ছবি - বিবিসি
২য় পর্বের পর -
আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প ছিলেন অনেকটা মাথা মোটা যে কিনা দুনিয়ায় প্রচলিত ভদ্রলোকের চুক্তি ( Gentleman Agreement) তথা কুটনীতির ধার ধারতেন না। তার নিকট যা ভাল মনে হত তাই করে ফেলতেন অবলীলায় । তার অনেক কাজই সুপার পাওয়ার আমেরিকার সাথে মানানসই হতনা এবং তার আগে যারা আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ছিলেন তাদের করা অনেক কাজকেই তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং তিনি আমেরিকার অনেক পুরনো ও বিশ্বস্ত বন্ধুদেরকে ত্যাগ করে একলা চলার নীতি পালন করতে গিয়ে আমেরিকাকে বিশ্বমঞ্চে প্রায় একা করে ফেলেছিলেন। নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হন বাইডেন যিনি কিনা ট্রাম্পের তুলনায় অনেকটা ঠাণ্ডা মাথার এবং সূক্ষ্ম ও কূটবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হিসাবে বিবেচিত। তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েই আমেরিকাকে আগের জায়গায় নেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেন।বাইডেন আবারো বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার নেতাগিরির স্বপ্ন দেখেন এবং আমেরিকাকে গ্লোবাল নেতৃত্বে নেয়ার জন্য মনোনিবেশ করেন। আর এর জন্য বাইডেনের মতো প্রেসিডেন্ট আমেরিকার সক্ষমতা হিসেবে যেসব টুলস বা হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করেন তা হলো -
১। অবরোধ আরোপ (মানে অপছন্দ বা শত্রু বিবেচিত দেশকে আমেরিকান ডলারে বৈদেশিক বাণিজ্য করতে না দেওয়া)।
২। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা (যে কাউকে ঘায়েলের পশ্চিমা পুরনো তরিকা)।
ছবি - cnn.com
বাইডেন ভাবেন যে, এই দুই হাতিয়ার ব্যবহার করেই বিনা অস্ত্রে ও সামরিক তৎপরতা ছাড়াই তিনি চীন ও রাশিয়াকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করতে পারবেন আর আমেরিকার নেতৃত্ব ফের অটুট করতে-রাখতে পারবেন বিশ্বমঞ্চে । আর তাই একই রকম উদ্দেশ্যেই বাইডেন ইউরোপীয়ান ইউনিয়নকে সাথে নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে যুদ্ধে এনেছিলেন। তার জন্য বাইডেন ক্ষমতার শপথ নেয়ার পরেই যখন তিনি এ দুই (অবরোধ ও মানবাধিকার) মহা অস্ত্রের কথা ইইউ নেতাদের জানান তারাও তাতে অন্ধ বিশ্বাস করেছিলেন। তাদের মনের মাঝে চিন্তা সম্ভবত এরকম ছিল যে, আমেরিকার হাবিলদার হয়ে যদি আরো কিছু দিন দুনিয়ায় সর্দারীর ভাগ পাওয়া যায় তা হলে আর চীনের পেছনে পেছনে লাইন ধরে ব্যবসা বদল করে বাঁচতে চাওয়ার দরকার কী ? অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিনা যুদ্ধে ও বিনা অস্ত্র ব্যবহারে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়ার উপরে অবরোধ আর মানবাধিকার এ দুই অস্ত্র ব্যবহার করে বিজয় লাভের ভাবনায় তারা (আমেরিকা ও ইউরোপ) এক সাথে কাজে নেমে পড়ে। আর এ কাজে বলির পাঠা হিসাবে বেছে নেওয়া হয় ইউক্রেনকে, যে কিনা পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরে ১৪ রাষ্ট্রের একটি যাকে এখনো ন্যাটোর