বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম : জমিন এবং আসমানের বরকতের দরজা খুলে দেয় যে বাক্য। বিসমিল্লাহ : তাৎপর্য, ব্যবহার ও অপব্যবহারের ক্ষেত্র। সাথে বোনাস হিসেবে বিসমিল্লাহ'র বিমূর্ত কিছু ক্যালিগ্রাফি
প্রাককথন
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। কয়েকটি আরবি শব্দের সম্মিলনে সুবিন্যস্ত ছোট্ট একটি বাক্য। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবি ভাষাভাষী ছিলেন বলে মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষাও আরবি। কিন্তু তিনি অন্যান্য নবী-রাসুলের ন্যায় নির্দিষ্ট সময়, যুগ, শতাব্দী, ভূখণ্ড ও অঞ্চলের মানুষের জন্য নবী হয়ে আসেননি; তিনি সময়, কাল, ভূখণ্ড ও অঞ্চলেরর সীমা অতিক্রম করে এসেছেন সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে- বিশ্বমানবতার ইহলৌকিক-পারলৌকিক মুক্তির উদ্দেশ্যে। 'রহমাতুল্লিল আলামীন' হিসেবে তাকে প্রেরন করা হয়েছে তামাম বিশ্ব চরাচরের জন্য। আল্লাহ পাক স্বয়ং হচ্ছেন 'রব্বুল আলামীন', গোটা সৃষ্টি জগতের 'রব' বা 'পালনেওয়ালা', 'পালনকর্তা'। আর প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহান প্রতিপালক আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত ওয়াল জালাল ভূষিত করেছেন 'রহমাতুল্লিল আলামীন', গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য 'রহমত' বা 'দয়া' উপাধিতে। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধূলির ধরায় এসেছেন। সাথে করে মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নিয়ে এসেছেন চির নবীন, চির প্রবীন, চির শাশ্বত, চিরন্তন, সর্বকালের ও সর্বযুগের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ধর্ম ইসলামকে। কালক্রমে, দিবস রজনীর বিবর্তনে, সময়ের ঘূর্ণনে সে ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে, বিশ্বের ভূখণ্ডে ভূখণ্ডে। আরব ভূখণ্ড থেকে হাজারো মাইল দূরে অবস্থিত লাল সবুজের পতাকা খচিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। ঐতিহাসিকভাবেই এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তাই ঐতিহাসিক কারণেই বাঙালি মুসলমানদের কাজ-কর্মে, আচার-আচরণে 'বিসমিল্লাহ', 'ইনশাআল্লাহ', 'মাশাআল্লাহ', 'আলহামদুলিল্লাহ', 'ফি আমানিল্লাহ', 'সুবহানাল্লাহ', 'ইন্না-লিল্লাহ' এবং 'আসসালামু আলাইকুম'সহ বহু আরবি শব্দের প্রচলন ঘটেছে। ব্যক্তির ধর্ম, আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা, তার কর্ম, আচরণ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলবে- এটাই স্বতসিদ্ধ। কিন্তু এসব বাক্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরবি ব্যাকরণগত বিধি বদ্ধতার পাশাপাশি রয়েছে ধর্মীয় ব্যবহারবিধি ও দিকনির্দেশনা। অনেকেরই জানা না থাকার কারণে সেসব ব্যবহারবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রায়শই। এতে কেবল উদ্দেশ্যেরই বিচ্যুতি ঘটছে না; বড় ধরনের পাপ হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দেয়। বক্ষমান নিবন্ধে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব-
২.
'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' -এর ঐতিহাসিক পটভূমি
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম- এ বাক্যটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছেন, নাবিয়্যিনা হজরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম। সাবা নগরীর রানি বিলকিসের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি এ বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। পবিত্র কুরআনের সুরা নামলের ২৯-৩০ নম্বর আয়াতে সে চিঠির বিবরণ উল্লেখ রয়েছে। এরপর প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কোনো নবীকেই বিসমিল্লাহর বিধান দেয়া হয়েছে বলে প্রমান পাওয়া যায় না। প্রাথমিক যুগে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম 'বিসমিকাল্লাহুম্মা' লিখতেন। তারপর সুরা হুদের ৪১ তম আয়াতে 'বিসমিল্লাহি মাজরেহা' নাজিল হলে তিনি কেবল 'বিসমিল্লাহ' লিখতে শুরু করেন। এরপর সুরা বনি ইসরাইলের ১০ নম্বর আয়াতে 'কুলিদউল্লাহা আওয়িদ্উর রাহমান' আয়াত অবতীর্ণ হলে তিনি 'বিসমিল্লাহির রহমান' লিখতে শুরু করেন। এরপর সুরা নামলের ৩০ তম আয়াতে পুরো বিসমিল্লাহ নাজিল হলে তিনি পুরো 'বিসমিল্লাহ' লেখার রীতি প্রচলন করেন। (রুহুল মাআনি ও আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস)।
৩.
