বাবার চাকুরীর সুবাদে আমার মনে রাখার মত বয়সের শৈশব কাটিয়েছি তিন জেলায়। মানিকগঞ্জ পুরানো ঢাকা আর নিজ জেলা মুন্সীগঞ্জ। মানিকগঞ্জের আধো আধো বোলের শৈশব আধো ই মনে আছে, লাল ইটের একটা সরকারী বাসায় থাকতাম। সে যুগে সন্ধ্যায় হাঁস মুরগী ঘরে তোলা, দাদি কে ঔষধ দেয়ার সাথে হারিক্যানের চিমনী পরিষ্কার করে কিনারায় দেয়াশালাই গুঁজে রাখা আর কুপি তে কেরোসিন ঢালা ছিল নিত্য কাজের অংশ। আমাদের সেই লাল দালানের বারান্দায় আধো উজ্জ্বল আলো' র হারিক্যানের ডিবডিব ছবি চোখে ভেসে আছে। সন্ধ্যে থেকেই আলো জ্বালিয়ে উজ্জ্বলতা কমিয়ে রাখা হত যাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে হাতের কাছেই পাওয়া যায়। ঠিকঠিক সন্ধ্যে নামার অল্পকিছু পর ই বিদ্যুৎ বিদায় নিত আর ততোক্ষণে সমস্ত দিনের শেষের ক্লান্তিতে বিছানায় ঢলে পরতাম আমি বিছানায়, মাসের অর্ধেক দিন চোখ বুঝে রাতের খাবার খেতাম তখন আধো ঘুম আধো জাগরণে।
পুরানো ঢাকার কলতা বাজার বসবাসের সময়টুকু ছিল সে সময় থেকে একেবারেই আলাদা। কোথায় মফঃস্বলের ঝিঁঝিঁ শেয়ালের ডাকে নামা সন্ধ্যা আর কোথায় " আপ জ্যায়সা কই মেরে জিন্দেগি ম্যায় অ্যাঁয়ে " সুরের সাথে তেলে ভাজা চা' য়ের কাপের টুংটাং। পুরানো ঢাকায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়া মানে ছিলো উৎসব বারতা, খুব পাশাপাশি কাছাকাছি বসতি হওয়ায় আশেপাশের দু দশ ঘর থেকে আমাদের বাচ্চাদের এক সাথে হইহই করে আনন্দ চিৎকার শুরু হয়ে যেত। সবার আগে টেবিলের চারপাশ থেকে চেয়ার গুলো কে ঘরের মেঝে তে এনে উল্টা করে রাখতাম, মাঝে মাঝে বিছানার চাদর অথবা এমনিতেই চেয়ার ফেলে লুকোচুরি খেলার ভুল্ভুলাইয়া সাজাতাম। এরপর শুরু হত লুকানো শেষ হলে টু উ উ উ দেয়া আর খুঁজে বেড়ানো।
আমাদের বাবা মা 'য়েরা হয়ত অত সিরিয়াস ছিলেন না, পড়ার মাঝে নিত্য দিনের এমন খেলা বা শোরগোল তাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হত। খুব বড় দুর্ঘটনা না ঘটলে মানে অন্ধকারে কোথাও ধাক্কা খেয়ে কপালে ডিম না বানালে অথবা উস্টা খেয়ে নাক ফাটিয়ে রক্ত বের না করলে তেমন কোন বকাঝকা শুনতাম না। স্কুল ছুটির দিনগুলো তে অনেক দিন বিদ্যুৎ চলে গেলে, গলি তস্য গলি তে মায়েরা হাওয়া খেতে বেরুলে আমরা ও একটু বড় এলাকা পেয়ে যেতাম খেলার। সেসব মহার্ঘ্য মুহূর্তে দৌড় আর হাহা হিহি ই ছিল প্রধান আকর্ষণ। আমার বড় ভাই বোনদের প্রাইভেট পড়াতেন যে স্যার একদিন সন্ধ্যায় স্যারের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা মজা করছিলাম এমন একটা মা দে না গান গেয়ে, কেউ হাত পাখা কে গিটার কেউ বা পড়ার টেবিল কে তবলা বানিয়ে। একদম খেয়াল করি নাই স্যার কখন এসে দরজার আড়াল থেকে আমাদের বাঁদরামি দেখছিলেন। সেই ঘটনার পর অনেকদিন আমার ভাইয়া স্যারের কাছে কোন ধানাই প্যানাই ছাড়াই পড়তে বসতেন। আবার অন্ধকারে দরজার আড়াল থেকে অন্যকে ভাউ বলে ভয় দেখানোর ফলাফল ও মাঝেমাঝে অন্যরকম হত।
কোন কোন দিন আমার বড় আপার মুড ভালো থাকলে সবাই কে গোল করে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে, মাঝে হারিক্যান রেখে বালিশের উপর বই খুলে - কবিতা, নতুন বই এর গল্প অথবা ইংরেজি গল্প বাংলা অনুবাদ করে শোনাতেন। নতুন বছরের শুরুর সেই শীতের ওম, নতুন বই এর ঘ্রাণ আর বড় আপার মায়া ঝরা কণ্ঠ, নীলাভ আলোর সেই সন্ধ্যা গুলো কে স্বর্গের উদ্যান নামিয়ে আনত আমাদের বাসায়।
তুমি যাবে ভাই
যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গাঁয় !
