আমার বয়স তখন ছয় কি সাত, আমার আম্মুর ছোট বোনের বাসায় আমি আর আম্মু যাই। উনি আমার মালিহা আন্টি,
আমি আর আমার কাজিন ইশা খেলা করছি মজা করছি হৈ হুল্লোড় করে বাসা একেবারে মাথায় তুলে রেখেছি। ইশা আমার থেকে বছর তিন ছোট, তারপরেও ওর সাথে আমি সব সময় খেলা করতাম এই আন্টির বাসায় আসলে ।
আমি খেলার ছলে, আমার হাতের কনিষ্ঠ অঙ্গুলে থাকা একটা আংটি হুট করেই ইশাকে পরিয়ে দেই। আর সে খুশি হয়ে তার মাকে দেখালো. আন্টির খুশি দেখে কে!
আমার আমার আম্মুকে বললেন, "আপা মিস্টি আনেন আপনার ছেলের আর আমার মেয়ের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে। বাগদান কি কিছুই জানতাম না , তবে তাদের হাসি তামশা দেখে মনে হলো এখন আমার লজ্জা পাওয়া উচিত কিন্তু ইশা তো লজ্জা পাচ্ছে না আমি কেন লজ্জা পাবো! দেখলাম সে তার সেই আংটি সবাইকে দেখাচ্ছে। আর সবাই সেই হাসির বোলে অংশ গ্রহন করছে।
কোন রকমে সেই দিন কাটলো ,
এর পর অনেক দিন এবাবেই কেটে যাচ্ছে।
স্কুলে সে আমার থেকে পাচঁ বছরের জুনিয়র , বাবা -মায়ের একমাত্র সন্তান তো তাই একটু দেরি করেই তার
স্কুলে গমন। আমাদের পরিবারের অবস্থা ইশার পরিবার থেকে তুলনা মুলক ভাবে একটু নিচে , তারা থাকে নিজের বাড়ি আর আমরা থাকি নানার বাড়ি ।
তারপরেও ছোট বেলা থেকেই
মালিহা আন্টি আমাকে খুব পছন্দ করতেন ভালোবাসতেন। হয়তো তার কোন ছেলে ছিলো না বলেই একটু বেশি ভালোবাসতেন।
আমার এসএসসি পরিক্ষার রেজাল্ট হয়, ভালো রেজাল্টই করি । আর এর পর থেকে আন্টির আরো আদর যত্ন। খুব ভালো কাটছিলো দিন গুলো , তার সাথে হাসি -ঠাট্টা করে । প্রায় প্রতিদিন আন্টির বাসায় যেতাম,
আমি তখন কলেজে পড়ি সবে ফাস্ট ইয়ার শেষ করে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি।
এমনই একদিন আন্টির বাসায় গেলাম সরাসরি কলেজ থেকেই, আমার কলেজ থেকে মালিহা আন্টির বাসা খুব কাছেই ছিলো, ইশা এসে আমাকে ওর ঘরে আসতে বললো- আমি বললাম এখানেই বল।
ও বললো, 'আসো না,' একটা সারপ্রাইজ আছে.
আমি বললাম কি এখানে নিয়ে আয়,
-তুমি আসো না।
ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও গেলাম।
গিয়ে দেখি কিছুই না, মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
ও বললো ওই খানে বসো, আমি বসে পরলাম-
আমার হাতে ওর ডায়েরিটা দিয়ে বললো, পড়ো।'
আমি খুলতে গেলাম তখনই দেখি ভিতর থেকে কিছু চমকি কাগজ, কিছু ফুলের পাপড়ি আর কিছু রঙ্গিন কাগজ বের হয়ে আসলো।
আমি অবাক হয়েও ডায়েরিটা খুললাম, একটা পাতা নির্দিষ্ট করা ছিলো
সেখানে বিভিন্ন রং এর কলম দিয়ে লেখা লেখা- I love u...
আমি অবাক হয়ে ইশার দিকে তাকাই, দেখি ও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে
আমি জিজ্ঞেস করি , এই গুলো কি আমার জন্য?
ও মাথা নেড়ে হা সূচক ভংগি করলো।
আমি কিছুই বলছি না দেখে ও ওর ঘর থেকে বের হয়ে আসলো,
আমি আবার সব কিছু ঠিক আগের মত করে ডায়েরির ভেতর রেখে ওর টেবিল এর ডেস্কের ভিতরে রেখে আসলাম।
ওর ঘর থেকে বের হয়ে এসে দেখি ও টিভি দেখছে, আমাকে দেখে উঠে ওর ঘরে চলে যাচ্ছিলো আমি সামনে গিয়ে বললাম, "সব কিছু আগের মতোই রেখে এসেছি, বাসায় গিয়ে রাতে ফোন করবো।"
ওকে ভালো না বাসার কোন কারন ছিলো না, কিন্তু আমার চিন্তা আন্টি যদি আমাকে ভুল বুঝে?
আমি রাতে ফোন দিয়ে ওকে বললাম, যদি তোমার বাবা মা মেনে না নেয়?
ও বলল, আম্মু তোমাকে আগে থেকেই অনেক পছন্দ করে, আর বাবা কিছুই বলবে না।
আমিও খুব নরম সুরে বলে দিলাম, আমিও খুব ভালোবাসি।
এরপর থেকে প্রায় তার সাথে ঘুরতে বের হতাম , কোন দিন রাস্তায় বসে ফুচকা খেতাম কোন দিন আমি যা পারতাম তাকে তা কিনে দিতাম যদিও কোনদিন আমাকে কোন কিছুর দাম দিতে দিতো না। কিছু দিন পরেই আমার নানা মারা যায় কিন্তু
সে আমাকে এমন ভাবে স্বান্তনা
দিচ্ছিলো যেন ওর কিছুই হয় নি কিন্তু
আমার কিছু একটা হারিয়ে গেছে। সেই
দিনের পর থেকে মনে হচ্ছিলো ও
আমাকে খুব বেশি কেয়ার করছে , আর
ধিরে ধিরে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে
পরছিলাম ।
আমাকে খাবার কথা না বলে দিলে
আমি ভুলেই যেতাম এখনো খাই নি।
এইচএসসি পরিক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করলাম। আন্টি আঙ্কেল মিলে আমাকে একটা ল্যাপটপ গিফট করলেন।
আমার কি যে আনন্দ , সারাদিন
ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকি আমার
সামনে বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভর্তি
পরিক্ষা মালুম ভুলেই আছি।
ইশা আমাকে অনেক বার বলেছে সেই
কথা কিন্তু কার কথা কে শোনে , আমি
যেন উড়ছি।
ফলাফল যা হবার তাই হলো , কোন
বিশ্ব বিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পারলাম না।
জীবন থেকে একটি বছর কেটে গেল,কিন্তু তার ভালোবাসা এতটুকুও কমলো
না।
কোন বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না
পেরে আমি হয়ে গেলাম বেকার ,কোন
কাজ নেই সময় পেলেই তাকে নিয়ে
ঘুরতে যেতাম। কোন দিন বা স্কুল ফাকি দিয়ে আমার সাথে ঘুরতে যেত , অবশ্য সেই দিন ও তার স্কুল ব্যাগে করে বোরখা নিয়ে বের হত তাই স্কুল
ড্রেসে কোন সমস্যাই হতো না। কোন
দিন সন্ধ্যা হয়ে গেলে খুব করে
মিথ্যে কথা বলতো , যাতে করে আমাকে কেউ কিছু না বলতে পারে।
ও তখন ক্লাস নাইনে পড়তো , একদিন স্কুল ফাকি দিয়ে আমরা গেলাম সোনারগাঁ রাস্তার জ্যামের কারনে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়,
আর এর মধ্যে সব জায়গায় খোঁজ খবর
নেওয়া শেষ।সবথেকে কড়া খবর আন্টি
জেনে গিয়েছে ইশা আজকে স্কুলে
যায়নি। ইশা তখনো মোবাইল ব্যাবহার
করে না, আন্টি আমাকে ফোন দিয়ে
বললেন, আমাকে জানিয়েও যেতে
পারতি ". বলে ফোন রেখে দিলেন। আমি অবাক এটা কি হলো!