বিসমিল্লাহর তাৎপর্য ও দর্শন
ইসলাম কেবল পারলৌকিক ধর্ম নয়; এ ধর্মে ইহকাল ও পরকালের মধ্যে যৌক্তিক ভারসাম্য স্থাপন করা হয়েছে। ইসলামের নামাজ ও ইবাদত মসজিদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীর যে কোনো পবিত্র স্থানে নামাজের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ ধর্মে বৈরাগ্যবাদ, কর্মহীন তপস্যার অনুমতি দেয়া হয়নি। ইবাদতের জন্য ইহকালকে বর্জন করতেও বলা হয়নি। বরং এমন দুর্লভ ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে দুনিয়ার কার্যাদিও দ্বীনের কাজে রূপান্তরিত হয়। বাহ্যত মানুষ পার্থিব কাজ করছে, অথচ সে পরকালের উদ্দেশ্যে পরমাত্মার ডাকে সাড়া দিচ্ছে। ইসলামী শিক্ষা অনুসারে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি কাজে এমন কিছু জিকির ও দুআ বাতলে দেয়া হয়েছে, যার উপর আমল করতে কোনো পরিশ্রম হয় না। কাজেও ন্যূনতম ব্যাঘাত ঘটে না।
৪.
অথচ এসবের মাধ্যমে নিজ নিজ কর্মে লিপ্ত মানুষগুলোও ঐশ্বরিক সূতিকায় গেঁথে যায়। অদৃশ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। 'বিসমিল্লাহ'ও এমন এক বাক্য, যার মাধ্যমে ক্ষুদ্র মানুষ মহা ক্ষমতাবান স্রষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত হয়। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। মর্তের সঙ্গে মহাকালের সংযোগ স্থাপিত হয়। 'বিসমিল্লাহ' কেবল একটি বাক্য নয়, এর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা'র বড়ত্ব প্রকাশ পায়। একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়া হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার নাম নিয়ে শয়তানকে বিতাড়িত করা হয়। মুসলমানিত্বের জানান দেয়া হয়।
৫.
ইসলামে বিসমিল্লাহর অবস্থান
পবিত্র কুরআন শুরু করা হয়েছে 'বিসমিল্লাহ'র মাধ্যমে। শ্রেষ্ঠতম ইবাদত নামাজের প্রত্যেক রাকাআত শুরু হয় 'বিসমিল্লাহ' দিয়ে। শ্রেষ্ঠতম স্থান মসজিদে প্রবেশ করতে হয় 'বিসমিল্লাহ' পড়ে। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'জিবরাঈল আলাইহিসসালাম যখনই আমার কাছে ওহি নিয়ে আসতেন, তিনি 'বিসমিল্লাহ' পড়তেন'- (দারে কুতনি)।
কুরআনের একটি সূরাহ ছাড়া সব সূরাহর শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' রয়েছে। হাদিসের কিতাবগুলো শুরু করা হয়েছে 'বিসমিল্লাহ' দিয়ে। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমকালীন সব রাজা বাদশাহর কাছে চিঠি লিখেছেন 'বিসমিল্লাহ' দিয়ে শুরু করে। এরপর হুদাইবিয়ার ঐতিহাসিক সন্ধিপত্রে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো বিসমিল্লাহ লিখতে বলেছেন। অবশ্য লেখার পর কাফেরদের আপত্তির কারণে কেবল 'বিসমিকাল্লাহুম্মা' রাখা হয়। (আহকামুল কুরআন লিল জাস্সাস, খ. ১, পৃ. ৮)
৬.
