শেষ বিকেলের রোদটা অনেকটাই মিইয়ে এসেছে। তারই রক্তিম একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত আকাশ জুড়ে, খানিকটা হয়তো ছড়িয়েছে প্রকৃতিতেও। কিন্তু সেটার প্রতি লক্ষ্য করার সময় কারও নেই। এই যান্ত্রিক শহরে সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। হয়তো যান্ত্রিক এই শহরে বসবাস করতে করতে মানুষগুলোও খানিকটা যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। যান্ত্রিক এই মানুষগুলোর ভিড়েই হাঁটছেন ইয়াকুব সাহেব। হয়তো এই মুহূর্তে তাঁর যাওয়ার একটা গন্তব্য ছিলো। কিন্তু তিনি তাঁর গন্তব্যের দিকে হাঁটছেন না। তিনি হাঁটছেন নিজের মতো করে। তিনি এই মুহূর্তে একজন গন্তব্যহীন মানুষ।
বেশ কিছুসময় এভাবে হাঁটতে হাঁটতে তিনি রমনা পার্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। উদ্যানের বাইরে তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং একসময় এর ভেতরে ঢুকে পড়লেন। দুদিন বাদেই পয়লা বৈশাখ। পার্কের চারিদিকেই একটা সাজ সাজ রব। বৈশাখকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। সবাই পার্কটিকে নানান রঙে এবং নানান সাজে সাজিয়ে তোলায় ব্যস্ত। তিনি এরই ভেতর একটি খালি বেঞ্চ খুঁজে বের করে সেটিতে বসে পড়লেন। পার্কের ভেতর একটি ছেলে বাক্সে করে চা-সিগারেট বিক্রি করছে। তিনি ছেলেটিকে ডাক দিলেন। কারণ তাঁর এখন প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। সিগারেটের তেষ্টা। তিনি তাঁর পকেট হাতড়ে সর্বসাকুল্যে পনেরো টাকা পেলেন, যদিও তাঁর পকেটে এই মুহূর্তে পনেরো টাকা থাকার কথা ছিলো না। তিনি ছেলেটির কাছ থেকে বারো টাকা দিয়ে একটি বেনসন সিগারেট এবং বাকি টাকা দিয়ে এক কাপ চা নিলেন। পনেরো টাকার মধ্যে বারো টাকা দিয়ে সিগারেট কেনাটা বাড়াবাড়ি রকম বিলাসিতার পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু ইয়াকুব সাহেব এই মুহূর্তে সেই বিলাসিতার কাজটিই করে ফেললেন এবং এটি নিয়ে তাঁর কোনো ভাবান্তর নেই। মানুষের মস্তিষ্ক যখন উত্তেজিত থাকে, তখন সিগারেট ও চায়ের যৌথ কম্বিনেশন মস্তিষ্ককে ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করে। ইয়াকুব সাহেবের এখন মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা রাখা খুবই প্রয়োজন।
ইয়াকুব সাহেব দুটো টান দিয়েই সিগারেটটির প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে ফেললেন। এই বিষয়টিও একধরণের বিলাসিতার আওতায় পড়ে। আজকের দিনটিতে তিনি শুধু বিলাসিতা করছেন। তিনি জীবনে কখনো কোনো বিষয়ে বিলাসিতা করেন নি। অত্যন্ত হিসেবি হয়ে তিনি তাঁর সংসার চালিয়েছেন। এই মিতব্যয়ীতার পুরস্কারস্বরূপ সৃষ্টিকর্তা তাঁকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি "উপহার" দিলেন। এই দুর্ঘটনাটিকে "সেলিব্রেট" করতে তিনি আজকে শুধু বিলাসিতা করছেন। দুই টানের সিগারেটটির প্রায় অর্ধেকটা শেষ করার পর কোনো এক বিচিত্র কারণে তিনি সেই আধ-খাওয়া সিগারেটটি ফেলে দিলেন।
ইয়াকুব সাহেব সারাটি জীবন তাঁর সংসারটি অত্যন্ত মিতব্যয়ীতার সাথে পরিচালনা করেছেন, যদিও তাঁর সংসারে "সুখ" বিষয়টার কোনো কমতি ছিলো না। তাঁর একটি ফুটফুটে মেয়ে ছিলো। মেয়েটির নাম ছিলো বিনু। মেয়েটিকে তিনি খুবই আদর-স্নেহ করতেন। সেই বিনুর হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়লো। ছোটখাটো জন্ডিস থেকে সরাসরি প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার। মেয়েটিকে তিনি একটি সস্তা হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। এতো টাকা খরচ করে ক্যান্সারের চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য তাঁর ছিলো না। তবুও তিনি তাঁর সাধ্যমতো সবরকম চেষ্টাই করেছেন মেয়েটির চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়ার জন্য। কয়েকদিন আগে বিনুকে হাসপাতাল থেকে বাসায় এনে রেখেছেন। দুদিন বাদে পয়লা বৈশাখ। ইয়াকুব সাহেব বিনুকে বললেন, "বাবা, তুমি এই পয়লা বৈশাখে আমার কাছে কী চাও? তুমি আমার কাছে যা-ই চাইবে, আমি তোমাকে তা-ই দেওয়া চেষ্টা করবো। বিনু তাঁকে বললো, "বাবা, আমি পয়লা বৈশাখের দিন ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে পান্তা ভাত খেতে চাই।"
ইয়াকুব সাহেব তখন বললেন, "ঠিক আছে মা, আমি আজই অফিস শেষ করে আসার সময় তোমার জন্য ইলিশ মাছ কিনে আনবো।"
ইয়াকুব সাহেব অফিস থেকে যখন বেরোলেন, তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। তিনি মাছের বাারে গিয়ে মোটামুটি চড়া দামে দুটো ইলিশ মাছ কিনলেন। মাছ কিনে বাসায় যেতে যেতে ছয়টা বেজে গেলো। বাসায় পৌঁছে তিনি একটা ছোটখাটো ভীড় দেখতে পেলেন। তিনি ভীড় অতিক্রম করে বাসার বারান্দায় পৌঁছে দেখলেন তাঁর স্ত্রী আহাজারি করে কাঁদছেন এবং কয়েকজন মহিলা তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি জানতে পারলেন, যে সময়ে তিনি মাছ কেনার জন্য বাজারে প্রবেশ করেন, ঠিক একই সময়ে হঠাৎ করে বিনুর রক্তবমি শুরু হয় এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ!
ইয়াকুব সাহেব বিনুর লাশ দেখতে গেলেন না। কেন গেলেন না, তা-ও এক রহস্য। তিনি মাছ দুটো রান্নাঘরে রেখে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। এরপর মানুষের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কে চলে আসলেন।
এতক্ষণ তিনি এই ঘটনাগুলো মনে করছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি চলে গেলো আধ-খাওয়া সিগারেটটির দিকে, যেটি তিনিই কিছুক্ষণ আগে ফেলে দিয়ছিলেন। তিনি সিগারেটটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে লাগলেন, যদিও সচরাচর কেউ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এরকম আধ-খাওয়া সিগারেট খায় না। কিন্তু তিনি এই কাজটি করবেন। কারণ, তার প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। সিগারেটের তেষ্টা।