somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা কবিতার ছন্দ – প্রাথমিক ধারণা

২৩ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উৎসর্গ : কবি ফরিদ আহমদ চৌধুরী। তিনি আমাকে নিয়ে তিন-তিনটে সনেট লিখেছেন, তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমি তাঁকে কিছুই দিতে পারি নি। এ পোস্টটি তাঁর নামে।

আমার আগে লেখা কিছু পোস্টের লিংক

১। নবীন কবিদের কবিতা : ‘কঠিন’ শব্দ ও ‘কঠিন’ কবিতা; ‘কাঁচা’ হাত ও ‘কাঁচা’ কবিতা বনাম ‘পরিণত’ হাত ও ‘পরিণত’ কবিতা

২। সনেটের অন্ত্যমিল ও পঙ্‌ক্তি-বৈচিত্র্য : প্রথম পর্ব

৩। সনেটের অন্ত্যমিল ও পঙ্‌ক্তি-বৈচিত্র্য : দ্বিতীয় পর্ব

৪। শব্দকবিতা - শব্দেই দৃশ্যানুভূতি

ছন্দ কাকে বলে?

১। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে,‘বাক্যস্থিত পদগুলিকে যেভাবে সাজাইলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে ভাবগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধ হয়, পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতিকে ছন্দ বলে।

২। কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, তাকে ছন্দ বলে। (বাঙলা ছন্দ – জীবেন্দ্র সিংহরায়)।অর্থাৎ, কবি তাঁর কবিতার ধ্বনিগুলোকে যে-সুশৃঙ্খল বিন্যাসে বিন্যস্ত করে তাতে এক বিশেষ ধ্বনিসুষমা দান করেন, যার ফলে পাঠক কবিতাটি পাঠ করার সময় এক ধরনের ধ্বনিমাধুর্য উপভোগ করেন, ধ্বনির সেই সুশৃঙ্খল বিন্যাসকেই ছন্দ বলে।

৩। অনেকে ছন্দ বলতে চরণ বা পঙ্‌ক্তির শেষে ধ্বনির মিলকে বুঝে থাকেন; এটা ভুল ধারণা, তা ছন্দ নয়। তাঁকে কাব্যালঙ্কার বলা হয়, সুনির্দিষ্টভাবে অন্ত্যানুপ্রাস। ছন্দ সৃষ্টির জন্য অন্ত্যানুপ্রাস কোনো শর্ত নয়।

৪। কবিতা লিখতে হলে আগে ছন্দ জানতে হবে তা জরুরি নয়। তবে যিনি কবিতা লিখছেন তাঁকে অবশ্যই আগে কবিতা পড়তে হবে, বা কবিতা কী জিনিস, বা কী রকম, কবিতার বৈশিষ্ট্য কী, সে সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকতে হবে। যিনি জীবনে কোনো কবিতা পড়েন নি, বা কবিতা ও এর ছন্দ বা বৈশিষ্ট্য কী রকম, তা জানেন না, তাঁর পক্ষে কবিতা লেখা অসম্ভব। যেমন, যে কখনো হাতি দেখে নি, তার পক্ষে হাতির ছবি আঁকা বা হাতির বর্ণনা লেখা সম্ভব নয়।

৫। তবে, যিনি ছন্দ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন, আর যিনি আদৌ রাখেন না, তাঁদের লেখার মধ্যে কিছুটা তফাত থাকবেই। একটা কবিতা বিশ্লেষণ করার সময় এর নানাদিক দেখা হয়; ছন্দ-সমীক্ষণও নিশ্চয়ই তার একটা আলোচ্য দিক থাকবে।

৬। নিখুঁত ছন্দে কবিতাটি লিখিত হয়েছে কিনা, তার চেয়ে বেশি জরুরি হলো কবিতাটি কবিতা হয়েছে কিনা তা বিচার করা। যিনি ভালো কবিতা লিখেন, তাঁর ছন্দ আপনা-আপনিই নিখুঁত হয়ে থাকবে, কারণ, তিনি ইতোমধ্যে কবিতার গভীরে প্রবেশ করেছেন, আর কবিতা কী জিনিস তা তাঁর একেবারে আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে।

৭। এ রচনাটি মূলত উইকি সংকলন। কবি, বাংলাপিডিয়া, কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ ও কবি সরদার ফারুকের রচনা থেকেই অধিক বর্ণনা এখানে সংযোজিত হয়েছে।

৮। আমি স্বীকার করছি, আমার জ্ঞান খুব কম। কিন্তু আমার অধীত বিদ্যা যতটুকু আছে, আমি তার সবটুকুই এখানে রেখে দিয়েছি। এটা আমার জন্যও একটা সহায়ক রচনা বটে।

৯। রচনাটি বেশ দীর্ঘ। কেবল আগ্রহীদের কথা চিন্তা করে এখানে এতকিছু সংযোজন করা হয়েছে।

১০। এখানে কোথাও কোনো ভুল পরিলক্ষিত হলে দয়া করে শুধরে দিলে বাধিত হবো।

ছন্দের ইতিহাস

১১। “ছন্দ হলো কাব্যের গতিসৌন্দর্য বিধায়ক একটি স্বতঃস্ফূর্ত নির্মাণকৌশল। হাজার বছর ধরে বিচিত্র আবেগ, অনুভূতি ও বিষয়ভাবনা দ্বারা পরিপুষ্ট বাংলা কাব্যের গতিময় নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কবিরা বহুবিধ ছন্দের নির্মাণ ও বিকাশ সাধন করেছেন।

১২। ভারতবর্ষে ছন্দচর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। সুদূর অতীতে বৈদিক ভাষা ও সাহিত্য (খ্রি.পূ ২৫০০-৯০০ অব্দ) চর্চার সময়কাল থেকেই ভারতবর্ষে কাব্যের প্রধান উপাদানরূপে ছন্দের চর্চা হয়ে আসছে। ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকিকে আদি কবি এবং তাঁর কাব্যে ব্যবহৃত ছন্দকে আদি ছন্দ বলেও একটা কথা প্রচলিত আছে। একদিন ব্যাধের শরে ক্রৌঞ্চমিথুনের ক্রৌঞ্চ নিহত হলে ক্রৌঞ্চী আর্তস্বরে বিলাপ করছিল। তা শুনে বাল্মীকির বেদনার্ত হৃদয় থেকে যে-ছন্দে সকরুণ অভিশাপোক্তি উচ্চারিত হয় তাই আদি ছন্দ হিসেবে পরিচিত। ছন্দটির নাম অনুষ্টুপ্। বাল্মীকির এ ছন্দোভাবনাই পর্যায়ক্রমে গায়ত্রী, অনুষ্টুপ্, ত্রিষ্টুপ্ ইত্যাদি শাখায় বিভক্ত ও বিকশিত হয়ে নব্যভারতীয় বিভিন্ন ভাষার কাব্যচর্চাকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনি নতুন নতুন দেশিয় ছন্দ নির্মাণেও উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা ছন্দের উদ্ভব ও বিকাশও এর ব্যতিক্রম নয়।