ঐতিহাসিক 'মদিনা সনদ'ও শুরু হয়েছে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম'-এর মাধ্যমে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ২ পৃ. ২২৩)
'বিসমিল্লাহ' পবিত্র কুরআনের একটি অংশবিশেষ হওয়ার ব্যাপারে কারোই দ্বিমত নেই। তাই তারাবিহর নামাজে একবার উচ্চৈঃস্বরে 'বিসমিল্লাহ' না পড়লে খতমে কুরআন আদায় হবে না।
৭.
বিসমিল্লাহ ব্যবহারের স্থানগুলো
ইসলামী শরিয়তে শব্দভেদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে 'বিসমিল্লাহ' ব্যবহারের পদ্ধতি শিখানো হয়েছে। এ ছাড়াও ওজু-নামাজের শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' পড়তে হয়। আর কোনো প্রাণী 'বিসমিল্লাহ' ছাড়া জবাই করলে তা ভক্ষণ করা বৈধ নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন, 'যেসব প্রাণীর ওপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি, তোমরা সেগুলো ভক্ষণ করো না'- (সুরা আনআম : ১২১)।
৮.
হানাফি ও মালেকি মাজহাব মতে, জীবজন্তু শিকারের আগেও 'বিসমিল্লাহ' পড়তে হয়। খাওয়ার শুরুতে পুরো 'বিসমিল্লাহ' পড়া সুন্নাত। তায়াম্মুমের শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' পাঠ করা সুন্নাত। এ ছাড়াও কুরআন পাঠের সময়, যানবাহনে আরোহনের সময়, ঘরে ও মসজিদে প্রবেশের সময় কিংবা বের হওয়ার সময়, বাতি প্রজ্বলিত করার সময়, বাতি নিভানোর সময়, প্রাকৃতিক ও বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণের সময়, মিম্বরে আরোহনের সময়, কোনো পাত্র ঢেকে রাখার সময়, লিখিত ও গ্রন্থিত যে কোনো কাগজের শুরুতে ও মৃতদের কবরস্থ করার সময় 'বিসমিল্লাহ' পড়া হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ বিষয়ে মূলনীতি হলো, প্রত্যেক ভালো কাজই 'বিসমিল্লাহ' দিয়ে শুরু করতে হবে। (আল মওসুআতুল ফিক্বহিয়্যাহ আল কুয়েতিয়্যাহ, হরফুল 'বা', 'বাসমালাহ'।
৯.
বিসমিল্লাহর বিকল্প ব্যবহারের বিধান
কেউ কেউ 'বিসমিল্লাহ'র পরিবর্তে ৭৮৬ ব্যবহার করেন, এটি পুরো 'বিসমিল্লাহ'র সংখ্যার মান হলেও এতে 'বিসমিল্লাহ'র সুন্নাত আদায় হবে না। সওয়াব প্রাপ্তির বিষয়টিও অনুরুপ। অর্থাত, 'বিসমিল্লাহ' উচ্চারনে যে সওয়াবলাভের কথা হাদিসে বর্নিত হয়েছে, সংখ্যাগত মান অনুসারে ৭৮৬ উচ্চারন করলে তা পাওয়ার আশা করা যায় না। (আহসানুল ফতোয়া, খণ্ড ৮, পৃ. ২৪/ আপকে মাসায়েল, খ. ২ পৃ. ৫৭১)
১০.
