বৃষ্টির ফোটাগুলো ঝাপটা মেরে শরীরে পড়তেই অস্বাভাবিক ভাবে শরীরটা শিউরে ওঠে। শরীরের সাথে সাথে মনটাও উৎফুল্ল হয়ে যায়। মনে হয় দু’হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকা যেত। আহা কতই না ভাল লাগতো! অফিসের বদ্ধ চার দেয়াল আর স্বল্প সময়ের সংসারী মন আর এমনটা চায় না, চাওয়ার সাহসও দেখায় না। কার না ভাল লাগে ছোট খোকা-খুকীদের মত করে বৃষ্টিতে গোল্লাছুট খেলতে। কে না ভালবাসে বৃষ্টির ফোটাগুলোর ভীড়ে হারিয়ে যেতে। চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? চাইলেই কি শিশু হয়ে যাওয়া যায়? আজ মনটা খুব বেশি খেয়ালী হয়ে উঠছে। অফিসের ইউনির্ফম আর ব্যাগের জরুরী কাগজ-পত্রগুলো ভিজিয়ে ফেলে মনটাকেও ভেজাতে ইচ্ছে করছে।
ঠিক পাঁচটায় অফিস থেকে বেড়িয়েই বিপদে পড়ে গেল মাহবুব। অফিসের গেট থেকে বের হয়েই দেখলো আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টির ফোটায় জুতার ডগাটা ভিজে গেল। ইশ্ গতকালই মাত্র জুতাটা কালি করিয়েছে ও। কিন্তু জুতা ভিজে যাওয়ায় খুব যে কষ্ট পেল তা নয়। মন বলছে ভিজুক না জুতা আজ, ভিজুক সারা শরীর, সারা মন। ধুয়ে মুছে যাক না সব কষ্ট আর কষ্টে ভরা কিছু অতীত। ইশিতা এখন কি করছে? নিশ্চই তিতলী মেয়েটাকে নিয়ে খেলছে। আর আজো অফিস থেকে দেরি করে ফেরার কারনে কি কি বলে বকা ঝকা করবে তার লিস্ট তৈরী করে রাখছে। দেরি যত বেশি হবে বকা খাওয়ার পরিমান চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়েই চলবে। তিন বছর হলো ওদের বিয়ে হয়েছে। প্রথম বছর ঘুরতেই ওদের ঘর আলোকিত করে তিতলী জন্মায়। বাবা-মার রোমান্টিক মন দুটোকে আরো বেশি সুখ এনে দেয় তিতলী। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করা, কারো বাবা-মা এর অবস্থা কারো থেকে কম নয়। তারপরও কোন পক্ষই রাজী হয় নি ওদেও সম্পর্কে। প্রথমে ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে দু’জনেই চাকরি খুজতে শুরু করেছিল। খুব বেশি ভাল চাকরি মাহবুব না পেলেও দু’জনের সংসার সচ্ছল ভাবেই কেটে যায়। তার উপর যে সংসারে ইশিতার মত বউ আছে সে সংসারে কষ্ট কিসের? খুব লক্ষী মেয়েটা। ইশিতাকে খুব বেশি ভালবেসেছিল মাহবুব, এখনও বাসে। বিয়ের তিন বছর পার হয়ে গেলেও ওদেও ভালবাসা এক বিন্দুও কমে নি, বরং বেড়েছে। আর তিতলীটা এত সুন্দও হয়েছে, ঠিক মায়ের মত। দেখলেই কাছে টেনে আদর করার ইচ্ছাটাকে সামলানো যায় না। তিতলীও বাবা ছাড়া কিছু বুঝে না। তাই যতক্ষন মাহবুব বাসায় থাকে ততক্ষন তিতলীও বাবার চোখের সামনে থেকে নড়ে না। দেখতে মায়ের মত হলে কি হবে, যদি বলা যায় কে বেশি ভালবাসে মা না বাবা? সুন্দর করে হাত তুলে বাবাকে দেখিয়ে দেয়। মাহবুবের খুব ভাল লাগে তখন। মা যখন খুব রাগ করে তিতলীর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়, তিতলী আস্তে আস্তে মায়ের কাছে গিয়ে থুতনিতে হাত দিয়ে কপালে চুমু খায়। আনন্দে বুক ফেটে কান্না চলে আসে ইশিতার। সুখগুলো এত সুখের কেন হয়? আনন্দে এত আনন্দ কেন? বিত্তশালী পরিবারে মানুষ হয়েও এখনকার কষ্টগুলোকে একদম ভুলে যায় ওরা। আকাশ সমান ভালবাসা, দুই বছরের তিতলীর আদর আর অভীমান মাখা আনন্দ আর এক টুকরো সংসার নিয়ে ভালই আছে ওরা।