১৩। তবে বাংলা কাব্যের বিভিন্ন ছন্দ সৃষ্টির পশ্চাতে সংস্কৃত অনুষ্টুপাদি ছন্দ ভিত্তি হিসেবে কাজ করলেও এক্ষেত্রে এ ভাষার কবি-মনীষীদের আবেগসমৃদ্ধ মৌলিক ও সৃষ্টিধর্মী চিন্তা এবং কৌশলই মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।” (বাংলাপিডিয়া)

১৪। “হাজার বছর বয়সী বাংলা কাব্যে সময়ের ধারাবাহিকতায় নতুন নতুন ছন্দের উদ্ভব ঘটলেও এর প্রধান শাখা হচ্ছে তিনটি: মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে বিশ শতকের শেষপাদ পর্যন্ত রচিত বাংলা কাব্যের বিচিত্র ধারায় এ তিনটি ছন্দই অসংখ্য কবির দ্বারা চর্চিত ও পরিপুষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া ধামালি, ভঙ্গপয়ার, ললিত, দিগক্ষরা, মহাপয়ার প্রভৃতি নামে যে ছন্দগুলি প্রচলিত, সেগুলি অনিয়মিত ও পারম্পর্যহীন। সেগুলি কবিবিশেষের সৃষ্টি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্রষ্টার ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।” (বাংলাপিডিয়া)

ছন্দের প্রকারভেদ - সারাংশ

১৫। ছন্দ মূলত ৩ প্রকার। শুরুতেই এই ৩ প্রকার ছন্দের নাম ও মাত্রাসংখ্যা সারাংশ হিসাবে উল্লেখ করা হলো।

ক। স্বরবৃত্ত ছন্দ। এ ছন্দটি ছড়ায় খুব বেশি ব্যবহৃত হয় বলে এটাকে ছড়ার ছন্দও বলা হয়। এতে সবসময় ৪ মাত্রার মূল পর্ব থাকে। বদ্ধস্বর ও মুক্তস্বর উভয়েই ১ মাত্রা হিসাবে গোনা হয়।

স্বর বা অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তা বদ্ধস্বর, যেমন বন (বন্‌), মান (মান্‌), এবং অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে তা মুক্তস্বর, যেমন বাধা= ব্+আ=বা, ধ্+আ=ধা; পড়ো=প্+অ=প, ড়্+ও=ড়ো

খ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। মূল পর্ব ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রার হয়। এই ছন্দে বদ্ধস্বর ২ মাত্রা এবং মুক্তস্বর ১ মাত্রা হিসাবে গণনা করা হয়। অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা, আর অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, এমনকি ‘য়’ থাকলেও, ২ মাত্রা ধরা হয়।

গ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়। মুক্তস্বর, অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা ধরা হয়। অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জন ধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা, আর শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা গোনা হয়। তবে দুই বর্ণ বিশিষ্ট কোনো শব্দ বদ্ধস্বর হলে তা দুই মাত্রা ধরা হবে, যেমন- নদ, বন, মন, তির, ধীর, ক্ষেত, চাষ, মাস, স্নান, স্থান।

সারাংশের সারাংশ

ক। স্বরবৃত্ত=মূল পর্ব ৪ মাত্রা।
খ। মাত্রাবৃত্ত=মূল পর্ব ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রা।
গ। অক্ষরবৃত্ত=মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রা।

বিস্তারিত আলোচনা

১৬। এবার উপরের কথাগুলোকে একটু বিস্তৃত করা যাক। তবে, ছন্দের মাত্রা সম্পর্কে জানার আগে ছন্দের বিভিন্ন উপকরণ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা জরুরি।


অক্ষর, স্বর বা ধ্বনি

১৭। বাগ্‌যন্ত্রের স্বলতম প্রয়াসে বা একঝোঁকে শব্দের যতটুকু অংশ উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বা দল বা স্বর বা ধ্বনি বলে। অক্ষর ইংরেজি সিলেবল-এর মতো। Conception= Con+cep+tion. এই Conception শব্দটিতে আমরা ৩টি সিলেবল দেখতে পাচ্ছি। তদ্রূপ, ‘সংসপ্তক’ শব্দটি ভাঙলে সং+সপ্‌+তক=৩টি অক্ষর পাচ্ছি। এভাবে, ‘অঘটনঘটনপটিয়সী’ শব্দটিকে ভাঙলে আমরা পাই=অ+ঘ+টন+ঘ+টন+প+টি+য়+সী=৯টি অক্ষর।

১৮। সাধারণ ভাবে আমরা বুঝি, প্রতিটি বর্ণই একেকটি অক্ষর। কিন্তু, বাংলা ব্যকরণের ভাষায় তা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়। আমরা জানি, মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য মুখ থেকে যে সকল শব্দ বা আওয়াজ বের করে তাই ধ্বনি। আবার, ধ্বনির লিখিত রূপই হলো বর্ণ। কিন্তু, মানুষ কোনো শব্দ উচ্চারণ করার সময়, একবারে যতগুলো কম সংখ্যক বর্ণ উচ্চারণ করে, তাদের একেকটিকে একেকটি অক্ষর বলে। যেমন- চললাম। এটিকে আমরা চল্‌+লাম, অর্থাৎ চল্‌ ও লাম্‌ এ ২টি ভাগে উচ্চারণ করে থাকি। এভাবে প্রতিটি শব্দই আমরা এমন ভাগ ভাগ করেই উচ্চারণ করি। আর এই প্রতিটি ভাগই হলো একেকটি অক্ষর বা স্বর। মাত্রা নিয়ে আলোচনার সময় বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

১৯। সাধারণত কোনো একটি শব্দের প্রতিটি অক্ষরকেই ১ মাত্রা বলে বিবেচনা করা যায়। যেমন, চল+লাম। এখানে চল্ একটা মাত্রা এবং লাম্’’ একটা মাত্রা। অক্ষর এবং মাত্রার মধ্যে পার্থক্য আছে। অক্ষরের ধারণা থেকেই মাত্রার উৎপত্তি। ছন্দের শ্রেণি মোতাবেক একটি অক্ষর কখনো ১ মাত্রা, কখনো-বা ২ মাত্রা বহন করে।