কোথায় চলেছো ? এদিকে এসো না!
দুটো কথা শোনো দিকি,
এই নাও-এই চকচকে, ছোটো,
নতুন রুপোর সিকি।
হ্যাকেলবারি ফিন টম স্যায়ারের অভিযান, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী এমনি কতশত দুর্ধর্ষ অভিযানে চলে যেতাম অন্ধকারের মায়ায়।
দিনের শেষ আলো টুকু' র আভা ঐ দূর দিগন্তে বিলীন হবার মুহূর্তের যে হলদেটে মায়া, নিশ্চুপ আলো আঁধারিতে বিলের মাঝে ছোঁ মেরে মাছ ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাওয়া চিলের ডানার যে মায়া, সান্ধ্য সাঁঝে এক পায়ে ধ্যানী বকের যে একাগ্রতার উদাসী সুর বুকে যে ঢেউ তোলে। এক চিলতে স্বর্ণালি ভোরের ঘোরলাগা সকালের সোনা রোদের যে মায়াভরা ওম। এমনি সব ছোট্ট ছোট্ট মায়া কুড়ানোর জন্যে লক্ষ কোটি বছর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়, তেমনি শৈশবের সেই নীলাভ সন্ধ্যার এক পশলা স্মৃতি রোমন্থনের অনুভবের জন্যে ও জনম জনম অপেক্ষা করা যায়।
আমার ডানপিটে শৈশবের শুরুটা পুরানো ঢাকার অলিগলিতে, পূর্ণতা পেয়েছে মুন্সিগঞ্জে। লিখতে বসেছিলাম লোডশেডিং নিয়ে, চলুন ফিরি সে গল্পেই -
মফঃস্বলের দিনরাত্রি সব পুরানো আট্টালিকার শ্যাওলা ধরা নোনা গন্ধের মাদকতায় মোড়ানো থাকে, যে বাসায় উঠেছিলাম সৌখিন বাগানীর বাসা। সেখানে লোড শেডিং হতেই খাতা খুলে বসে যেতাম ভাইবোন চোর - পুলিশ বা নাম দেশ, ফল ফুল খেলতে। নাম দেশ ফুল ফল খেলার নিয়ম
কখনো টিনের বাসার সামনের উঠানে সব বাচ্চারা মিলে লুকোচুরি আবার লম্বা স্কুল ছুটির দিনগুলো তে, কবিতা বা গল্প বলা প্রতিযোগিতা করত বড় ভাই বোনের রা। আর একটা খেলা খেলাতাম, দাদার আদেশ নামে - দাদা বলেছেন বস/ দাদা বলেছেন উঠ। রুমের ভেতরে থাকলে হারিক্যান আর উঠানে গেলে কুপি' র আলোয় চলত শোরগোল। গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে যেয়ে কাদামাটিতে বানাতাম গোল মাথা সরু কুপির চুঙা, সে সময় ইনজেকশনের ছোট ছোট কাঁচের বোতল পাওয়া যেত। খালি সে বোতলে মায়ের ভাণ্ডার থেকে কেরোসিনের তেল লুকিয়ে নিয়ে, উপর মাটির চুঙা বসিয়ে ছেড়া সুতি কাপড় প্যাচিয়ে সলতে বানাতাম। আর যাবতীয় এডভেঞ্চার সে আলোতেই চলত। টর্চ লাইট, চার্জার লাইট সব কিছুই ছিল হাতের নাগালের বাইরে।
এই ছোট খালি বোতলে কেরোসিন নিতাম।
আরও একটু বড় হবার পর ইলেক্ট্রিসিটি দুম করে চলে গেলে পাড়ার সবাই যার যার বাসার বারান্দায় বসে দল বেঁধে শেষ অক্ষরে গানের প্রতিযোগিতা করতাম। ততদিনে অবশ্য " কোথাও কেউ নেই" জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি, কিন্তু খুব বেশি কষ্ট পেয়েছি বা মনে রাখার মত আফসোস নেই সেসব নিয়ে। কারন আমার মনে হয় অফিস ভাংচুরের ভয়ে উনারা ও সাহস পেতেন না সে সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার। বরং শুক্রবার থান্ডার ক্যাটস সময় টা অনেক ভোগাত লোডশেডিং।
