১ম , ২য় ও শেষ পর্বের পর
সেদিনের সেই অনাকাঙ্খিত প্রথম দেখা এবং তিক্ত বিদায়ের দশ বছর পর দেখা হলো। দেখা হবার পর সোয়েবের মনে হচ্ছে দেখা না হওয়াই ভালো ছিলো। সে যদি জানত, দেখা হবার পর মোহনার কাছে থেকে একটা অপ্রত্যাশিত সত্য শুনতে হবে, তাহলে কথাগুলো না শুনেই পালিয়ে যেতো বোধহয়।
এখন দু'জনের কেউ কোন কথা বলছে না। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ঝগড়া চলছিলো। সেই আগের মতোই। যেনো মাঝের হারিয়ে যাওয়া বছর দশেক দু'জনের উপর কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি।
দেখা হবার প্রথম ধাক্কায় সোয়েব চিনতে পারেনি মোহনাকে। পড়ন্ত বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ সোয়েবের ইচ্ছা হয়েছিলো ব্যস্ত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা পান করার।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অভ্যাস বসত রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। নির্দিষ্ট করে কিছু দেখছিলো না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার ব্যস্ততা দেখার এক ধরনের আনন্দ আছে। নিজেকে কিছু সময়ের জন্যে ব্যস্ত নগর জীবনের বাইরে মনে হয়। অন্য এক ধরনের প্রশান্তি আসে ।
এই ব্যস্ততার মাঝে একটা অফিস বাস এসে থামলো সোয়েবের দাড়ানোর জায়গা থেকে গজ দশেক দূরে। ৫/৬ জন নামলো গাড়ি থেকে। সবার শেষে নামলো এক নারী।
প্রথম দর্শনে যার চুলের দিকে নজর যায়। চোখে আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক। যাকে দেখলে মনে হয় এখনই বুঝি কোথায় হারিয়ে যাবে।
মোহনা। কোন সন্দেহ নেই, এই সেই সোয়েবের কল্পনার শিউলি।
শাড়ি পরে আছে। কালো রঙের শাড়ি। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে সৌন্দর্য্য কমেনি মোটেও। বরঞ্চ মনে হচ্ছে আরো পরিপূর্ন হয়েছে।
সোয়েবের মনে হচ্ছে, সে আবারো দশ বছর আগের সদ্য কৈশোর পেরনো সেই সময়ের মত আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছে। ডাক দেবে নাম ধরে? যদি না ফিরে তাকায়?
না তাকালে কি আর হবে? কিছু হতে কি আর বাকী আছে?
সর্ব শক্তি উজাড় করে মোহনার নাম ধরে ডাক দিলো সোয়েব,
-মোওওওওওহনাআআআআ
মোহনা ফিরে তাকালো ঠিকই। কিন্তু মনে হলো ভয় পেয়েছে। সেটা পাওয়া খুব অস্বাভাবিক মনে হলো না সোয়েবের কাছে। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যে লজ্জ্বা লাগলো তার। দ্রুত চায়ের দাম দিয়ে হাটতে শুরু করলো মোহনার দিকে।
মোহনা বোধহয় সোয়েবকে চিনতে পারলো না। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শব্দের উৎসের দিকে।
সোয়েব কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, "কেমন আছো?"
- "হ্যা ভালো", দায়সারা উত্তর দিলো মোহনা। আপনাকে চিনলাম না।
- "Social Girl এর মেমরি তাহলে আর আগের মত শার্প নেই এখন" কথাটা বলে সোয়েব আত্মতুষ্টির হাসি হাসলো।
- "সরি, কি বললেন?" মোহনা তখনো চিনতে পারেনি মনে হয়।
(মোহনার এই কথাতে সোয়েব একটু হতাশ হলো। সে আশা করেছিলো দশ বছর আগের সেই প্রথম দেখার মত আজকেও মোহনা তাকে প্রথম দর্শনে চিনবে)
- "আমি সোয়েব", হতাশ কন্ঠে উত্তর দিলো সোয়েব। পুরো নাম শাহরিয়ার.....
