আমি খবরের কাগজ নিয়মিত পড়িনা; কখনোই পড়িনি। কারন গত কয়েক বছরে প্রফেসর ইউনূসের নোবেল জয় ছাড়া হাতে গোনা আর কয়েকটা খবর ছাড়া হেড লাইন হিসেবে কখনোই কোন ভালো খবর আসেনি। সহিংসতা আমি সইতে পারিনা। জানি এই কথা বলার সাথে সাথে প্রশ্ন আসবে, তাহলে তুমি ডাক্তার হয়েছো কি করে? কি করে বুঝাই, ক্যাজুয়ালটিতে অ্যাকসিডেন্ট আর গুলি বিদ্ধ রুগীদের সেবা দেয়া আর সহিংসতার বর্ননা পড়া-দুইটার মাঝে বিস্তর তফাত। সেখানে আমি একজন ডাক্তার, রুগীকে বাঁচানো ছাড়া ভিন্ন কোন চিন্তা তখন মাথায় আসে না। কিন্তু পেপার যখন খুলি তখন আমি একজন পাঠিকা, দেশের নাগরিক। এসব খবরে গা শিউরে ওঠে, কখনো লজ্জায় মাথা নীচু হয় আর কখনো অব্যক্ত ক্রোধ সামলাতে না পেরে পেপারটাকেই ছিড়ে ফেলি, এর চেয়ে বেশী ক্ষমতা আমার নেই কিনা।
পেপার পড়া বাদ দিয়েছি যখন প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে নির্লজ্জ টানাটানি হয়, তাকে দোষী প্রমাণ করার জন্য পুরো প্রশাসন উঠে পড়ে লাগে। একবারো কেউ ভাবে না যে এভাবে শুধু দেশের ভাবমূর্তিটাই নষ্ট হচ্ছে। তিনি তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল। দেশের বাইরে সবাই আমাদেরই অকৃতজ্ঞ ভাবছে, কৃতঘ্ন শব্দটি পাকাপাকি ভাবে আমাদের গায়ে সেটে যাচ্ছে।
রুমানা-সাঈদের ঘটনা যেদিন প্রথম পেপারে আসে, আমি সযত্মে এড়িয়ে যাই পুরো ঘটনা। আশে পাশের আলোচনা থেকে চোখ তুলে নেয়ার কাহিনী শুনেই আমি পেপার গুটিয়ে ফেলি। ইন্টার্ন লাইফের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। চক্ষু বিভাগে আমি এক রোগীর চোখের ড্রেসিং খুলছিলাম। তার চোখ নেই। স্বভাবতই আমি ধরে নিয়েছিলাম যে কোন দূর্ঘটনার ফলেই সে চোখ হারিয়েছে। ড্রেসিং করা শেষে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করেছিলাম যে দূর্ঘটনাটা কি করে ঘটলো। রোগী আমাকে জানালো জমির বিরোধে তার আত্মীয়রা চাকু দিয়ে তার চোখ তুলে নিয়েছে, তার সজ্ঞানে। শোনার সাথে সাথে আমি কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ি। আমার বন্ধুরা জাপটে ধরে। একজন মানুষ কি করে এত অমানবিক হতে পারে ভাবতেই আমার বমি আসতে থাকে ঘৃণায়। রোগীর লোক খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, ড্রেসিং করতে যেখানে আমার হাত কাঁপে না, চোখ তুলে নেয়ার ঘটনা শুনে আমি দুর্বল হই কি করে? কিন্তু ব্লগে নিয়মিত আসার ফলে আর দূরে থাকা সম্ভব হলো না। নারীবাদ, পুরুষবাদ, আমলাতন্ত্র এসব থেকে সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করি। স্টিকি পোস্টে করা কিছু মানুষের করা কমেন্ট দেখে আমার আতংকে হাত পা পারলে পেটের ভিতর ঢুকে যায়। কি করে পরকীয়ার দোহাই দিয়ে বেশীরভাগই রুমানাকেই দোষী ঠাউরাচ্ছে? অনেকে আবার বলছে যে সমস্যা আছে বলেই তো ডিভোর্স দেয়নি এতকাল। একজন প্রশ্ন তুললো যে