সদস্যই করা হয়নি। গত ২০১৪ সাল থেকে ইইউ, আমেরিকাসহ ন্যাটো ইউক্রেনকে প্রলুব্ধ (তার সামনে মূলো ঝুলায়) করে তাকে ন্যাটোর সদস্য করে নেয়া হবে বলে - আর তাই ন্যাটোর সদস্যপদ ইউক্রেনের কাছে এক সোনার হরিণ করে গড়ে তোলা হয়েছিল এবং ইউক্রেনের রুপালী পর্দার হিরো প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সেই মূলো লাভের আশায় তার অতীতকে ভূলে এক অদৃশ্য সোনার হরিণের পিছনে ছুটে চলা শুরু করেন এবং খায়েশ করেন বর্তমান রাশিয়ান আধিপত্য থেকে বাইরে থাকার ।
ইউক্রেনের সামনে আমেরিকা-ইউরোপের মুলো ঝুলানো ও জেলেনস্কির হিরোগিরী ও অতিলোভ -
আমেরিকা-ইউরোপ সবসময়ই তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কখনো কখনো কাউকে বলির পাঠা বানিয়ে তাদের কাংখিত স্বার্থ হাসিল করেন। আমেরিকা-ইউরোপ সর্বশেষ বলির পাঠা হিসাবে বেছে নেয় ইউক্রেনকে যে কিনা আগে থেকেই তাদের ফাদে পা দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল। তার সামনে ঝুলানো হয় ন্যাটোর সদস্য করার মুলো আর এই মুলো (ন্যাটোর সদস্যপদ) ইউক্রেনের কাছে এক সোনার হরিণ হিসাবে প্রচার করা হয়েছিল। এদিকে ইউক্রেনের রুপালী পর্দার হিরো প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সেই মূলো যে কোন মূল্যে পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠেন। তার এই খায়েশের কারনে ও লোভে পড়ে জেলেনস্কি ভূলে যান ইউক্রেনের ৪০০ বছরের পুরনো ইতিহাস। অর্থাৎ, এই যে ইউক্রেন ১৬৬৭ সাল থেকে রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল এবং ১৯১৭ সাল থেকে তা সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনস্থতায় কাটিয়েছিল। এতসব বাস্তবতা ভূলে জেলেনস্কি যে চেষ্টা করেছিলেন তাতে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা একদমই মাথায় রাখেননি বা আমেরিকা-ইউরোপের ভরসায় এটা ভূলে গিয়েছিলেন যে, রাশিয়ান আধিপত্য থেকে বাইরে থাকার খায়েশ তাকে না আবার পরাধীনতার শিকলে বন্দী করে ফেলে। কাজেই এখন যে পরিস্থিতি তাতে অপমান ও বিড়ম্বনা দিয়ে যদি ব্যাপারটা শেষ হতো সেটিও ভালো হত ইউক্রেনের জন্য তবে এর চেয়ে আরো খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে ইউক্রেনের সামনে এটা নিশ্চিত।
কারন, এই যুদ্ধ প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে এক কঠিন বাস্তবতার সামনে পৌঁছে দিয়েছে এবং তিনি বোকা হয়ে গেছেন, হয়েছেন প্রতারিত। ন্যাটোর সদস্যপদ এক সোনার হরিণ ছিল - এই লোভ দেখিয়ে তাকে প্রতারণা করে বিপথে নেয়া হয়েছে এবং তার ও ন্যাটোর লোভের বলি হয়েছে ইউক্রেনের জনগণ ।
যার ফলে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেনে হামলা শুরু করে ইউক্রেন সহ সবাইকে পর্যুদস্ত করা শুরু করেছেন। জেলেনস্কি অবাক হয়ে দেখেন তার পাশে কেউ নেই, কেউ আসেনি যারা তাকে আশা দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিয়েছিল। না ন্যাটো, না ইইউর কোন দেশ, না আমেরিকা। তিনি এই ক্ষোভ ও অপমান না লুকিয়ে যুদ্ধ শুরুর পরের দিন সকাল থেকে অভিযোগ করতে থাকেন যে, "কেউ তার পাশে আসেনি, সবাই তাকে ভালুকের সামনে একা রেখে কেটে পড়েছেন আর তারা একাই লড়ছেন ভালুকের (রাশিয়ার) বিরুদ্ধে। ন্যাটো- আমেরিকার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ মারাত্মক।
