে । টিফিন শেষ করে ক্লাশে ফিরছিলাম । আম্মার দেয়া পরটা সুজি আর ডিম ভাজা দিয়ে উদরপুর্তি করে ঢেকুর তুলতে তুলতে ক্লাশের দরজায় পা রাখতেই ঢং ঢং করে ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলো । আমরা সবাই এর ওর মুখ দেখছি । এমন ঘটনা আমার জানামতে কখনই ঘটে নাই । ক্লাশে না ঢুকে সবাই মিলে স্কুলের প্যারেড গ্রাউন্ডে হাজির হলাম । আমার আসার আগেই অনেকেই দেখছি গ্রাউন্ডে জড়ো হয়েছে । সবাই ফিসফাস করছে ।ধীরে ধীরে গ্রাউন্ড ভরে গেলো । সিনিয়র ভাইরা একটূ দূরে দাঁড়িয়ে সিনিয়র আপাদের সাথে চোখের দৃষ্টি বিনিময় করে হেলেদুলে মজা নিচ্ছে । আমরা কেউই জানি না ছুটির ঘন্টা কেনো বাজলো ।
অংকের স্যার । রবীন্দ্রনাথ বাবু । অসম্ভব রাগী এবং কাটখোট্টা একজন মানুষ । তিনি যখন মাইক হাতে নিয়ে ফ্লাগ স্ট্যান্ডে এলেন বুঝলাম সিরিয়াস কিছু । সবাইকে বাড়ি চলে যেতে বললেন আর সাবধানে থাকতে বললেন । স্কুল অনিদৃষ্ট কালের জন্য ছুটি ঘোষনা করলেন । সবাই এমন জোড়ে খুশিতে হৈ হৈ করে উঠলো যে স্যারের বাঁকি কথায় কানেই এলো না । সবাই যে যার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দে ছুট । আমাদের মধ্যে এমন একটা তাড়া ছিলো যে আবার না স্যার ডেকে বলেন স্কুল চলবে যার যার ক্লাশে ফিরে যাও । আমাদের স্কুলে ছেলেদের জন্য কোন বাসের ব্যাবস্থা ছিলো না । কেবল মেয়েরা বাস পেতো । ছোট বোন টিয়া কে বাসে তুলে দিয়ে । কাঁধে ডাউস সাইজের ব্যাগ নিয়ে বাসার রাস্তা ধরলাম ।
স্কুলের পাশ দিয়ে মিটার গেজের একটা রেল লাইন চলে গিয়েছে । বেশিরভাগ সময় তাতে মাল গাড়ি যাতায়েত করতো । আমি অন্তত কখনই পেসেঞ্জার গাড়ি চলতে দেখি নাই । আমরা কয়েকজন সেই রেল লাইন ধরে বাসায় ফিরতাম । কারন মুল রাস্তা দিয়ে গেলে পাক্কা এক ঘন্টা লেগে যেতো আর রেল লাইন দিয়ে গেলে আধা ঘন্টায় বাসায় পৌছে যেতাম । যেহেতু আবাসিক এরিয়ার পাশে রেল লাইন তাই কাঁটা তারের বেড়া দেয়া ছিলো সেই বেড়ার এক কোনা ফাকা করে মাথাটা গলিয়ে সাবধানে পুরা বডি চালান করে দিয়ে ঠ্যাং দুইখানা বিভিন্ন কসরতের মাধ্যমে বেড়া পার হতে হতো । এর কারনে প্রায় জামা প্যান্টের বিসর্জন দিতে হতো এবং কানমলা ও চর থাপ্পর বাধ্যতামূলক ছিলো । তো সেই রেল লাইন ধরে হেটে যেতে আরো একটা মজা ছিলো মাল গাড়ি গুলা বেশ আস্তে চলতো । আমরা মাল গাড়ি দেখলেই টুক করে লাফিয়ে মাল গাড়ির পেছন দিকে খোলা বগীতে উঠে পরতাম । তারপর আর কি বেশ আরাম করে কলনির সামনে লাফিয়ে নেমে যেতাম । কিন্তু আজ আর কোন মাল গাড়ি দেখা যাচ্ছে না । আকাশ হালকা মেঘে ঢেকে আছে । সেই সাথে ঠান্ডা বাতাস ।
