ই-মেইল মানে তো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখা। আমার আকাশের ঠিকানায়ও ঠিক লিখতে ইচ্ছা করছে না। কারণ মেইল লিখলে তো কাউকে পাঠাতে হবে, আমি কাউকে পাঠাতে চাই না। কারণটা বোধহয় এই যে পাঠাবার মত কেউ নেই আমার। মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েকে লিখি... পরক্ষণেই মনে হয় কেমন যেন সেই বিখ্যাত বইয়ের মত করার চেষ্টা করছি যেটাতে মা তার গর্ভের সন্তানকে চিঠি লিখে আর সে গল্প এক বিশাল বিখ্যাত উপন্যাস। আর আমার মেয়েতো আর পেটের ভেতরে নেই। সে এক পূর্ণাঙ্গ মানুষ। যার জন্ম আমার মধ্য দিয়ে কিন্তু যার জীবন আমার ধরা ছোঁয়ার বহুদূরে।
মনটা আজ অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। মন ভাল নাই, মন ভাল নাই, মন ভাল নাই, তবু দিন কাটে, দিন কেটে যায় আশায় আশায় আশায় আশায় মুখে ছায়া নেই। নাহ্ ঠিক ঠাক মনে পড়ছে না কবিতাটা। বহুদিনের কথা। ভুলেই গেছি একেবারে। যখন আমার মেয়ের বাবার সাথে প্রেম করতাম তখন যদি তার সাথে বিচ্ছেদের দুঃখ বাজত মনে তাকে চিঠি দিতাম লম্বা লম্বা তাতে এই কবিটাটা বেশ ভরে রাখত পাতাটুকু। সেসব এতো যুগ আগের কথা যে মনে হয় অন্য কারো জীবনের গল্প, মনে হয় কোথাও কোনো ছোট গল্পে পড়া।
আজকে ভাবছিলাম যে আমার জীবনের কথা লিখে পাতা ভরিয়ে তুলব। কিন্তু দু পাতা লিখে মনে হল আর, এতো আমার জীবন না, এতো কেমন একটা গল্পের শুরু বলে বোধ হচ্ছে। নিজের দিনলিপি লিখতে গিয়ে অন্যের জীবনের গল্প লেখা শুরু করে দিলাম। কেন যে তা অবশ্য এখনো বুঝতে পারছি না। যা মনে আসছে লিখে যাচ্ছি... কেন লিখছি... কি উদ্দেশ্য, এতো ভেবে কি হবে! প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েকে একটা ই-মেইল করব। তারপর তাকে ই-মেইল করা ফেলে লিখতে বসলাম নিজের দিনলিপি, যা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল- কী জানি কী!!
গর্ভে যখন সন্তান থাকে তখন বুঝি নারীর তার সাথে কত কথা কইতে শখ হয়! আমার বড় বোন চিঠি লিখত তার পেটের সন্তানকে। বোকা মেয়ে লিখেছিল বাংলায়, আজও যতেœ রাখা আছে আমার গোপন বাক্সের ভিতর। ছেলেটা বিদেশে বড় হয়েছে বাংলা পড়তে আর শেখানো হয়ে ওঠেনি বোনের। মাঝে মাঝে সেই গোপন কুঠুরি ছেড়ে বেড়িয়ে এসে বাংলা ছোট ছোট বর্ণগুলো আমার চোখের সামনে নেচে বেড়ায়। ভাগ্যিস আমি অমন কোনো চিঠি লিখতে যাই নি মেয়েকে। আমার তো গচ্ছিত রাখার মত কোনো বোনও ছিল না যে সে আমার বহুদূরের মানুষ মেয়েটা যে তার অচেনা মা এর চিঠি পড়তো না এই কষ্টে একা হয়ে কাঁদতে বসতো। কীরকম জটিল একটা লাইন লিখে ফেললাম। মাথার ভিতরটা কেমন যেন তালগোল হারিয়ে বসে। সবকিছুকে মনে হয় দূরে কোথাও... দূরে... দূরে...
