রুটির ফুল
ছোট্ট কলিয়ার যতদূর মনে পড়ে , যুদ্ধের দিনগুলোয় তার কেবলি ক্ষিদে পেত। ক্ষিদে সে কিছুতেই সইতে পারত না , মানিয়ে নিতে পারত না , রাগের ঝলক ফুটত তার কোঠরে ঢাকা চোখে , অনবরত খাবার খুঁজে বেড়াত। না-ছাঁটা এলোমেলো কালো কালো চুল আর খোঁচা খোঁচা পাঁজরায় তাকে দেখাত যেন ছোট্ট রোগাটে এক নেকড়েছানা। খাওয়ার মতো কিছু একটা পেলেই সে তা মুখে তুলত --- সরেল , মুখে আঁটকে আসা বৈঁচি , বার্ড-চেরী , কি সব শেকড়বাকড় , অসহ্য টক আর শক্ত বুঁনো আপেল।
বাড়িতে সে পেত জলের মত কিছু ঝোল আর রুটি। ঝাড়াই করা জোয়ারের গুছি গুঁড়ো করে মা মেশাতো ময়দার সঙ্গে , ফলে রুটি হতো ভারি , চ্যাটচেটে , সোঁদা সোঁদা কাদাটে গন্ধ উঠতো। কিন্তু এ রুটিও কলিয়া দেখতে দেখতে খেয়ে নিত , নাক ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করতো লোভীর মতো। সারা যুদ্ধের মধ্যে একবার সে রুটি খেয়েছিলো পেট পুরে। সে রুটি জোয়ার গুছির গুঁড়োর নয় , সত্যিকারের। তা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো সৈন্যরা। কুটিরে তারা ঢোকে রাত্তিরে। তাদের ভারী গ্রেডকোট আর জীর্ণ হাইবুটে শাদামত কী একটা জিনিসের প্রলেপ , আধা-অন্ধকারে চিকচিক করছিলো তা , মনে হয় যেন তুষার কণা লেগে আছে। অথচ বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। স্তেপ থেকে তারা আসে নি , নেমে এসেছে খড়ি পাহাড়ের উৎরাই থেকে। উৎরাই টা বেশ কঠিন, তাই খড়িমাখা হয়ে গেছে। গরম ঘর খানায় ওদের গা থেকে ভাপ উঠছিল, সঙ্গে সঙ্গে ঘর ভোরে গেলো তামাকের ধোঁয়া , ভেজা পা-পটি , চামড়ার বেল্ট আর রাইয়ের টাটকা চাপাটির গন্ধে। চাপাটি গুলো তারা রেখেছিল টেবিলের ওপর।
অতিথি আগমনে খুব ঘেঁষাঘেঁষি হচ্ছিল ঘরে, যেন রেলের স্টেশন , ছোট্ট কলিয়ার খুব অস্বস্তি লাগছিল । এককোণে জড়সড়ো হয়ে শঙ্কিতভাবে তাকিয়ে দেখছিল আগন্তকদের। এই সময়ে খুঁড়িয়ে- চলা গাল -উঁচু এক সৈন্যের চোখে পড়ে যায় সে।
হাতছানি দিয়ে কলিয়াকে ডাকে নিজের কাছে :
' ওহে কর্তা , আয় এখানে। রুটি খাবি ? '
কলিয়ার ইচ্ছে হয়েছিল চেঁচিয়ে ওঠে : ' খাবো ! খাবো ! ' কিন্তু গলায় ওর দলা পাকিয়ে উঠল। একটা কোথাও বলতে পারল না সে , শুধু চুপ করে লালা গিলতে লাগল। ' পেট পুড়ে খেঁট দিয়েছিস বুঝি ? '
অসহায়ের মত চোখ পিট্ পিট্ করলে কলিয়া। আর গাল উঁচু সৈন্যটি তার থলে খুলে তার হাতে গুঁজে দিলে মস্ত এক টুকরো রুটি। মাথা ঘুরে উঠল ক্ষুধিত ছেলেটির। খচমচ করে সে উঠে পড়ল চুল্লির ওপরকার মাচায় , জড়িয়ে ধরলে রুটিটা। রুটির গন্ধ নিলে সে , আদর করলে , হাত আর গালে চেপে গরম করে তুলল সেটা।
