somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিঃশব্দ দূরত্বে (২)

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উনিশ ছয়চল্লিশ সাল।লালপুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম-সোনারপাড়া।বড়াল নদীর পাশের একটি হিন্দু পাড়া।এই পাড়ারই একটি ধনাঢ্য পরিবার।পরিবারের একটিই মেয়ে-বিধবা। তিন ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করে।বিধবার নাম মাধবীলতা।তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।বড় ছেলেকে এক বছর হলো ভারতে আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।আর পাঠাবেনা কেন?পাশের পাড়ার এক মুসলিম মেয়ের সাথে তার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল।গ্রামে এ নিয়ে বেশ কানাঘুঁষা হওয়াতে ছেলেটাকে এক রকম জোড় করেই ভারতে পাঠিয়েছে মাধবীলতা।

মাধবীলতা সুজলাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল কোথায় কোথায় গোবর দিয়ে লেপতে হবে।এই সময় মাধব দৌড়ে মায়ের কাছে আসে।সাথে ছোট ভাই রিপন।
-মা পয়সা দাওনা।মেলায় যাবো।
মাধব মায়ের কাছে আবদার করে।
-একা একা মেলায় যাবি?
-না মা পাশের বাড়ির ওরা ওদের কাকার সাথে যাবে।আমি আর রিপন ওদের সাথে যাবো।
মাধবীলতা ঘরের মধ্যে চলে যায়।ফিরে এসে মাধবকে পাঁচ আনা আর রিপনকে এক আনা দেয়।পয়সা পেয়ে দুই ভাই ভোঁ দৌড়।পেছন হতে মাধবীলতা চিৎকার করে বলে,ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে রাখিস।
-ধরবো মা।
চিৎকার করেই মাধব জবাব দেয়।মাধবীলতা আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

রিপন মাধবের হাত ধরে টানে।মাধব রিপনের দিকে তাকায়।
-দাদা আমি বুড়ো কিনবো।আমায় বুড়ো কিনে দে।
-বুড়ো দিয়ে কি করবি?তার চেয়ে চিনির গজা নে।আর একটা চাকু কিন।আমের সময়।
-না দাদা,আমি বুড়োই কিনবো।
-ঠিক আছে বাবা।ঠিক আছে।
মেলার মধ্যে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ায় ওরা।মাধব মনস্থির করতে পারেনা কি কিনবে।মেলায় কতকিছু উঠেছে ওরা দেখেই শেষ করতে পারছেনা।রিপন ক্লান্ত হয়ে পড়ে।মাধব ভাইকে কোলে নেয়।শেষে সেও হাঁপিয়ে উঠে।
-দাদা তুই কিছু কিনবি না?
-কিনবো।

ছেলের কান্ড দেখে মাধবীলতার চক্ষু চড়কগাছ।ছেলে করেছে কি-পাঁচ কেজি কুরিকচু কিনে এনেছে মেলা হতে।মাধবীলতার হাসি আর থামেনা।তার হাসির শব্দ শুনে ঘর থেকে বাসনা বুড়ি বেড়িয়ে আসে।বাসনা সম্পর্কে মাধবীলতার পিসী।
-এত কচু কে আনলোরে লতু?
-কে আবার তোমার মেজো নাতি।
হাসি থামিয়ে পিসীকে বলে মাধবীলতা।
-নাতি আমার কচু খেতে খুব ভালোবাসেরে।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়া শেষে মাধব আর রিপন বাসনার ঘরে আসে।খাওয়া শেষে বাসনা পানের বাটা নিয়ে বসেছে।দুই ভাইকে দেখে সে খুশিই হয়।
-কি দাদু ভাইয়েরা পান খাবে?
-না দিদা।
মাধব জবাব দেয়।
-তো?
-গল্প শুনবো দিদা।
পান চাবাতে চাবাতে একটি পান মাধবের দিকে এগিয়ে দেয়।
-যা,আগে এইটা মাকে দিয়ে আয়।

