somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিন্দুবাদ না সুবিধাবাদ ? গোবিন্দ প্রামাণিক, জামায়াত এবং সংখ্যালঘু রাজনীতির নগ্ন বাস্তবতা

৩০ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দেশের সংকটের সময় বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের দুটি ভিন্নধর্মী বক্তব্য এবং তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান দেশের সংখ্যালঘু রাজনীতিতে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একদিকে তিনি বর্তমান সরকারকে মৌলবাদী ও হিন্দুবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে পৃথক নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন, অন্যদিকে তিনি জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক দলকে ইউনিভার্সাল ইউনিভার্সিটি বলে প্রশংসা করছেন। এই বৈপরীত্য শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, এটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু রাজনীতির গতিপথ নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে।

প্রামাণিক তাঁর প্রথম বক্তব্যে বলেছেন, "পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা না হলে হিন্দু সম্প্রদায় ভোটকেন্দ্রে যাবে না। এই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি এবং বিশ্ববাসীকেও জানিয়ে দেব।" তিনি বর্তমান সরকারের "রন্ধ্রে রন্ধ্রে মৌলবাদ" এবং "প্রতিটি মানুষ হিন্দুবিদ্বেষী" বলেও অভিযোগ করেছেন। এই বক্তব্য পাকিস্তান আমলের ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থার প্রতিধ্বনি।

প্রথমত, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের দাবি শুধু অসাংবিধানিকই নয়, এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এই দাবি অতীতে জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করেছে, যার ফলস্বরূপ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সরকারকে 'মৌলবাদী' ও 'হিন্দুবিদ্বেষী' আখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে জানানোর হুমকি একটি রাজনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এর উদ্দেশ্য হতে পারে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায় বা বৈদেশিক হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করা। তবে, এই ধরনের অভিযোগের পেছনে সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত তথ্য থাকা জরুরি। নতুবা, এটি কেবল রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে পারে।

গোবিন্দ প্রামাণিকের রাজনৈতিক অবস্থান আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন তাঁর অন্য একটি বক্তব্য সামনে আসে। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে গিয়ে বলেছেন, "জামায়াতে ইসলামী একটি ইউনিভার্সাল ইউনিভার্সিটি!" এই বক্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ জামায়াত বাংলাদেশে একটি বিতর্কিত দল, যাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে এবং এই দলটি ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘু, নারী অধিকার এবং বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরোধী হিসেবে পরিচিত।

এখানেই মূল প্রশ্ন ওঠে: একদিকে যিনি বর্তমান সরকারকে 'মৌলবাদী' ও 'হিন্দুবিদ্বেষী' বলছেন, তিনি কিভাবে জামায়াতের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের 'ইউনিভার্সাল ইউনিভার্সিটি' বলতে পারেন? এই 'ইউনিভার্সাল ইউনিভার্সিটি'র সংজ্ঞায় কি সংখ্যালঘুদের অধিকার সংকুচিত করার নীতিও অন্তর্ভুক্ত ?

এই দুই বিপরীতধর্মী অবস্থান স্পষ্টতই একটি দ্বিচারিতা নির্দেশ করে। এটি এমন একটি ইঙ্গিত দেয় যে, প্রামাণিকের মূল উদ্দেশ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার আদায় নয়, বরং রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। যেখানে হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়, মন্দির ভাঙা হয়—যেমন নাসিরনগর, রামু, শাল্লা, বা সাম্প্রতিক খুলনার শ্রীমন্তপুর—সেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ, জামায়াতের মতো একটি দলের মঞ্চে তিনি সরব।

এই প্রেক্ষাপটে গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের ভূমিকা নিছকই একজন 'হিন্দু নেতা' হিসেবে থাকে না। বরং, তিনি এমন একজন রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করে নিজের ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের সত্যিকারের আন্দোলনকে দুর্বল করে এবং তাদের অধিকার আদায়ের প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

গোবিন্দ প্রামাণিকের এই বক্তব্য এবং কার্যকলাপ বাংলাদেশের সংখ্যালঘু রাজনীতিতে একটি বিপজ্জনক ধারা তৈরি করতে পারে। এটি কেবল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকেই বিনষ্ট করবে না, বরং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তাদের সত্যিকারের দাবিগুলোকেও ম্লান করে দেবে।

সামগ্রিকভাবে, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না। দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষায় এই ধরনের রাজনৈতিক চাল থেকে সতর্ক থাকা জরুরি।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ৮:০৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×