কখনো সে কামড় দেয় তার শাঁসে , কখনো বা উত্তেজিত আহ্লাদে চিবিয়ে যায় তার চটা , সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে একটা শান্ত পরিতৃপ্তি। রুটিতে তার মন ভিজে উঠল যেভাবে মাঝে মাঝে বড়োরা দিলখুশ হয়ে ওঠে নেশায়। মনে হল তার , চারিপাশের সবকিছুই রুটি-ময় : শুয়ে আছে সে রুটির ওপর , মাথার নিচে নরম রুটি , গা-ঢাকা দিয়ে আছে গরম রুটিতে। ঘুমিয়ে পড়লো সে। আর সারা রাতই কেবল স্বপ্ন দেখল রুটির।
.... যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে আসছে , মা তখন তাদের ঘরোয়া ক্ষেতের একফালি মাটিতে গম বোনে। অচিরেই মাটি ফুঁড়ে মাথা তুললে ভীরু-ভীরু অঙ্কুর। দেখতে ঘাসের মতো। সে ঘাস চিবিয়ে দেখল কলিয়া --- মোটেই তাতে রুটির স্বাদ নেই , ঘাস যেমন হয় তেমনি । আদপেই হয়ত কোনো রুটি হবে না এতে। কিন্তু শিগগিরই ঘাসগুলো নলের মত হয়ে উঠলো।
' এবার মঞ্জরী ধরবে, ' বললে মা ।
দিন গুনতে লাগল সবাই , কলিয়াও ; মনে পড়ত তার সেই টাটকা চাপাটি আর রুটি-ময় সেই রাতের কথা , যা হয়তো বা বাস্তব , হয়তো স্বপ্ন।
কলিয়া ভাবত নীল নীল ফুল কিংবা আলতা রঙের মুকুল ফুটবে তাতে। অথবা চেরি গাছের মতো ছেয়ে যাবে শাদা শাদা গুচ্ছে। কী ভাবে ফুল ফুটল সেটা কিন্তু তার চোখেই পড়ল না -- দেখা দিল বড়ো বড়ো দানার মঞ্জরী , একটু নীলচে , ভেজা - ভেজা। তারপর জায়গাটা হয়ে উঠল খড়-রঙা।
প্রথম ফসল ওঠার আনন্দে দিদিমা প্রকান্ড সূর্যমুখী ফুলের মতো দুটি চাপাটি বানালে। লালচে-লালচে রঙ , ঝলমলে তার গন্ধ। মাখনের প্রলেপ দিয়ে দিদিমা ভাঙা কাঁচের মতো বড়ো বড়ো নুন ছিটিয়ে দিলে তাতে। ভাপ উঠছিল চাপাটি থেকে , জ্বল-জ্বল করছিল যেন দুটি ছোট্ট নোনতা সূর্য !
টেবিলে বসে ছিল কলিয়া , খালে ঢোকা চোখ তার চাপাটি দুটোর উপর নিবন্ধ। অপেক্ষা করতে ছিল কখন ওকে খেতে দেবে , বুক ভরে টানছিল সেঁকা রুটির তপ্ত গন্ধ। প্রানপনে সে ঠেকালে যাতে হাত না বাড়ায় , ঈর্ষণীয় খাদ্যটা সে না নেয় বিনা অনুমতিতে।
শেষ পর্যন্ত দিদিমা এসে বললে :
' নে বাছা , খেয়ে দ্যাখ আমার চাপাটি। '
কোন একটা গোপন স্প্রিঙ যেন কাজ করে গেল তার মধ্যে , নিমেষে হাত এগিয়ে গেল রুটির দিকে , আঙ্গুল গুলো সজোরে তা চেপে টেনে আনলো মুখের কাছে। ঠোঁটে ছ্যাকা লাগছিল , জিভ পুড়ে যাচ্ছিল নুনে , রুচিকর গন্ধটা যাতে ফস্কে না যায় , তার জন্য স্ফীত হয়ে উঠলো নাকে ফুটো। না, সৈনিকের রুটির চেয়েও চাপাটিতা খাতে অনেক ভালো। কিন্তু মুখের মধ্যে তা মিলিয়ে যেতে লাগল খুবই চটপট , শিগগিরই কলিয়ার হাতে রইল কেবল একফালি চাঁদ।