রাত নয়টার দিকে বাসায় পৌছালাম।
আন্টি কাউকে কিছুই বললেন না, যে
যার মত চলে গেলাম পরদিন সকালে আঙ্কেল আমাকে ডেকে পাঠালেন, এই ঘটনার কিছুই আমার মা জানে না।
আঙ্কেল আমাকে বললেন, "বাবা সব
কথাই তো পরিষ্কার এখানে লুকোচুরির
কি আছে , আর বোঝার বয়স তোমার
ভালোই হয়েছে । তুমি কোথাও ভর্তি
হতে পারোনি সমস্যা নেই কিন্তু
প্রায়ই ইশা স্কুল ফাকি দিয়ে তাকে
নিয়ে কোথাও চলে যাচ্ছো এতে করে
তার লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হচ্ছে ।
তুমিও লেখাপড়া কর আমার মেয়েকেও
লেখাপড়া করতে দাও। আঙ্কেলের কথা
শুনে আমি চলে আসলাম।
কিন্তু আমি যা কিছুই বলি ইশা কিছুই
বুঝতে চায় না তাকে নিয়ে ঘুরতে
যেতে হবেই , আমি তখন উভয় সংকটে ।
তারপরেও মনে হলো ওর মন রক্ষা
করাই আমার উচিত, আর তাই সবাইকে
ফাকি দিয়ে ঘোরাঘুরি বন্ধ হলো না।
দ্বিতীয় বার চেষ্টা করেও কোন বিশ্ব
বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলাম না ,
আর তাই জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের
অধীনে কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়ে গেলাম।
এক বছর যায় দুই বছর যায় , আমার আর লেখাপড়া শেষ হয় না ।
ইশা এসএসসি পরিক্ষা শেষে খুব
ভালো একটা কলেজে ভর্তি হলো।
কলেজ শেষে ইশা, বেসরকারি
হসপিটালে ডক্টর হওয়ার জন্য
লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছে কিন্তু
আমার লেখাপড়া শেষ হওয়ার নাম
নেই।
পড়া লেখা শেষ হবার পরে , চাকরির
বাজারে আমি কোথাও কোন চাকরি
নেই। এক বছর যায় দুই বছর যায়,
কিন্তু চাকরি হয় না।
আন্টির একটাই কথা আগে চাকরি
তারপরে বিয়ে , আমিও তাই চাচ্ছি।
কিন্তু চাকরি কোথায় পাই! এই দিকে
ওর ডাক্টারি পড়া শেষ। সেখানেই
ডাঃ হিসেবে জয়েন করেছে। আর আমি
বেকার, এমন অবস্থায়ও পরতে হয় ওর
কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাকে চলতে
হয়।
ইশা একবার ভেবেছিলো পালিয়ে বিয়ে
করে ফেলি , কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম
না। আমি চাচ্ছিলাম তাকে বীরের মত
নিয়ে আসবো।
কিন্তু আমার কোন কিছু করার নেই
কারন কোন চাকরি নেই, এর মাঝে শুনতে পেলাম তার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়েছে।
আর এই দিকে আমি বেকার কিছু বলতেও পারছি না। কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ধরে ইশার কি কান্না, বলে বোঝাতে পারবো না।
আমার বাবা আর মাকে আন্টি বুঝিয়ে
বললেন, যে তিনি আমার মাকে কিছু টাকা দিবেন আমাকে ভালো কোন দেশে পাঠাতে যাতে করে আমি বিদেশ থেকে টাকা আয় করে আসতে পারি।
কিন্তু আমার মনে হলো ইশার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্যই আমাকে দেশের বাহিরে পাঠানো হচ্ছে। আমি কোন ভাবেই যাবো না, ইশা আমাকে বুঝিয়ে বললো আমার উপর ভরসা রেখো!