এখন তার বাচ্চার কি হবে? সে কি স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে? কারন সেটিও রুমানার দোষ। বাচ্চার জন্যই যে সে মুখ বুজে সহ্য করছিলো এই সহজ কথা কেউ ভাবলো না। অথবা বাবা মাকে বাচ্চার সামনে মারলে যে ঘৃণা বাচ্চার মনে জন্ম হয়, সেটি বুঝতে কারো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই। কিন্তু তারপরেও মানুষ প্রশ্ন তোলে, এই দেশ বলেই হয়ত তোলে।
আজকে টানা হরতালের দ্বিতীয় দিন; আল্লাহ আমার কথা শুনে বৃষ্টিকে পাঠিয়েছেন ধরাকে ঠান্ডা করতে। রাজনৈতিক হরতালে বৃষ্টি আমার পছন্দ, কারন আমার ধারনা বৃষ্টিতে মানুষ সহিংস কাজ করতে পারেনা। কালও বৃষ্টি ছিলো। সহিংসতা বন্ধ হলো কি? পেপার খুলেই প্রথমে চীফ হুইপ ফারুক আর পুলিশের টানাটানির ছবি। তার উচ্চারিত শব্দ শুনে যেমন মনে প্রশ্ন জাগে যে কি করে এই ব্যবহার নিয়ে তিনি এই পদে আছেন, তেমনি পুলিশের আচরন নিয়েও প্রশ্ন জাগে যে ব্যবহার শিক্ষা আদতে তারা পেয়েছে কিনা। দুই পক্ষকেই মনে হয় শিষ্টাচারের মগজ ধোলাই দেয়া অত্যন্ত জরুরী।
জীবনে প্রথমবারের মতো হরতালকে সমর্থন জানিয়েছিলাম গত ৩রা জুলাই এর হরতালকে। আশা করেছিলাম যে যেহেতু রাজনৈতিক দলের ডাকা হরতাল না, তাই সহিংসতা হবে না। কিসের কি? পুলিশ এসে বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়া থেকে প্রফেসর আনু মোহাম্মদ সহ বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারের স্বনামধন্য ব্লগারদের যেভাবে গ্রেপ্তার করলো তা দেখে আমার মত নিরীহ মানুষেরও ইচ্ছে হতে থাকলো সব কিছু অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে যাই। প্রফেসর সম্পর্কে যে কটুক্তিটা প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় এলো, সেটা দেখে রাগের পরিবর্তে লজ্জা পেলাম। আমরা ভোট দেয়ার আগে কি কারো শিক্ষাগত যোগ্যতাটা একবারো দেখেছি? প্রথম আলোর প্রতিবেদন টা মনে পড়লো, যেখানে ৮০ ভাগ সাংসদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। তেল-গ্যাস চুক্তিনামা পড়ে আমার মতো আম পাবলিক যেখানে ফাঁক গুলো ধরতে পারছে, সেখানে বিশেষজ্ঞরা নির্লজ্জের মত চোখ খুলে তাকিয়ে আছে কি করে? তারা দমনে বিশ্বাসী, এইকারনেই গ্রেপ্তারকৃতদের উপরে রাস্ট্রোদ্রোহিতার মামলা দেবার কড়া হুকুম হয়। অভিনন্দন সেসব সাহসী ব্লগারদের যাদের মানব বন্ধন এবং প্রচেষ্টায় সবাইকে পরে রাত্রে মুক্তি দেয়া হয়। কথক পলাশ ভাইএর কথা মনে পড়লো, বিচারপতির বিচার করার জন্য আজ সবাই জেগেছে, এবার গণজোয়ারের পথ রুধিবে কে? কিন্তু সংশয় চেষ্টা করেও দূর করতে পারিনা। আসলেই কি আমরা নষ্টদের কাছ থেকে আমাদের অধিকার ছিনিয়ে আনতে পারবো? ছিনেয়ে আনতে পারবো আমাদের কনোকো-ফিলিপসের পেটে চলে যাওয়া স্বদেশকে? ইনশাল্লাহ।
