আগের ব্লগে বাংলাদেশ দাবার দৈন্যদশা তুলে ধরায় অনেকে আমাকে নৈরাশ্যবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন, সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমি আশাবাদী একজন মানুষ। আমি সবকিছুর মধ্যেই ইতিবাচক বিষয় খুঁজে বের করতে চেষ্টা করি। আজ তাই লিখতে বসেছি সম্ভাবনাময় খেলা দাবায় ভাল করতে হলে আমাদের করণীয় কি কি হতে পারে সেটা নিয়ে।
আমি নিজে একজন ক্ষুদে দাবাড়ু। তাই আমার চেয়ে ভাল খেলোয়াড়দের জন্য আমার এই লেখা নয়। যারা দাবায় ভাল করতে চায় কিন্তু ঠিক পদ্ধতি অবলম্বন না করায় এখনও দাবায় কেবল হাতেখড়ি পর্যায়ে বসে আছে বিশেষ করে যারা স্কুল,কলেজ পর্যায়ে পড়াশোনা করছে তাদের জন্যই আমার এই লেখা।যারা ঢাকার বাইরে থাকেন তাদের জন্য দাবায় ভাল করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। তবে সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে এই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। বলাবাহুল্য আমি নিজে কিন্তু ঢাকার বাইরে স্কুল ও কলেজ জীবন পার করেছি।
দাবায় হাতেখড়ি হয় দাবার নিয়মকানুন শেখার মাধ্যমে । তবে অনেকক্ষেত্রেই আমরা ভুল নিয়ম জেনে খেলা শুরু করি যেমন আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে প্রথমে দুই চাল এবং শেষে ১৬ চাল বলে কিছু নেই এটা অনেকেই জানে না। আমরা যেহেতু ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি তাই এসব নিয়মকানুন জানার জন্য শুধু একবার গুগোল এ "রুলস অব চেস" লিখে সার্চ দিলেই এগুলো পাওয়া সম্ভব। অনেকেই এখনও ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাই তাদের জন্য বাংলাদেশের দাবার অন্যতম কর্ণধার রাণী হামিদ এর লেখা "দাবা খেলার আইনকানুন" বইটা সাহায্য করতে পারে। আমি ক্লাস এইটে যখন এই বইটা পড়েছিলাম তখন অবাক হয়ে ভাবতাম শতকরা কতজন এই নিয়মকানুন সঠিকভাবে জানে!! দাবার চাল লেখার নিয়ম জানাও অত্যন্ত জরুরী, এই নিয়ম না জানলে যেকোন টুর্নামেন্ট এই বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গুগোল সার্চ ও রাণী হামিদের "মজার খেলা দাবা" বইটা এক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করতে পারে।
নিয়মকানুন ও চাল লেখা শেখার পরই সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ শুরু হয় দাবায়। দাবায় ভাল করতে হলে যে অনেক পড়াশোনা, প্রাকটিস, ধৈর্য প্রয়োজন তা কয়েকটা বড় টুর্নামেন্ট খেললেই বোঝা সম্ভব। শুধুমাত্র প্রাকটিস এর উপর ভিত্তি করে হয়ত মোটামুটি একটা রেটিং অর্জন করা সম্ভব কিন্তু পড়াশোনা ব্যতীত এই রেটিং বাড়ানো বা ধরে রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আমার কাছে মনে হয় দাবা হল গণিত বা বিজ্ঞানের মতই পাঠ্য বিষয়, এখানে জানার কোন শেষ নেই তাই জানার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পৃথিবীতে সব খেলার মধ্যে দাবা নিয়েই যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বই রচিত হয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দাবায় আবার বই পড়ে কি হবে ? এমন অবান্তর প্রশ্ন করেন অনেকেই। সহজ উত্তর পড়াশোনা ব্যতীত পরীক্ষা দেয়া, অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধে নামা আর দাবার পড়াশোনা ব্যতীত বড় টুর্নামেন্ট খেলতে নামা একই কথা। বড় খেলোয়াড়দের সাফল্যের পিছনে যে এই পড়াশোনা কতখানি দায়ী তা তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন।
এখন কথা হল কি বই পড়ব দাবার জন্য। প্রথমেই বলেছি দাবার বইয়ের সংখ্যা এত বেশি যে পড়ার মত বইয়ের অভাব নেই। তবে সমস্যা হল বাজারে খুব অল্প সংখ্যক বই পাওয়া যায়। তবে যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলো জোগাড় করে পড়াটাও অনেক কাজে দিতে পারে যেমন রাণী হামিদ এর "মজার খেলা দাবা", জিয়াউর রহমান এর "দাবা", বিশ্বজিৎ মণ্ডল এর "আন্তর্জাতিক রেটেড দাবা খেলোয়াড় হোন" এগুলো খেলার প্রাথমিক ধারণা লাভে অনেক সাহায্য করতে পারে। তবে আশার কথা এই যে দাবার উপর ভাল সব বই ই ইন্টারনেট এ সহজলভ্য । যাদের ই-বুক পড়ার অভ্যাস আছে তাদের জন্য নিমজোভিচ এর "মাই সিস্টেম",মার্ক দোভারস্কি এর "এন্ডগেম ম্যানুয়াল", গ্যারি ক্যাস্পারভ এর "মাই গ্রেট প্রিডিসিসরস" ইত্যাদি বই অনেক কাজে দিতে পারে। আর আমার মত যাদের কাছে বই প্রিন্ট করা সহজলভ্য তাদের বলব অল্প কিছু খরচ করে পিডিএফ থেকে হার্ডকপি বানিয়ে নিলেই অনেক ভালভাবে বই পড়া সম্ভব। দাবা ফেডারেশন(পল্টন) এ যাদের যাতায়াত আছে তারা ইতিমধ্যেই জানে আমাদের প্রিয় মাসুম ভাই প্রতিদিনই সেখানে দাবার বিভিন্ন বই প্রিন্ট করে বিক্রি করেন । তো ইচ্ছা থাকলে এসব বই জোগাড় করে পড়া সম্ভব।
