তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি
১
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী সম্ববত বাংলা ভাষায় লেখা সেরা উপন্যাস। শুধু কাহিনী নয় প্রকৃতির বর্ণনাতেও এর তুলনা মেলা ভার। পথের পাঁচালী উপন্যাস নিয়ে সিনেমা করেই মূলত খ্যাতির চূড়ায় উঠেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর লেখাগুলোতে সোঁদামাটির আকুল করা ঘ্রাণ, অপূর্ব নিসর্গ মূর্তমান। পথের পাঁচালী প্রকৃতই প্রকৃতি নির্ভর। এই উপন্যাস থেকেই লেখা হয়েছে ছোটদের জন্য ‘আম আঁটির ভেঁপু। শৈশব থেকে পল্লীর প্রকৃতি তাঁকে মুগ্ধ করত বলেই, লিখতে পেরেছেন এতো গভীরভাবে প্রকৃতিকে। এর অপু-দুর্গা কালজয়ী চরিত্র। আমরা বিভূতিবাবুর অপরাজিত উপন্যাসেও অপুকে দেখি আরো বড় হতে, বিয়ে করতে। কিন্তু পথের পাঁচালীর অপুই চিরন্তন কিশোর। দুর্গা তখন মারা গেছে। তাঁর পিতা হরিহর খবর পায়নি। বাড়ি এসে ডাকছে। স্ত্রী সর্বজয়া এটাওটা বলছে। হরিহর কতকিছু এনেছে দুর্গার জন্য। .. পরে কিছু নিরাশামিশ্রিত সতৃষ্ণ নয়নে চারিদিকে চাহিয়ো বলিল, কৈ-অপু দুগ্গা এরা বুঝি সব বেরিয়েচে-
সর্বজয়া আর কোনো মতেই চাপিতে পারিল না। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল- ওগো দুগ্গা কি আর আছে গো- মা যে আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েচে গো- এতদিন কোথায় ছিলে!
এসব পাঠে বহুবারই চোখ শিক্ত হয়ে উঠে।
২
তবে প্রকৃতির বর্ণনা আরো ভালভাবে উঠে এসেছে তার আরণ্যক উপন্যাসে। আমার আরেকটি প্রিয় বই ‘আরণ্যক’। বিহারে তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে উপন্যাসটি লিখেন। বিভূতিভূষণের আজন্ম প্রকৃতিপূজারীর মনোভাবের প্রকাশ ঘটে এখানে। ব্যাপক পরিভ্রমণ ও নানা বিষয়ে পর্যবক্ষেণের ফসল এটি। জঙ্গলের বৈচিত্র আর তার উপর নির্ভরশীল মানুষ আরো বৈচিত্রময়।লেখক এখানে গল্পের চেয়ে প্রকৃতিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিভাবে মানুষ চিনা ঘাসের দানা খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারে, কিভাবে বনের আগুন নেচে বেড়ায়, কিভাবে দুর্ভিক্ষ হানা দিয়ে সব কিছু তছনছ করে দেয়, কিভাবে মানুষের দারিদ্রতা আর সরলতা একাকার হয়ে থাকে সেই সব উঠে আসে আরণ্যকে।সব স্থানের মতো ওই অরণ্যেও দেখি দুষ্টু লোকদের সরব উপস্থিতি। অরণ্যে সবকিছুতেই বৈচিত্র।
৩
একজন কবিয়ালের কথা। যার ভালবেসে সাধ মিটেনি, যার রয়েছে জীবন ছোট হওয়ার আক্ষেপ। কবিয়াল সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য এই উপন্যাস পড়াই যথেষ্ট। উপন্যাসটির নাম কবিয়াল হতে পারতো। ডোম নিতাইচরণ কবিয়ালই ছিল। দুধওয়ালি নারী ঠাকুরঝির প্রতি প্রথম ভালবাসা জন্মেছিল কবিয়ালের। ঠাকুরঝির গায়ের রঙ ছিল কালো। কবিয়াল পদ লিখে- কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে? কিন্তু বিবাহিতা ঠাকুরঝির প্রতি সেই ভালবাসা কুসুমিত হয়নি। নিতাই যোগ দেয় এক ঝুমুর দলে কবিয়াল হিসেবে। সেখানেই আবার প্রেমে পড়ে ঝুমুর দলের বসন্তর। বসন্ততো শুধু ঝুমুর দলে নেচে গেয়েই সময় কাটায় না, পুরুষ ধরার কাজও তাদের করতে হয়। সেখানে ভালবেসে বসন্ত কিভাবে নিতাইর সাধ মিটাবে? রূপোপজীবিনী নারীর যে আজীবনের বহুভোগের নেশা। তবুও সে নিতাইকে ভালবেসেছিল। কিন' বসন্তর মৃত্যু সে সাধ মেটাতে দেয়নি।
এই খেদ মোর মনে
ভালোবেসে মিটল না আশ, কুলাল না এ জীবনে
হায়! জীবন এত ছোট কেনে,
এ ভুবনে?
