আমি তখন ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। গরমের শুরু, তখন বিদ্যুৎ আসেনি পাথরঘাটায়। সন্ধ্যে বেলায় অধিকাংশ ঘরের হেতনিতে ( বারান্দায়) জ্বলে উঠতো টেমি( কেরোসিনের কূপি) আর হেরিকেন। আমাদের পাড়াটা অন্যান্য পাড়ার চেয়ে একটু বেশি ঘণবসতিপূর্ণ ছিল। আমাদের বাড়ীর পাশে খয়রাত আলী (খাইরুল বাসার) ভাইয়ের কাঁচা মুদির টং। মাটির বাড়ীর বারান্দায় আলাদা করে দোকান খুদা। বাইরে বাশের উচু চাটাই দিয়ে বেন্চ করা। সন্ধ্যায় হেরিকেনের আলোয় ক’জন বসে গল্প করা যেত। ঐ টং এর সামনে একটা মাকাল ফলের বিরাট গাছ। একটু পাশেই বিশাল তেতুলের জমজমাট প্রাচীন বৃক্ষ। রাস্তার অপর পাশে রাজ্জাক দাদার একটা খোলা জমি। আমরা ওখানে খেলা করতাম। তো সেদিন সন্ধ্যায় আমার সাপে কাটলো। যদিও সাপটি আমি দেখতে পাইনি। কিন্তু দাগ এবং অন্যান্য লক্ষণ স্পষ্ট। বাড়ী ফিরে আমার পায়ের হাটুতে গামছা দিয়ে গিরে দেওয়া হলো, দুটো; আর ডাকা হলো কিনু কবিরাজকে।
আমাদের গ্রামের সাপে কাটা এবং অন্যান্য বিবিধ চিকিৎসার একমাত্র আধ্যাত্বিক সাধক আমিনুদ্দীন সরদার, সবাই যাকে কিনু কবিরাজ নামে একডাকে চেনে। উনি এসে প্রথমে হাত চালান দিলেন, তারপর নিমের পাতা দিয়ে ঝাড়ফুক করা হলো। বিষ উঠেছিল কোমর অব্দি। ঝাড়ানোর ফাকে তিনি আমাকে একটি গাছের ছাল বাটা খাওয়ালেন। মাঝরাত পর্যন্ত এই চিকিৎসা চললো এবং অতঃপর উনি চলে গেলেন।
কিনু কবিরাজ জ্বীন হাসিল করতেন। পাগলের চিকিৎসা করতেন। আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি একদিন বন্ধুরা মিলে উনার বাড়ী গিয়েছিলাম পাগল দেখতে। একজন পাগলকে শেকল দিয়ে উনার বাড়ীতে বাধা দেখলাম। তাকে পুকুরে গোছল করানো হলো, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সুস্থ করার চেষ্টা চলছে।
কিনু কবিরাজের যে চেহারাটা আমার স্মৃতিতে আছে তা হলো, বেশ দীর্ঘকায় সুস্বাস্থের অধিকারী একজন মধ্য বয়স্ক মানুষ, মুখে হালকা বসন্তের দাগ। গম্ভীর স্বরে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারিত করছেন। বিভিন্ন চুরির ঘটনায় তাকে বাটি চালান করতেও সম্ভবত আমি দেখেছি। আমাদের বাড়ীর পূর্বপাশের অর্জুন গাছের ছাল নিতে তিনি মাঝেমাঝে আসতেন।
যতদূর আমি শুনেছি উনার চাচা ছিলেন ময়জুদ্দীন কবিরাজ। তিনি অনেক নামী কবিরাজ ছিলেন। তিনি স্বপ্নে একটি ঔষধ পান এবং এই ঔষধ দিয়ে সবরকম চিকিৎসা করতেন। পরবর্তীতে কিনু কবিরাজ তার চাচার কাছ থেকে এই ঔষধ এবং অন্যান্য পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হন।
আমার ছোটবেলায় কিনু কবিরাজ সম্পর্কে আর একটি ঘটনা মনে পড়ে, উনার একটি মেয়ে ছিল, তখন অনেক ছোট। একদিন সন্ধ্যায় কেরোসিনের কূপি বা টেমির আগুনে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। মুখ এবং শরীরের একটা অংশ ঝলসে যায়। সে বড় মর্মান্তিক, বড় কষ্টের। খুব অস্পষ্ট মনে আছে গ্রামের লোক বলাবলি করতো, কিনু কবিরাজ জ্বীন হাসিল করতে সেদিন অন্য গ্রামে গিয়েছিলেন কিন্তু ভুলবশত তার বাড়ী মন্ত্র পড়ে বন্ধ করতে ভুলে যান আর তাই জ্বীনেরা এই প্রতিশোধ নিয়েছে।
কিনু কবিরাজ চাচার এখন অনেক বয়স হয়েছে। উনি সম্ভবত পায়ের অসুখে ভুগছেন। তার একমাত্র ছেলে শফি আমাদের কাছাকাছি বয়সের। একসময় কিনু কবিরাজ তার মেধা, দক্ষতা এবং শ্রম দিয়ে গ্রামের মানুষের জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছেন, আজ আমাদের উচিত উনার অন্তত খোজ খবর টুকু নেওয়া। আমি তার চিকিৎসা পদ্ধতি কিংবা তার কাজের ক্ষেত্র নিয়ে এখানে লিখতে বসিনি। আমি আমার শৈশবের সেই আলোচিত কিনু কবিরাজকে আজকের প্রজন্মের কাছে পরিচয় এবং বয়স্কদের স্মৃতিতে একটু উসকে দিতে এই লেখা লিখলাম। তবে আমার ইচ্ছে আছে ইনশাআল্লাহ উনার ডিটেলস একটা ইন্টারভিউ করার, যেখানে তিনি তার জীবনের বিভিন্ন লোমহর্ষক কাহিনী এবং অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য বর্ণনা করবেন! তাহলে কিন্তু মন্দ হবে না!
( পুনশ্চঃ আমি পরবর্তিতে যখন হুমায়ুন আহমদের বিভিন্ন আধিভৌতিক গল্প বা তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিক পড়ি তখন কিন্তু কিনু কবিরাজের মুখটি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল। আশা করি পাঠক আমার আবেগের জায়গাটা স্পর্শ করতে পেরেছেন।)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৫:২০