২০। বাংলা অক্ষর, স্বর বা ধ্বনিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথাঃ

ক। বদ্ধস্বর বা বদ্ধাক্ষর, ও
খ। মুক্তস্বর বা মুক্তাক্ষর।

বদ্ধস্বর

২১। যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয় তাদের বদ্ধস্বর বা বদ্ধাক্ষর বলা হয়। অন্য কথায়, অক্ষরের শেষে যদি ব্যঞ্জনধ্বনি থাকে, তাকে বদ্ধস্বর বা বদ্ধাক্ষর বলা হয়। যেমন : সব (সব্‌), জিভ (জিভ্‌), নাক (নাক্), তিল (তিল্‌), সম্মান (সম্‌+মান্‌), বলতেন (বল্‌+তেন্‌), চাইতেন (চাই+তেন্‌), মন, বিল, দিন, ইত্যাদি।

২২। সব, জিভ, নাক, তিল, মন, বিল, দিন শব্দগুলোতে ১টি করে বদ্ধস্বর; সম্মান, বলতেন, চাইতেন শব্দগুলোতে ২টি করে বদ্ধস্বর রয়েছে। খেয়াল করুন, এই বদ্ধস্বরগুলো ইংরেজি সিলেবল-এর (syllable) সাথে তুলনীয়।

মুক্তস্বর

২৩। যে সব ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের প্রবহমান বাতাস জিভের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের মুক্তস্বর বা মুক্তাক্ষর বলে। অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে তা মুক্তস্বর বা মুক্তাক্ষর হবে। যেমন: বাবা (বা+বা), হ্যাঁ, না, চিরজীবী (চি+র+জী+বী), কালি (কা+লি), আলোছায়া (আ+লো+ছা+য়া), এইখানে (এ+ই+খা+নে), ভিজায়ে (ভি+জা+য়ে), ভুখানাঙ্গা (ভু+খা+না+ঙ্গা), কইতরী (ক+ই+ত+রী), যাবতীয় (যা+ব+তী+য়), নি, যা, খা, নে, ইত্যাদি।

২৪। উপরের ‘বাবা’ শব্দটিতে বা+বা ২টি মুক্তস্বর রয়েছে। ‘চিরজীবী’ শব্দে চি+র+জী+বী ৪টি মুক্তস্বর, আলোছায়া, এইখানে, ভুখানাঙ্গা, কইতরী, যাবতীয় শব্দগুলোতে ৪টি করে এবং ভিজায়ে শব্দটিতে ভি+জা+য়ে ৩টি মুক্তস্বর রয়েছে।

২৫। একই শব্দে বদ্ধস্বর ও মুক্তস্বর। আমাদের (আ+মা+দের), দাদির (দা+দির), ডালিম (ডা+লিম), করিলাম (ক+রি+লাম), যাচ্ছিলেন (যাচ্‌+ছি+লেন), আরামকেদারা (আ+রাম+কে+দা+রা), বাহাদুর (বা+হা+দুর), সঙ্গোপন (সং+গো+পন), স্থাপন (স্থা+পন), সংস্থাপন (সং+স্থা+পন), আস্থাশীল (আস্‌+থা+শীল), নির্ভরযোগ্য (নির্‌+ভর্‌+যোগ্+গ)।


মাত্রা

২৬। ছন্দের প্রকারভেদ বলতে গিয়ে মাত্রার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে, এবার মাত্রা সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।

২৭। একটি অক্ষর উচ্চারণের জন্য যতটুকু সময়ের প্রয়োজন, তাকে মাত্রা বলে। “সোজা কথায় মাত্রা মানে পরিমাপক অর্থাৎ ইউনিট অফ মেজার। জল মাপি লিটারে, কাপড় মাপি মিটারে আর ছন্দ মাপি মাত্রায়। কবিতার এক-একটি পঙ্ক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং তাকে উচ্চারণ করার জন্য মোট যে সময় আমরা নিয়ে থাকি, সেই উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটা অংশই হলো মাত্রা। প্রবোধচন্দ্র সেন তারই নাম দিয়েছেন কলা। কলা মানে এখানে অংশ।” (সরদার ফারুক)

২৮। যখন একটি অক্ষরে একটিই বর্ণ থাকে, তখন সেটি ১ মাত্রা হবে। যেমন,‘কলম’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দুটি অক্ষর ক, লম্ পাওয়া যায়। এতে,‘ক’ একাই একটি মাত্রা, এবং এটি মুক্তস্বর বা মুক্তাক্ষর।

২৯। যদি একাধিক বর্ণ মিলে একটি অক্ষর বুঝায়, তখন ঐ একাধিক বর্ণ মিলে এক বা দুই মাত্রা হবে, এবং তা এক, নাকি দুই মাত্রা হবে সেটা ছন্দের শ্রেণিবিভাগের উপর নির্ভর করবে। যেমন, 'কলম' শব্দের 'লম্‌'- এটি বদ্ধস্বর হওয়ায় স্বরবৃত্তে এক মাত্রা, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তে তা দুই মাত্রা। এখন, একটি বড় শব্দের ক্ষেত্রে বোঝার চেষ্টা করি। যেমন, প্রত্যুৎপন্নমতি = প্রত্, তুৎ, পন্, ন, ম, তি। এখানে, ন, ম, তি এই তিনটি মুক্তাক্ষর এবং প্রত্, তুৎ, পন্, এই তিনটি বদ্ধাক্ষর। এ শব্দটি স্বরবৃত্তে ৬ মাত্রা হবে, বিভাজিত প্রতিটি অক্ষর এখানে এক মাত্রা। মাত্রাবৃত্তে ৯ (ৎ-কে এক মাত্রা ধরে) বা ৮ মাত্রা (ৎ-কে বাদ দিয়ে)। অক্ষরবৃত্তেও ৬ মাত্রা হবে। অক্ষরবৃত্তে বদ্ধস্বর শব্দের শুরুতে বা মাঝখানে থাকলে ১ মাত্রা ধরা হয়, আর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা ধরা হয়। এখানে প্রত, তুৎ, পন্‌ শব্দের শুরু বা মাঝখানে থাকায় এগুলো ১ মাত্রা হিসাবে গণ্য হবে।