অচিরে সেটাও আর রইল না.... ঠোঁট চাটলে কলিয়া , আঙ্গুল গুলো চাটলে , তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললে। আর লালচে , অটুট , হয়ত - বা আরো বেশি সুস্বাদু দ্বিতীয় চাপাতিটা এখনো টেবিলেই , সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে তা ডাক দিচ্ছে।
' এই চাপাতিটা নিয়ে যা তোর দাদুর জন্যে ' বললে দিদিমা।
' বেশ, নিয়ে যাচ্ছি , ' দমে যাওয়া গলায় বললে কলিয়া।
দাদু খুবই বুড়ো , থাকে মৌমাছির খামারে। বাড়ি আসে সে কালে-ভদ্রে , যখন সবজি ভুঁইয়ে গরম করা হয় ঝুলকালিমাখা , বেঁকে যাওয়া , চালাঘরটা। সারা মুখে তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি , যেন থুতনি থেকে গাল পর্যন্ত উঁচিয়ে আছে অসংখ্য লোহার পেরেক। কলিয়া তার কাছে ঘেঁষতে ভয় পেত , খোঁচা লাগবে বলে।
গরম চাপাটিটা দিদিমা চওড়া বার্ডক পাতায় মুড়ে এগিয়ে দিলে কলিয়ার দিকে। এই অমূল্য সম্পদটি কলিয়া প্রথমে হাতে করেই নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর পাতাটা ফেলে দিয়ে চাপাটিটা লুকিয়ে রাখতে হল জামার ভেতর যাতে ছেলেপিলেরা কেড়ে না নেয়। চাপাটিটা গরম , চামড়ায় ছ্যাকা লাগছিল , ছ্যাকা খাওয়া জায়গাটা জ্বলছিল বড়ো বড়ো নুনের দানায়। কলিয়ার মনে হচ্ছিল কোন এক হিংস্র জন্তুর বাচ্চা সে নিয়ে যাচ্ছে কোলে করে , বাচ্চাটা কামড়াচ্ছে তার পেটে। কিন্তু সহ্য করে গেল কলিয়া। ছেলেগুলো পাশ দিয়েই গেল , কী চমৎকার খাবার তার জামার তলে লুকোনো , সেটা তারা সন্দেহও করলে না।
মৌমাছিরা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছিল দাদুর কাঁধে , মাথায় , ঢুকে পড়ছিল নাকের কানের ফুটোয় , কিন্তু কামড়াচ্ছিল না। দাদুকে ওরা জানে ওদেরই একজন বলে।
খুশি হয়ে উঠল দাদু। চাপাটিটা হাতে নাড়াচাড়া করে সে তার গন্ধ শুঁকলে।আর বুড়োর সামনে কলিয়া দাঁড়িয়ে রইল বুক-ভরা এই আশা নিয়ে যে দাদু আধাআধি ভাগ করবে চাপাটিটা।
' খাসা চাপাটি , ' বললে দাদু।
' ভারি সুন্দর ', চট করেই সায় দিলে কলিয়া।
' জার্মানরা সরে যেতেই মাটিও ভালো ফলন দিচ্ছে! ' রুটি ধরা হাতটা নামলে দাদু , ' আর তোর দিদিমা আছে কেমন ? হেঁটে-হুটে বেড়াচ্ছে ? '
' বেড়াচ্ছে ' দীর্ঘশ্বাস ফেললে কলিয়া , আর চাপাটির কথা যাতে বেশি ভাবতে না হয় তাই জিজ্ঞেস করলে , ' আচ্ছা দাদু , জার্মানদের সাথে যে তুমি লড়লে , তার জন্যে তোমায় মেডেল দিবে ?
'মেডেলের কি দরকার ?' বললে দাদু , ' তবিয়ৎ বহাল থাকলেই আমার হল।'
চাপাটিটা দাদু খেলে না , নিয়ে গেল তার চালাটায়। ইস , কি লোভী দাদুটা !
