ঈদুল আযহা—শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি মুসলিম জীবনের গভীরতম আত্মত্যাগ, মানবিকতা, নৈতিকতা ও আল্লাহর প্রতি পরম আনুগত্যের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। প্রতিবছর এই মহিমান্বিত ইবাদতের সময় এলেই দেখা যায়, কিছু ভেকধারী 'সিজনাল পশুপ্রেমিক' কুরবানির বিরুদ্ধাচরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা একে "অবলা প্রাণী হত্যা", "নিষ্ঠুরতা" কিংবা "বর্বরতা" বলে আখ্যা দিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত হন। বাস্তবে এসব বক্তব্য কুরবানির প্রকৃত তাৎপর্য, ধর্মীয় গভীরতা এবং বৈজ্ঞানিক-নৈতিক দিকগুলো সম্পর্কে অজ্ঞতারই ফল।
ইসলামে কুরবানির শিকড় রয়ে গেছে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের স্মৃতিতে। আল্লাহর আদেশে পুত্রকে কুরবানি দিতে প্রস্তুত হয়ে ইব্রাহিম (আ.) নিঃস্বার্থ আনুগত্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আল্লাহ এই পরীক্ষায় তাঁর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে একটি পশুকে দিয়েছেন বিকল্প হিসেবে। এই ঘটনা মুসলমানদের শেখায়—আল্লাহর জন্য প্রিয় বস্তু ত্যাগে দ্বিধা না রাখা, এবং ঈমানের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা গড়ে তোলা।
কুরবানি কোনো নিছক প্রাণীজবাই নয়। এটি অত্যন্ত মানবিক, নিয়মবদ্ধ এবং শৃঙ্খলিত একটি ইবাদত। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী কুরবানির প্রতিটি ধাপে রয়েছে করুণার শিক্ষা: ধারালো ছুরি ব্যবহার, পশুকে পানি পান করানো, অন্য পশুর সামনে জবাই না করা—এগুলো সবই পশুর প্রতি সহানুভূতির নিদর্শন। আধুনিক পশু কল্যাণ গবেষণা এবং ভেটেরিনারি বিজ্ঞানের একাধিক গবেষণায় স্বীকৃত, ইসলামি পদ্ধতিই সবচেয়ে কম যন্ত্রণাদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত 'হিউম্যান স্লটারিং' পদ্ধতি।
তদুপরি, কুরবানির মাংস সমাজে সাম্য ও সংহতির অনন্য নজির স্থাপন করে। এটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়—এক অংশ আত্মীয়স্বজনের জন্য, এক অংশ দরিদ্র-দুঃস্থদের জন্য, এবং এক অংশ নিজের পরিবারের জন্য। অর্থাৎ, এতে কেবল উৎসব নয়, বরং মানবিক দায়বদ্ধতার চর্চা ও বিতরণের নৈতিকতা নিহিত রয়েছে।
এখানে প্রশ্ন জাগে—যেখানে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি পশু সুপারমার্কেট, রেস্তোরাঁ কিংবা ফাস্টফুডের জন্য জবাই হচ্ছে, সেখানে কুরবানিকে নিয়েই কেন এত প্রশ্ন? এটি কি শুধুই প্রাণীর প্রতি সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ, নাকি এর পেছনে রয়েছে সুস্পষ্ট ইসলাম ধর্মবিদ্বেষ ও পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি?
আসলে ইসলাম প্রাণী হত্যা অনুমোদন করে না, বরং কেবলমাত্র খাদ্য ও ইবাদতের জন্য নির্ধারিত শর্তে এবং আল্লাহর নামে তা বৈধ করেছে। কুরআনে (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩) বলা হয়েছে:
“তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শুকরের মাংস এবং যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে…”
অর্থাৎ ইসলাম বেপরোয়া হত্যা নয়, বরং ন্যায়সংগত, মানবিক এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবনের প্রয়োজন মেটানোর পক্ষে।
সুতরাং, যারা কুরবানিকে "অবলা প্রাণী হত্যা", "নিষ্ঠুরতা" কিংবা "বর্বরতা" বলে প্রচার করে, তারা হয় ধর্মীয় অজ্ঞতায় ভোগে, নয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচারে লিপ্ত। প্রকৃত সত্য হলো—কুরবানি কোনো বর্বরতা নয়; এটি আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতীক এবং দরিদ্র-দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াবার এক সুমহান উপলক্ষ। যারা সত্যের পথে থাকেন, তারা অপপ্রচারের মুখে নয়, বরং যুক্তি, সহমর্মিতা এবং ঈমানের দৃঢ়তায় অবিচল থাকেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২৫ সকাল ৯:৩১