- "আজিম, আপনার পুরো নাম শাহরিয়ার আজিম সোয়েব।" বলে মোহনা মুচকি হাসলো।
- তোমাকে আজকে প্রথম হাসতে দেখলাম। ভাগ্যিস দশ বছর আগে হাসতে দেখিনি।
- কেনো? দেখলে কি হতো?
- হাহাহাহা। খুবই উত্তম প্রশ্ন করেছো। তুমি জানো না কি হতো?
- না। আপনি জানেন?
- জানি, পাগল হয়ে যেতাম আর কি।
- নিজেকে সুস্থ দাবী করা শিখেছেন তাহলে। আগে তো পাগল পরিচয় দিয়ে শান্তি পেতেন।
- সব ই তো মনে আছে তোমার।
- তাই? আচ্ছা, আপনি এখনো সেলসম্যান সেজে আছেন কেনো?
- "মানে?", প্রথমে সোয়েবের মনে হলো সে মোহনার প্রশ্ন বোঝেনি, প্রশ্নটা করার পর মোহনার হাসি কেনো বড় হলো তাও তার বুঝতে দেরী হলো। তারপরে হঠাৎ করে বুঝে ফেললো।
তার স্বপ্নবিলাসী মন তাকে নিয়ে গেলো অতীতে। ভুলে গেলো সে কোথায় আছে। মনে পড়লো, ছাত্র জীবনে সিদ্ধান্তহীনতার কথা। ক্রিকেটার হতে চেয়ে কত পাগলামী। তারপর মোড় গেলো ঘুরে। না হলো খেলোয়াড় হওয়া, না পড়ালেখাটা ঠিকভাবে করতে পারলো। চাচা মারা যাবার সাথে সাথে খেলোয়াড় হবার ইচ্ছা ও কেনো জানি মরে গেছিলো।
সোয়েবের খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো পুরনো দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে জীবনটাকে আবার রঙ্গীন করে আনতে।
রাস্তায় চলমান কোন এক গাড়ির জোরালো হর্ণে বাস্তবে ফিরলো সোয়েব।
এতক্ষণে তার খেয়াল হলো, তারা দাঁড়িয়ে আছে।
- সরি, তোমাকে দাড় করিয়ে রেখেছি।
- হুম। আনসোশাল ম্যানতো। Still the same man
- আরে নাহ। মানুষ সকালে বিকালে বদলায়, আর তো দশ বছর। এতো লম্বা সময়ে সব মানুষ বদলে যায়।
- জ্বি না। সবাই বদলায় না।
- ঠিক আছে। তুমি যা বলো তাই। আপাতত চলো কোথাও বসে কথা বলি।
এই কথার উত্তরে মোহনা কিছু না বলে হাতের ইশারায় সামনে চলতে বললো।
রেষ্টুরেন্টে বসে প্রথম কথা বললো মোহনা, "বিয়ে করেছেন?"
- না
- আপনি কি জানেন, আপনি ঠিকমত মিথ্যা বলতে পারেন না?
- মানে?
- আপনি বিবাহিত, এটা অস্বীকার করছেন কেনো?
- ভাবলাম, আবার একটু সেলসম্যান হবার চেষ্টা করি।
- বোকা বানাতে চান? কি হবে আর বোকা বানিয়ে?
- না না। তোমাকে আমি কেনো বোকা বানাবো? ওটা তো সেই কবে থেকে তোমার কপি রাইট।
- ও , তাই? তাহলে আমি এখন নিশ্চয়ই আপনার সময় নষ্ট করছি।
- প্লিজ, be my guest, just one time. আনসোশাল ম্যানতো উল্টা-পাল্টা বলবেই। সেটাতে রাগ করলে কি চলে? তোমার আইসক্রীম অনেক পছন্দ আমি জানি। কি আইসক্রীম অর্ডার দিবো তাই বলো।
- মনে আছে আপনার??? আমি খুবই অবাক হলাম। আপনি যে এতো কিছু মনে রেখেছেন, আপনার ওয়াইফ রাগ করবেন না জানলে?
- করতেও পারে। না করলেই অবাক হবো।
- তাহলেতো আপনার ওয়াইফের সেল নাম্বারটা জোগাড় করতে হয়।
- মোহনা, কিছু কথা স্মৃতির আড়ালে চলে গেছিলো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কিছু প্রশ্ন থেকে গেছে যার উত্তর জানা দরকার।
- কোন লাভ আছে কি?
- আছে। শুধু জানতে চাই আমি গত দশ বছর যে ধারনা করেছি, সেগুলো সত্যি কিনা।
এই প্রশ্নের কোন উত্তর মোহনার কাছ থেকে না পেয়ে সোয়েব আবার বলতে লাগলো, "ঠিক আছে, তুমি না চাইলে সেসব প্রশ্ন আর করব না। তোমার হাজবেন্ড কি করে?"
- আপনি বললেন না, এখনো সেলসম্যান সেজে আছেন কেনো?
- আমিতো অফিস থেকে আসলাম, তাই ফরমাল ড্রেসে আছি। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে টপিক ঘোরানোর স্বভাব তোমার আজও যায়নি দেখছি।
- এটাতো আপনি করেন।
-কোথায়?
- এইত, কতক্ষণ আগের প্রশ্নের উত্তর এখন দিলেন।
- সেদিন আমার মনে হয়েছিলো আবার তোমার সাথে দেখা হবে। আজ মনে হচ্ছে আর দেখা হবে না।
- সব সময় আপনার যেটা মনে হবে সেটাই হবে ভাবেন কেনো?
- ভাববো কেনো? সেটাই তো হলো।
- একবার হয়েছে বলে বারবার হবে?
- তুমি সেদিন চেয়েছিলে আর আমাদের দেখা না হোক
- আর আজ?
- সেটা তুমি ভালো জানো।
- আপনার ধারনা যে ভুল আপনি জানেন?
- ভুল না। সম্পূর্ন সঠিক। নাহলে অভিনয় করেছিলে কেনো?
- সেটা বোঝার ক্ষমতা কি আপনার কোনদিন ছিলো?
- আমি চাই না ঐ ক্ষমতা। ছলনার ক্ষমতা আমার দরকার নেই।
- আপনি মুখে যাই বলেন, আপনি এখনো আগের মতই আছেন।
- কি রকম?
- একরোখা, অবুঝ কিন্তু সবজান্তা ভাব
- হাহাহা। মনে আছে তোমার, বলেছিলাম যে, এই স্পষ্টবাদীতার জন্যেই তোমাকে এতো পছন্দ
- পছন্দ এর পরে করতাম শব্দটা যোগ করতে ভুলে গেলেন মনে হয়।
- তোমার সাথে তর্কে কখনোই আমি পারিনা।
- আমি শুধু তর্ক করি?
- সেটা বলেছি আমি?
- হুম, ইনডিরেক্টলি।
- না, এটা তোমার ধারনা। তুমি কিন্তু এখনো বলোনি তোমার হাজবেন্ডের কথা। উনি কি করেন?
- কিছু করেন না।
- মানে? তাহলে ?
- "এতোবার মানে মানে করছেন কেনো?" একটু যেনো রাগত্ব স্বরে বললো মোহনা। "আমার হাজবেন্ড কিছু করে না। হাজবেন্ড থাকলে তো কিছু করবে। আমি বিয়ে করিনি। বাসা থেকে আলাদা হয়ে কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলে থাকি।"
- কিন্তু......