দুই ভাই দিদার পাশে বসে।বাসনা গল্প শুরু করে।শোন,আমার এক পিসী ছিল।আমরা ক্ষেন্তি বুড়ি বলতাম।একদিন হয়েছে কি চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমরা ওই আম বাগানে দৌড়ে যাই।গিয়ে যা দেখলাম তাতেতো আমাদের চক্ষুছানাবড়া।
-কি দেখলে দিদা?
ঘুম ঘুম চোখে রিপন প্রশ্ন করে।
-তুই থামতো।
ছোট ভাইকে ধমক দেয় মাধব।
-শোন গিয়ে যা দেখলাম তা আর তোদের বলবোকি।দেখি পিসীর হাতে ঝাঁটা।সেই ঝাঁটা দিয়ে উনি বাঘের মুখে সমানে বাড়ি দিচ্ছেন।
-বল কি দিদা?বাঘের মুখে ঝাঁটার বাড়ি।
মাধব অবাক হয়ে বলে।
-হ্যাঁ রে।তবে আর বলছি কি?বাঘ করেছে কি,পিসীর বাছুরের পেছনের অংশ কামড়ে ধরে আছে।আর পিসী এক হাত দিয়ে বাছুরের গলার দড়ি ধর আছে আর অন্য হাত দিয়ে বাঘের মুখে ঝাঁটার বাড়ি মারছে।বাড়ি দিতে দিতে বাঘকে বকছেন।
-বাঘকে বকা দিচ্ছেন?
-কি বলে বকা দিচ্ছিলেন শোন।এই বাঘ,তুই না দেবী দূর্গার বাহন?আর তুই কিনা আমার বাছুর খাবি?বকছেন আর ঝাঁটার বাড়ি মারছেন।
-তারপর?
-তারপর আর কি?বাঘ চলে গেলো
-বল কি দিদা ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে বাঘ চলে গেলো!
ঠিক এই সময় মাধবীলতা ঘরে আসে।
-ছোটটা ঘুমিয়ে পড়েছে পিসী?
-হ্যাঁ রে লতু।
-অনেক গল্প শোনা হলো মাধব।চল এবার ঘুমবি চল।
মাধবীলতা ছোট ছেলেকে কোলে নেওয়ার জন্যে খাটের কাছে যায়।আচমকা বাহিরে ধরাম ধরাম আওয়াজ হয়।মাধব ভয়ে দিদার কাছে সরে যায়।কুকুর বিকট শব্দে ডাকতে শুরু করে।কিছুক্ষণ পর দ্রুত পদে মানুষ চলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া যায়।মাধবীলতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খাটের হাতল ধরে।বাসনাও চুপ।সবাই খুব ভয় পেয়েছে।কুকুরগুলি কিছুক্ষণ চিৎকার করে থেমে যায়।ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ নীরবতাকে বিদ্রুপ করে।
-পিসী কোন কিছুতেই কোন কিছু হচ্ছেনা।অত্যাচার থামছেনা।
-কার্তিককে বলেছিস?
বাসনা প্রশ্ন করে।
-বলেও লাভ হচ্ছেনা।আর সে কি ব্যবস্থা নেবে?সে তো ভিতুর ডিম।
-মা,আমাদের বাড়িতেই শুধু ঢেল মারে কেন?পাড়ার অন্য কারও বাড়িতে ঢেল মারেনা?
-কি বলবো বাবা,আমাদের কপাল।তা না হলে তোদের বাবা এত তাড়িতাড়ি চলে যাবে কেন?কত মানুষেরই তো জ্বর হয়।আর তোদের বাবা কিনা একদিনের জ্বরেই মরে গেলো।
মাধবীলতা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে।
-কাঁদিসনা মা।ভগবান সব দেখছেন।তিনিই উদ্ধার করবেন।
বাসনা সান্তনা দেয়।
-কোথায় ভগবান আছে তুমি বলতে পারো পিসী?ভগবান নাই।থাকলে এই ছোট ছোট বাচ্চাসহ আমার উপর অত্যাচার হতোনা।
-মারে বিশ্বাস হারাতে নেই।
ছোট ছেলেকে কোলে তুলে নেয় মাধবীলতা।বাসনা ওদের চলে যাওয়া দেখে।বাসনা শোবার জন্যে বালিস ঠিক করে আর ভাবে,যুগ কিভাবে বদলে যাচ্ছে।আগে শ্যাম-যদু এরা অত্যাচার চালাতো গ্রামের ভেতর।এখন জব্বার মোল্লারা অত্যাচার চালায়।

