কবিদের কাজ কবিরা করেন
কবিতা লেখেন তাই
ভেতরে হয়ত মানিক রতন
কিবা ধুলোবালিছাই
জহু্রি চেনেন জহর, তেমনি
সোনার পাঠক হলে
ধুলোবালিছাই ছড়ানো পথেও
মাটি ফুঁড়ে সোনা ফলে।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০
***
স্বরচিত কবিতাটির ছন্দ-বিশ্লেষণ
শুরুতেই সংক্ষেপে ছন্দের প্রকারভেদ জেনে নিই। ছন্দ মূলত ৩ প্রকার। এই ৩ প্রকার ছন্দের নাম ও মাত্রাসংখ্যা নিম্নরূপ :
১। স্বরবৃত্ত ছন্দ। এ ছন্দটি ছড়ায় খুব বেশি ব্যবহৃত হয় বলে এটাকে ছড়ার ছন্দও বলা হয়। এতে সবসময় ৪ মাত্রার মূল পর্ব থাকে। বদ্ধস্বর ও মুক্তস্বর উভয়েই ১ মাত্রা হিসাবে গোনা হয়।
স্বর বা অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তা বদ্ধস্বর, যেমন বন (বন্), মান (মান্), এবং অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে তা মুক্তস্বর, যেমন বাধা= ব্+আ=বা, ধ্+আ=ধা; পড়ো=প্+অ=প, ড়্+ও=ড়ো
স্বর বা অক্ষর হলো সহজ ভাষায় ইংরেজির সিলেবল (Syllable), যেমন, Yes-ter-day. এখানে তিনটা সিলেবল আছে, বাংলায় তিনটা স্বর বা অক্ষর বলা হয়।
২। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। মূল পর্ব ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রার হয়। এই ছন্দে বদ্ধস্বর ২ মাত্রা এবং মুক্তস্বর ১ মাত্রা হিসাবে গণনা করা হয়। অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা, আর অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, এমনকি ‘য়’ থাকলেও, ২ মাত্রা ধরা হয়।
৩। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়। মুক্তস্বর, অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা ধরা হয়। অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জন ধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা, আর শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা গোনা হয়।
সারাংশ
ক। স্বরবৃত্ত=মূল পর্ব ৪ মাত্রা।
খ। মাত্রাবৃত্ত=মূল পর্ব ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রা।
গ। অক্ষরবৃত্ত=মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রা।
***
আমার উপরের কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। মূল পর্ব ৬ মাত্রার। ৩টা মূল পর্ব আছে, ২ মাত্রার একটা অতি-পর্ব আছে।
কবিদের কাজ
কবিরা করেন
কবিতা লেখেন
তাই
ক-বি-দের কাজ
ক-বি-রা ক-রেন
ক-বি-তা লে-খেন
তা-ই
ক-মুক্তস্বর-১ মাত্রা
বি-মুক্তস্বর-১ মাত্রা
দের-বদ্ধস্বর-২ মাত্রা
কাজ-বদ্ধস্বর-২ মাত্রা
রেন/খেন/লেন-বদ্ধস্বর-২ মাত্রা
উপরের কবিতায় ৬-৬-৬-২ মাত্রা করে আছে প্রতি চরণে।
ছন্দ সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে পড়তে পারেন : বাংলা কবিতার ছন্দ - প্রাথমিক ধারণা
বিশেষ নোট : ছন্দ বলতে অনেকেই আগের লাইনের শেষ শব্দের সাথে নীচের লাইনের শেষ শব্দের মিলকে বুঝে থাকেন। এটা ছন্দের মূল বৈশিষ্ট্য না; এটাকে অন্ত্যমিল বা অন্তানুপ্রাস বলা হয়। কবিতামাত্রেই ছন্দ থাকবে, হোক তা পদ্য কবিতা, কিংবা গদ্য কবিতা। স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ। এখানে কোনো অন্ত্যমিল নাই। কিন্তু এখানে অসাধারণ একটা ছন্দ রয়েছে, যেখানে প্রতিটি পর্বে রয়েছে ৬টি করে মাত্রা। তবে, এ ছন্দ বোঝার জন্য ছন্দ পড়া আবশ্যিক নয়, কবিতা পড়া ও কবিতা বোঝা আবশ্যিক। আহমেদ জী এস ভাইয়ের একটু প্রশংসা করে নিই। তিনি ছন্দ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখেন না বলে কোনো এক কবিতা পোস্টে তার কবিতাটির আমি ছন্দ-বিশ্লেষণ করার পর জানিয়েছিলেন। অথচ, তার সবগুলো কবিতাই নিখুঁত ও নিপুণ ছন্দে রচিত, সর্বাধুনিক গঠনশৈলীতে ঋদ্ধ। আমিও যে ছন্দ সম্পর্কে কবিতা লেখার শুরু থেকেই জ্ঞান রাখতাম, তা না। তবে, আমি প্রচুর কবিতা পড়তাম। তা থেকেই আমার ছন্দ সম্পর্কে ধারণা হয়। অনেকে একটা কথা বলে থাকেন, সৃজনশীল লেখায় কোনো বাঁধাধরা নিয়ম থাকা ঠিক নয়। এটা খুবই অপ্রয়োজনীয় একটা কথা। আপনি যাই লিখতে যান না কেন, নিজের অজান্তেই আপনি একটা ছন্দের ভেতর ঢুকে যাবেন। আপনি যদি জীবনে কোনো কবিতা না পড়ে থাকেন, তাহলে আপনি জানবেনই না আপনি কবিতা লিখলেন, নাকি সবিতা আঁকলেন, যেমন, জীবনে কোনোদিন কাক না দেখে থাকলে বা বর্ণনা না পড়ে থাকলে কাক চেনা বা কাক আঁকা সমভব না। আর যদি কবিতা পড়েই থাকেন, তাহলে যা লিখলেন, ঠিক আগে পড়া কবিতাগুলোর ছন্দেই কবিতাটি লিখেছেন।
ঘুরে আসতে পারেন নীচের লিংকগুলোও :
আমার আগে লেখা কিছু পোস্টের লিংক
১। নবীন কবিদের কবিতা : ‘কঠিন’ শব্দ ও ‘কঠিন’ কবিতা; ‘কাঁচা’ হাত ও ‘কাঁচা’ কবিতা বনাম ‘পরিণত’ হাত ও ‘পরিণত’ কবিতা
২। নবীন কবিদের কঠিন কবিতা
৩। কবিতার প্যাটার্ন
৪। সনেটের অন্ত্যমিল ও পঙ্ক্তি-বৈচিত্র্য : প্রথম পর্ব
৫। সনেটের অন্ত্যমিল ও পঙ্ক্তি-বৈচিত্র্য : দ্বিতীয় পর্ব
৬। শব্দকবিতা - শব্দেই দৃশ্যানুভূতি
৭। আমার কবিতা ভাবনা
৮। আপনাদের জন্য কিছু উপকারী পোস্ট
ছন্দ সম্পর্কে আমার গুরু বলেন : কবিতা লেখার জন্য ছন্দ জানার বা শেখার মোটেও দরকার নাই, যেটা দরকার তা হলো কবিতা কী তা জানা ও বোঝা।
জয় গুরু। পোস্টটি উৎসর্গ করলাম আমার গুরুকেই, যিনি বহুদিন ধরে এখানে নিদ্রাযাপন করছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২২ রাত ৮:৪০