কিন্তু মজার ব্যাপার হল আমি হচ্ছি খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ, হিসাব কষতে আজও আমার জুড়ি নাই। এখন যে কাজটা করছি তাতে জটিল সব হিসাব কিতাবই হল মূল ব্যাপার। সে সব হিসাব কষতে যখন বসি তখন আবার কিছুই মনে পড়ে না। তখন অংকের সংখ্যাগুলোই যে আমার বেশ কাছের ক্যারেক্টার তা বুঝে নিতে দেরী হয় না এক ফোটাও। এইজন্যই তো সংসার হল না আমার। মেয়েটা হারিয়ে গেল কোথায়... দূরে... বহুদূর। অঙ্কের জগতে ঢুকে গেলে কখনই আমার আর কিছু মনে থাকে না। দিন রাতের হিসাবও না। একবার মেয়েটা দুই দিন এক রাত না খেয়ে প্রায় মরতে বসেছিল। আমার অংকটা মিলে গেছে - ততক্ষণে মেয়েটা আধমরা। অনেক কাঁদছিল নিশ্চয়ই কিন্তু আমি শুনতেই পাই নি। আমার নিজের পেটের সন্তান। ধফড়ঢ়ঃ করি নি। আমি এমনই।
তবে ইদানিং একটা সমস্যা হচ্ছে আমার চোখে। প্রিয়তম সংখ্যাগুলো কেমন ঝাপসা আর দূরে ছুটে যেতে চাইছে। মাঝে মাঝে ঝাপসা অংকগুলোকে সোজা করতে চোখ ডলে নেওয়ার পর দেখি অংকের বদলে সাদা কাগজে ফুটে আছে আমার মেয়েকে কখনো না লেখা চিঠির মন ছোঁয়া বর্ণগুলো। মেয়ের চেহারাটা মনে পড়ে না... আসলে আমি তো জানি ও আর সেরকম দেখতে নেই। কয়েকযুগ আগের কথা। তখন আমি অনেক সুন্দরী ছিলাম। আমার মেধার তাপে পুরুষেরা আমার ধারে -কাছে ভিড়তে চাইতো না। আমার এক ছয় ফুট দুই ইঞ্চি শিক্ষক যিনি কেমন করে যেন নারী হয়ে জন্মেছিলেন তিনি বলতেন যে পুরুষরা তাদের চেয়ে লম্বা আর স্মার্ট মেয়েদের কখনো বিয়ে করে না। আমার সেই শিক্ষক কখনো বিয়ে করে নি। কারণ জানতে চাইলে এই উত্তর পেয়েছিলাম। আমি খুব হাসলাম। কারণ আমার ধারণা ছিল আমি আমার সঙ্গীর চেয়ে আমি স্মার্ট ছিলাম তবু সে আমাকে খুব ভালবাসতো। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো সে ভাবতো যে সে আসলে আমার চাইতেও স্মার্ট আর আমার চেয়ে লম্বা ছিল বলে দ্বিতীয় ব্যাপারটা তো বাদই পড়ে গেল। সেই লোকটাকেই আমি বিয়ে করেছিলাম। যেহেতু অন্য পুরুষরা আমার আশে পাশে ঘেষতো না, এই ‘হলেও হতে পারে’ স্মার্ট ছেলেটাকে আমি বাবা-মা’র মতে বিয়ে করে ফেললাম। তখন কিছুদিনের জন্য অনেকের চাইতে তাকে প্রিয় মনে হত।
এখনও বুঝিনা অংক সস্থানে ফিরে এল কি করে-- সে আমার কাছে ফরংঢ়বহংরনষব হয়ে উঠেছিল? অন্য কোন পুরুষ তার জায়গা নিয়েছিল? আমি তাকে আর ভালবাসতাম না? নাকি ভালবাসাবাসিটা দেহের তৃষ্ণা মিটে যাওয়া পর্যন্তই রঙিন থাকে? তৃষ্ণা মিটে গেলেই ভালবাসার পুরুষের চেহারা ছাপিয়ে ভেসে ওঠে এরাবিক নিউমেরালস ? আমার মনে আছে বিয়েটার শেষের দিকে আমাদের দেহের ভালবাসা তুখোর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করলে আমার প্রিয়তম সংখ্যাদের ভরমঁৎব গুলো আমার চোখের সামনে এমন ধাঁধাঁ লাগিয়ে দিত যে একদিন ভুল করে আমার পুরুষকে বলে বসেছিলাম... না থাক সে বড় বিব্রতকর সময়। আমার পুরুষ আমার ভিতর থেকে নিজেকে উপরে আনতে আনতে বলেছিল; কি বললা এটা তুমি? তুমি এটা কি বললা? লজ্জায় আমি তার চোখে চাইতে পারিনি বহুদিন। ভাল ছিল মানুষটা। খুব ভাল। নির্ভরযোগ্য। সব কাজে ঠান্ডা মাথার বিবেচক মানুষ। মেয়েটা তার কাছেই বড় হল। আমাকে লাগেনি আর ওদের। আমারও না। বাবা তার মেয়েকে আমার চেয়ে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছিল, বহু বহুদূরে......