তারাশঙ্কর কবি লিখতে গিয়ে নিজেই কবিয়াল হয়ে উঠেছিলেন। কবি উপন্যাসে অনেক পঙ্কতি তাকে লিখতে হয়েছে নিতাইর কণ্ঠে দেয়ার জন্য। বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি ‘কবি’ উপন্যাস।
৪
বাংলা উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসের চেয়ে দুর্দান্ত শুরু আর কোন উপন্যাসে নেই। হুমায়ূন আহমেদের মতো অনেকে মানিকের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের চেয়েও পুতুল নাচের ইতিকথা-কে এগিয়ে রেখেছেন। বন্ধু শ্বাশত স্বপনতো বলেছিলেন, শুরুটা তিনি ধরতেই পারেননি প্রথমে। আমিও ধরতে পারিনি প্রথমে। উপন্যাসের প্রথম দুটি প্যারা এরকম-
খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারুঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।
হারুর মাথায় কাঁচা-পাকা চুল আর মুখে বসন্তের দাগভরা রুক্ষ চামড়া ঝলসিয়া পুড়িয়া গেল। সে কিন্তু কিছুই টের পাইল না। শতাব্দীর পুরাতন তরুটির মুক অবচেতনার সঙ্গে একান্ন বছরের আত্মমমতায় গড়িয়া তোলা জগৎটি তাহার চোখের পলকে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
একজন তরুণ লেখক হিসাবে মানিকের ভাষার উপর যে দখল দেখলাম তা শুধু বিরলই নয় সম্ভবত অদ্বিতীয়। যারা উপন্যাসটি পড়েননি তাদের জন্য বলি- আসলে হারু ঘোষের উপর বজ্রপাত হয়েছে, সে বজ্রপাতে মারা গেছে।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে বিক্রমপুর অনন্য কৃতীসন্তান মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তার শারিরীক অসুস্থতায় তার পূর্ণতা পায়নি। এ বিষয়ে মানিক তার জ্যৈষ্ঠভ্রাতা সুধাংশুকুমার বন্ধ্যোপাধ্যায়ের কাছে ২৪/০৯/১৯৩৭ এ একটি চিঠি লিখেন-
শ্রীচরণকমলেষু,
আপনি বোধ হয় জানেন আমি প্রায় দুই বৎসর হইল মাথার অসুখে ভূগিতেছি, মাঝে মাঝে অজ্ঞান হইয়া যাই। .. সর্ব্বাগ্রে আমাকে সুস' হইবার জন্য সর্ব্বপ্রকার চেষ্টা করিতে হইবে।
আমার যতদূর বিশ্বাস, সাহিত্যক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি নাম করিবার জন্য স্বাস্থ্যকে সম্পূর্ণ অবহেলা করাই আমার এই অসুখের কারণ। আমার প্রথম পুস্তক ১৩৪০ সালে প্রকাশিত হয়। তিন-চার বৎসরের মধ্যে বাঙ্গালা সাহিত্যের অধিকাংশ সমালোচক স্বীকার করিয়াচেন যে, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরবর্ত্তী যুগে আমি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ লেখক। অবশ্য mass এর নিকট পপুলার হইতে আমার কিছুদিন সময় লাগিবে। কারণ massmind নূতন চিন্তাধারাকে অত্যন্ত ধীরে ধীরে গ্রহণ করে। ... বাঙ্গালাদেশে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য আমাকে আর কিছু করিতে হইবে না।
কিন' দুঃখের বিষয় আমি যখন internationalfame এর জন্য নিজেকে প্রস'ত করিতেছিলাম সেই সময় এই অসুখ হইয়া সব গোলমাল করিয়া দিয়াছে। যে সময়ের মধ্যে এবং যে বয়সে আমি বাঙ্গালা সাহিত্যে যতখানি প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছি বাঙ্গালাদেশে আর কেহই তাহা পারে নাই। অন্যদেশের সাহিত্যের ইতিহাসেও এরূপ দৃষ্টান্ত নাই।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে (১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ) বিহারের সাওতাল পরগনা,বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে ৷ জন্মপত্রিকায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র। তার পিতার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধকুমার আর ডাকনাম মানিক। তাঁর পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদনীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্টার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তাঁর মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমিতে তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা।
৫
মানিকের পদ্মা নদীর মাঝি বাংলা সাহিত্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। বইটি আমারও একটি প্রিয় বই।পাঠ্য থাকায়, সিনেমা হওয়ায় এটিই মানিকের সর্বাধিক পঠিত ও আলোচিত উপন্যাস। বাংলাভাষায় লিখিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনুদীত হওয়া উপন্যাস। এটিও সম্ভবত বিক্রমপুর থেকে আরিচা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার পটভূমিতে লেখা। দীন-দরিদ্র জেলেদের জীবনের খাঁটি গল্প। মানিকের পৈতৃক বাড়ি, মামার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি বিক্রমপুরে। তবুও প্রমাণ করা সহজ নয় যে এটি ঠিক বিক্রমপুরের পটভূমিতে রচিত। আমাদের বিক্রমপুরের সাথে মেঘনার মোহনার দ্বীপগুলোর সম্পর্ক রয়েছে। ওখানে জেলেরা মাছ ধরতে যায়। ওখান থেকে অনেক সময় বিয়ে করেও নিয়ে আসে। আবার কুবের কপিলাকে নিয়ে হোসেন মিয়ার ময়নার চরে চলে যায়। সবকিছু ছাপিয়ে কুবের আর কপিলার পরকীয়া প্রেমও হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ। দরিদ্র জেলেদের যে জীবন তিনি এঁকেছেন বাস্তবিক সেটা অতুলনীয়। আমি ব্যক্তিগতভাবেও জেলে পরিবারগুলোকে ভালমতো পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। অনেকের মধ্যেই কুবেরকে খুঁজে পেতাম।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪৯