ইতিহাস এর প্রতি আমার ছোটবেলা থেকে অনেক আগ্রহ। যখন সেটা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তখন তো কথাই নেই। মুক্তিযুদ্ধের গল্প উপন্যাস সিনেমা -অনেক কিছু অনেকেই পড়েছি ও দেখেছি। তাই এটা নিয়ে আজ লিখছি না। আমার আগ্রহের বিষয় ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে।
ক্লাস টেন এ থাকতে সদ্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর "প্রথম আলো" শেষ করেছি। বিষয়বস্তু না দেখেই বাবার একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করি। মেজর রফিকুল ইসলাম পি এস সি এর " পচাত্তরের রক্তক্ষরণ " । বইটা পড়ার সময় অনেক ভাল লেগেছিল-ওই বয়সে যা হয় আর কি।মোটামুটি একটা অতিমাত্রায় বঙ্গবন্ধুপ্রেমী বই ছিল ওটা আজ বুঝতে পারি । তবে ওই বই পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার তখনও হয় নি। বিচারের ফল অনেকাংশে ওই বইএর কথিত অংশ গুলোকে সমর্থন করে। জিয়াকে অতিমাত্রায় তাচ্ছিল্য আর খালেদ মোশাররফ নিয়ে অতিরিক্ত ভাবালুতা আমার কিশোর মনে সেদিন দাগ কাটে নি। সামান্য সন্দেহ হয়েছিল এই আর কি।
দ্বিতীয় বই - হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল। এই বই পড়ার প্রাসঙ্গিকতাও একই। হিমু আর মিসির আলি পড়তে পড়তে একসময় মনে হত হুমায়ূন আহমেদ মনে হয় সিরিয়াস বই লিখতেই পারেন না।অবশেষে 'মধ্যাহ্ন' পড়লাম । এক কথায় অসাধারণ ছিল বইটা। তারই ধারাবাহিকতায় দেয়াল পড়তে শুরু করলাম। শুরুটা মধ্যাহ্নের মতই। সেই স্টাইল সেই মুগ্ধতা। বঙ্গবন্ধুর সাথে হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের ব্যক্তিগত টানাপোড়েন এর কারণে কিছুটা বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষ হয়ত চোখে পড়বে লেখায়। তবে সেটা বোধগম্য হুমায়ূন আহমেদ এর পরিস্থিতিতে যে কেউ আরও বাজে ভাবে লিখতে পারত, হুমায়ূন আহমেদ বলেই এটার মাত্রা ছিল সামান্য। দেয়াল সত্যনিষ্ঠতা আর সাহিত্যগুণের অপূর্ব সমন্বয়। শেষ এর দিকে পাঠক হয়ত হতাশ হবেন লেখক এর তাড়াহুড়ার কারণে। তবে এর কারণ নিশ্চয়ই অনেকে জানেন লেখকের ক্যান্সার হওয়ার কারণে সময় ফুরিয়ে আসছিল। মৃত্যুশয্যায় এর থেকে ভাল লিখতে পারা দুরুহ ছিল।
তৃতীয় বই- আন্থনি মাস্কারেনহাস এর 'রক্তের ঋণ'। দেয়াল পড়ার পরই আমি এই বইটা বাজারে খোঁজা শুরু করি।শেষমেশ রকমারি তে পাই। যদি ইতিহাস ও সত্যনিষ্ঠতা দিয়ে শুধু বিচার করতে হয় তবে এই বইটা এক কথায় অসাধারণ। এত খুঁটিনাটি কাহিনী আর কোন বই বইতে আমি পাই নি। লেখককে সামান্য জিয়াপন্থি মনে হতে পারে তবে সব মিলিয়ে বইটিকে আমি আমার পড়া সেরা ইতিহাস বইগুলোর তালিকায় রাখব।
তিনটা বইয়ের ইতিহাসে আমি এতটাই আনন্দ পেয়েছি যে এদের ধারাবাহিকতায় পড়া শুরু করেছি আরও দুইটা বই - হাবিবুর রহমানের 'মুজিব হত্যা কাহিনী' এবং ড। হাসান উজ্জামান এর "১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান, মুজিব হত্যা ও ধারাবাহিকতা"।
বইগুলো আমাকে যেমন সত্য ঘটনা উপহার দিয়েছে তেমনি বিভ্রান্তিমূলক তথ্যও কম দেয় নি। জিয়া হত্যা নিয়ে "রক্তের ঋণ' পড়ার পর জেনারেল মঞ্জুরকে স্বপ্নে ফাঁসিতে ঝুলতে দেখলে পাঠকের কোন মায়া হবে না। দেয়ালেও তাই। 'পচাত্তরের রক্তক্ষরণ' এ সে তেমন তথ্যই পাবে না এ ব্যপারে। আবার লরেঞ্জ লিফসুলতজ এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়লে সে মঞ্জুরকে নিষ্পাপ আর এরশাদকে প্রকৃত খুনি ভাবতে শুরু করবে।
সত্য যেটাই হোক পাঠক ৭১-৮১ এর ইতিহাস পড়ে অনেক কিছু জানতে পারবে। জানবে তার মাতৃভূমি সম্পর্কে অনেক অজানা ঘটনা যা থেকে সত্য মিথ্যা যাচাই করা তার নিজ দায়িত্ব । যারা রাজনীতি করে বা ভালবাসে এবং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করে তাদের সবাইকে আমি অনুরোধ করব এদেশের ইতিহাসটা আরও ভালভাবে জানার জন্য। তাতে পরবর্তী প্রজন্মও অনেক উপকৃত হবে।