একইভাবে 'বিসমিহি তায়ালা' ব্যবহার করলেও সাওয়াব হবে না। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর যুগ থেকে চিঠিপত্রে, সরকারি কাগজপত্রে, লিখিত যেকোনো বস্তুর শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' লেখার রীতি প্রচলিত রয়েছে। সুরা নাহলের ৩০ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে কুরতুবিতে রয়েছে, 'গ্রন্থ, চিঠিপত্র ও সীলমোহরের ওপর 'বিসমিল্লাহ' লেখার বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন..... এ প্রথা আবহমানকাল থেকেই চলমান।' একই কথা ওই আয়াতের অধীনে তাফসিরে রুহুল মাআনিতেও রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, 'বিসমিল্লাহ'র অনুবাদ পাঠ করলে কিংবা লিখলে 'বিসমিল্লাহ'র সুন্নাত আদায় হবে কি? প্রসিদ্ধ ফতোয়াগ্রন্থ আহসানুল ফতোয়াতে রয়েছে, 'বিসমিল্লাহর পরিবর্তে অন্য বাক্যের ব্যবহার কুরআন, প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আমল ও উম্মতের পরম্পরাগত কর্মের বিরোধী'- (ঐ, খণ্ড. ৮, পৃ. ২৪) ইসলামী শরিয়তের অন্যতম মূলনীতি হলো, শরিয়ত যেসব স্থানে যে পদ্ধতিতে কোনো ইবাদত করতে বলেছে, সেগুলোর বিকল্প ব্যবহার নিষিদ্ধ। কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত দুআগুলোর ক্ষেত্রেও শরিয়তের নির্ধারিত শব্দ ব্যবহার করতে হয়। তাই নামাজে 'বিসমিল্লাহ', 'ফাতেহা', 'সূরাহ' ও 'খোতবা' আরবিতেই পড়তে হয়। একই কারণে সালামের বাংলা হিসেবে 'আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক' বললে সালাম আদায় হবে না। যেমনটা কাউকে তার নামের অর্থের আলোকে ডাকা সমীচীন নয়। তা ছাড়া 'আল্লাহ' শব্দের বঙ্গানুবাদ 'স্রষ্টা' শব্দ দিয়ে করা ভুল। স্রষ্টা বোঝাতে আরবিতে খালেক বা বাদী' শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়। তর্কশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ শরহে তাহজিবে আল্লাহর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, 'আল্লাহ ওই সত্তা, যার অস্তিত্ব সদা বিরাজমান, যিনি সব ধরনের পূর্ণতা ও গুণাবলির অধিকারী।' আর স্রষ্টা তাঁর একটি গুণবাচক নামমাত্র।
১১.
বিসমিল্লাহর অপব্যবহার ও শরিয়তের বিধান
খুবই দুঃখজনক কথা হলো, আমাদের অজ্ঞতার কারণে এ দেশে 'বিসমিল্লাহ'র অপব্যবহার বেড়ে চলছে। রাজনৈতিক নেতারা 'বিসমিল্লাহ' বলে বক্তৃতা শুরু করে থাকেন অথচ প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বক্তৃতাকালে হামদ বা আল্লাহর প্রশংসা করতেন। তিনি লেখালেখির ক্ষেত্রেই 'বিসমিল্লাহ'কে প্রাধান্য দিতেন। কেউ কেউ বক্তৃতার সূচনায় 'আউজুবিল্লাহ'ও পড়ে থাকেন। অথচ কুরআন পাঠ ছাড়া অন্যত্র 'আউজুবিল্লাহ' পড়া কুরআন-সুন্নাহবিরোধী। তবে রাগ উঠলে, বাথরুমে যেতে আউজুবিল্লাহ পড়ার কথা রয়েছে। (তাফসিরে মা'আরেফুল কোরআন, খ. ৫, পৃ. ৪০১)।
১২.
রাজনৈতিক পোস্টার থেকে শুরু করে শরিয়ত নিষিদ্ধ পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের পোস্টার, বিজ্ঞাপন ও লিফলেটে 'বিসমিল্লাহ'র ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, 'যদি কোনো কাগজের অপব্যবহার ও মর্যাদাহানি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়, তবে সেক্ষেত্রে 'বিসমিল্লাহ' লিখবে না।' (ফতোয়া ওসমানি, খ. ২, পৃ. ১৪৫)
আর কোনো নিষিদ্ধ কাজ 'বিসমিল্লাহ' দিয়ে শুরু করা হারাম ও কুফরি। একটি লিফলেটের নমুনা দেখুন :
'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, স র গ ম সংগীত একাডেমিতে সংগীত, নৃত্য, গিটার ও তবলা বিভাগে ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি চলছে। আসন সংখ্যা সীমিত। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে যোগাযোগ করুন।'
১৩.
এবার বুঝুন অবস্থা!
