ছবিঃ অন্তর্জাল।
'মাসহু আলাল খুফফাইনি' বা 'মোজার উপর মাসেহ' করার বিষয়টি মুতাওয়াতির পর্যায়ে সহিহ হাদিস দ্বারা সুপ্রমাণিত। শীতের প্রকোপ থেকে সুরক্ষা কিংবা অন্য কোনো অসুবিধার কারণে অথবা অন্যবিদ সুবিধা বিবেচনায় পবিত্রতা অর্জনের বিষয়টিকে সহজ করার জন্য অজু সম্পন্ন করার পরে পা ধোয়ার পরিবর্তে মোজার ওপর মাসেহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বস্তুতঃ মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মোজার উপর মাসেহ করার বিধান দিয়ে দ্বীন পালনকে আমাদের জন্য সহজ করেছেন। যেমন, পবিত্র কুরআনে এক স্থানে তিনি ইরশাদ করেন-
مَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَـٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর। -সূরা মায়িদাহ: ৬
তবে এই মাসেহ সকল ধরণের মোজার উপরেই প্রযোজ্য নয়। এটি জায়েজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। চামড়া, সুতা, কাপড় বা পশমের তৈরি যেসব মোজায় নিম্নোক্ত সেই শর্তগুলো পাওয়া যাবে সেসব মোজার উপরেই মাসেহ জায়েয হবে।
শর্তগুলো হচ্ছেঃ
১. পবিত্র হয়ে মোজা পরিধান করা। অর্থাৎ অজু করে পা ধোয়ার পরেই মোজা পরিধান করা হলে কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রেই মোজার ওপরে মাসেহ জায়েজ হবে। -সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৯
২. মোজা এমন হতে হবে যা পরিধান করলে তা দ্বারা টাখনু ঢেকে যায়। -মুসলিম, হাদিস : ৩৫৪
৩. মোজা ফাটাছেঁড়া হলে পায়ের ছোট আঙুলের তিন আঙুল পরিমাণের কম ফাটাছেঁড়া থাকতে হবে। এর বেশি ফাচাছেঁড়া হলে তার ওপরে মাসেহ জায়েজ হবে না। -আবু দাউদ ২৪২০, আল-আশবাহ ১/১১৪, আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা : ৩৭/২৬৫
৪. এমন ধরণের মোজা হতে হবে যা বেধে রাখা ছাড়াই পায়ে লেগে থাকে এবং তা পরিধান করার পর মোজার উপর থেকে পায়ের ভিতরের অংশ দৃষ্টিগোচর হয় না।
৫. তা ধারাবাহিক চলার উপযোগী হতে হবে। -আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা : ৩৭/২৬৪
৬. মোজা এমন মোটা যে, তা পানি চোষে না এবং তা ভেদ করে পানি পা পর্যন্ত পৌঁছায় না।
৭. সংকীর্ণতা বা রাবার অথবা সুতা ইত্যাদি দিয়ে বাঁধা ছাড়াও স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে পায়ের সঙ্গে লেগে থাকে এমন হতে হবে।
৮. মোজা এমন মোটা ও পুরু হওয়া যে, জুতা ছাড়া শুধু মোজা পায়ে দিয়ে তিন মাইল পর্যন্ত হাঁটা যায়। এতে মোজা ফেটে যায় না এবং নষ্টও হয় না। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১/১৮৮; ফাতহুল ক্বদির : ১/১০৯
উপরোক্ত শর্তগুলোর আলোকে এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, একমাত্র চামড়ার মোজা ব্যতিরেকে সচরাচর ব্যবহৃত সুতা, কাপড় বা পশমের মোজায় যেহেতু এসব শর্ত পাওয়া যায় না তাই চামড়ার মোজা ছাড়া বাকিগুলোর উপরে মাসেহ জায়েয হবে না। যদিও ইবনে হাযম ও ইবনে তাইমিয়া এইক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষন করে বলেছেন যে, সুতা, কাপড় বা পশমসহ সব ধরণের মোজার ওপরেই মাসেহ জায়েজ, কিন্তু অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারদের উপরে বর্ণিত অভিমত বিবেচনায় তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তেমন শক্তিশালী কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না। সাম্প্রতিক সময়ের ইসলামিক পন্ডিত ইবনে উসাইমীন ও শানক্বীতী উপরে বর্ণিত দুই স্কলারের নীতি অনুসরণ করেছেন। তাদের মতামতের পক্ষে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন- আল-মুহাল্লাহ (২/৮৬), আল-মাসায়িলুল মারদিনিয়্যাহ (৫৮ পৃ.), মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৮৪), আল-মুমতি’ (১/১৯০), আযওয়াউল বায়ান (২/১৮, ১৯)