কলনিতে পৌছাতে পৌছাতে সম্পুর্ন আকাশ কৃষ্ণবর্ন ধারণ করলো । আমাদের ব্লকে এসে দেখি আম্মা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে । হাত দিয়ে ইঁশারা করে ব্যাগ সিড়ির উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে মাঠের দিকে ছুটে গেলাম । এমন মেঘলা দিনে ফুটবল খেলতে দারুন মজা। মাঠে গিয়ে দেখি একটা প্রানীও নাই । দূরে সেন্ট্রীরা মাথায় বিভিন্ন বোঝা নিয়ে ছোটাছুটি করছে । বিষন্ন মনে বাসায় ফিরতেই আম্মা কানের নিচে বিরাশি সিক্কার একটা থাবড়া মেরে ঘেটি ধরে ঘড়ে ঢুকিয়ে কিছুক্ষন বকাঝকা করলো । এমন সব বকাঝকা আমার আবার তেমন গায়ে টায়ে লাগে না । কিন্তু টিয়ার বেইমানী আমাকে আশাহত করে দিলো । আজ নাকি টিয়ার সত্য বলা দিবস তাই সে বলে দিয়েছে যে আমি মাল গাড়ির ঘাড়ে চড়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরি । আঁড় চোখে ওর দিকে অগ্নী দর্শন দিয়ে বিনা প্রতিবাদে সুন্দর বাক্যমালা গুলি গলায় পরে নিলাম । আম্মা আমাকে ছেড়ে অন্যকাজে ব্যাস্ত হয়ে পরলে আমি টিয়ার কানে কানে শুনিয়ে দিলাম আজ রাত্রে ঘুমাতে এলে কাঁটা কম্পাসের কাঁটা দিয়ে ওর পিঠ ফুট করে দেব । আমার হুমকি দিতে দেড়ি টিয়া এক দৌড়ে আম্মার কাছে গিয়ে বসে পরলো।
আব্বা এখনো ফেরেনি । সাধারনতো দুপুরে আব্বা খানা খেতে আসে । আজ এখনো আসে নাই । আম্মা চিন্তিত মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে । আকাশে ধুমধাম করে শব্দ হচ্ছে । আমাদের কলনি সমুদ্র থেকে দশ কিলোমিটার দূরে ছিলো । আর আমরা যে বিল্ডিঙে থাকতাম সেটা ছিলো সারির মাথার শেষ বিল্ডিং । আমাদের বিল্ডিং থেকে সুন্দর সমুদ্র দেখা যেতো । সন্ধায় প্রাই আমরা ছাদে চলে যেতাম । সমুদ্রে নোঙর করা জাহাজের বাতি গুলে এক এক করে জ্বলে উঠতো । মনে হতো সমুদ্রের মধ্যে অন্য একটা শহর । দেখতে বেশ লাগতো । বাতাসের বেগ যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে । সেই সাথে আম্মার মুখ আরো বেশি কালো হচ্ছে । আম্মা সারা ঘরময় পায়চারী করতে লাগলো । কখনো সামনের বারান্দা কখনো পেছনের বারান্দা । বাতাসের বেগ বেড়ে যাওয়ায় আম্মা সব জানালা বন্ধ করে দিলো ।
আম্মা আমি আর টিয়া একটা রুমে চুপ চাপ বসে আছি । টিয়া আমার কাছ থেকে দূরে বসে আছে । আমিও তক্কে তক্কে আছি কম্পাসের কাটাটা ফুঁটিয়ে দেবার জন্য । কারন আব্বা আজ না এলে টিয়া আম্মার সাথে রাত্রে ঘুমাবে । আমার পরিকল্পনা একদম ব্যার্থ হতে দেয়া যাবে না। বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান এইবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান । বাতাসের ধাক্কা বেশ বেড়ে গেলো । টানা শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে । মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে বাতাস যেনো পাগলা ষাঢ়ের মতো এসে গুঁত দিচ্ছে । কোথায় যেনো ঝনঝননিয়ে কিছু ভেঙ্গে পরতে শুনলাম । আমি দরজার ফাঁকা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম । আমাদের বাসার পেছন দিকের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চৌচির । জানালার সাথে ঝুলে থাকা ভাঙ্গা কাঁচের টুকরা গুলি বুলেটের মতো ছুটে এসে দরোজায় এসে বিঁধল। আম্মা আমাকে এক টান দিয়ে ঘরের ভেতর টেনে নিলো । আবার একপ্রস্থ বাক্যবানে জর্জরিত হলাম । মন খারাপ করে বাসার এক কোনে বসে রইলাম ।
বাতাস যেনো বেড়েই যাচ্ছে । সেই সাথে বাতাসের তিব্র ধাক্কা । আমাদের বাসাটা খানিকটা কেঁপে উঠলো । আমি খাট থেকে নেমে মেঝেতে বসে পরলাম । টিয়া কোন ফাঁকে এসে আমার কাছ ঘেঁসে বসে পরেছে টের পাই নাই কারন ঘুটঘুটে অন্ধকার । বাহিরে বিশাল শব্দে এক একটা বাঁজ পরছে । আম্মা আমাদের তিনজন কে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে বসে রইলো । আমাদের বিল্ডিংটা আবার কেঁপে উঠলো মনে হলো বড় কোণ দৈত্য তার হাত দিয়ে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে । বেশ কিছুক্ষন এমন কাঁপাকাঁপি চললো । হঠাত করে খেয়াল করলাম আমাদের বিল্ডিংটা এক দিকে খানিকটা কাত হয়ে গেছে । টেবিল থকে ফুলদানী টা বিনা কারনে ঠাস করে পরে গেলো । আমি মনে মনে নিশ্চিন্ত হলাম অন্তত আমার হাত দিয়ে ওঠা পরে নাই । কান পাতলেই শুনতে পাচ্ছে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ । ঝনঝন করে ভাংছে । দূরে হালকা মানুষের আর্ত চিৎকার ও শুনতে পাচ্ছি । আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখি আম্মা আমাদের জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে । এমন সময় কে যেনো আমাদের বাসার দড়জায় বার বার জোরে জোরে কড়া নাড়ছে । টিয়া লাফ দিয়ে উঠে বললো আব্বা আসছে । ও এক দৌড়ে রুমের দরজা খুলে ছুটে গেলো । ঠিক তখনি দেখলাম একটা কাঁচ উড়ে এসে টিয়া কপালে এসে বিধলো । টিয়া ভাইয়া বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পরে গেলো । আমি আম্মা কে ছাড়িয়ে দৌড়ে টিয়ার কাছে ছুটে গেলাম । মঝে ভর্তি ভাঙ্গা কাঁচ । পায়ের নিচে পরে কিচমিচ করে ভাংছে । আমার পা কেটে রক্তে লাল হয়ে গেছে । আমি কোন রকমে টিয়া কে টেনে অন্য একটা রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম । ওই দিকে আম্মা জোরে জোরে আমাদের নাম ধরে ডাকছে আর কাঁদছে । আমি আম্মা কে আমাদের দিকে আসতে বললাম । আম্মা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে দৌড়ে আমাদের কাছে চলে এলো ।
দরজায় একের পর এক ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে কেউ । আমি মাথা নিচু করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম । আমাদের পাশের বাসার আন্টি আমাদের কে বাসার বাহিরে আসতে বললেন । সবাই নাকি বিল্ডিঙের ছাদে চলে গেছে কেবল আমরাই বাকি । আম্মা আর টিয়াকে নিয়ে কোন রকম বাসার ছাদে চলে এলাম । ছাদের ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই । সবাই চুপ চাপ বসে আছে । বাতাসের চাপে সিড়ি ঘরের লোহার দরজা বাকা হয়ে খুলে পরে গেছে । খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে বাতাস আর পানির ছিটা আসছে । সবাই আমরা ভিজে টুপটুপ । এমন সময় দোতালার আন্টি চিৎকার করে উঠলো । হায় হায় আমার মালিহা কই । আমরা আশেপাশে তাকিয়ে মালিহা আপা কে খুজলাম তাকে পেলাম না । আন্টি দৌড়ে নিচে নামতে লাগলো । সবাই মিলে আন্টি কে ধরে রাখলো । কারন বিল্ডিঙের দুই তালা অব্দি ডুবে গেছে । আর মালিহা আপারা দোতালায় থাকতো । আন্টি জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলেন । তখন আমি আর এক বড় ভাই দুই জন মিলে নিচে নামার প্রস্তুতি নিলাম । আম্মা আমার হাত টেনে ধরে রাখলেন । কিছুতেই যেতে দেবে না । আমি সেই বড় ভাইয়ের সাথে আম্মার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিচের দিকে নেমে এলাম । এসে দেখি দোতলার বুক পর্যন্ত পানি । আন্টিদের বাসার দরজা খোলা । অন্ধকারে হাতাড়তে হাতড়াতে একটু দূরে আবছামতো কিছু ভাসতে দেখলাম । পানি ঠেলে কাছে গিয়ে দেখি । মালিহা আপা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আর তার খাট পানিতে ভাসছে । সাথের বড় ভাই দেখে হি হি করে হেসে উঠলো । আপা কে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে উঠালো । আপা কিছু না বুঝে পানির মধ্যেই ধপাস করে পরে পরে গেলো । ওরে বাব গো মাগো বলে চিৎকার শুর করে দিলো আপা । কোন রকমে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে সেই বড় ভাইকে নিয়ে আবার পানির মধ্যে চিত হয়ে পরলো । এইবার সেই ভাই আপার চুলের মুঠি ধরে টনাতে টানতে যেখানে পানি কম সেই পর্যন্ত এনে কি বকাটাই না দিলো । আপা হাউ মাউ করে কান্না কাটি করতে লাগলো ।ততক্ষনে মালিহা আপার আম্মা নিচে নেমে এসে আপা কে নিয়ে উপরে উঠে গেলো । আম্মা আমাকে আবার কান ধরে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেলো । পুরুষ মানুষের এমনি হয় । বিরত্বে কোণ মূল্য নাই তাদের।
সারা রাত এমন চললো । আমাদের বিল্ডিং কাত হয়ে আছে । আশেপাশে কিচ্ছু দেখা যায় না । কেবল দূরে মানুষের চিৎকার বাতাসের সাথে ভেসে আসছিলো । আম্মা কোথাও থেকে ছেড়া কাপড় এনে আমার পা আর টিয়ার মাথায় বেঁধে দিলো । কতো যুগ পরে মনে হলো যেনো হালকা আলো দেখা গেলো । দূরে সূর্যের মাথাটা উঁকি দেয়াতে আলো কিছুটা ছড়িয়ে গেলো । আমি ছাদের কার্নিশে গিয়ে তাকিয়ে দেখি আমার পরিচিত কলনী আর সেই কলনী নাই যেন ধ্বংসস্তুপ । আমাদের বিল্ডিং থেকে কয়েকটা বিল্ডিং দূরে একটা গাছে আস্ত একটা প্লেন এসে পরে আছে । দূরে অসংখ্য মানুষ পরে আছে কিন্তু কেউই নড়াচড়া করছে না । আস্তে আস্তে আলো ফুটে উঠলে আমরা যারা বেঁচে আছি তারা বেরিয়ে এলাম । যেন নতুন জীবন পেলাম । আব্বার কোন খোঁজ আমরা তখনো পাই নাই ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০২৩ রাত ১০:৫০