আগের ব্লগ পড়ে অনেকের হয়ত মনে হয়েছে, আমি র্যাগবিরোধী স্লোগান দেয়ার জন্য ব্লগিং শুরু করেছি, ব্যপারটা মোটেও তা নয় । আমি একজন ছোটখাট দাবা খেলোয়াড় , জীবনের অন্যতম লক্ষ্য গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। আর কথা না বাড়িয়ে যেটা লিখতে বসেছি তাতে চলে আসি।
প্রতিবছরের মত এবারও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় দাবা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হল(২৬-২৯ নভেম্বর,শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ,সিলেট )। গতবারের মত এবারও বুয়েট দলের হয়ে আমি খেলার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের দলে খেলোয়াড় ৫ জন, আমি সবচেয়ে জুনিয়র। আমি ছাড়া দলে আছে ০৯ ব্যাচ এর নাবিল ভাই, নির্মল ভাই, তফা ভাই ও ০৭ ব্যাচ এর রৌপ্য ভাই । সিলেট যাওয়ার ব্যপারটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র আমাদের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা ৩ সপ্তাহ অকারণে পিছিয়ে যাওয়ার ফলে(কে জানে আরও নাকি পিছাবে)। তো ২০ তারিখে ঠিক হল আমরা সিলেট যাচ্ছি । ১৫ হাজার টাকার বাজেট এ বুয়েট থেকে আমাদের সবার জন্য ট্রাকসুট, জার্সি , জুতা এগুলো কেনা হল।খেলা শুরুর আগেই সবাই খুব খুশি।
২৬ তারিখে যথাসময়ে গ্রীনলাইন বাস এ করে আমরা বিকালের দিকে সিলেট পৌছালাম । আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হলের ৫ তলায় , যেটা সদ্য নির্মিত হয়েছে । সবাই এক রুম এ । পাশেই দেখি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় , জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আরও কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় আগে থেকেই হাজির । আমরা জানতাম অন্যতম শক্তিশালী ঢা,বি এবার খেলছে না তাদের নিজেদের ভেতর কলহের কারণে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এবার আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা ছিল অনেক বেশি। রুমে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরই ফিকচার হাতে পেলাম। আমাদের গ্রুপে খুলনা ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র খেলছে অন্য গ্রুপ এ পড়েছে শাহজালাল ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ।রাত এ খুলনা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দল আমাদের রুম এ আসল আমাদের খোঁজখবর নিতে (!)। দুই দলই বলে গেল তারা খুব অনভিজ্ঞ , খেলা পারে না(!) , আমাদেরই চ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি ।
২৭ তারিখ যথাসময়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এর মধ্য দিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু হল । সকাল ১২ টায় আমাদের সাথে খুলনার খেলা । সকাল ১০ টায় শাহজালাল ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে "বিগ ম্যাচ" শুরু হল । আমাদের দলের সবাই দর্শক হয়ে চলে গেলাম খেলা দেখতে । কিন্তু গিয়ে দেখি কোথায় "বিগ ফাইট "হবে সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দল এর জেতার কোন লক্ষণ নাই । সবার আগে হারল চার নম্বর বোর্ড(যার খেলা দেখে মনে হল আমি