ওর ওই মৌমাছির সঙ্গে থেকে থেকে একেবারে বুনো হয়ে উঠছে। ইচ্ছে করেই চাপাটি লুকিয়ে রাখলো ভাগ দিতে যাতে না হয় , পরে নিশ্চিন্তে মধু মাখিয়ে চিবুবে।
ফিরে আসছিলো কলিয়া। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দাদু যখন নোংরা জামা-কাপড়ের একটা পুঁটলি এগিয়ে দিয়ে বললে , ' দিদিমাকে বলিস কেচে দিতে !' তখন কেমন যেন চমকে উঠল কলিয়া , আর একটু হলেই দাদুর কাছ থেকে এক টুকরো চাপাটি চেয়ে বসত সে। কিন্তু মুহূর্তের দুর্বলতাটা সে জয় করলে। কোনো কথা বললে না।
বাড়ি ফিরল ধীরে সুস্থে , পোঁটলাটা দোলাতে দোলাতে , ভাবছিল যুদ্ধ যখন শেষ হবে ,বাড়িতে ময়দা থাকবে অনেক , যখন সকাল দুপুর সন্ধ্যে --- সবসময়ই চাপাটি খাবে সে। এখন চাপাটিটা খাচ্ছে দাদুই , কলিয়াও তো নিজেরটা খেয়েছে। দাদুর ছবিটা ভেসে উঠল কলিয়ার সামনে : ফোকলা মুখে বহুক্ষণ ধরে চিবিয়ে চলেছে সেঁকা চটাটা। বুড়ো তো , নিশ্চয় স্বাদও কিছু টের পে না।
বাড়িতে পুঁটলিটা দিদিমাকে দিয়ে গজ-গজ করলে :
'দাদু কেচে দেয়ার জন্য দিয়েছে! '
'আছে কেমন সে ? অসুখ - বিসুখ করে নি তো ? ' শঙ্কিত হয়ে উঠলো দিদিমা।
'অসুখ করবার কি আছে ?' বললে কলিয়া, ' মৌমাছি পালছে। '
চুপ করে দিদিমা ময়লা কাপড়-চোপড় গুলো বের করে রাখতে লাগল মাচায়, দেখতে লাগল কোথায় রিপু করতে হবে , কোথায় মারতে হবে তালি। পুঁটলির তলায় দেখা গেল পরিষ্কার ন্যাকড়ায় বাঁধা একটা মোড়ক। অবাধ্য আঙুলে দিদিমা ধীরে সুস্থে খেললে মোড়কটা। ন্যাকড়ায় দেখা গেল সেই চাপাটিটা। কিছুই বললে না সে। অপ্রত্যাশিত খাদ্যটা সে রাখলে নাতির সামনে।
ঘন করে নুন ছিটানো লালচে সূর্যটায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল কলিয়ার। চোখে ওর ঝিলিক দিলে আনন্দের ছটা। স্বাদটা মনে হতেই মুখ ওর লালায় ভরে উঠল , হাত বাড়িয়ে দিলে চাপাটির দিকে। কিন্তু কী একটা অচেনা হৃদয়াবেগে হাত ওর থেমে গেল।দেখা গেল সেটা ক্ষিদের চেয়েও জোরালো , রুটির চেয়েও জরুরী।
তার মানে দাদু চিবোয় নি চাপাটিটা , মধু , মাখায় নি , খেয়েছে শুধু ওই মিষ্টি- মিষ্টি জল , ক্ষিদে যাতে মরে আসে, আর মৌমাছি গুলো নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে তার কাঁধে....আর ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে সে , কিন্তু মেডেল সে চায় না....
বেঞ্চি থেকে নেমে গেল কলিয়া.... কিন্তু কিছুক্ষনের পরেই বাড়ি ফিরে এলো সে। ঠান্ডা চাপাটিটা সে টেবিল থেকে নিয়ে পরিপাটী করে মুড়লে পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে। তারপর দাদুর যে-বাক্সটায় থাকে তার পুরোনো হাই বুট , টুপি, ঘরোয়া তামাকের বটুয়া , আর গত যুদ্ধের সঙিন , সেইখানে তা রেখে দিলে।
**********************************************শেষ ***************************************************
রূপের ডালি খেলা - নামের শৈশবের একটা রাশিয়ান বইয়ের গল্প রুটির ফুল ! মাঝে মাঝে শৈশবের সেই রাশিয়ান বইগুলো বুকের মাঝখান থেকে আচমকা বের হয়ে আসতে চায় লেখায়। খুব ছোটবেলায় যখন আব্বা আমাকে বই পড়ে শোনাতেন , যখন আমি বানান করেও পড়তে পারতাম না , যখন আমি স্কুলেও যেতাম না -- তখন থেকেই রাশিয়ান বইগুলো আবার সাথেই আছে। তাই সেই 'ছোটমানুষের ' বইগুলোকে মাঝে মাঝে আমি শৈশবের স্কুল বলে ডাকি !
আরো সোভিয়েত শৈশব :
১। সাত বন্ধু ইয়ুসিকের - ( আমার সোভিয়েত শৈশব )
২।রূপের ডালি খেলা - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৩। জ্যান্ত টুপি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৪।সভ্য হওয়া - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৫। মালপত্র (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৬।শেয়ালের চালাকি ১ (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৭।মোরগ ভাইটি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৮।বীরব্রতী ভাসিয়া -- আমার সোভিয়েত শৈশব (আমার শৈশবের স্কুল !)
৯। আমার সোভিয়েত শৈশব - আমার শৈশবের স্কুল !
১০। শুনছি , ঘাস বাড়ছে...
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৩:৫১