শুধু কি তাই? আমাদের দেশে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছে 'বিসমিল্লাহ ফ্যাশন'। এছাড়া বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে শত শত কোটি টাকার ঋণ খেলাপীর ঘটনা আমাদের জানা রয়েছে। বিসমিল্লাহ বলে এখন মদও খাওয়া হয়। নাউজুবিল্লাহ। এসব কেবল অজ্ঞতাই নয়; ধৃষ্টতাও বটে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, অনেক সিনেমা হলে ছবি প্রদর্শনের আগে 'বিসমিল্লাহ' লেখা ভেসে আসে। এটি যদি অবজ্ঞা করে করা হয়, তাহলে অবশ্যই ইহা মারাত্মক গোনাহের কাজ। আর অজ্ঞতাবশত করলেও এটি একটি কুফরি কাজ।
এ প্রসঙ্গে নির্ভরযোগ্য একটি ফতোয়া আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন, 'কেউ যদি দুআ-দরূদ নিয়ে ঠাট্টা করে অথবা মদ্যপানের সময়, ব্যভিচারের সময় কিংবা অকাট্য হারাম কাজের শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' পাঠ করে, সে কাফের হয়ে যাবে।' (মাজমাউল আনহুর, খ. ১ পৃ. ৬৯৩/ তাহতাবি আলাল মারাকি্ব পৃ. ৬)।
তাই এসব অপকর্মের লাগাম টেনে ধরার লক্ষ্যে আমাদের সতর্ক হতে হবে। সচেতন হতে হবে। জানার পরিধিকে সমুন্নত করতে হবে। অজ্ঞতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আলোর পথে।
১৪.
বিসমিল্লাহ’ উচ্চ আওয়াজে বলা উত্তম
বিধেয় সকল স্থানেই সশব্দে (মৃদু আওয়াজে) বিসমিল্লাহ বলা উত্তম। এর ফলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। প্রায়ই দেখা যায়, খাবারের শুরুতে আমরা বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে যাই। এরকমটা করা হলে এই ভুলে যাওয়ার পরিমানটা কমে যাবে।
১৫.
খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে
খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে স্মরন হওয়ার সাথে সাথে বিসমিল্লাহি আলা আউয়ালিহি ওয়া আখিরিহী বলতে হবে। এমনি করে অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রেও একই বিধান।
১৬.
বিসমিল্লাহ’র অলৌকিক শক্তি
কুরআনুল কারিমে সকল সূরাহর শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম রয়েছে কেবলমাত্র একটি সূরাহ ব্যতিত। সেটি হচ্ছে সূরাহ আততাওবাহ। প্রশ্ন হচ্ছে, সূরাহ আততাওবা বিসমিল্লাহ ছাড়া কেন নাযিল হয়েছে? এ বিষয়ে একাধিক বক্তব্য রয়েছে। তবে হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কথা এক্ষেত্রে সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য। তিনি বলেন, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ হচ্ছে 'রহমত' এবং 'নিরাপত্তার' প্রতীক অথচ সূরা তাওবায় কাফের মুশরিকদের নিরাপত্তার অবসান ঘোষণা করা হয়েছে এবং জিহাদের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।' (যাদুল মুছীর, আল্লামা জাওযী)
১৭.
মুশরিকরা মুসলমানদের ধোকা দিয়েছে এবং চুক্তি লংঘন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীদের সংগে হাত মিলিয়েছে। এ কারণে মুশরিকদের সাথে কৃত চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। তা ছাড়া চুক্তি বহাল রাখার কোনো নৈতিক বৈধতাও আর তখন অবশিষ্ট ছিলো না।
এ কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা ও তাঁর প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুক্তির অবসান ঘটিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধের ঘোষণা দেন। যদি এই সূরাহর শুরু 'বিসমিল্লাহ' দিয়েই হতো তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার শানের করুনাময়তা এবং দয়া মুশরিকদের জন্যে রহমত এবং নিরাপত্তার প্রতীক হতো। অথচ এই সূরাহর শুরুতেই নিরাপত্তার অবসান এবং যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং মুসলমানদের আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আল্লাহ তাআ'লা বলেন,’মুশরিকদের যেখানে পাবে সেখানেই তোমরা হত্যা করবে, তাদের বন্দী করবে, তাদের অবরোধ করবে এবং তাদের (ধরার) জন্যে তোমরা প্রতিটি ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে।’ (সূরা আত তাওবা, আয়াত ৫)
১৮.
