somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি: নয়নের জন্য জোছনা-বিষয়ক দু-লাইনের কবিতা

০২ রা এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৮:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করলে আমার ভীষন খারাপ লাগে। মাঝারিদের পরীক্ষার রেজাল্ট যা হয় হোক; কিন্তু, প্রকৃত মেধাবীরা কোনও কারণে রেজাল্ট খারাপ করে যখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে - আমি তখন মর্মাহত হই।
সেরকম ঘটনাই একবার ঘটেছিল। যার ফলে জোছনা-বিষয়ক দু-লাইনের অদ্ভুত এক কবিতার জন্ম হয়েছিল। আজ অনেকদিন পর সে কথা মনে পড়ল ...

১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি। এম এ পাস করে ঘরে বসে আছি। খানিকটা অসুস্থ। মাস কয়েক আগে টাইফয়েড হয়ে গেছে। শরীর দূর্বল। হাঁটতে অসুবিধে হয়। সারাদিন শুয়ে বসে থাকি আমার বিবর্ণ ঘরে। মগ ভরতি করে হরলিকস খাই। সিগারেট খাই; তেতো লাগে। বই পড়ি। সুনীলের ‘একা এবং কয়েকজন’। কিংবা, সেলিনা হোসেনের ‘ক্ষরণ’। কবিতাও পড়তাম। যেমন, আবুল হাসান। “সে এক পাথর আছে/কেবলি লাবণ্য ঝরে।” ইত্যাদি।
তো, বাবু নামে আমাদের পাড়ায় একটি ছেলে থাকত। ফরসা মতন, হাসিখুসি একটা ছেলে-সেবার এইচ এস সি পাশ করে মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়েছে। বয়েসে বাবু আমার অনেক ছোট হলেও আমাদের মনের মিল ছিল। তার কারণ, বাবু হাওয়াইন গিটার বাজাত-আমি স্পেনিশ। সেই সূত্রেই আমার ঘরে মাঝেমাঝে আসত ও। দু-জনে মিলে মিউজিক থিওরি নিয়ে আলাপ করতাম।
একদিন। বাবু এল। ওর সঙ্গে শ্যামলা মতন কোঁকড়া চুলের চশমা পরা একটি ছেলে। আমার চোখে কৌতূহল। বাবু বলল, ইমন ভাই, এ হইল নয়ন। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়ছি।
ও। বস, নয়ন।
ওরা বসল। নয়নকে কেমন অস্থির মনে হল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। পরনের শার্টটা ময়লা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কোনও কারণে অস্থির হয়ে আছে নয়ন? আমার ঘরটা শান্তির জায়গা। বই, গিটার, সনি ডেক সেট। বাবু কি ওর বন্ধুকে আমার এখানে সেকারণেই নিয়ে এসেছে? ভাবতে চেষ্টা করলাম। অ্যাফেরারসংক্রান্ত কোনও সমস্যা? এই বয়েসে সে রকম হতেই পারে।
বাবু বলল, ইমন ভাই, নয়নে গিটার শিখতে চায়। ওরে একটু তালিম দেন।
আচ্ছা দেব। আমি যা পারি ওকে শেখাব। আমি হেসে বললাম।
এই ঘটনার পর থেকে নয়ন প্রায়ই আমার কাছে আসতে লাগল। তখনও গিটার কেনেনি। আমার গিভসনটা দিয়েই কর্ড ধরার চেষ্টা করত। ই মাইনর -সি-বি-সেভেন-ই মাইনর। কখনও এ-মাইনর। জেমস তখন ভীষন হিট। ‘চেয়ে দেখো, উঠেছে নতুন সূর্য ...’ইত্যাদি।
আস্তে আস্তে নয়নের বিমর্ষতার কারণ জানলাম। এইচ এস সি পরীক্ষায় ওর রেজাল্ট ভালো হলেও ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পায়নি। ভালো করে পড়তে পারেনি।
কী হয়েছিল? আমি খানিকটা বিমূঢ়।
কী আর হবে-ফ্যামিলি প্রোবলেম। ওর গলার ভয়েস কেমন ফ্যাফ্যাসে।
আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ও টের পেল না।মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ আমার ভীষন খারাপ লাগে। মাঝারিদের পরীক্ষার রেজাল্ট যা হয় হোক; কিন্তু, প্রকৃত মেধাবীরা কোনও কারণে রেজাল্ট খারাপ করে যখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে - আমি তখন মর্মাহত হই। আমি বললাম, মন শক্ত কর। পরের বার ভালো করে দাও।
নয়ন কাঁধ ঝাঁকাল। ভঙ্গিটায় অস্থিরতা প্রকট। আমি ছেলেটাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। দারুন মেধাবী। রসিক। ছোট ছোট মন্তব্যে চমকে উঠতে হয়। কন্যা রাশি। সেপ্টেম্বর ৭।
বাবু মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেছে। নয়নের অন্য সব বন্ধুরাও এখানে-ওখানে টিকে গেছে। ওদের এক বন্ধু, মামুন, শ্যামলীতে থাকে-আমেরিকা চলে গেল। নয়ন একেবারেই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। অ্যাপ্লাইড ক্যামিষ্ট্রিতে পড়ার ইচ্ছে ছিল; হল না। বন্ধুদের এড়িয়ে চলছে। ওদিকে ওর ফ্যামিলি প্রবলেম বাড়ছিল। ওর মা-বাবা ... নীলক্ষেত যেত নয়ন। পুটুলি কিনে ভরত সিগারেটে; ভরে টানত। তারপর ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটত। তারপর বিকেলের দিকে কিংবা সন্ধ্যার মুখে ক্লান্তবিধ্বস্ত হয়ে আমার কাছে আসত। আমি রান্নাঘর থেকে একপ্লেট ভাত- আর তরকারী যা থাকত, না থাকলে আম্মাকে বলতাম ডিম ভেজে দিতে- ভাত এনে বলতাম, আগে খেয়ে নাও। পরে সব কথা শুবব।
ও খেতে খেতে আমাকে সব বলত। ওর ফ্যামিলি। ওর মা-বাবা। আমি বলতাম, শক্ত হও, শক্ত হও। জীবন এখানেই শেষ না। অন্ধকার নিকষ রাতই সব না। জোছনার আলো বলেও একটা জিনিস আছে। একটা ঘটনা ঘটে গেলে তার কারণ তখনই বোঝা যায় না, বোঝা যায় অনেক পরে। তুমি তো জান-জীবন রহস্যময়। আর, নীলক্ষেতে না গেলেই কি না?
কথাটা এড়িয়ে নয়ন বলল, বাড়িতে পড়া যাচ্ছে না। এমন গোলমাল। পরের বার কি হবে কে জানে।
আমি খানিক ক্ষণ ভাবলাম। তারপর বললাম, দেখ, অন্য কোথাও থেকে পড়তে পার কি না। মামুন তো আমেরিকা চলে গেছে। দেখ, ওদের শ্যামলীর বাড়িতে থেকে পড়তে পার কি না। ওর মা-বাবা তোমাকে পছন্দ করেন।
নয়ন তাই করল। মামুনদের শ্যামলীর বাড়িতে থেকে পড়তে লাগল।
ঢাকা ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল।
এবারে নয়ন ভার্সিটিতে টিকে গেল।
সুসংবাদটা দিতে খালি হাতে আসেনি-২ কেজি মধুমিতার রসগোল্লা নিয়ে এল। ওর মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত। আমারও।
ক’দিন পর এসে খুশি খুশি কন্ঠে বলল, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি পেয়ে গেছি ইমন ভাই!
আমার মনে পড়ল ও প্রাণ রসায়নেই পড়তে চেয়েছিল। আমার মনের ভিতরে, মস্তিস্কের কোষে কোষে বিদুৎ খেলে গেল। শীর্ষেন্দুর মানবজমিন বইটি সদ্য কিনেছি। সেই বইটা টেনে নিয়ে সে বইয়ের প্রথম পাতায় বল পয়েন্টে লিখলাম-

জীবন মানে শুধুই যদি প্রাণরসায়ন
জোছনা রাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন?

তারপর বইটি নয়নকে উপহার দিলাম।
ও কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহন করল।
জানিনা বইটি আজও নয়নের কাছে আছে কি না।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:১১
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×