ছবি - unsplash.com
দ্বিতীয় পর্বের লিংক - Click This Link
দ্বিতীয় পর্বের পর -
ডলারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি বা রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলার একচেটিয়া রাজত্ব করছে সারা বিশ্বে। জ্বালানি তেলের লেনদেনে ডলার ব্যবহারের মাধ্যমে সেই একচেটিয়াত্ব সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওঠে, আর তাই বহুকাল ডলার আর নিশ্চয়তা সমার্থক ছিল। এসবই বিভিন্ন দেশকে ডলারে রিজার্ভ রাখতে উৎসাহ জুগিয়েছে। ডলারের এই অর্থনৈতিক আভিজাত্যের রাজনৈতিক ফল ভোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির শাসকেরা বহুবার এ সুবিধাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে ভিন্নমতালম্বী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে। এসব আক্রমণে বিভিন্ন সময় তারা সহযোগী করে নিয়েছিল পাউন্ড ও ইউরো'কে।
সামরিক,আর্থিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে বিশ্বের প্রধান বা এক নাম্বার অবস্থানে রয়েছে। আবার, কিন্তু নিক্সন-শক কার্যকর হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠল বিশ্বের প্রধান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি এবং এই পরাশক্তির প্রভাবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার মতো সারা বিশ্বে তখন অন্য কোনো দেশ ছিল না এবং এখনো নেই। স্বভাবতই বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের এই একাধিপত্যকে মার্কিন সরকার নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করেছে। আর তাই, মার্কিন ডলারের মানের পতন ঘটলেও সারা বিশ্বে তাদের আধিপত্য কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো অভিযোগ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন সময়ে ইরান, চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র মূলত ডলার রক্ষার স্বার্থেই। যেমন - ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার একটি দিক হচ্ছে, ইরান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে পারে না। যেখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সিংহভাগ ডলারের মাধ্যমে ঘটে থাকে, সেখানে মার্কিন ডলার ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত হওয়াকে অত্যন্ত কঠিন করে দিয়েছে। একইভাবে, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোর ওপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, এবং এর ফলে এই রাষ্ট্রগুলো মার্কিন ডলারের একাধিপত্যের তীব্র বিরোধী।এর ফলে এসব দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করা অনেক কঠিন হয়েছে। আমরিকার রোষানলে পড়ে ইরাক, লিবিয়ার মতো অর্থনীতিতে সমৃদ্ধিশালী দেশও ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধুই ডলার না থাকায় বিশ্বের বহু দেশকে দেউলিয়াত্ব বরণ করতে হয়েছে। সদ্য দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কা, লেবানন তার অন্যতম উদাহরণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার অনেক কারণের কথা বলা হলেও মূল যে কারন বিদ্যমান তা হলো রাশিয়ার ডলার থেকে বের হয়ে আসার প্রচেষ্টা ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী পক্ষকে দমন ও রাজনৈতিক কারণে ডলারকে ক্রমাগত মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে অনেক দেশ এখন ত্যক্তবিরক্ত। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া পর্যন্ত সবার ডলার-রিজার্ভ ইচ্ছেমতো আটকে দিচ্ছে, তাতে মধ্যপন্থী দেশগুলোর ভেতরও ভয় ঢুকেছে। গ্লাজিয়েভের ভাষায়, "ডলার এখন এক বিষাক্ত মুদ্রার নাম"। এ রকম ভীতিকে কাজে লাগিয়েই ডলার আধিপত্যের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে চায় চীন - রাশিয়া সহ আরো অনেক দেশ ।
ছবি - global.chinadaily.com.cn
ডলারের বিকল্প কেন জরুরী -
ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রিজার্ভ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেনের যোগাযোগব্যবস্থা সুইফট (SWIFT ) থেকে রাশিয়ার অনেক ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।এ মুহূর্তে প্রায় সম্পূর্ণরূপে রাশিয়া ডলারভিত্তিক আন্তর্জাতিক লেনদেনব্যবস্থা থেকেও বাইরে। এর আগে গত কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক এক বাণিজ্যযুদ্ধ চালিয়েছে । এ বিষয়ে আমার একটি লেখা (" ট্রাম্প - চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এবং চায়না ডি-কাপলিং প্রক্রিয়া" - কার লাভ কার ক্ষতি? নির্বাচনে ট্রাম্পের হার - এ সমস্যার গতিপ্রকৃতি কি হবে বা নতুন কিছু ঘটার সম্ভাবনা আছে কি ?) লিংক - Click This Link