দাবা শেখার আরেকটা সহজলভ্য উপায় হল দাবার ভিডিও লেসন দেখা। দাবার আবার ভিডিও কি জিনিস এমন প্রশ্ন এর উত্তরে বলব, ইন্টারনেট এ ঢুকে শুধু "চেস ভিডিও টরেন্ট" লিখে সার্চ দিন । সাথে সাথে হাজারো দাবা ভিডিও ডাউনলোড করার লিঙ্ক পাবেন। টরেন্ট ফাইল যেহেতু ফ্রী ডাউনলোড করা যায় তাই ডলার খরচ হয় এমন লিঙ্ক এ ঢুকবেন না কষ্ট করে। চেস ভিডিও গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল হল "চেসবেস শপ" এর প্রোডাক্টগুলো । সমস্ত ওপেনিং , মিডলগেম আইডিয়া , এন্ডগেম এর ব্যাসিক থেকে এক্সপার্ট পর্যন্ত সব রকমের ভিডিও পাওয়া যাবে খুঁজলে । বলা বাহুল্য আমরা কয়েকজন মিলে ইতিমধ্যে ১৫০ গিগাবাইট দাবার ভিডিও ডাউনলোড করেছি এবং আরও ডাউনলোড চলছে। আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে আমরা এসব ভিডিও সবাইকেই দিই(অবশ্যই ফ্রী)।
তবে কথা হল , ভিডিও সহজলভ্য এবং বই দামী এর কারণটাও বোধগম্য । ভিডিও থেকে অর্জিত জ্ঞান ক্ষণস্থায়ী আর বইয়ের জ্ঞান অনেক সময়ই হয় চিরস্থায়ী (কারণটা আপনারাই যাচাই করলে বুঝতে পারবেন), কিন্তু ভিডিও বা বই যেকোনো মাধ্যমের প্রতি এলার্জি ভাল জিনিস নয় । দাবা খেলোয়াড় এর মন হওয়া প্রয়োজন মুক্ত , সবকিছুই গ্রহণ করে দেখতে আপত্তি নেই এমন । তাহলে ভালমন্দ বিচার করতে অনেক সুবিধা হবে। আর ভিডিও অথর ও বই এর লেখক কিন্ত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন , সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার বিভিন্ন খ্যাতিমান খেলোয়াড়গন । তাই তাদের এসব জিনিসকে খারাপ বলার আগে ভালভাবে যাচাই করা প্রয়োজন।
শেষ মাধ্যমটার কথা বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই না। তবে এটাও অনেক কাজে আসে। এটা হল দাবার বিভিন্ন চাল বিশ্লেষণ এর জন্য সফটওয়্যার, ইঞ্জিন। বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন হল হুডিনি ৪, এছাড়াও আছে ডিপ রিবকা ৪, ফ্রিটজ ১৩ ইত্যাদি । এসব ইঞ্জিন দিয়ে যেকোনো পজিশনে মোটামুটি সঠিক চাল বের করা সম্ভব। নিজের খেলায় কোথায় কোথায় ভুল হল বা কোন চাল টা ভাল ছিল এসব বিশ্লেষণ এর জন্য ইঞ্জিন অনেক সাহায্য করতে পারে । এসব ইঞ্জিন নেট এ সার্চ দিয়ে ডাউনলোড করা যায় অনায়াসে। বাজারে পাওয়া যায় "চেসমাস্টার গ্রান্ডমাস্তার এডিশন " নাম এর একটা গেম। শুরুর দিকে এটাও খারাপ না প্রাকটিস এর জন্য।
এতক্ষণ যাবত দাবা শেখার বিভিন্ন উপকরণ এর কথা বললাম। এখন কিছু বাহ্যিক বিষয় নিয়ে কথা বলব। আন্তর্জাতিক মাস্টার আন্ড্রু মারটিন বলেছেন, "দাবায় ভাল করতে হলে মোটামুটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে। দাবা বাদে অন্য কিছু নিয়ে তীব্র নেশাগ্রস্ত হওয়া চলবে না", তিনি আরও বলেছেন যদি সময় কম থাকে তবে প্রতিদিন মাত্র ২৫ মিনিট করে হলেও দাবা প্রাকটিস ও স্টাডি করতে হবে । এতে নিয়মিত হারে রেটিং বাড়তে থাকবে। আর আমি বলব, ভাল খেলার জন্য অভিজ্ঞতা এরও মূল্য আছে। তাই অনেক অনেক টুর্নামেন্ট খেলে যেতে হবে সুযোগ পেলেই। আর প্রতিটা পরাজয় এর পর এটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে ভুলগুলো শুধরানোর চেষ্টা করতে হবে।
আর বেশি কিছু বলতে চাই না, আগে নিজে বড় প্লেয়ার হয়ে নিই। সেদিন হয়ত আরও ভাল পরামর্শ দিতে পারব। বাংলাদেশের দাবানুরাগিগণ দাবাকে আরও ভালবেসে খেলতে থাকবেন এবং স্টাডি, প্রাকটিস ও ধৈর্যের সাথে দাবা খেলে বাংলাদেশের দাবাকে আরও উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাবেন এই আশা পোষণ করেই শেষ করছি আজকের মত।