বলা বাহুল্য, চামড়ার মোজার ক্ষেত্রেই উপরোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যায়। এ কারণে জমহুর বা সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কিরাম ‘জাওরাব’ তথা সাধারণ সুতা, কাপড় বা পশমের মোজার ওপর মাসেহ করাকে বৈধ বলেননি। চামড়ার মোজাকে আরবি ভাষায় ‘খুফ’ আর সুতা, কাপড় বা পশমের মোজাকে ‘জাওরাব’ বলা হয়। চামড়ার মোজার ওপর মাসেহ করা সর্বসম্মতিক্রমে বৈধ। -আবুদাউদ: ১৫৯, তিরমিজি: ৯৯, আহমাদ: ৪/২৫২, মাজমুআ ফাতাওয়া: ২১/১৮৪
নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও মোজার ওপর মাসেহ করেছেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে আগেই বলা হয়েছে যে, সবধরনের মোজার ওপর মাসেহ করা বৈধ নয়। তাই মোজার উপরে মাসেহের ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধানগুলোর প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
মুসাফির ও মুকিমের জন্য রয়েছে আলাদা বিধানঃ
মোজার উপরে মাসেহের জন্য মুসাফির ও মুকিমের জন্য আলাদা আলাদা বিধান রয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মোজার ওপর মাসেহ করার সময় মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত এবং মুকিমের জন্য এক দিন এক রাত।’ -আবু দাউদ, ১৩৫
মোজার ওপর মাসেহর নির্ধারিত সময়সীমাঃ
মুকিম বা নিজ এলাকায় থাকা অবস্থায় এক দিন এক রাত অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত মোজার ওপর মাসেহ করা যায় এবং মুসাফির বা পরবাসে তথা সফরে (অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়ি বা কর্মস্থল থেকে ৪৮ মাইল বা ৭৭ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার পথে এবং সেখানে পৌঁছে ১৫ দিনের কম থাকার ইচ্ছা করলে তাঁকে মুসাফির হিসেবে ধরা হয়) থাকাকালীন তিন দিন তিন রাত তথা ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত মোজার ওপর মাসেহ করা যায়। -আবুদাউদ: ১৩৫, রাদ্দুল মুহতার : ১/২৬০
এই হিসাব শুরু হবে প্রথমবার মাসেহ করার সময় থেকে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/১৮০
মোজার ওপর মাসেহ করার পদ্ধতিঃ
দুই হাতের ভেজা আঙ্গুলগুলো দুই পায়ের আঙ্গুলের ওপর রাখবে। এরপর হাত দুইটি পায়ের গোছার দিকে টেনে আনবে। ডান পা ডান হাত দিয়ে মাসেহ করবে; বাম পা বাম হাত দিয়ে মাসেহ করবে। মাসেহ করার সময় হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁকা ফাঁকা করে রাখবে। একাধিকবার মাসেহ করবে না। -শাইখ ফাউযানের ‘আল-মুলাখ্খাস আল-ফিকহি ১/৪৩
মাসেহর সুন্নাতঃ
পায়ের আঙুলের মাথা থেকে হাতের আঙুলগুলো প্রশস্ত করে টাখনু পর্যন্ত মাসেহ করা। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/১৮৫, কিতাবুল আসার: ১/৭২
মাসেহর পরিমাণঃ
হাতের ছোট তিন আঙুলের সমান পায়ের ওপরের অংশ মাসেহ করা। -আবুদাউদ: ১৪০, সুনানে কুবরা, বায়হাকি: ১৪৩৭, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/১৮৫
মাসেহ ভঙ্গের কারণসমূহঃ
১. যেসব কারণে অজু ভঙ্গ হয়, সেসব কারণে মাসেহও ভঙ্গ হয়। -তিরমিজি: ৬৯
২. মোজা খোলার কারণে মাসেহ ভেঙে যায়। -সুনানুল কুবরা, বায়হাকি: ১৪২২
৩. মোজা যদি পায়ের টাকনুসহ বেশির ভাগ অংশ বের হয়ে যায়। -সুনানুল কুবরা, বায়হাকি: ১৩৯৬
৪. উভয় মোজার কোনো একটিতে বেশির ভাগ অংশে পানি পৌঁছে গেলে মাসেহ ভেঙে যায়। -মুআত্তা মুহাম্মদ: ২/৫৮৭
৫. প্রসঙ্গত জেনে রাখা ভালো যে, পাগড়ি, টুপি, বোরকা ও নিকাবের ওপর মাসেহ করা জায়েজ নেই। হাতমোজার ওপরও মাসেহ করার বৈধতা নেই। -আবুদাউদ: ১৪০, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/২৩
মোজার ওপর মাসেহ কখন বাতিল হবেঃ
নির্ধারিত সময় (২৪ ঘণ্টা বা ৭২ ঘণ্টা) শেষ হওয়ার মাধ্যমে মাসেহ বাতিল হয়ে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে: ১/৪৬
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের সকল বিধি-বিধান ও দিক-নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুধাবন করে সেসবের পরিপূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে উত্তম এবং আদর্শ জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১২:২৮