সার্গেই গ্লাজিয়েভ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ রকম অর্থনৈতিক মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে এখনই দাঁড়ানো দরকার রাশিয়া, চীনসহ অন্যদের। এটাকে ‘শেষ বিশ্বযুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করে বইও লিখেছেন তিনি ২০১৬ সালে।
SWIFT বা সুইফট কি - (The Society for Worldwide Interbank Financial Telecommunication বা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকম্যুনিকেশন হলো ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাসেলস ভিত্তিক আন্তঃব্যাংক আর্থিক লেনদেনের বার্তা প্রেরণের একটি সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক। নিরাপদ ও দ্রুত অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে সুইফট একটি বার্তা নেটওয়ার্ক পদ্ধতি যা মূলত সংকেত লিপি বা নির্ধারিত কোডের মাধ্যমে বার্তা আদান প্রদান এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। এক্ষেত্রে লেনদেনের তারবার্তা (ওয়ার) এই কোডের মাধ্যমে আদান-প্রদান করা হয়। বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের ১১ হাজারের অধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুইফটের মাধ্যমে আন্তঃ ব্যাংকিং লেনদেনের বার্তা প্রেরণ তথা লেনদেন সম্পাদন করে থাকে। বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুইফটের সদস্য। এজন্য অর্থ লেনদেনের সুবিধায় প্রত্যেক সদস্যকে ৮ বা ১১ কোডের একটি গোপন পিনও সরবারাহ করা হয়।
ছবি - cfr.org
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পাল্টা হিসেবে রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের একটা বড় প্রকল্প হলো ইউরেশিয়া ইউনিয়ন। বর্তমানে এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন সার্গেই গ্লাজিয়েভ। ইউরেশিয়া ও চীনকে কাছাকাছি এনে এই পণ্ডিত দল বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারবিরোধী নতুন অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। পুতিনের এই পরামর্শকদের পরিকল্পনা হলো ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কিভাবে ইউক্রেন যুদ্ধটা আরও বড় পরিসরে করা যায়। তাঁরা মনে করছেন, ঔপনিবেশিক মুরব্বি হিসেবে ব্রিটিশদের আধিপত্য খর্ব হওয়ার সময় গত শতাব্দির মাঝামাঝি বিশ্ব যেভাবে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছিল, সে রকম আরেক মুহূর্ত এসেছে এখন। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কমবে এবং তা কমানোর সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। কেবল সার্গেই গ্লাজিয়েভ বা পুতিন নয়, চীন-ভারতও নতুন সেই চিন্তায় শামিল হতে আগ্রহী। তবে এখানে যে বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে তা হলো, এ ব্যাপারটা এতটা সহজ হবেনা এবং ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে গিয়ে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার গাদ্দাফি জীবন ও রাজ্য হারিয়ে তার মূল্য দিয়েছেন।
এক কথায়, সারা বিশ্ব শোষিত হচ্ছে আমেরিকান ডলারে। ফলে ডলারের বিকল্প খুঁজছে সারা বিশ্ব যা কখনো ইউরো, কখনো রুবল কিংবা কখনোবা ইউয়ানে । আবার কেউ কেউ বলছেন ক্রিপ্টোকারেন্সি হতে পারে ডলারের বিকল্প কিন্তু এখানে মূল যে বিষয়টা হলো, সেখানে ওয়াশিংটনের জায়গায় বিশ্বে তখন আধিপত্য করবে বেইজিং, মস্কো ও নয়াদিল্লি। সুতরাং কেবল ডলার উচ্ছেদ করে বিকল্প কোনো মুদ্রার আধিপত্য সৃষ্টি না করে এমন মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে যেন প্রতিটি স্বাধীন দেশ স্বাধীনভাবে তার অর্থনীতি ও মুদ্রানীতি পরিচালনা করতে পারে,শোষিত না হয়।
কোটি টাকার প্রশ্ন হলো - সেই অর্থ ব্যবস্থাটি কী --------
---------------------------
জবাবদিহীতা - এই লিখা লিখতে নিম্নে বর্ণিত তথ্যসূত্র ছাড়াও আরও অনেক জায়গা থেকে ছোট-খাট সাহায্য নিতে হয়েছে যা আমি এখানে উল্লেখ করিনি। তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
পূর্ববতী পোস্ট -
১। প্রথম পর্বের লিংক - Click This Link
==========================================================
তথ্যসূত্র -
১। উইকিপিডিয়া - SWIFT - https://bn.wikipedia.org/wiki/
২। Money - https://www.britannica.com/topic/money
৩। নিউ ইয়র্ক টাইমস - Click This Link
৪। যেভাবে মার্কিন ডলার বিশ্বজুড়ে আধিপত্য স্থাপন করেছিল - Click This Link
৫। Encyclopaedia Britannica - লিংক - https://www.britannica.com/topic/fiat-money
৬। দানা বাঁধছে ডলার বিরোধী মহাযুদ্ধ - প্রথম আলো (২০/০৯/২০২২) - https://www.prothomalo.com/world/europ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:৫২