মাধব পুকুর পারে মাছ ধরছিল।এই সময় বাড়ির রাখাল দৌড়ে আসে।
-কি হয়েছে পল্টু?
-দাদা,পাশের পাড়ার মুসলমানরা আমের বাগানে ঢুকেছে বস্তা নিয়ে।আম পাড়ছে।
ছিপ ফেলে মাধব দৌড় দেয় আম বাগানের দিকে।
-মাধব দাদা, একা যেওনা।ওরা অনেক।
পল্টু বুঝতে পারেনা মাধব শুনতে পেলো কিনা। সে বাড়ির দিকে দৌড়ে যায় মাকে খবর দিতে।

মাধবীলতা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিল।পল্টুকে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকতে দেখে আয়না নামিয়ে রাখে।
-কি হয়েছে?
-মা ওপাড়ার মুসলমানরা খেরসাপাতের বাগানে ঢুকেছে।আম পাড়ছে।মাধবদা গিয়েছে থামাতে।
পল্টুর কথা শুনে মাধবীলতা পিসীকে ডেকে ঘটনা বলে।
-বাড়ির আর কামলা কোথায়?
বাসনা প্রশ্ন করে।
-সবাই পাথারে গিয়েছে মোষের গাড়ি নিয়ে।
পল্টু উত্তর করে।
-পল্টু তুই কামার বাড়িতে যাতো ।গিয়ে জোগেসকে বলবি সব কথা।আর পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে আসতে বলবি।আর লতু, চলতো মা আমরা সামনে এগিয়ে যাই।
-পিসী,তোমার এই বয়সে ওসবের মধ্যে যাবার দরকার নাই।
-চলতো মা চল।
বাসনার মাজা পড়ে গিয়েছে।তবুও লাঠিতে ভর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।অগত্যা মাথায় কাপড় টেনে মাধবীলতাও বেরিয়ে পড়ে।কিছুদূর যাওয়ার পরই ওরা মাধবকে দেখতে পায়।মাধব কাঁদতে কাঁদতে ফিরছে। জামা ছেঁড়া।গায়ে ধুলো মাখা। মাধবকে নিয়ে ওরা বাড়ি ফিরে আসে।
মাধবীলতা কুয়োতলায় নিয়ে যায় মাধবকে।মাধব তখনও ফুঁপিয়ে চলেছে।
-ছিঃ বাবা ওত কাঁদতে নাই।তুই পুরুষ মানুষনা?
-আমাদের বাগানের আম পেড়ে নিয়ে গেলো আর আমাকেই ধরে মারলো।
-বাবা,জীবনে এর চেয়েও বড় বিপদ আসতে পারে।এত কাঁদলে হয়?
মাধব কান্না থামায়।মাধবীলতা কুয়ো তলা হতে ঘরে নিয়ে আসে মাধবকে।চুল আঁচড়িয়ে আর একটি জামা পড়িয়ে দেয়।
-মা, ওরা মারার সময় আমাকে মালাউনের বাচ্চা বলছিল।মালাউন কি মা?
-জানিনা বাবা।চল বাহিরে গিয়ে বসি।
বারান্দায় সপ পেড়ে দেয় সুজলা।সবাই সেখানে বসে।পল্টু শুকনো মুখে বাড়িতে আসে।
-জোগেস কোথায় পল্টু?
বাসনা জানতে চায়।
-কেউ এলোনা।
বাড়ির মধ্যে অসহ্য নীরবতা নেমে আসে।


নিঃশব্দ দূরত্বে (১) (Click This Link)
চলব…………

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৪৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×