ছবি - cbs58.com
জেলেনস্কির অভিযোগের পরদিনই বাইডেনের মুখপাত্র জেন সাকি পরিষ্কার করে বলে দেন যে,"আমেরিকা ইউক্রেনের পক্ষে কোনো যুদ্ধেই যাবে না,সেটা রাশিয়ার সাথে সরাসরি কোনো যুদ্ধে তো নয়ই, এমনকি ইউক্রেনের মাটিতেও আমেরিকা কোনো যুদ্ধে যাবে না"।
আমেরিকা-ইউরোপ কেউ সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবেনা এটা তারা সবাই জানত তবে তা ইউক্রেনকে জানানো হয়নি। কারণ - বাইডেনের পরিকল্পনা ছিল, রাশিয়ার সাথে তিনি লড়বেন বিনা-অস্ত্রে ও বিনাযুদ্ধে এবং তা কেবল অবরোধ ও মানবাধিকার এ দুই হাতিয়ার দিয়ে। কিন্তু এসবের চেয়েও সবচেয়ে অনৈতিক কথাটা হলো, এ দিকটা জেলেনস্কিকে কখনো জানানো হয়নি বা পশ্চিমের কেউ-ই জানাতেই চায়নি। শুধু তা-ই না, তাকে ন্যাটোর সদস্যপদের লোভ দেখিয়ে যুদ্ধে টেনে আনা হয়েছে। সরাসরি বললে, এটা শ্রেফ একটা প্রতারণা যা করা হয়েছে জেলেনস্কির সাথে । আর জেলেনস্কি ভূত-ভবিষ্যত না ভেবে তাদের প্রতারণার ফাদে পা দিয়েছেন লোভের বশে।
আর এ কাজ করে জেলেনস্কি তার ভাগ্যকে বেঁধে ফেলেছেন রাশিয়া এবং ইউক্রেনীয় জনগণের হাতে । কারণ জেলেনস্কিও তো তার ইউক্রেনীয় নাগরিকদের ভুল ও মিথ্যা বুঝিয়েছেন, যুদ্ধে টেনে নিয়ে গেছেন। দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটি তার অযোগ্যতা । তিনি বুঝতেও পারেননি যে , আমেরিকা-ইউরোপ যুদ্ধে তাদের পাশে আসবেই না, যা তারা বলেছিল। আসলে এসবই ছিল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি অর্থাৎ জনগণকে প্রতারণার মুখে ফেলে দেয়া। এটিই জেলেনস্কির সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং এটা তার অযোগ্যতাও যে তিনি বুঝতেই পারেননি, পশ্চিমারা প্রতারক।
আমেরিকা- ইউরোপ যে শুধু সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি এমন ও নয়। এমনকি তারা জেলেনস্কির কোন চাওয়াকেই আমলে নিচছেন না যেমন নেয়নি রাশিয়ার (ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য না করা ) চাওয়াকে। আর তাই জেলেনস্কির চাওয়া ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ওপর দিয়ে রাশিয়ার জন্য চলাচলে নো ফ্লাই জোন ঘোষণা না দেয়া কিংবা যুদ্ধ বিমান দিয়ে সাহায্য করার। তাই জেলেনস্কি এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, " ন্যাটোর প্রশ্নে আমি নিজেকে ঠাণ্ডা করে নিয়েছি বেশ আগেই। যখন আমি বুঝে গেছি, ন্যাটো ইউক্রেনকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়"। এটিই আসলে পরিষ্কার করে বলা যে, মিথ্যা আশ্বাসে পশ্চিম (আমেরিকা ও ইইউ) ইউক্রেনের সাথে প্রতারণা করেছে। এ কারণে নিজেই নিজের আকাংক্ষাকে দমন করতে হয়েছে, মেরে ফেলতে হয়েছে যদিও এখন এভাবে বলার কারণে ইউক্রেনবাসী কাকে মাফ করবেন, কাকে ছুড়ে ফেলবেন আমরা কেউ জানি না।