এই ঘটনার রেশ থাকতে থাকতেই ভিকারুন-নিসা স্কুলের ভয়ংকর কাহিনী শুনে আবার সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দেশের সবচেয়ে স্বনামধন্য গার্লস স্কুলে, একটি বাচ্চা মেয়ে নির্যাতিত হলো, আর তার স্কুলের সবচেয়ে বড় অভিভাবক, তার প্রধান শিক্ষিকা নির্লজ্জের মত নির্যাতনকারীর সাফাই গাইলেন? এমনকি তিনি ব্যাপারটি মিউচুয়াল বলেও চালিয়ে দিয়ে চাইলেন। ঘটনা ঘটেছে বেশ কিছুদিন আগে, অথচ বেজন্মা (দুঃখিত, গালি দেয়া ছাড়া তার নাম উচ্চারণ করতে পারছিনা) পরিমলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলো আজ? তাও এত প্রতিবাদ, আন্দোলনের পর? উচিত কি ছিলো না সেদিনই রিমান্ডে নিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা? তার কি এমন খুঁটির জোর যে এরকম ভয়ংকর অপরাধ করার পরও পুলিশ তাকে ধরতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলো? অবশ্য যে দেশে খুনের মত অপরাধেও অপরাধী ক্ষমা পায়, সে দেশে আর আমরা কি আশা করবো? গার্লস স্কুলে যদি এরকম ঘটনা ঘটে, তবে আপনি আপনার আদরের সোনামণিকে কোথায় পাঠিয়ে শান্তিতে দু-দন্ড বসতে পারবেন? তীব্র ঘৃণা এদের প্রতি, তার চাইতেও বেশী আকুতি রাস্ট্রের মাথাদের কাছে, প্রিয়জনদের নিরাপত্তার জন্য।
কালকেই ব্লগার অচিন দেশে পাখির কাছ থেকে শুনলাম আরেকটি ভয়ংকর ঘটনা, হয়ত এটা পেপারের প্রথম পাতায় আসার মত যোগ্যতা অর্জন করেনি, কিন্তু শুনে স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। এক পরিবার ছুটি কাটাতে যাচ্ছিলো কক্সবাজার। তিন বছরের ছোট্ট শিশু নুহা তার পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান, তার বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলো। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ডাকাতরা রাস্তায় গাছের গুড়ি ফেলে ডাকাতির চেষ্টা করলে ড্রাইভার গাড়িটি টান দেয় জোরে। ডাকাতদের ছোড়া গুলি এসে লাগে নুহার মাথায়। রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় দেড় ঘন্টা সবাই ছুটাছুটি করে এ ক্লিনিক থেকে সে ক্লিনিক। কিন্তু এত খারাপ কেস দেখে কেউ হাত লাগাতে সাহস পায়নি। একসময় ছোট্ট নুহা পাড়ি দেয় দূর দেশে; এমন এক দেশে যেখানে শুধু যাওয়া যায়, কিন্তু ফিরে আসা যায় না। ব্লগার শাহরিয়ার নির্জনের ২০০৮ সালের আজ ছিলো নুহার জন্মদিন পোস্টটা পড়ে চোখের পানি আটকাতে পারিনি। কত স্বপ্ন নিয়ে তার নাম রাখা হয়েছিলো নুহা, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত; আর আজ কিছু হিংস্র ডাকাতের কারনে সেই স্বপ্ন কোথায় হারালো? প্রায় ১ মাস আগের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস মনে পড়ে গেলো। সিলেট মেডিকেলের আমার এক বন্ধু স্ট্যাটাস দিয়েছিলো, “আমার ভাইকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তোমরা কেউ যদি কোন খবর জানো আমাকে প্লিজ জানাও”। আতংকে