somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারিব না এ কথাটি বলিও না আর-৩(শেষ পর্ব)

০৯ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

দিন কেটে যায় বিষন্ন ভাবে। সকালে স কাজে চলে যায়। ঘরে আমার অঢেল সময়। সে সময় কিভাবে কাটাব? বাজারঘাট, শপিং মল অনেক দূরে। দু-চারটি বাঙালী পরিবারের সাথে পরিচয় হয়েছে, কিন্তু তারাও থাকে দূরে দূরে। ইচ্ছে হলেই যে কোথাও যাব, সে উপায় নেই। ঘরেই থাকি। রান্নাবান্না করার চেষ্টা করি। রান্না যে পারি তাও না। কোনোমতে সেদ্ধ পোড়া হয়ে যায়। সাথে সিদ্দিকা কবীরের 'রান্না খাদ্য পুষ্টি' বইটা আছে। খুব একটা কাজে লাগেনা। রান্নার উপকরণ জোগাড় করতে করতেই আমি শেষ, রাঁধব কখন ? আজকে বুঝি, আসলে রেসিপি পড়ে রান্না করার মানুষ আমি না। সদ্য পরিচিত ভাবী-বউদিরা, যাদের ফোন করলে বিল উঠবেনা, তারা প্রায়ই আমার কল পায়, ভাবী, ঘরে এই এই আছে, কি রাঁধা যায়? কিংবা ইমার্জেন্সী কল, বউদি, বাঁধাকপিতে লবন বেশী পড়ে গেছে, কিভাবে সামলাবো? উপদেশ আসে, টম্যাটো আছে? টম্যাটো কেটে দিয়ে দাও, গরম মশল্লা দিওনা। এসব কি রান্নার বই পড়ে শেখা যায়? স-বাবু ওসব কম লবনের বা বেশি লবনের খাবার অম্লান বদনে খেয়ে যায়, সেও রান্না পারেনা কিনা! শুধু মাঝে মাঝে বলে, ডালটা কেমন যেন হয়েছে, কি যেন দাওনি। আমি তাড়াতাড়ি মুখে দিয়ে বুঝি, 'কি যেন' হচ্ছে লবন। আমি বেমালুম ভুলে গেছি লবন দিতে। সাধে কি আনমনা নিক চাইছিলাম? তাও তো আনমনে আনমোনা হয়ে গেলাম।

মাঝে মাঝে দেশে ফোন করি, আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে। তখন মুঠোফোন সবে বাংলাদেশের বাজারে এসেছে, মধ্যবিত্তের নাগালের অনেক বাইরে। টি-আ্যন্ড-টি র ফোন আছে কোনো প্রতিবেশীর, আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মা বাবা তাদের বাড়ি আসে, আমি হয়তো ঘন্টা-খানেকের চেষ্টায় লাইন পাই। অল্প কথা বলেই রেখে দিতে হয় ঊর্ধ্বমুখী বিলের চিন্তা মাথায় রেখে। ফোনে শুধু আপনজনের গলার স্বর শোনার সান্ত্বনা পাই। মনের কথা হয় চিঠিতে। ছেলেমানুষী কথায় ভরা লম্বা চিঠি লিখি। ফিরতি চিঠি আসে সবার বিস্তারিত খবর নিয়ে। সাথে থাকে ছোট সহজ রান্নার রেসিপি, রান্নাঘরের টুকটাক টোটকা। সে চিঠি পড়ব কি, খাম খুলতে খুলতেই চোখের জলে সব ঝাপসা হয়ে আসে।

বাজার করতে ভারত বাজারে যাই। সপ্তাহের মাঝে গেলে পাওয়া যায় আধ শুকনো পচা তরকারী। তাই শনিবার করেই যাই। তখন ভারত বাজারে যেন মেলা বসে। উপমহাদেশীয় চেহারার লোকজনের ভিড় ঠেলে হাটা দায়। কোথায় পাব লাউ, উচ্ছে, মরিচ, এই সব দেশীয় সবজি? পাশেই কে-মার্ট। তরকারীর ডেলিভারী ট্রাক আসতে দেরী হলে কে-মার্টের ট্রাফিক বেড়ে যায়। যেই ট্রাক আসে অমনি ভিড় চলে যায় ভারত বাজারে। দেখা যায় লেবারদের সাথে হাত মিলিয়ে বাক্স নামিয়ে পছন্দের তরকারী খুঁজে নিচ্ছে ক্রেতারা। আমরা হাসি, ভারত বাজারের লেবার খরচ কমে যাচ্ছে বলে।

এসবের মধ্যেও আমাকে কুরে কুরে খেতে থাকে বাহন সমস্যা। ভিসা স্ট্যাটাসের দরুন এখন কাজ করতে পারবনা, কিন্তু পড়াশুনা করে নিজেকে তৈরী রাখতে পারব। তার আগে এ সমস্যার সমাধান করা দরকার। দৈনন্দিন সব কাজেই আমাকে স-এর মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। মাঝে মাঝে আমার কোনো দরকারে স কে কাজের দিনে ছুটি নিতে হয়। বেশ বুঝতে পারি গিন্নীর বাহন হওয়াটা আমার বর মোটেও উপভোগ করছেনা। তার গোমড়া মুখ থেকে ঝগড়া বেধে যায়। যার রেশ চলে উইক-এন্ডেও। কি করব? আমি যে কিছুতেই আর স্টিয়ারিংএ বসার সাহস করতে পারছিনা। কিছুদিন তো বসিইনি। পরে বসলেও প্রচন্ড ভয় করতো। গাড়ি চালানো শেখা প্রায় বন্ধ। প্র্যাকটিসের সময় আগে যা শিখেছিলাম, তাও ভুল করি। আরেক দফা ঝগড়া বাধে। প্র‌াকটিস বন্ধ করে বাসায় চলে আসি।

দেখতে দেখতে শীত চলে আসে। স্থানীয় কম্যুনিটি কলেজের ইএসএল(English as Second Language) ক্লাশে ভর্তি হই। প্রতিদিন দুই ঘন্টা ক্লাস। যাতায়াত দুই দুগুনে চার ঘন্টা। বাড়ি থেকে আধাঘন্টা হেটে বাসস্টপ। সেখানে পনেরো মিনিট পরপর বাস আসে, ভালোই। সেখান থেকে মিনিট পঁচিশেক বাস রাইড শেষে আরেক বাস। সেটা সারা শহর ঘুরিয়ে পনেরো মিনিটের রাস্তা সোয়া ঘন্টা নিয়ে কলেজে পৌঁছাই। এই বাস আবার একঘন্টা পরপর। মানে প্রথম বাসে দেরী করলে আরো একঘন্টা দেরী।

নিজের পরে খুব বিরক্ত বোধ করি। ঠিক করি, অন্য পক্ষ যতই রাগারাগি করুক, আমি কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো নীতি অবলম্বন করে চলবো। আমারই তো দায়। ততদিনে ভয়টা একটু ভেঙ্গেছে, ভুল করাটা কমেনি। এদিকে লার্নারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। পুরোদমে আবার প্র্যাকটিস শুরু হয়। কিছুটা হাত আসতে আসতেই দেখি আর একমাসও বাকি নেই লার্নার শেষ হবার। দুর ছাই করে রোড-টেষ্ট দিয়েই ফেললাম। এবং সগৌরবে ফেল করে লার্নারের মেয়াদও পার করে দিলাম।

এর পর সংসারে এলো নতুন মানুষ, আমার বড় ছেলে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তাকে নিয়ে। ছেলের মাস দুই বয়স হলে আবার গেলাম লার্নিং পারমিট আনতে। এবার টায়ে টায়ে না, শ'য়ে শ পেয়েই পাশ করলাম। পরের প্রশ্ন, শেখাবে কে? ছেলেকে নিয়ে তো যেতে পারিনা। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একজন প্রফেশনাল ইন্সট্রাকটর পেলাম যে উইকএন্ডে শেখাবে। বাপ-ছেলের বন্ড তৈরীর সুযোগ দিয়ে আমি শিখতে যেতাম।

কয়েকটি লেসনের পরে ইন্সট্রাকটর জানালো রোড-টেষ্ট দিতে পারি। ততদিনে আমি খুঁজে চলেছি রবার্ট ব্রুসদের। অনেকেই একবারে পাশ করেছে। দুইদাগী বা তিনদাগীর সংখ্যাই বেশী। তবু আমি হতাশ হই। না, এরা আমার সমব্যথী হতে পারবেনা। নিদেনপক্ষে রবার্ট ব্রুস না হলে কি চলে? সুকুমারের গঙ্গারাম হলে আরো ভালো, ঊনিশ বার চেষ্টা করতে পারব। তাই চললাম ঊনিশবারের দ্বিতীয়বার দাগাতে। এবার সগৌরবে না হলেও টেনেটুনে অকৃতকার্য হলাম। আমার যা মন খারাপ তার চেয়ে বেশী মন খারাপ ইন্সট্রাকটরের। সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা তার ছাত্রী ফেল করেছে। আর কি করা। দুসপ্তাহ পরে আরেকটা ডেট নিয়ে ফের প্র্যাকটিসে মন দিলাম।

তৃতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার সময় সেই আগের বারের ফেল করানো এক্সামিনার এলো। আমার কাগজ দেখে সে বললো যে আমি চাইলে তাকে রিফিউজ করে অন্য এক্সামিনার চাইতে পারি। আমি তাকেই টেষ্ট নিতে বললাম। সে তো আমাকে ফেল করায়নি, আমিই ভুল করে ফেল করেছি। এবার আর ভুল হলোনা। পাশ করার পর DMV থেকে কাগজ নিয়ে ইন্সট্রাকটর আমাকে বাসায় নামিয়ে চলে গেলো।

ছেলের বাপ তখন অনেক নাকানি-চুবানি খেয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে উঠেছে। একটু নেচে থাম্বস-আপ করে তাকে খবর দিলাম। একই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাঁচকলা দেখালাম। হু, এখন আর আমার সাথে ঝগড়া করতে পারবেনা। তারপর বললাম, আজকে আর আমার রান্না ওসব আলুনি বা নুনে ভরে খাবার খাবনা। বাইরে খেয়ে আসব। সে একটু কিন্তু কিন্তু করে বললো, 'ছেলে এখন সবে ঘুমিয়েছে, তুমি যাও, খাবার কিনে আনো'।

এ্যা! আমি যাবো খাবার কিনতে, একা একা গাড়ি চালিয়ে? পাশে কেউ থাকবেনা, ভয়েই মরে যাব। মুখ ঝামটা দিয়ে বলতে গেলাম, 'পারবোনা'। সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলাম।

পারিব এ কথাটি বলি বার বার।

--সমাপ্ত



***************************
কিছু বানানের সমস্যা আছে। আপনাদের চোখে পড়লে জানাবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ২:১০
১৯টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×