৩০। সতর্কতা। এই বিভাজন দেখে স্বর, মাত্রা আর অক্ষরের মধ্যে কনফিউশন সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘অঘটনঘটনপটিয়সী’ শব্দে ৯টি অক্ষর থাকলেও স্বরবৃত্ত ছন্দে এখানে ৯ মাত্রা হবে, মাত্রাবৃত্তে ১১ মাত্রা এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ৯ মাত্রা হিসাবে গণনা করা হবে।

৩১। “কাব্যে গতির সমতা রক্ষাকে মাত্রা বলে। মাত্রা সময়নিরূপক নির্দেশনা। কোন অক্ষরে কত সময় স্বর অবস্থান করবে, মাত্রায় তা উল্লেখ থাকে। আবৃত্তির ক্ষেত্রে মাত্রা অপরিহার্য। সময়ের পরিমাণ মাত্রা দিয়েই বোঝানো হয়। সঙ্গীতে যেমন : ধা। ধিন। ধিন। ধা। =৪ মাত্রা। তেমনি কাব্যে ছিপ।খান। তিন।দাঁড় । তিন।জন ।মাল।লা=৮ মাত্রা। অক্ষর বলতে, আমরা একসঙ্গে কোন বর্ণে কতটা সময় অবস্থান করি, তার উপর নির্ভর করে ধরা হয়। অক্ষর অনেকটা ইংরেজী সিলেবল-য়ের মতো। অক্ষর আর বর্ণ সম্পূর্ণ আলাদা । যেমন, ক+ল+ম -এখানে বর্ণ আছে তিনটি কিন্তু যখন শব্দটা উচ্চারণ করি তখন বলি ক+ লম, অর্থাৎ অক্ষর এখানে ২টি।” (মকসুদা হালিম)

৩২। কোন অক্ষর বা স্বরে কয়টি মাত্রা হবে, তা নির্ভর করে ছন্দের প্রকারভেদের উপর। অর্থাৎ, স্বরবৃত্ত ছন্দে কোনো একটি নির্দিষ্ট অক্ষরকে ১ মাত্রা ধরলেও মাত্রাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত ছন্দেও যে সেটি ১ মাত্রাই হবে, তা না, এর চেয়ে বেশিও হতে পারে। এই মাত্রার ভিন্নতাই বিভিন্ন ছন্দের ভিত্তি।

৩৩। সাধারণভাবে বলা যায় যে, সব ছন্দেই একটি মুক্তস্বর ১ মাত্রা হিসাবে ধরা হয়, মুক্তস্বরের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন (শব্দের শুরুতে, মাঝখানে বা শেষে)। যেমন, চিরজীবী=চি+র+জী+বী; এখানে ৪টি মুক্তস্বর রয়েছে; ৩ প্রকার ছন্দেই চিরজীবী শব্দটাতে ৪টি মাত্রা গণনা করা হবে। অন্যদিকে, অবিরল=অ+বি+রল; এখানে ‘অ’ এবং ‘বি’ ২টি মুক্তস্বর; ‘অ’ এবং ‘বি’ ৩ প্রকার ছন্দেই প্রত্যেকটি ১ মাত্রা হিসাবে গণ্য হবে; কিন্তু ‘রল’ বদ্ধস্বরটিতে কয়টি মাত্রা হবে তা নির্ভর করবে ‘অবিরল’ শব্দটি কোন প্রকার ছন্দের কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে, তার উপর। স্বরবৃত্ত ছন্দে ‘রল’ (যদি রল্ হিসাবে উচ্চারিত হয়) বদ্ধস্বরটি ১ মাত্রা হিসাবে গোনা হবে; অন্য ২ প্রকার ছন্দে ‘রল’ বদ্ধস্বরটিতে ২ মাত্রা ধরা হবে (এ নিয়মের ব্যতিক্রম আছে)।বিস্তারিত নীচে।


ছন্দের অন্যান্য উপকরণ


যতি বা ছন্দ-যতি

৩৪। কোনো বাক্য পড়ার সময় শ্বাস গ্রহণের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর যে উচ্চারণ-বিরতি নেয়া হয়, তাকে যতি বা ছন্দ-যতি বা শ্বাস-যতি বলা হয়।

এইখানে তোর/দাদির কবর/ডালিম গাছের/তলে,
তিরিশ বছর/ভিজায়ে রেখেছি/দুই নয়নের/জলে।

উপরের কবিতাংশে ‘/’ , (কমা) ও দাড়ি দিয়ে যতি নির্দেশ করা হয়েছে।

৩৫। যতি মূলত ২ প্রকার, যথা- হ্রস্ব ও দীর্ঘ যতি। অল্পক্ষণ বিরিতির জন্য বাক্য বা পঙ্ক্তির মাঝখানে যে যতি পড়ে, তাকে হ্রস্বযতি বলে। দীর্ঘ বিরতির জন্য বাক্য বা পঙ্ক্তির শেষে দীর্ঘ যতি পড়ে।

উপরে ‘/’ চিহ্নগুলো হ্রস্ব যতি এবং কমা বা দাড়ি দীর্ঘ যতি হিসাবে বিবেচিত হবে।

৩৬। পর্ব, অতিপর্ব ও উপপর্ব। বাক্য বা পঙ্ক্তির এক হ্রস্ব যতি থেকে আরেক হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়। উদ্ধৃত কবিতাংশের প্রতি পঙ্ক্তিতে ৪টি করে পর্ব রয়েছেঃ

১ম পর্ব- এইখানে তোর
২য় পর্ব- দাদির কবর
৩য় পর্ব- ডালিম গাছের
৪র্থ পর্ব- তলে

৩৭। পর্বগুলো সাধারণত সমমাত্রার হয়। পঙ্‌ক্তি শেষের পর্বাংশকে অতিপর্ব বলা হয় যার মাত্রা সংখ্যা পর্বের মাত্রা সংখ্যা থেকে সর্বদাই কম। এ ধরনের পর্বাংশ পঙ্‌ক্তির শুরুতে থাকলে তাকে উপপর্ব বলা হয়।


স্বরবৃত্ত ছন্দ

৩৮। এ ছন্দটি ছড়ায় খুব বেশি ব্যবহৃত হয় বলে এটাকে ছড়ার ছন্দও বলা হয়। এতে সবসময় ৪ মাত্রার মূল পর্ব থাকে। বদ্ধস্বর ও মুক্তস্বর উভয়েই ১ মাত্রা হিসাবে গোনা হয়।