আমি ওর হাত ধরে বললাম, তুমিই তো আমার সব।
আমিও সব কিছু মেনে চলে যাচ্ছি দেশের বাহিরে ,
আর যাওয়ার সময় ইশাকে বুঝিয়ে
বললাম মাত্র দুই বছর এর মধ্যেই
তোমার যোগ্য স্বামী হয়ে ফিরে আসবো।
দেশের বাহিরে গেলেও, জানি রেখে
যাচ্ছি আমার আস্থার অপর নাম
ইশাকে । আমি জানি আমি ফিরে আসা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবে।
দুই বছর পর!
দেশে ফিরে যাচ্ছি, আমি জানি আমার
জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে ইশা।
কখন ওর কাছে যাবো- তাকে বাহু ডোরে
জড়িয়ে ধরবো , সেই অপেক্ষায় প্রহর
গুনছি।
তার জন্য কত কিছু নিয়ে এসেছি , কোন দিন তাকে কিছু কিনে দিতে পারি নি সেই সব সময় দিয়েছে আমাকে।
তার সবথেকে প্রিয় কিছু।
এর মাঝে আমাদের অনেক কথা হয়েছে,
আমাকে অনেক ছবি পাঠিয়েছে, ও
দেখতে এখন আগের থেকে অনেক সুন্দরী হয়েছে ।
বাড়ি পৌঁছে বাবা -মার সাথে দেখা
করেই গেলাম তার সাথে দেখা করতে
কিন্তু বাসায় কেউ নেই , আমার একটু
খটকা লাগলো বেপার কি! ওরা
সবাইতো জানে আমি আসবো তাহলে কেউ বাসায় নেই কেন?
আম্মু বললো সে কিছুই জানে না।
রাতে, আন্টি আমাদের বাসায় আসলেন,
এসে বললেন তার দূর সম্পর্কের কে যেন মারা গিয়েছে সেখানেই
গিয়েছিলেন।
আমি বললাম ইশা কোথায়! ওকে আনলেন না?
আন্টির কোন কথা নেই।
পরদিন সকালে আমার মাকে জিজ্ঞেস
করলাম, কি হয়েছে তারা এমন
লুকোচুরি করছে কেন?
মা আমাকে বললেন , "কি যেন হয়েছে
ইশা একদিন সকালে উঠে বলে সে
নাকি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না,
এরপর হসপিটালে ভর্তি ছিলো কিছু
দিন, চশমা দিয়ে ভালোই চলতে
পারছিলো এর আরো কিছু দিন পর চশমা দিয়েও কিছু দেখে পাচ্ছে না , ডাঃ বলেছে , গ্লুকোমা এর কারনে সে আর দেখতে পাবে না। "
আমার চোখ দিয়ে পানি পরছে ,
-আমি মাকে বললাম ও কোথায়?
-আছে হয়তো তাদের বাসাতেই।
কাউকে কিছু না বলে চলে গেলাম
তাদের বাসায়, আন্টি দরজা খুলে দিলেন ।
আন্টিকে ইশারায় চুপ করিয়ে চলে
গেলাম ইশার রুমে , দেখি পূবের
জানলা খুলে জানলায় মাথা ঠেকিয়ে
দাড়িয়ে আছে।
আমি তার পেছনে গিয়ে দাড়ালাম,
কাধেঁ হাত রাখতেই ও চমকে উঠলো
,কে!
কাধেঁ রাখা হাতের উপর হাত দিয়ে
বললো , তুমি!
আমি বললাম, হ্যাঁ আমি ,
ভাবতে অবাক লাগছে ,তুমি আমার দুই
চোখের উপর এতটুকু বিস্বাস করতে পারছো না !
তুমি কি মনে করো না, আমি তোমাকে
সঠিক পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবো?
কিছু ক্ষন নিশ্চুপ থাকার পর ফুপিয়ে
কেদে উঠলো , আমি জানি এ কান্না
কিসের আমার বুকে তার মাথা রাখলাম, বুক ভেসে যাচ্ছে তার চোখের জ্বলে
তাতে কি! আমি জানি এই জলে দুঃখ নয় আনন্দ ঝরে পরছে।