‘বিসিমল্লাহ’র অপরিসীম ফজীলত
কুরআনের ১১৪ টি সূরাহর মধ্যে ১১৩ টি সূরাহর শুরুতেই ‘বিসিমল্লাহির রহমানির রহিম’ শোভিত। এই ‘বিসিমল্লাহ’র ফজীলত অপরিসীম। এই আয়াতটিকে পবিত্র কুরআনের মুকুট বলা হয়। এর অর্থ হচ্ছে—'পরম করুণাময় আল্লাহপাকের নামে শুরু করছি-যিনি অতি দয়ালু, করুণাময়।' প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতটিকে আল কুরআনের শ্রেষ্ঠতম আয়াত বলে উল্লেখ করেছেন। এই আয়াতের মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামীনের অতি দয়া-করুণাসূচক ‘রহমান ও রহিম’ নাম দু'টো মানবকূলের জন্য সর্বাগ্রে উপস্থাপন করা হয়েছে। এজন্যও 'বিসিমল্লাহির রহমানির রহিম'-এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বেশি।
১৯.
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, 'কোন ভালো কাজের পূর্বে তাসিময়া তথা বিসিমল্লাহ পাঠ না করে নিলে কাজে রহমত-বরকত আশা করা যায় না। সুফলও পাওয়া যায় না।' ‘বিসিমল্লাহির রহমানির রহিম’ জিকর ও আমলের মাধ্যমে অধিক সওয়াব ছাড়াও অসংখ্য শুভ এবং সৎ কাজ ত্বরিত সম্পন্ন হয়।
হজরত ঈমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, 'কোন সৎ, বৈধ ও ভালো কাজ সম্পাদনে এক হাজার বার ‘বিসিমল্লাহ’ পাঠ করে দু’রাকাআত নফল সালাত আদায় করলে আল্লাহ পাক তার মনের মকসুদ পূরণ করে দিবেন।'
২০.
হজরত শায়েখ আবু বকর সিরাজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, 'যদি কেউ ছয়শত পঁচিশ (৬২৫) বার ‘বিসিমল্লাহির রহমানির রহিম’ লিখে সঙ্গে রাখে তবে তার কোন আপদ বিপদের আশংকা থাকবে না।'
তাফসীরে কাবীরে হাদিসের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, 'কেউ চার হাজার বার ‘বিসিমল্লাহির রহমানির রহিম’ পাঠ করলে রোজ হাশরে তার পতাকা উড্ডীন থাকবে।'
২১.
দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু রোমের সম্রাটকে টুপী ব্যবহার করতে দিলে ‘বিসিমল্লাহ’ খচিত টুপীর বরকতে তার শিরঃপীড়া দমন থাকতো। ওলী-আউলিয়া, পীর-মুরশিদ, বুজুর্গানে দ্বীনগন ‘বিসিমল্লাহির রহমানির রহিম’ আমল করতেন এবং এ আমল দ্বারা অগণিত উপকার পেতেন যা পরীক্ষিত ও সত্য। তাফসীরে মারেফুল কুরআনে 'বিসিমল্লাহ' সম্পর্কিত আলোচনায় বিস্তারিত কথা বলা হয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ করতে, বাতি নেভাতে, কোন কিছু খাওয়া, পানি পান করা, ওজু করা, যানবাহনে চড়তে ও যানবাহন থেকে নামতে ‘বিসিমল্লাহ’ বলার নির্দেশনা পবিত্র কুরআন-হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক এমন সত্তার নাম যে সত্তার সমস্ত গুণাবলীর এক অসাধারণ প্রকাশ হচ্ছে বিসিমল্লাহ। বিসমিল্লাহর মাধ্যমে খুলে যায় জমিন ও আসমানের বরকতের দরজাসমূহ।
২২.
পরিশেষে...
আসুন, কাজে কর্মে আমরাও অনুশীলন করি বরকতময় বাক্য বিসমিল্লাহর। প্রতিটি ভালো ও শুভ কাজের শুরুতে ভক্তি, বিশ্বাস এবং নিখাঁদ আন্তরিকতা নিয়ে পাঠ করি মহান প্রতিপালকের শিখিয়ে দেয়া অমিয় বানী ‘বিসিমল্লাহির রহমানির রহিম’। আল্লাহ পাক আমাদের সকল কাজে বিসমিল্লাহ বলার তাওফিক দান করুন। কাজের কাঙ্খিত উত্তম ও বরকতময় ফলাফল দান করে আমাদের চিত্তকে প্রশান্ত করুন।
২৩.
২৪.
২৫.
২৬.
২৭.
২৮.
২৯.
৩০.
৩১.
৩২.
৩৩.
৩৪.
৩৫.
৩৬.
৩৭.
৩৮.
৩৯.
ছবি কৃতজ্ঞতা: গুগল, পিন্টারেস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:৩৭