আজ ভেজা শরীরে বাসায় গিয়ে উঠলে কি হবে? নিশ্চই ইশিতা খুব রাগ করবে। বলবে যদি জ্বর এসে যায় কি হবে তাহলে? আমি সারাদিন মেয়েকে সামলিয়ে কুল পাই না, মেয়ের বাবাকে দেখবো কখন? বলুক না আজ কটা কথা, তবুও ভিজতে ইচ্ছে করছে আজ। মাহবুব জানে জ্বর তার আসবে না। যাদের কেউ নেই তাদের আল্লাহ্ আছেন। পৃথিবীর আপনজন, সবচেয়ে কাছর মানুষ মা-বাবাই ওকে আর ভালবাসে না। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কিভাবে? বড়লোকদের মনটা আনেক শক্ত, সেখানে তুলতুলে ভালবাসার বদলে ঠাই নেয় শক্ত আত্ম-সন্মান। এসব ভেবে ভেবে দুঃখ বাড়িয়ে লাভ কি? সবচেয়ে ভাল হত ইশিতাকে নিয়ে বাসার ছাদে গিয়ে ভিজতে পারলে। একটু কি ফোন করে বলবে ইশিতাকে? নাহ্ কিন্তু ততক্ষনে বৃষ্টি যদি থেমে যায়! তাহলেতো আর ভেজাই হবে না মাহবুবের। তাছাড়া ছাদে উঠতে হলে বাড়ীওয়ালার বারান্দা হয়ে যেতে হবে। স্বামী-স্ত্রীকে একসাথে ভিজতে দেখলে কি ভাববে মহিলা? ইশিতা হয়ত যেতে রাজিই হবে না। একবার মনে আছে ইশিতার কলেজের সামনে রোজকার মত মাহবুব দাড়িয়ে ছিল ক্লাস ফাঁকি দিয়ে। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। পাশের দোকানে পর্যন্ত উঠবার সুযোগ পেল না। ততক্ষনে কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। মাহবুবকে এইভাবে কাক-ভেজা হতে দেখে দোতলার বারান্দা থেকে খুব হেসেছিল ইশিতা আর বান্ধবীদের সাথে কি যেন ফিসফিস করে বলছিল। সবাই হেসে গড়াগড়ি খাবার অবস্থা। ইশিতা বুঝেছিল মাহবুব খুব লজ্জা পাচ্ছে। মাহবুবের লজ্জাকে ভাগাভাগি করে নিতে সিড়ি বেয়ে নেমে এসেছিল ভিজতে ভিজতে। তারপর দু’জনে অনেক্ষন ঘুরেছিল। এর আগে কলেজের ইউনিফরমে এতসময় কোনদিনই থাকে নি মাহবুবের সাথে। মাহবুব জানে বন্ধুদের সামনে লজ্জিত হতে দেখে ইশিতার ভাল লাগে নি। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে শাস্তি দিচ্ছিল আর কাঁদছিল মেয়েটা। মাহবুব শুধু চুপচাপ তাকিয়ে ছিল ইশিতার লজ্জামাখা সুন্দর মুখটার দিকে। মেয়েটা এমনই, ভুল করে ফেললে নিজে নিজে শাস্তি পায় কাউকে কিছু বলেও না। সেই যে ওরা একসাথে ভিজেছিল বৃষ্টিতে, এরপর আর ভেজা হয় নি। মাহবুব অনেকবার চেষ্টা করেছে কোন লাভ হয় নি। একটা না একটা সমস্যা লেগেই থাকে। আজও হবে না। বোধহয় বয়সটাও আর নেই। আচ্ছা জীবনটা যদি একটা সিনেমা হতো! ইচ্ছামত চরিত্র আর ঘটনাগুলো পরিবর্তন করা যেত। এসব ভাবতে ভাবতে বৃষ্টিটাই বোধহয় থেমে যাবে, আর ভেজাই হবে না হয়ত। এক লাফে রাস্তায় নেমে পড়ে মাহবুব।