একে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটে হারিয়ে দেব)। এরপর এক নম্বর বোর্ড হারল জঘন্য ভাবে (নাবিল ভাই ও এক ই মন্তব্য করল খেলা দেখে)। দুই নম্বর বোর্ড লড়াই করল বেশ কিন্তু শাহজালাল এর চ্যাম্পিয়ন তাকে হারিয়ে অপরাজিত থাকার রেকর্ডটা আরো বাড়িয়ে নিল । খেলা দেখেই বুঝেছিলাম তিন নম্বর বোর্ড এ জাতীয় এর সবচেয়ে ভাল প্লেয়ার খেলছে । সে জেতার অনেক চেষ্টা করল কিন্তু শেষে ড্র হয়ে গেল । ফলাফল জাতীয় .৫ - শাহজালাল ৩.৫ ।
যাই হোক , ১২ টায় আমাদের খেলা শুরু হল খুলনার সাথে । এক নম্বর বোর্ড এ নাবিল ভাই , ২ এ নির্মল ভাই , ৩ এ রৌপ্য ভাই ৪ এ আমি । শুধু আমার প্রতিপক্ষ পড়ল একটা মেয়ে() । আমি কোনদিন কোন মেয়ের সাথে হারি নি । তাই ভাবলাম এ আর কি খেলবে । কিন্তু প্রথম চাল এই ভুল ভাঙল , ইংলিশ ওপেনিং এর চাল দিল সে । একটু বিব্রত হলাম, এই ওপেনিং খেলার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না । স্লাভ ওপেনিং এ ট্রান্সপোজ করলাম । এরপরও সে ইংলিশ খেলতে চাইল কিন্তু তিন চাল এর পর খেলা সেমিস্লাভ এ ট্রান্সপোজ করল । যথারীতি চার নম্বর চাল এ আমি ডাচ খেলা শুরু করলাম । মেয়েটা এবার থমকে গেল , আমার ধারণা এই ওপেনিং সে জানত না । ১০ মিনিট চিন্তা করে নরমাল চাল দিল । আমি বুঝলাম আমার টার্গেট পূর্ণ হয়েছে । ৪০ মিনিট করে দুই জনের সময় ছিল প্রথমে , কিছুক্ষণ এর মধ্যে মেয়েটার সময় কমে হল ১৮ মিনিট আর আমার ৪২ মিনিট । সময়ের চাপ থাকলেও মেয়েটা বড় কোন ভুল করেনি । সে শুধু নতুন ওপেনিং এর কারণে বেশ কিছু পজিশনাল ভুল করল যার সুবিধা আমি যথাযথভাবেই নিলাম।একসময় তার ঘড়িতে হল ১ মিনিট আর আমার ২২ মিনিট। দুইটা বিশপ এর সুবিধায় একটা বড়ে বেশি হয়ে গেল। কনফিডেন্স এর সাথে সব গুটি কাটাকাটি করলাম ও নিরিবিলি জিতে গেলাম সবার আগে।
উঠে দেখলাম এক নম্বর বোর্ড এ নাবিল ভাই জেতার পথে তিন নম্বর বোর্ড এও জয় অবশ্যম্ভাবী । দুই নম্বর বোর্ড এ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । নাবিল ভাই জিতল । কিন্তু এরপর আমরা অবাক হয়ে গেলাম রৌপ্য ভাই এর একটা বিশপ বেশি, দুইটা বড়ে বেশি তারপর ও সে আজেবাজে চাল দিয়েই যাচ্ছে, নির্মলদা যুদ্ধ করছে, কিন্তু রৌপ্য ভাই এর জঘন্য খেলা দেখে শেষে খেলা দেখাই বাদ দিয়ে দিলাম । বহুক্ষণ পর রৌপ্য ভাই জিতল। নির্মল দা ভয়ঙ্কর কিছু ভুল চাল দেয়ার পর ড্র করল। ফলাফল বুয়েট ৩.৫ - খুলনা ০.৫ ।
ফলাফল ভাল হলেও এই দলের পারফরমেন্স এ কেউ খুশি ছিল না রাত এ। পরদিন কুমিল্লার সাথে খেলা ।এবারও সবার আগে আমি জিতলাম , তারপর নাবিল ভাই ও নির্মল দা। কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের দলে প্রথম হারের মুখ দেখল রৌপ্য ভাই । ফলাফল বুয়েট ৩ - কুমিল্লা ১।
বুয়েট গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনাল এ উঠল । সাথে খুলনা, জাতীয় এবং শাহজালালও উঠল । ওইদিন বিকালেই সেমিফাইনাল হওয়ার কথা । আমাদের সাথে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল এর সাথে খুলনার খেলা । জাতীয় ওইদিন খেলতে রাজি হল না , তারা পরদিন খেলতে চাইল, আমরাও আপত্তি করলাম না ।বিকালে অবাক হলাম খুলনা ও শাহজালাল এর খেলা দেখে , খুলনা শাহজালালকে ৩-১ এ হারিয়ে দিল। আমি রাতের বেলা বন্ধুর সাথে চা বাগান এ ঘুরে আসলাম । বাকিরা "পাঁচভাই" রেস্তোরা তে খেতে গেল ।
