রাজাকার শব্দটি বলতেই দেশের অগ্রহনযোগ্য অতিমাত্রায় ঘৃনিত ব্যক্তি বুঝায়। আমরা মনে প্রাণে রাজাকারদের ঘৃণা করি, তাদের শাস্তি দাবি করি। কারণ তাদের অতীতের প্রেক্ষাপটটাই ছিল ঘৃণা করার মত। দেশের সাথে,দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিল ৭১ এর রাজাকারেরা, তারা পাক-হানাদারদের সহায়তা করেছিল আমাদের মা-বোনের ইজ্জতের উপর ঝাপিয়ে পড়তে, মুক্তিকামি মানুষকে হত্যা করতে, মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে হত্যা করতে, ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দিতে ইত্যাদি অমানবিক কাজে তাদের সম্পৃ্ক্ততা ছিল সবখানে।
কিন্তু সে সময়ের গ্রামে গঞ্জে এমন কিছু রাজাকার ছিল যারা রাজাকার হয়েছিল শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তি যোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাকারীদের সাহায্য করার জন্য। মুরব্বিদের মুখে শুনেছি ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানার অর্ন্তগত একটি আদর্শ গ্রামে (নাম উল্লেখ করলাম না) যোদ্ধ চলাকালীন মুক্তি যোদ্ধাদের খাওয়া-দাওয়া সরবারহ করা সহ বিভিন্ন সাহায্য প্রধান করতেন উক্ত গ্রামের চৌধুরী সাহেব(পরিচয় তুলে ধরতে চায়না) ।
মুরব্বিদের মুখে শুনেছি প্রতিদিন রাত হলেই, মুক্তিযোদ্ধারা সারিবদ্ধ হয়ে চৌধুরী সাহেবের ঘরে আসতেন নিশিভোজের জন্য, এবং দুপুরের খাবার চৌধুরী সাহেবের ঘর থেকে পাঠানো হত তাদের গোপন আস্তানায়। সে কাজটা করতেন আমার বাবা ও বাবার বাড়িস্থ বাল্য বন্ধু, এই দুই কিশোর বালক প্রায় দুই/তিন মাইল পথ হেটে খাবার সরবারহ করতেন তাও আবার অতি গোপনে। বাবার আফসুস তিনি সে সময় যোদ্ধ করতে পারেননি।
আর সে সময়ে একজন মৌলানা রাজাকার হয়ে কাঁদে রাইফেল অবস্থায় রাস্তায় টহল দিতেন, তিনিই সালাম রাজাকার। মজার কথা হল যে এলাকায় রাজাকার ছিল সেখানে হত্যা,ধর্ষন,বসত-বাড়ীতে আগুন দেওয়া বিদ্যমান ছিলই, কিন্তু আমাদের গ্রামে এমন ঘটনার নজির নেই, অথচ রাজাকার বিদ্যমান ছিল। মুরব্বিদের ভাষ্য অনুসারে সালাম রাজাকার,রাজাকার হয়েছিল কেবলমাত্র এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের সাহায্য করা।
কোন দিন এলাকায়, কার ঘরে,কার উপর পাক বাহীনি হানা দিবে সেটা সালাম রাজাকার আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের এবং যার বাড়ীতে হানা দিবে তাদের জানিয়ে দিতেন এবং নিরাপদ দূরত্ব অবলম্বন করতে বলতেন। এভাবে একদিন চৌধুরীকে হত্যা করার উদ্দেশ্য পাক-হানাদার বাহীনি খবর দেয়া ছাড়াই হঠাৎ চলে আসে, এবং সালাম রাজাকার কৌশল অবলম্বন করে দূরের পথ দিয়ে তাদের চৌধুরী সাহেবের বাড়ীতে আনেন যাতে, তার কাছে খবরটা পৌছে যে তারা আসতেছে।
সে দিন ঠিকই খবর পৌছে ছিল যে পাক বাহিনি আসতেছে, চৌধুরী সাহেব ছিলেন তার পাশের বাড়ীর একজনের ঘরের ছালের মধ্যবর্তী অংশে লুকানো অবস্থায়, সালাম রাজাকার তা জানার পরও পাক বাহীনিদের ভুল রাস্তা দেখিয়ে বলেছিলেন চৌধুরী ঐ রাস্তা দিয়ে গেছেন আমি দেখেছি। সে দিন হয়ত সালাম রাজাকার না থাকলে চৌধুরী সাহেব গ্রামে সর্বপ্রথম স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াতে পারতেন না।
এরকম আরো নজির রেখেছেন তিনি, সময় সল্পতার কারণে লিখতে পারছি না। একদিন আমার গ্রামের মুক্তিযোদ্ধ নিয়ে কিছু লিখব ।
আর সে নিরব সাহায্যকারীকে একজন সাংবাদিক কিছু দিন আগে হুমকি দিল রাজাকার বলে ধরিয়ে দিবে তার নামে আর্টিকেল লিখবে ফাঁসিতে ঝুলাবে।
হুমকি দেয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে, তিনি ঐ সাংবাদিক স্থানীয় স্কুল কমিটির সভাপতি হওয়ার সুবাদে অসৎ পন্থায় টাকা আত্বসাদ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেন, অথচ যোগ্য শিক্ষক স্কুলে বিদ্যমান ছিল এবং ইন্টারভিউতে যিনি প্রথম হয়েছিলেন তাকেও চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
সেটার প্রতিবাদ করে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক সহ উক্ত সাংবাদিককে সাথে নিয়ে স্থানীয় এম,পি মহোদয়কে নালিশ করতে যাওয়ার পথে গাড়ীতে তার উপর চড়াও হয়ে হাত তুলেন গাড়ীভর্তি শিক্ষকের সামনে এবং হুমকি দেন।
আমার মনে হয় উনি তখন ভুল করেছিলেন, সবাইকে এভাবেই মরতে দেওয়া উচিত ছিল তার, ভাল করতে গিয়ে সমাজের কিছু মানুষ তাকে আজ রাজাকার বলে সম্মোধন করে, অথচ মুক্তিযোদ্ধের সময় মানুষগুলো ছিল অবুঝ শিশু যোদ্ধ বলতে বুঝত না কিছু। কি ধরকার এমন উপকার???।
কৌশলে দেশের সেবা করে যদি ফাঁসিতে ঝুলতে হয়???!! তাহলে বড়ই আক্ষেপ হয়।
সালাম রাজাকারের এই বাস্তব গল্পটার সাথে আমি বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের বাংলা সাহিত্যের কলিম-উদ্দীন দফাদার গল্পের সাদৃশ্য খুজে পায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০০