কলেজে উঠে সবচাইতে বড় আতঙ্ক ছিল যে কোন ঝড় ঝঞ্ঝাতে ট্রান্সমিটার ব্রাস্ট অথবা বিদ্যুতের খুঁটির তার ছিঁড়ে যাওয়া। উফ ভয়ে থাকতাম ঝুম বজ্র বৃষ্টি শুরু হতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে, কান পেতে শুনতাম বিকট শব্দ হয়েছে কিনা। ব্রাস্ট হবার শব্দ হলেই বলতাম, যাহ্ গেলো কয়েকদিনের জন্যে। বিশেষ করে যখন বোর্ড পরীক্ষা থাকত এলাকার মুরুব্বীরা ব্যস্ত হয়ে উঠতেন এইসব অফিসিয়াল সমস্যা মেটাতে। ধরে নিন যদি বুধবারে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে মানে মিটার ব্রাস্ট, তার ছেড়া ধরনের কিছু, তাহলে রবিবারের আগে কিছু হবে না পাক্কা। এভাবে সাতদিন / তিনদিন পর যখন বিদ্যুৎ আসত হাফ ছেড়ে বাঁচতাম।
যেহেতু আমরা সে সময় খুব বেশি প্রযুক্তি নির্ভর ছিলাম না এখনকার মত, তবুও ব্যান্ডের গানের পোকা, কবিতা 'র ক্যাসেটের পোকা খুব কষ্ট দিত। ওয়াকম্যানের ব্যাটারি খুব কৃপণের মত খরচ করতাম, লোড শেডিং হলে তো ব্যাটারি ভরসা। টু ইন ওয়ানের ব্যাটারি তো আরও মহার্ঘ্য ছিল।
শখের ওয়াকম্যান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো তে এই বিদ্যুৎ পানি এসব নিয়ে খুবে বেশি বেগ পেতে হয় নি, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ভি আই পি এলাকা। তাছাড়া এসব ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবার মতন সময় ই বা কোথায় ছিল? কতশত ব্যস্ততা, তাছাড়া দিনে বিদ্যুৎ না থাকলে রোকেয়া হল মাঠে' র উথাল হাওয়াতে প্রাণ জুড়াতাম। মাঝ রাতে গেলে চলত আড্ডা গান জমজমাট।
এরপর সংসার জীবন লোড শেডিং এ বড় ভোগান্তি ছিল পানি না পাওয়া, তাই সব সময় বড় বড় দুই ড্রাম পানি ধরে রাখতাম। কল্যাণপুরের নাভানা সোসাইটি তে লোডশেডিং এ সবাই ফ্ল্যাটের বাইরে আড্ডা দিত নিজেদের সার্কেলে, আশেপাশে বাচ্চাদের কলরোল, ফিরে যেতে পারেন আমার পুরানো ঢাকার জীবনে, এখানে চরিত্র বদল হয়েছে মাত্র। যেখানে আমার শৈশব ই ভিন্ন মাত্রায় ফিরে এসেছে। তবে সে সময়ে মনে আছে প্রথম ইন্ডিয়ান আইডলের ফাইনালের দিন ঠিক রাত নয়টা থেকে ১১ টা বিদ্যুৎ বিহীন ছিলাম আর ভীষণভাবে উৎসুক ছিলাম ফলাফল জানবার। নাহ সে রাতে আর জানা হয় নি অভিজিৎ সাওয়ান্ত মুকুট পরার কাহিনী, পরের দিন সংবাদ পত্রে দেখেছিলাম ফলাফল।
প্রবাসের ১৫/১৬ বছরের জীবনের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বড় কোন গল্প নেই যদিও শুধু দুবাই তে অফিস থেকে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় নোটিশ দিয়ে রেখেছিলো ১ ঘণ্টার মাঝে কানেকশন কেটে দিবে। আমি বাচ্চাকাচ্চা সহ দুবাই মলে চলে গিয়েছিলাম, বাসায় ফিরতে ফিরতে সব স্বাভাবিক।
এই তো আবার দেশে বহু ভাগ্যে হুটহাট বিপর্যয় নয়, ঘোষণা দিয়ে লোড শেডিং সুবিধা পেতে যাচ্ছি, তবে আমরা দেশবাসী প্রস্তুত যার যা আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরার জন্যে। বিদ্যুৎ নাই! তাতে কী জেনারেটর আছে, জেনারেটর আছে তো লিফট আছে, আগাম এয়ার কন্ডিশনে ঘর ঠাণ্ডা করা আছে, আই পি এস আছে, ওয়াইফাই নেই তো সমস্যা নেই মোবাইল ডাটা আছে। সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ তো উপায় আছে, আগের দিন ট্যাংক ফুল করা আছে। যত বেড়া তত ফোঁকর, সুবিধা ই সুবিধা জনাব।
হ্যাপি সিডিউল ভিত্তিক লোডশেডিং মোবারক ব্লগারস !
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০২২ বিকাল ৪:৩৬