আমার ছায়াটা বিশেষতঃ অপছন্দ ছিল আমার পুরুষটার যেদিন থেকে সে জেনেছিল আমাদের ভালবসায় আমি কখনই পূর্ন ছিলাম না। আমার কোথায় যেন সবসময় কমতি থেকে যেত। মনে হত কি যেন ঠিক পাওয়া হল না। শীর্ষসুখের অভিষেকের মত প্রতি রাতের ভালবাসায় আমার নতুন কোনো পাওয়ার আশায় এক অতৃপ্তি থেকে যেত। আমার পুরুষটি মানুষ হিসেবে ছিল অসাধারণ কিন্তু কোথায় যেন কম পরে যেত। কমতিটা তার ছিল না, ছিল আমার। আমার ভালবাসার বুভুুক্ষা মেটানোর মত পুরুষ আজও জন্মেনি বোধ করি। এতটা বয়স পার করলাম তেমন কাউকে হাতে ঠেকলনা আজও। তাই তৃষ্ণাটা মিটে নি।
মেয়েকে দেখতে ইচ্ছা করেছিল, মনে হয়েছিল তাকে দেখে হয়ত তৃষ্ণাটা মিটে যাবে। বহু খোঁজ করে তার ঠিকানা বের করে গিয়েছিলাম চোখের দেখা দেখতে। বাংলাদেশে থাকে সে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। সে পড়ায় একটা ছায়া ঘেরা প্রাথমিক স্কুলে। আমার মত (থাকলে) নোবেল প্রাইজ পেতে-পারতো মায়ের (আলফ্রেডের স্ত্রী গণিতবিদের সাথে ভেগেছিল বলে ১০০ বছর ধরে আমাদের কপালে নোবেল জুটল না।) এমন মেয়ে দেখে সবার নিশ্চই অবাক লাগে... অথবা বাবা আমাকে তার মেয়ের জীবন থেকে সফল ভাবে সম্পূর্ণ মুছে ফেলেছে যেমন অনেকে অনেক কিছু মুছে ফেলে। মাতৃত্ব মোছে কি? কিন্তু আমার বুকটা কেমন যে এক ভাল লাগায় ভরে উঠল সেদিন। মেয়েটা আমার তার বাপের মত হয়েছে। শান্ত আর তৃপ্ত। আমার অতৃপ্তির প্রেতাত্মা যেন ওকে না ছোঁয় - এরচেয়ে বেশি কিছু আর জানার ছিল না আমার। ওর স্কুলের ছায়া ঘেরা বারান্দায় খেলতে থাকা বড়ই গাছের পাতার লুকোচুরি দেখতে দেখতে কেমন এক নেশাগ্রস্ত আরাম বোধ হচ্ছিল... দপ্তরি যখন চমকে দিয়ে জানালো যে বাংলা আপা আর ৫ মিনিট পরেই ক্লাস থেকে বের হবেন, আমি যেন আপাদের রুমে গিয়ে বসি... ততক্ষণে আমার সামনে বড়ই গাছের পাতার ছায়ার ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে আমার নিয়তির মত, অবিশ্বাসীর ঈশ্বরের মত আমার ঘৃণার ভালবাসা - আমার এরাবিক নিউমেরালস ।
--মানসিক হাসপাতালের স্টোর রুম থেকে উদ্ধার করা সমকামী বৃদ্ধার ডায়রীর ছেঁড়া পাতা থেকে।
রচনাকাল: ২২/১২/২০০৫
বেথলেহেম, পেনস্যীল্ভানিয়া, ইউএসএ
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ৯:০৮