সকাল আটটায় খেলা শুরু হল , খেলা শুরুর আগমুহূর্তে আমি কিছুটা নার্ভাস ফিল করতে শুরু করলাম । তারপর কাল নিয়ে খেলা, বিরক্তও হলাম । প্রথম চাল থেকে বুঝতে পারলাম এই খেলোয়াড়টি প্রথম ম্যাচ এ যা খেলছে তার সাথে সেমিফাইনাল এ খেলার কোন মিল নেই । মুখস্ত চাল গুলো দিতে লাগল একের পর এক । আমি বিরক্ত হয়ে উঠলাম । সম্প্রতি সব খেলায় আমি প্রতিপক্ষকে টাইম প্রেসার এ ফেলিয়ে অভ্যস্ত আর এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ এ আমি ই উল্টা টাইম প্রেসার এ । যাই হোক খেলা চলতে থাকল , যত ভালই খেলুক এই খেলা আমি হারবনা এমন চিন্তা করতে থাকলাম । খেলার মাঝপর্যায় , দুই পক্ষ সমান অবস্থান এ আছে । তখনই দেখলাম বুয়েট চ্যাম্পিয়ন নাবিল ভাই ২০ চাল এই হেরে গেছে । পাশের বোর্ড এ রৌপ্য ভাই ভালই খেলছে দেখলাম । ৫-১০ মিনিট পর নির্মল দা হেরে গেল । আমি আর রৌপ্য ভাই খেলছি শুধু। এই সময় আমার আর রৌপ্য ভাই এর প্রতিপক্ষ বারবার ড্র অফার করা শুরু করল । দুইজনই নাকচ করে দিলাম, যে ড্র তে দল হারে তার চেয়ে লড়াই করে হারা অনেক ভাল । রৌপ্য ভাই এর ঘড়িতে ৮ মিনিট আর প্রতিপক্ষের ঘড়িতে ৫ মিনিট আছে আর । আমার ঘড়িতে ২ মিনিট প্রতিপক্ষের ঘড়িতে ২২ মিনিট । রৌপ্য ভাই এর জেতা পজিশন আর আমার ড্র টাইপ পজিশন ।
খেলা চলছে আর নার্ভাসনেস বাড়ছে । কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যথেষ্ট ঝুকি নিচ্ছি কিন্তু প্রতিপক্ষ ড্র ই করতে চায় শুধু । প্রতি ২ মিনিট পরপর ড্র অফার করা শুরু করল আমাদের । একটু পর রৌপ্য ভাই প্রতিপক্ষ চিৎকার করে উঠল, সে জিতে গেছে কারণ রৌপ্য ভাই এর টাইম আপ হয়ে গেছে , বুয়েট দল স্তব্ধ। এমন হবে এটা কেউ ভাবতেই পারে নি । আমি আর কি করব, ড্র পজিশন থেকে জেতার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম । অবশেষে প্রতিপক্ষ ভুল করল এবং জিতলাম । ফলাফল জাতীয় ৩- বুয়েট ১।
এরপর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ শাহজালাল এর সাথে । দল তখন বিধ্বস্ত , কারো খেলার ইচ্ছা নেই। তবু খেলতে তো হবে । খেলতে বসলাম , আমার প্রতিপক্ষের আন্তর্জাতিক রেটিং ২০২২, আর আমার ১৭৫৫, আমি তার কাছে নিতান্ত ছোট প্লেয়ার । রৌপ্য ভাই জিতল , নির্মল দা হারল , আমি হারলাম , নাবিল ভাই জিতল , ড্র হয়ে গেল । এবার টাইব্রেক হবে ১৫ মিনিট এর , এবার জিততেই হবে এমন মন নিয়ে খেলতে বসলাম। আমার প্রতিপক্ষ এবার একটু রিলাক্সড মুড এ খেলতে লাগল । যথারীতি সে একটা বড়ে হারাল এবং ম্যাচ হারল। কিন্তু রৌপ্য ভাই ও নির্মল দা হেরে বসল। নাবিল ভাই এর জেতা খেলা, সে এক চালের জয় দেখতে পেল না প্রেসার এ ,হেরে গেল। আমরা হারলাম ৩-১ এ । খুলনাকে ফাইনাল এ ৩-১ এ হারিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হল।
লজ্জিত , বিধ্বস্ত হয়ে আমরা ঢাকার পথে রওনা দিলাম , এভাবে হারব আমরা কে ভেবেছিল, কারো মুখে কোন কথা নাই। গতবারের মত এবারও সেমিফাইনাল এ বিদায় নিলাম। এর পরের বার হয়ত আরও বেশি শক্তিশালী দল নিয়ে খেলতে যাব , সেবার হয়ত চ্যাম্পিয়ন ই হয়ে যাব ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:৪৮