জেলেনস্কি আরো বলেন,"ন্যাটো জোট রাশিয়ার সাথে সঙ্ঘাতে যেতে বা বিতর্কে জড়াতে ভয় পায়, ভীত। আর আমিও অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষা করে পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাওয়ার বিনিময়ে কিছু আনব, এমন প্রেসিডেন্ট হতে চাই না"। জেলেনস্কির এসব করার পিছনের কারন দেশবসাীর সামনে নিজ ইজ্জত বাঁচানোর চেষ্টা। তবে তার এসব চেষ্টা বৃথা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী কারণ,তাহলে ইউক্রেনের জনগণকে ন্যাটোর কাছে নিয়ে গিয়েছিল কে? কিসের ভরসায়? কে দিয়েছিল সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি - এসব প্রশ্নে জেলেনস্কি লা-জবাব থাকতে পারবেন না এবং ভবিষ্যতে এসবের জবাব তার দেশের জনগণকে তাকে দিতেই হবে ।
যুদ্ধে জেলেনস্কি হারবেন এটা নিশ্চিত । আবার রাশিয়া বার বার বলছে ইউক্রেন দখলের কোন ইচছা রাশিয়ার নেই। রাশিয়া শুধু কিছু জিনিষের নিশ্চয়তা চাচছে ইউক্রেন থেকে । যখনই ইউক্রেন তার শর্ত মানবে তখন থেকেই পুতিন যুদ্ধ বন্ধ করে দিবেন। আর তাইতো ক্রেমলিনের মুখপাত্র বলেছেন,"ইউক্রেনকে দেয়া শর্ত পূরণ হলেই মুহূর্তের মধ্যে রাশিয়া থেমে যাবে"।
রাশিয়া যুদ্ধ থামানোর জন্য ৩ টি শর্তের কথা বলেছেন যেগুলো আগেও রাশিয়া-ফ্রান্স আলোচনায় পুতিন স্পষ্ট করে বলেছিলেন।পুতিনের শর্ত তিনটা হলো-
১। ইউক্রেন নিরেপেক্ষ হয়ে যাবে । এ জন্য তার কনস্টিটিউশন সংশোধন করে এ কথাগুলো সেখানে ঢুকাবে। অন্য ভাষায় রাশিয়ার নিরাপত্তাবোধে অভাব সৃষ্টি করবে না, ন্যাটোর সদস্য হতেও আর চেষ্টা করবে না।
২। রাশিয়া ইউক্রেনকে অসামরিকীকরণের কাজ শেষ করবে।
৩। বিচ্ছিন্ন দুই প্রদেশ যার বাসিন্দারা এথনিক রাশিয়ান, সে দুই আবাসভূমিকে স্বাধীন দেশ বলে ইউক্রেন মানবে এবং ক্রাইমিয়ার বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়াকেও মেনে নেবে।
জেলেনস্কি রয়টার্সের সংগে সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলছেন, "তিনি রাশিয়ার আলোচনায় আপস করতে প্রস্তুত এবং রাশিয়া প্রভাবিত ইউক্রেনের দুই প্রদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতেও তিনি প্রস্তুত"। কিন্তু এখানে যে প্রশ্ন , " এত সহজে কেন জেলেনস্কির এই উদারতা"? উত্তর আসলে খুব সোজা। কারণ,পুতিনও আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, জেলেনস্কিকে ক্ষমতাচ্যুত করা বা কোনো রেজিম চেঞ্জ রাশিয়ার আক্রমণের লক্ষ্য নয়। কেবল ওই তিন দফাই তার যুদ্ধ বন্ধের মূল শর্ত। তাই জেলেনস্কি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন এমন আশার কথা শোনার পরেই জেলেনস্কি জান হাতে ফিরে পেয়ে রাশিয়ার সাথে আপসে রাজি হয়েছেন। আর তাই, এখন ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যে আলোচনা চলছে তাকে অনেকটা যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা বলা চলে।ভবিষ্যতে রাশিয়া-ইউক্রেন কী কী ব্যাপারে আপস করবে এসবই রাশিয়া-ইউক্রেন উভয়ে বসে ফাইনাল খুঁটিনাটি চুক্তিপত্র ঠিক করে নেবে আলোচনার মাধ্যমে। অতএব আশা করা যায় যুদ্ধ থামার পথে।
তাহলে কি রাশিয়ার উপর আরোপিত বাইডেনের অবরোধ এখন উঠে যাবে?
রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তি হলে কি রাশিয়ার উপর আরোপিত বাইডেনের অবরোধ এখন উঠে যাবে ? এক কথায়, তা মনে হয় না । ইউক্রেন রাশিয়ার সাথে কোনো চুক্তি করে রাশিয়ার ভিতর চলে যাবে বা রাশিয়ার কর্তৃত্ব মেনে নিবে কিনা সেদিকে বাইডেনের কোনো আগ্রহ নেই। বাইডেন চেয়েছিলেন রাশিয়ার ওপর অবরোধ জারি করতে , তাই তিনি সেখানেই মনোযোগ দিতে চান। কিন্তু অন্তত এখানে কি বাইডেনের আশা পূরণ হবে যেমনটা আমেরিকা করেছেন ইরান,সিরিয়া,আফগানিস্তান, লিবিয়ায় ? রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাইডেনের এই চাওয়ার সাথে কি তার ইউরোপীয় সাগরেদরা একমত হবেন যেমনটা হয়েছিলেন বাকী সবার ক্ষেত্রে?
রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাইডেনের এ চাওয়ার সাথে মনে হয় ইউরোপ একমত নাও হতে পারে। ইইউর প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক হিসাবে ধরা হয় ফ্রান্স ও জার্মানিকে। এরই মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ান তেল ও গ্যাস ছাড়া তারা চলতে পারবে না। জার্মান ডয়েচে ভেলের বরাতে ঢাকার এক বাংলা পত্রিকা রিপোর্টের শিরোনাম," রাশিয়ার তেল-গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা চায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অসম্মতি"। রাশিয়ান তেল-গ্যাসে এমনিতেই জার্মানির নির্ভরশীলতা প্রায় ৪৫ ভাগ। অন্য সবাইও কমবেশি নির্ভরশীল। এ দিকে ডাচ ও ফরাসি সরকারপ্রধানরাও যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, রাশিয়ার জ্বালানি ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য তা আনসাসটেইনেবল যার মানে টেকা অসম্ভব। সোজা ভাষায়, রাশিয়ান জ্বালানি ইস্যুতে আমেরিকা-ইইউ আলাদা আলাদা রাস্তা ধরে ফেলেছে এরই মধ্যে । অর্থাৎ পুতিনের হুমকিটাই যেন কার্যকর যে, তিনি বলেছিলেন, আমাদের তেল না নিলে " এক ব্যারেল তিন শ ডলারে কিনতে প্রস্তুত হও"।
ছবি - dailyindia.net
বাইডেন আসলে কি চেয়েছেন বা কি আশা করেছিলেন ?
বাইডেন আশায় ছিলেন এবং ধরে নিয়েছিলেন যে, রাশিয়া যদি তেল-গ্যাস বেচতে না পারে এবং তার ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ আটকে গেলে রাশিয়ার কিছুই করার থাকবে না, সব স্তব্ধ হয়ে যাবে। অথচ আমেরিকার মত দেশের একজন প্রেসিডেন্ট এসব মনগড়া অনুমানে কি করে চলতে পারেন? বাইডেনের অনুমান অবশ্য কিছুটা সত্য, এতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু তিনি শুধু ঘটনার একটি দিক নিয়ে ভেবেছেন অন্য দিকের খবর তিনি নেননি বা ভাবেন নি । দুনিয়ার সব বেচা-বিক্রি মানেই যে একপক্ষীয় এমন নয়। কারণ যেটা বেঁচা সেটিই আরেক দিক থেকে কেনা। এখানে দুটি পক্ষই জড়িত থাকে । কাজেই রাশিয়া বেঁচতে না পারলে যেমন রাশিয়ার বিপদ, তেমনি বিপদ জ্বালানি ক্রেতারও। বাইডেন এ দিকটা ভেবে দেখতেই চাননি। যার ফলে বাস্তবতা হলো, ক্রেতা ইইউর সব সদস্যের জন্যই এটি বিক্রেতা রাশিয়ার মতোই সমান সঙ্কটের। যদি ইউরোপ রাশিয়ান তেল-গ্যাস না কিনে কাতার বা অন্য কোথাও থেকে কিনতে চায় তা হলে সেই বিকল্প জ্বালানি যদি পাওয়াও যায় তবু সেটি তাদের জন্য বিপদেরই হবে। কারণ তার জন্য অবকাঠামো কোথায়?