- কিন্তু কি? এটাইতো জিজ্ঞাসা করবেন, বিয়ে করলাম না কেনো? নিজেকে না শার্লক হোমসের মত ভাবেন আপনি? সামনে বসে থেকে মনের কথা পড়তে পারেন? কই? সেগুলো কি ভোঁতা হয়ে গেলো দশ বছরে?
- সত্যি বলছি, আমি কিছুই বুঝছি না।
- সেটাই। যদি বুঝতেই পারতেন, তাহলে নিশ্চয় ভালোবাসার কথা বলে হারিয়ে না গিয়ে দশ বছরে অন্তত একবার খোঁজ নিতেন, যার জন্যে এতো করলেন, সে আপনার জন্যে অপেক্ষা করে আছে কিনা। যে ছেলেটা না চিনে না জেনে কোন মেয়েকে শুধু দেখার জন্যে সেলসম্যান সেজে তার বাড়িতে হাজির হতে পারে, তার ভালোবাসা যে দশ বছরে একবারও নাড়া দেবে না, তা কি আমি জানতাম? আসলে তার ভালোবাসা যেমন হঠাৎ করে এসেছিলো, তেমনি হঠাৎ করে উড়ে গিয়েছে।
- Shut up!
- No, no. আমিতো বলতে চাইনি। আপনিই টেনে এনেছেন। এখন আপনাকে শুনতেই হবে। সেদিনের ছোট্ট একটা ঠাট্টার জন্যে আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন। অথচ আর কখনো যোগাযোগ করলেন না। আর আমি সেই পাগল ছেলেটার খোঁজে জীবন পার করে দিলাম।
- সেটার জন্যে আমি দায়ী নই নিশ্চয়ই
- না না, আপনি কেনো দায়ী হবেন? সব দোষ আমার । এতোদিন মনে হত পাগল ছেলেটার আমার কথা মনে পড়বেই কোন এক দিন, সে আবার ফিরে যাবে সেই পথে। কিন্তু এই মুহুর্তে শুধু আফসোস হচ্ছে হারানো মূল্যবান সময়টার জন্যে।
এরপর থেকে দুজনেই চুপ করে বসে আছে। সোয়েব সরাসরি তাকিয়ে আছে মোহনার দিকে, আর মোহনা তাকিয়ে নিজের ডান কাঁধের উপর দিয়ে জানালার বাইরে। মোহনা কি কাঁদছে?
কেনো কাঁদছে? কেঁদে কি আর কোন লাভ আছে?
সোয়েবের এটা ভেবে প্রচন্ড কষ্ট হলো, দশ বছর আগে মোহনার অভিনয়ের কান্নাটাকে সত্যি ভেবে সে যদি সেদিন প্রতারিত হতো, তাহলেই ভালো হত। অন্তত আজকে মোহনার সত্যি কান্না তাকে দেখতে হতো না।
একটা কথাই তার মনে আসলো, "হে আল্লাহ, তুমি নারী হৃদয়কে এতো জটিল করলে কেনো? সেদিন কষ্ট হয়েছিলো এই হৃদয়ের পাঠোদ্ধার করতে না পারায়। আজ কষ্ট হচ্ছে সম্পূর্ন উল্টোটা ঘটেছে বলে,"
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সোয়েব মোহনাকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। বললো, "চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।"
- আপনার সাহায্য দরকার নেই আমার। আপনি বোধহয় ঠিকই বলছেন। আমাদের আর দেখা হবে না। না হওয়াই ভালো। ভালো থাকবেন।
শেষ কথা বলে মোহনা আর দাড়ালো না। উঠে চলে গেলো তার রাস্তায়।
মোহনার শেষ কথাগুলো সোয়েবকে আঘাত করলেও সে এর ব্যাতীক্রম করেনি । আর কখনোই মোহনার সাথে দেখা হয়নি তার। এমনকি সেই চায়ের দোকানের সামনেও না।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:৪১