শিউরে উঠেছিলাম। তার ভাই সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে দুপুরে রওনা দিয়েছিলো বাসে করে, কিন্তু এখন আর কোথাও তাকে ট্রেস করা যাচ্ছে না। গভীর রাতে ছেলে ঘরে ফেরে। জানা যায়, ডাকাতি হয়েছিলো বাসে। সব কেড়ে নিয়ে বাস আটকে রেখেছিলো অনেকক্ষন। আল্লাহর রহমতে, কিছু যাত্রীকে তারা মারধোর করলেও কারো প্রাণ নেয়নি। আমার এক বন্ধুর বাবা ওসি হওয়ায় জানলাম যে, এইসব ডাকাতদের অত্যাচারে কিছু কিছু বাস মালিক এদের টাকা দিয়ে শান্ত করে রাখে যাতে তার বাসে হামলা না হয়। এদের সংগঠন এতই শক্তিশালী যে পুলিশ প্রশাসনও ধরতে সাহস পায় না। এতই উঁচু লেভেল পর্যন্ত তাদের কালো হাত বিস্তৃত।
ছোট্ট নুহার জন্য তার চাচারা Unite for Nuha’s sake, unite agaist Crime গ্রুপ খুলে অপরাধের বিরুদ্ধে সংগঠিত হবার চেষ্টা করছে। ভিকারুন নিসা স্কুলের বেজন্মা লোকটার (আমি শিক্ষক বলতে পারবো না) বিরুদ্ধে আন্দোলন হওয়ায় আজ তাকে কেরানীগঞ্জ থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।ব্লগার রুদ্রপ্রতাপ না! এই আন্দোলনের শেষ এখানেই না। এতো মাত্র শুরু! পোস্টে জোরে সোরে একত্রিত হবার ডাক দিচ্ছেন। সাঈদের বিচারের দাবীতে সবাই একত্রিত হয়ে হাত তুলছেন। আমি জানি, আমি জানি এসব খবর আশা জাগানিয়া। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি বিশ্বাস করতে যে আমাদের তেল-গ্যাস আমাদেরই থাকবে, সাঈদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে, আর কোন স্কুল ছাত্রী কারো কুৎসিত রূপ দেখবে না, নুহারা আনন্দ করবে ঢেউএর সাথে বাবার হাত ধরে। কিন্তু পারছি না, পাসপোর্টে জন্মসূত্রে বাংলাদেশী সিল আছে, তাই সংশয় দূর হচ্ছে না। আমরা যে কেউই কারো ভালো দেখতে পারিনা। সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উঠার জন্য আমরা নিজেদের আত্মিক উন্নতি না ঘটিয়ে অপরকে চেষ্টা করি টেনে নিচে নামাতে। যখন পারিনা, তখন ছড়াই কুৎসা।
আমি এইসব নারীবাদ, আমলাতন্ত্র, ধর্মান্ধতা আরো কত কত কঠিন রাজনৈতিক টার্ম – কিছু বুঝিনা। আমি শুধু জানি যে আমরা সবাই বাংলাদেশী, এই দেশটা আমাদের। ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭১ এর সাহসী দেশপ্রেমিক মানুষগুলো ছিলেন বলেই আমরা আজো মাথা উঁচু করে হাঁটি। গর্বভরে নিজেদের সবুজ পাসপোর্ট ইমিগ্রেশনে দেখাই, আমরা সেই দেশের মানুষ যারা নিজেদের ভাষার জন্য প্রাণ দেয়; আমরা সেই দেশ থেকে এসেছি যে দেশের জননীরা তাদের ছেলেদের হাসিমুখে যুদ্ধে পাঠায়; আমরা নোবেল বিজয়ীর দেশ। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, এই ২০১১ সালে আমরা কি এমন কিছু করতে পারিনা, যাতে ২০৪১ সালের তরুনরাও এভাবে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে রাখতে পারে? নাকি আমরা তাদের জন্য রেখে যাবো লজ্জা আর কলঙ্ক ভরা এক অতীত?