সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১৮)
বিচারবিভাগ: নির্বাহী বিভাগের কাজকে বৈধতা দানকারী প্রতিষ্ঠান
সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে বিচারবিভাগ সংক্রান্ত বিধানগুলি বর্ণনা করা হয়েছে। এই ভাগে মোট ৩টি পরিচ্ছেদ আছে; ১ম পরিচ্ছেদ সুপ্রীম কোর্ট, ২য় পরিচ্ছেদ অধস্তন আদালত এবং ৩য় পরিচ্ছেদ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল।
২২ ধারাতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে বলা হয়েছে যে "রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন৷" এইগুলি ছেলে ভুলানো সুবচন, কেন না, এই মূলনীতিগুলো রাষ্ট্র মানতে বাধ্য নয়। কারণ ৮ ধারাতে পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে " ... তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না৷"
বিচার বিভাগ সংক্রান্ত বিধানগুলি এমন কৌশলে প্রণয়ন করা হয়েছে যে সাধারণ ভাবে বুঝা যাবে না যে বিচার বিভাগ কার্যত নির্বাহী বিভাগ তথা প্রধানমন্ত্রী দ্বারা, প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছায় এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পরিচালিত হয়।
সংবিধানে বিচার বিভাগ বলতে সুপ্রীম কোর্ট, অধস্তন আদালত এবং প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালকে একত্রে বোঝানো হয়েছে। সংবিধানে "বিচারক" বলতে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদেরকে বুঝানো হয়েছে। আর অধস্তন আদালতের বিচারকদেরকে "বিচারবিভাগীয় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের সকল বিচারক নিয়োগ কার্যত প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বা পরামর্শ বা নির্দেশে হয়ে থাকে। যদিও সংবিধানের ৯৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, "প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।" সাধারণ ভাবে এই ধারাটি পড়লে মনে হবে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কোন ভূমিকা নাই। ৪৮ ধারার সাথে ৯৫ ধারা মিলিয়ে পড়লে দেখা যাবে "প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন:" তাই ৯৫ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি যদি কোন বিচারক নিয়োগ দিতে চান তাহলে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ বা নির্দেশ গ্রহণ করতে হবে। পেঁচালো কথাগুলি সহজ করলে অর্থ দাঁড়ায় প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ অনুসারে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আর প্রধান বিচারপতির নিয়োগের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণের কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার কারণে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাহী বিভাগের উপর তথা প্রধানমন্ত্রীর উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। তাই কার্যত প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ লাভ করেন।
সংবিধানের ১১৫ ধারায় অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, "বিচারবিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।" বিচারবিভাগীয় পদ বলতে অধস্তন আদালতের বিচারকদেরকে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ (নির্দেশ) ছাড়া কোন কাজ করতে পারেন না তাই কার্যত অধস্তন আদালতের বিচারকদেরকে নিয়োগ দিয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী।
১১৬ ধারায় বলা হয়েছে, "বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরি সহ) ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।" অর্থাৎ অধস্তন বিচারকদের পোস্টিং, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুবিধা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তো ৪৮ ধারার বিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোন কাজ করতে পারেন না, তাই অধস্তন বিচারকদের পোস্টিং, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুবিধা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি প্রদান করেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী অধস্তন বিচারকদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
সংবিধানে উল্লেখিত আরো দুইটি সুবচন উল্লেখ করা প্রয়োজন।
৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, "এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।" এবং ১১৬ক ধারায় বলা হয়েছে, "এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।"
এই দুইটি সুবচন হচ্ছে হাত পা বেঁধে সাঁতার দিতে বলার মত। নির্বাহী বিভাগ তথা প্রধানমন্ত্রী যখন একজন বিচারক নিয়োগ প্রদান করেন বা তার পোস্টিং, পদোন্নতি ইত্যাদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন তখন একজন বিচারকের পক্ষে ন্যায়বিচার করা বা স্বাধীন ভাবে বিচার করা সম্ভব না।
এখানে কি ভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় সেই ব্যাপারে একজন বিচারক চমৎকার ভাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কোন মামলার ব্যাপারে সরকার উৎসাহিত হলে রায় সরকারের পক্ষে যায়, দুই ব্যক্তির মধ্যে মামলা হলে যে পক্ষ বিত্তশালী রায় তার পক্ষে যায়, দুই পক্ষ বিত্তশালী হলে যে বেশি প্রভাবশালী তার পক্ষে যায়, দুই পক্ষ বিত্তহীন ও প্রভাবহীন হলে বিচারক স্বাধীন ভাবে ন্যায়বিচার করেন।
বিচারক নিয়োগ, পোস্টিং, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান করার ক্ষমতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যতদিন নির্বাহী বিভাগ তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকবে ততদিন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-২২