কাতার বা ভেনিজুয়েলা থেকে গ্যাস-তেলের জন্য এখন নতুন করে বিকল্প পাইপলাইন বসাতেও তো কয়েক বছর লাগবে। এ সময় কিভাবে চলবে ইউরোপ বা আমেরিকা ? এসব প্রশ্নের জবাব মনে হয়না বাইডেন কিংবা ইউরোপের নেতাদের কাছে আছে। এ ছাড়া কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগের খরচ তোলার ব্যাপার আছে। যে তেলের দাম এত দিন আশি ডলারে ছিল সারা বিশ্বে, কয়েক দিনের যুদ্ধে এরই মাঝে এটি চলে গেছে ১১২ ডলারে । অনুমানে আরো বলা হয়, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা ১৫০ ডলার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। বাইডেনের চাওয়া পূরণ করতে চাইলে তেলের দাম পুরনো ৮০ ডলারে ফিরে যাওয়া দূরে থাক এটি মনে হয় সত্যি সত্যিই ৩০০ ডলারের দিকে যাত্রা শুরু করবে যা বলেছেন পুতিন। করোনার ধাক্কা সামলাতে যেখানে সারা দুনিয়া মন্দা আর মুদ্রাস্ফীতির কবলে, সেখানে এই নতুন তেলের দামের বোঝা কয়টা দেশ সামলাতে পারবে? বাছ-বিচারহীন ভাবে বাইডেনের এমন অবরোধের পদক্ষেপের বলি কি শুধু রাশিয়া হবে না সারা পৃথিবী?
কে নিবে বা নিতে চাইবে বাইডেনের অপরিণামদর্শী কাজের বিষময় ফলের দায় কিংবা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির হিরোগিরী ও অতি লোভের দায় ?
কি পেল ইউক্রেন তার অপরিণামদর্শী প্রেসিডেন্টের কাজের ফলে ?
কে হারল বা হারাচ্ছে সব কিছু - রাশিয়া ? ইউক্রেন ?
এ যুদ্ধের পরে বিশ্বে কে শক্তিশালী নেতা হিসাবে আর্বিভূত হবেন ?
- বাইডেন ?
- জেলেনস্কি ?
- পুতিন ?
কিংবা ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ?
এসব প্রশ্নের জবাব হয়ত ভবিষ্যতে মিলবে তবে তার জন্য মূল্য দিয়ে জানতে হবে সারা দুনিয়াবাসীকে। কারন, এ দুনিয়ায় কোন কিছুই বিনামূল্যে মিলেনা। তা সে সম্পদ কিংবা প্রশ্নের জবাব যাই হোক না কেন।
তথ্যসূত্র - আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স, ডয়চে ভেলে।
=====================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
"রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধ" - (২য় পর্ব) Click This Link
"রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধ" - (১ ম পর্ব) Click This Link
এবং
" ইউক্রেন সংকট " - (শেষ পর্ব) - Click This Link
" ইউক্রেন সংকট " - ২ য় পর্বের লিংক - Click This Link
" ইউক্রেন সংকট " - ১ ম পর্বের লিংক - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০২২ দুপুর ২:৫৩