রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একটি নিরাপদ ত্রাণপথ বা "মানবিক করিডোর" স্থাপন নিয়ে সাম্প্রতিক কূটনৈতিক আলোচনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা রাখাইনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি উঠছে নানা প্রশ্ন—এই করিডোর সত্যিই মানবতার আশীর্বাদ হবে, নাকি বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে?
কী এই "মানবিক করিডোর"?
"মানবিক করিডোর" বলতে বোঝানো হয় একটি নিরাপদ ও নিরপেক্ষ পথ, যা সাধারণত যুদ্ধ বা সংকটপূর্ণ এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো বা বেসামরিক মানুষ সরিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে, সব পক্ষের সম্মতিতে এমন করিডোর পরিচালিত হয়, যেখানে মানবিকতা, নিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করাই মূল শর্ত।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশ সরকার নীতিগতভাবে মানবিক করিডোরে সম্মত হলেও তাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
ত্রাণ বিতরণে কোনো জাতিগত বৈষম্য চলবে না।
সহায়তা হতে হবে শর্তহীন ও নিরপেক্ষ।
রাখাইনে যুদ্ধবিরতি ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
জাতিসংঘের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ত্রাণ পরিবহন ও বিতরণ পরিচালিত হতে হবে।
সম্ভাব্য সুফল
বিশ্লেষকদের মতে, এই করিডোর বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে আবারও স্বীকৃতি পাবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা বাড়তে পারে, যা কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে উপকারী হবে।
রাখাইনে সহায়তা পৌঁছালে অঞ্চলটির অস্থিতিশীলতা কমতে পারে। এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি, করিডোর পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বা সাহায্য বাংলাদেশের স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
বিপদের আশঙ্কা
তবে এই উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকি। বিশেষ করে, রাখাইনের বড় অংশ বর্তমানে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকায় করিডোর ব্যবহার হয়ে উঠতে পারে জটিল ও বিপজ্জনক। ত্রাণ সরবরাহ যদি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে পড়ে, তবে বাংলাদেশ অনিচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। অতীতের উদাহরণ (যেমন গাজা, ইউক্রেন, সিরিয়া) থেকে দেখা গেছে, অনেক সময় মানবিক করিডোর সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক সংস্থার স্থায়ী উপস্থিতি জাতীয় সার্বভৌমত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছে অনেক রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষক। বিরোধী দল বিএনপি এবং বিভিন্ন নাগরিক সমাজ করিডোরকে “সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
ভূ-রাজনৈতিক চাপ
রাখাইন অঞ্চলকে ঘিরে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ও রাশিয়ার কৌশলগত আগ্রহ রয়েছে। এই করিডোর ব্যবস্থায় বাংলাদেশ কোন পক্ষের ঘনিষ্ঠ হয়, সেটি ভেবে ওজন করে পদক্ষেপ না নিলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র করিডোরে আগ্রহ দেখালেও চীনের অবস্থান নিয়ে স্পষ্টতা নেই, যা বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
অতীত অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের জন্য সতর্কতা
বিশ্বে অনেক মানবিক করিডোর ব্যর্থতার ইতিহাস বহন করে। আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার লাচিন করিডোর, বসনিয়ার সারায়েভো করিডোর বা সিরিয়ার ঘৌতা করিডোর তেমনই কিছু দৃষ্টান্ত, যেখানে মানবিক করিডোর সামরিক করিডোরে পরিণত হয়েছে।
পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—আফগানিস্তানে করিডোর দেওয়ার পর সেই অঞ্চল হয়ে উঠেছিল সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি, যা পরবর্তীতে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ঝুঁকি নাকচ করা যায় না।
বাংলাদেশের করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করিডোর বাস্তবায়নের আগে সরকারকে চাই স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন প্রয়োজন।
জাতিসংঘের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধান ছাড়া করিডোর পরিচালনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ত্রাণ যাতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে না পড়ে, সেজন্য কঠোর নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
উপসংহার
মানবিক করিডোর, একদিকে যেমন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য একটি নতুন দরজা খুলে দিতে পারে, তেমনি অদূর ভবিষ্যতে নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, এবং কূটনৈতিক ভারসাম্যের মারাত্মক পরীক্ষায় ফেলতে পারে বাংলাদেশকে। ফলে করিডোর বাস্তবায়নে প্রয়োজন অত্যন্ত সতর্ক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ, এবং সর্বোপরি—জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৪২