৩৯। “এই ছন্দে যতি এবং দল ঘন ঘন পড়ে বলে বাগযন্ত্র দ্রুততা লাভ করে। প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষর শ্বাসাঘাতযুক্ত। এই ছন্দের প্রয়োজনে ৫ মাত্রাকে সংবৃত উচ্চারণে ৪ মাত্রার মতো আবৃত্তি করা যায়, আবার কোথাও ১ মাত্রা কম থাকলে বিবৃত উচ্চারণ করে ১ মাত্রাকে ২ মাত্রায় টেনে নেয়া যায়।” (উইকিপিডিয়া – স্বরবৃত্ত ছন্দ)

৪০। “স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৪ মাত্রার চালে চলতে পছন্দ করে। প্রধানত ছড়া এবং গান লিখতেই এই ছন্দ সচরাচর ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন পয়ারের পাশাপাশি অবস্থান করেও এই বিশেষ ছন্দরীতিটি প্রাকৃত বাংলা বা লোকসাহিত্যের ছড়া, প্রবাদ, পাঁচালি প্রভৃতির বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবুও বাঙালির চিন্তা-চেতনায় এ ছন্দের প্রভাব অখণ্ড, অনন্ত।” (উইকিপিডিয়া – স্বরবৃত্ত ছন্দ)

৪১। “বাংলা ভাষা ও বাঙালির ধ্বনি উচ্চারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছন্দ হচ্ছে স্বরবৃত্ত ছন্দ। এর কারণ, বাংলা শব্দ স্বভাবগতভাবেই হলন্ত বা ব্যঞ্জনান্ত উচ্চারণ প্রক্রিয়াবিশিষ্ট, যাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘হসন্তের ছাঁচ’। এ বৈশিষ্ট্য স্বরবৃত্ত ছন্দে রক্ষিত হয়েছে। চলিত বা প্রাকৃত বাংলার স্বভাব রক্ষা করে এ ছন্দের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। ফলে এ ছন্দকে সাধু বাংলার বাইরে বাউল গানে, লোককথায় ও ছড়ায় খুঁজে পাওয়া যায়।

৪২। সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলা লোকসাহিত্যে প্রচলিত এই ছন্দোরীতিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দিয়েছেন ‘বাংলা প্রাকৃত’। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর নাম দিয়েছেন ‘চিত্রা’। ইংরেজির syllable এর মতো বাংলা শব্দাংশ হিসাব করে এই ছন্দের সমতা নিরূপিত হয়। এই syllable কে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলতেন ‘শব্দ পাঁপড়ি’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলতেন ‘মাত্রা’ আর প্রবোধচন্দ্র সেন বলতেন ‘দল’। আর তাই দ্বিজেন্দ্রলাল এই ছন্দকে ‘মাত্রিক’ এবং প্রবোধচন্দ্র ‘দলবৃত্ত’ নামে অভিহিত করেন। এই ছন্দে প্রতি পর্বের প্রথমেই শ্বাসাঘাত পড়ে বলে অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এই ছন্দকে ‘শ্বাসাঘাতপ্রধান’ ছন্দ বলে নির্দেশ করেন। স্বরবৃত্ত নামটিও প্রবোধচন্দ্র সেন প্রদত্ত নাম, যদিও তিনি পরবর্তীকালে নিজেই এই ছন্দের নাম 'দলবৃত্ত' প্রস্তাব করেন। তবে এখন বাংলা ছন্দে স্বরবৃত্ত' নামটিই প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

৪৩। উচ্চারণে দ্রুততা ও সবলতা স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতি পর্বের প্রথমে প্রবল শ্বাসাঘাত যেমন এ ছন্দের দ্রুততার প্রধান কারণ, তেমনি শ্বাসাঘাতের শক্তিই একে করে তুলেছে সবল ও প্রাণবান। আবার স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রধান পর্ব যেহেতু ৪ মাত্রার এবং তার পরেই থাকে একটি ক্ষুদ্র পর্ব, সেজন্যও এ ছন্দ দ্রুত উচ্চারিত হয়। যেমন:

উইড়া যাও রে/ বনের কুড়া/ কইও মায়ের্/ আগে।
তোমা-র্ না/ চান্দ্ বিনোদে/ খাইছে জংলার/ বাঘে।।
[মৈমনসিংহ গীতিকা]।

৪৪। এখানে সর্বশেষ ক্ষুদ্র পর্বটি ৪ মাত্রার কম বলে বিশ্লিষ্ট ও বিলম্বিত উচ্চারণ করে ৪ মাত্রা ধরা হয়েছে। স্বরবৃত্ত ছন্দের পর্বের এ স্থিতিস্থাপক গুণ বাংলা কাব্যে বিভিন্ন সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছে। দ্রুততা ও প্রবল শ্বাসাঘাতের জন্যই স্বরবৃত্ত ছন্দ অধিকতর প্রাণবন্ত এবং কথ্যভাষার উপযোগী হয়ে উঠেছে।

৪৫। অনেকের মতে, আধুনিক স্বরবৃত্ত ছন্দ মধ্যযুগীয় কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ধামালি ছন্দ থেকে উদ্ভূত, কেননা ধামালিকাব্য নামে পরিচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ধামালি ছন্দে স্বরবৃত্তের পূর্ববর্তী রূপটি পরিলক্ষিত হয়। এ কাব্যের শব্দে যেহেতু হসন্ত উচ্চারণ নেই এবং অকারান্ত শব্দ অকারান্ত রূপেই উচ্চারিত হয়, সেহেতু পর্বের আদিতে শ্বাসাঘাত স্পষ্ট না হলেও তার ইঙ্গিত আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে এমন কতগুলি তৎসম শব্দ আছে যেগুলির আদিতে শ্বাসাঘাতের অস্তিত্ব লক্ষণীয়, যেমন: আসুখ (অসুখ), আনল (অনল), আন্তর (অন্তর), আধিক (অধিক) ইত্যাদি। মূলত উপর্যুক্ত শব্দগুলির আদিস্বরের বৃদ্ধি প্রবল শ্বাসাঘাতের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তাই আদি স্বরের এ বৃদ্ধি দ্বারাই শব্দের আদি শ্বাসাঘাতকে বুঝে নিতে হয়, যা স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

৪৬। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পরে বৈষ্ণব পদাবলির কবি লোচনদাসের পদাবলিতে স্বরবৃত্ত ছন্দের পর্বগত শ্বাসাঘাত অত্যন্ত স্পষ্ট, যাকে অতি সহজেই এ ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্যরূপে চিহ্নিত করা যায়:
আর্ শুন্যাছ’/ আলো সই/ গোরা ভাবের/ কথা।
কোণের্ ভিতর্/ কুলবধূ/ কান্দ্যা আকুল্/ তথা।।

৪৭। স্বরবৃত্ত ছন্দ পরবর্তী সময়ে লোচনদাসের পদের ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতকের গোপীচন্দ্রের গান,শ্যামাসঙ্গীত, বাউল পদ, পাঁচালি ও মৈমনসিংহ-গীতিকার মধ্য দিয়ে পরিপুষ্টি লাভ করে আধুনিক যুগের ছড়ার ছন্দরূপে পরিপূর্ণ ও স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।” (বাংলাপিডিয়া)

৪৮। কিছু উদাহরণ দিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক।

আমি হব/সকাল বেলার/পাখি
সবার আগে/কুসুম বাগে/উঠবো আমি/ডাকি
সুয্যি মামা/ জাগার আগে/ উঠব আমি/ জেগে,
'হয় নি সকাল,/ ঘুমোও এখন’,/ মা বলবেন/ রেগে।
বলব আমি-/ 'আলসে মেয়ে/ঘুমিয়ে তুমি/ থাকো,
হয় নি সকাল,/ তাই বলে কি/ সকাল হবে/ নাকো?
আমরা যদি/ না জাগি মা/ কেমনে সকাল/ হবে?
তোমার ছেলে/ উঠবে মা গো/রাত পোহাবে তবে।

১ম পঙ্‌ক্তিতে ৪ মাত্রার ২টি পর্ব এং ২ মাত্রার ছোটো পর্ব (এর নাম অতিপর্ব) আছে।

আমি হব= এই পর্বে স্পষ্টত ৪ মাত্রা, কারণ, আ+মি, হ+ব, প্রতিটিই মুক্তস্বর।

সকাল বেলার= এই পর্বেও ৪ মাত্রা। স+কাল বে+লার। ‘কাল’ ও ‘লার’ বদ্ধস্বর, এবং স্বরবৃত্তে বদ্ধস্বর একমাত্রা হিসাবে ধরা হয়।

২য় পঙ্‌ক্তি থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি পঙ্‌ক্তিতে ৪ মাত্রার ৩টি মূল পর্ব ও ২ মাত্রার ১টি অতিপর্ব রয়েছে।

৪৯। “মামার বাড়ি/আর যাবো না/আর খাবো না/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/পড়বে না আর/আমার পিঠে/অমন তাল।

এখানে প্রতি পঙ্‌ক্তিতে ৩টি করে পর্ব এবং ১টি করে অতিপর্ব আছে। প্রত্যেক পর্বে সমান সংখ্যক মাত্রা আছে এবং লক্ষ করলে দেখা যাবে অতিপর্ব, পর্ব থেকে কম সংখ্যক মাত্রা ধারণ করেছে।

৫০। উপরে প্রদত্ত উদাহণের ছন্দবিন্যাস লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, প্রতিটি পর্বের মাত্রা সংখ্যা ৪, এবং অতিপর্বের মাত্রা সংখ্যা ৩। এই কাব্যাংশে কোনো উপপর্ব নেই।

৫১। যদি কবিতাটি সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিটি বর্ধিত লাইনেও উপরের লাইনগুলির সমান সংখ্যক পর্ব একই মাত্রায় রাখতে হবে, এবং অতিপর্বেও উপরের লাইন অনুসারে ৩ মাত্রা থাকবে। যেমন,

মামার বাড়ি/ আর যাবো না/ আর খাবো না/ মামীর গাল,
কথায় কথায়/ আমার পিঠে/ পড়বে না আর/ অমন তাল।
সকাল বেলা/ জেগে আমি/ তাই তো গেলাম/ মায়ের ঘর,
‘ভায়ের বাড়ি/ যাওগে একা,/ আমার গায়ে/ ভীষণ জ্বর।’

তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের এই কবিতাটির কাঠামো দাঁড়াবে:
৪+৪+৪+৩” (হাসানআল আব্দুল্লাহ)

৫২।

আম্মা বলেন/ পড়্‌রে সোনা/ আব্বু বলেন/ মন দে
পাঠে আমার/ মন বসে না/ কাঁঠাল চাঁপার/ গন্ধে

আম্‌+মা ব+লেন=৪ মাত্রা
পড়্‌+রে সো+না=৪ মাত্রা
আব্‌+বু ব+লেন=৪ মাত্রা
মন্‌ দে=২ মাত্রা

পা+ঠে আ+মার=৪ মাত্রা
মন্‌ ব+সে না=৪ মাত্রা
কাঁ+ঠাল চাঁ+পার=৪ মাত্রা
গন্‌+ধে=২ মাত্রা

উদ্ধৃত ছড়াটিতে ২ পঙ্‌ক্তিতেই ৪ মাত্রার ৩টি পর্ব এবং ২ মাত্রার ১তি অতি পর্ব রয়েছে।

৫৩।

মেজাজ ছিল—তিরিক্ষি তার
মাথায় ছিল—চুলের বাহার
শুনতে পেলাম—তার সে চুলে
কোত্থেক এক—বাবুই ভুলে
মনের সুখে—বানিয়ে বাসা
কাটাচ্ছে দিন—বেশ তো খাসা

মে+জাজ ছি+ল=৪ মাত্রা। তি+রিক্‌+খি (ষি) তার=৪ মাত্রা
মা+থায় ছি+ল=৪ মাত্রা। চু+লের বা+হার=৪ মাত্রা
শুন+তে পে+লাম=৪ মাত্রা। তার সে চু+লে=৪ মাত্রা
কোত্‌+থে+কে এক=৪ মাত্রা। বা+বুই ভু+লে=৪ মাত্রা
ম+নের সু+খে=৪ মাত্রা। বা+নিয়ে (নি+য়ে) বা+সা=৪/৫ মাত্রা
কা+টাচ্‌+ছে দিন=৪ মাত্রা। বেশ ত খা+সা=৪ মাত্রা

৫৪।

ভোলানাথ—লিখেছিল=৩ ও ৪ মাত্রা
তিন-চারে—নব্বই=৩ ও ২ মাত্রা (নব্+বই)
গণিতের—মার্কায়=৩ ও ৪ মাত্রা
কাটা গেলো—সর্ব্বই=৪ ও ২ মাত্রা (সর্ব্+বই)
তিন-চারে—বারো হয়= ৩ ও ৩ মাত্রা।
মাস্টার—তারে কয়=২ ও ৩ মাত্রা।
লিখেছিনু—ঢের বেশি=৪ ও ৩ মাত্রা।
এই তার—গর্ব্বই= ২ ও ২ মাত্রা।

রবীন্দ্রনাথের এ ছড়াটির সবগুলো মূল পর্বে মাত্রাসংখ্যা সমান নয়।

৫৫।

সুবলদাদা /আনল টেনে/ আদমদিঘির/ পাড়ে,
লাল বাঁদরের/ নাচন সেথায়/ রামছাগলের/ ঘাড়ে।
বাঁদরওয়ালা/ বাঁদরটাকে/ খাওয়ায় শালি/ধান্য,
রামছাগলের/ গম্ভীরতা/ কেউ করে না/ মান্য।
দাড়িটা তার/ নড়ে কেবল,/ বাজে রে ডুগ/ডুগি।
কাৎলা মারে/ লেজের ঝাপট,/ জল ওঠে বুগ্/বুগি।
রামছাগলের/ ভারী গলায়/ ভ্যাভ্যা রবের/ ডাকে
সুড়সুড়ি দেয়/ থেকে থেকে/ চৌকিদারের/ নাকে।

এটিও রবীন্দ্রনাথের ছড়া (ছড়া-১)। প্রতি পঙ্‌ক্তিতে ৪ মাত্রার ৩টি মূল পর্ব ও ২ মাত্রার ১টি অতিপর্ব রয়েছে।

৫৬।

ছেঁড়া মেঘের/ আলো পড়ে/
----------------দেউলচূড়ার/ ত্রিশূলে;
কলুবুড়ি/ শাকসবজি/
----------------তুলেছে পাঁচ/মিশুলে।
চাষী খেতের/ সীমানা দেয়/
----------------উঁচু করে/ আল তুলে;
নদীতে জল/ কানায় কানায়,/
----------------ডিঙি চলে/ পাল তুলে।

(রবীন্দ্রনাথ, ছড়া-৫)


৫৭।

ছেঁড়া মেঘের=ছেঁ+ড়া মে+ঘের=৪ মাত্রা
আলো পড়ে=আ+লো প+ড়ে=৪ মাত্রা
দেউলচূড়ার=দে+উল+চূ+ড়ার=৪ মাত্রা
ত্রিশূলে=ত্রি+শূ+লে=৩ মাত্রা

প্রতিটি বড়ো পঙ্‌ক্তিতে ৪ মাত্রার ২টি পর্ব এবং ছোটো পঙ্‌ক্তিতে যথাক্রমে ৪ ও ৩ মাত্রার ২টি পর্ব।

৫৮।

তালগাছ-------এক পায়ে/ দাঁড়িয়ে/
-----------------সব গাছ/ ছাড়িয়ে
-----------------------উঁকি মারে/ আকাশে।
মনে সাধ,------কালো মেঘ/ ফুঁড়ে যায়
-----------------একেবারে/ উড়ে যায় ;
-----------------------কোথা পাবে/ পাখা সে?
(তালগাছ, রবীন্দ্রনাথ)

‘তালগাছ’ (২ মাত্রা) ও ‘মনে সাধ’ (৩ মাত্রা) উপপর্ব।

এক পায়ে= এক+পা+য়ে=৩ মাত্রা
দাঁড়িয়ে=দাঁ+ড়ি+য়ে=৩ মাত্রা
সব গাছ= সব+গাছ=২ মাত্রা
ছাড়িয়ে=ছা+ড়ি+য়ে=৩ মাত্রা
উঁকি মারে=উঁ+কি+মা+রে=৪ মাত্রা
আকাশে=আ+কা+শে=৩ মাত্রা
কালো মেঘ=কা+লো+মেঘ=৩ মাত্রা
ফুঁড়ে যায়=ফুঁ+ড়ে+যায়=৩ মাত্রা
একেবারে=এ+কে+বা+রে=৪ মাত্রা
উড়ে যায়=উ+ড়ে+যায়=৩ মাত্রা
কোথা পাবে=কো+থা+পা+বে=৪ মাত্রা
পাখাসে=পা+খা+সে=৩ মাত্রা

৫৯।

থাকবো নাকো/ বদ্ধ ঘরে/ দেখবো এবার/ জগতটাকে
কেমন করে/ ঘুরছে মানুষ/ যুগান্তরের/ ঘূর্ণিপাকে
দেশ হতে দেশ/ দেশান্তরে
ঘুরছে তারা/ কেমন করে
কিসের নেশায়/ কেমন করে/ মরছে যে বীর/ লাখে লাখে,
কিসের আশায়/ করছে তারা/ বরণ মরণ/-যন্ত্রণাকে।

কেমন করে/ বীর ডুবুরি/ সিন্ধু সেঁচে/ মুক্তা আনে,
কেমন করে/ দুঃসাহসী/ চলছে উড়ে/ স্বর্গপানে।
জাপটে ধরে/ ঢেউয়ের ঝুঁটি
যুদ্ধ-জাহাজ/ চলছে ছুটি,
কেমন করে/ আনছে মানিক/ বোঝাই করে/ সিন্ধু-যানে,
কেমন জোরে/ টানলে সাগর/ উথলে ওঠে/ জোয়ার-বানে।

নজরুলের ‘সংকল্প’ শীর্ষক এ ছড়াটিতে প্রতি বড়ো পঙ্‌ক্তিতে ৪ মাত্রার ৪টি পর্ব এবং ছোটো পঙ্‌ক্তিতে ৪ মাত্রার ২টি পর্ব রয়েছে।

৬০।

ছিপখান তিন দাঁড়
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিনভর
দেয় দৌড় পাল্লা

এটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়া। প্রতি পর্বে ৪ মাত্রা বিদ্যমান।

৬১।

এই এক গাঁও/ ঐ এক গাঁও/ মধ্যে ধু-ধু/ মাঠ
ধান-কাউনের/ লিখন লিখি/ করছে শুধু/ পাঠ

জসীমউদ্‌দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ থেকে উদ্ধৃত অংশে প্রতি পঙ্‌ক্তির প্রথম ২ পর্বে ৩ মাত্রা, ৩য় পর্বে ৪ মাত্রা এবং অতিপর্বে ১ মাত্রা আছে।

এই (১)+এক (১)+গাঁও (১)= ৩ মাত্রা।
মধ্যে ধু-ধু= মধ্‌+এ ধু+ধু=৪ মাত্রা
ধান(১)+কাউ(১)+নের(১)=৩ মাত্রা

৬২।

“যখন ওরা অপিশে যায় কিংবা চালায়
তুমুল দোকানদারি
তখন আমি ঢেউ সাজানো নদীর বুকে
দিব্যি জমাই পাড়ি।
(যখন ওরা/শামসুর রাহমান)

পর্ববিন্যাস:

যখন ওরা/ আপিশে যায়/ কিংবা চালায়/
তুমুল দোকান/ দারি
তখন আমি/ ঢেউ সাজানো/ নদীর বুকে/
দিব্যি জমাই/ পাড়ি।

মাত্রাবিন্যাস:
৪+৪+৪
৪+২

এখানে ৪ মাত্রার ৪টি পর্ব এবং ২ মাত্রার ১টি অতিপর্ব দিয়ে পঙ্‌ক্তি গঠিত হয়েছে। সাথে সাথে লক্ষণীয় যে শামসুর রাহমান একটি পঙ্‌ক্তি ভেঙে দু’টি লাইন করেছেন। কিন্তু পর্বসংখ্যা প্রতি দুই-দুই লাইনে সমান রেখেছেন। ইচ্ছে করলে প্রথম উদাহরণের কবিতাটিও একই ভাবে ভেঙে দেয়া যায়। যেমন,

৬৩।

মামার বাড়ি আর যাবো না
আর খাবো না মামীর গাল,
কথায় কথায় পড়বে না আর
আমার পিঠে অমন তাল।

এই নতুন আঙ্গিকে কবিতাটির কাঠামো দাঁড়াবে:

৪+৪
৪+৩

প্রতি দুই লাইনে পর্ব সংখ্যা সমান রাখা হয়েছে।

৬৪।

মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে
মেঘের মতো পাল উড়িয়ে কী ভাসে!
(ভর দুপুরে/আল মাহমুদ)

পর্ববিন্যাস:

মেঘনা নদীর/ শান্ত মেয়ে/ তিতাসে
মেঘের মতো/ পাল উড়িয়ে/ কী ভাসে!

মাত্রাবিন্যাস:৪+৪+৩

অর্থাৎ এই কবিতায় কবি প্রতি লাইনে ৪ মাত্রার দু’টি পর্ব এবং ৩ মাত্রার একটি অতিপর্ব রেখেছেন।” (হাসানআল আব্দুল্লাহ)

৬৫।

মা কেঁদে কয়/মঞ্জুলী মোর/ঐ তো কচি/ মেয়ে ৪+৪+৪+২
ওরি সঙ্গে/বিয়ে দিবে/বয়সে ওর/ চেয়ে ৪+৪+৪+২
পাঁচ গুণো সে /বড় ৪+২
তাকে দেখে/বাছা আমার/ভয়েই জড়/সড়। ৪+৪+৪+২

৬৬।

পক্ষীরাজের/ খেয়াল হল/ ঘাস খাবে ৪+৪+৩
স্বর্গে কোথায়/ ঘাস পাবে? ৪+৩
একদিন সে/ ইন্দ্র রাজার/ সুখের দেশ ৪+৪+৩
শূন্য করে/ নিরুদ্দেশ ৪+৩

“উপরের উদাহরণগুলি (অনুঃ ৬৫ ও ৬৬) থেকে দেখা যায় সব ক্ষেত্রেই প্রতিটি মূল পর্বে ৪ মাত্রা এসেছে। তাহলে কি বলা যায়, স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতিটি মূল পর্বে মাত্রাসংখ্যা ৪-এ সীমাবদ্ধ থাকে? তাৎক্ষণিক উত্তর হ্যাঁ-সূচক।

৬৭। তবে স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতার পর্বকে আরো এক প্রকার মাত্রার সমন্বয়ে গঠন করা যায়। সেটি হলো ৭ মাত্রার মন্দাক্রান্তা ছন্দ’ বা সংক্ষেপে মন্তাক্রান্তা ছন্দ। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কৃত ধাঁচের এই বুনন সম্ভব। নাম থেকেই বোঝা যায় পর্বে মাত্রা সংখ্যা থাকবে ৭টি।

৬৮। উদাহরণ:

বাবুদের তাল পুকুরে
হাবুদের ডাল কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া
বলি থাম একটু দাঁড়া।
(লিচু চোর/ কাজী নজরুল ইসলাম)

এখানে প্রতিটি লাইন ৭ মাত্রার একটি মাত্র পর্ব দিয়ে গঠিত। আবার অন্যভাবে বলা যায় যে, প্রথমে ৩ এবং পরে ৪ মাত্রার দু’টি পর্ব দিয়ে লাইন গঠিত হয়েছে।

৬৯। একই ছন্দে রচিত অন্য একটি কবিতার (গান) কথা বিবেচনা করা যায়,

আগুনের পরশমণি/ ছোঁয়াও প্রাণে,
এ জীবন পূণ্য করো/ দহন-দানে।
আমার এই দেহখানি/ তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের/ প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোকশিখা/ জ্বলুক গানে।
(পরশমণি/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

লক্ষণীয়, প্রতিটি লাইনের প্রথমে ৭ মাত্রার একটি পর্ব ও শেষে ৪ মাত্রার একটি অতিপর্ব এসেছে।

এই বুননে কবিতাটির কাঠামো দাঁড়ায় :
৭+৪
৭+৪

তবে কেউ হয়তো বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায় ৩ মাত্রার উপপর্ব রেখে ৪ মাত্রার পর্ব গঠন করেছেন। সেক্ষেত্রে মাত্রা বিন্যাস হবে নিম্নরূপ:

আগুনের পরশমণি/ ছোঁয়াও প্রাণে,/
এ জীবন পূণ্য করো/ দহন-দানে।/
আমার এই দেহখানি/ তুলে ধরো,/
তোমার ওই দেবালয়ের/ প্রদীপ করো/
নিশিদিন আলোকশিখা/ জ্বলুক গানে।/

মাত্রাবিন্যাস:

৩+৪+৪
৩+৪+৪

লক্ষণীয়, যে ভাবেই পড়া হোক না কেনো, কবিতার চাল প্রথম পর্বকে ৭ মাত্রায় টেনে নিয়ে যায়।” (হাসানআল আব্দুল্লাহ)

৭০।

যেদিন আমি/ হারিয়ে যাব,/ বুঝবে সেদিন/ বুঝবে
অস্তপারের/ সন্ধ্যাতারায়/ আমার খবর/ পুঁছবে
বুঝবে সেদিন/ বুঝবে।
ছবি আমার/ বুকে বেঁধে
পাগল হয়ে/ কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু/ কানন গিরি
সাগর আকাশ/ বাতাশ চিরি
সেদিন আমায়/ খুঁজবে
বুঝবে সেদিন/ বুঝবে।

(অভিশাপ/কাজী নজরুল ইসলাম)

৭১।

মা মণিটার/ চোখ এড়িয়ে
গলির মোড়ের/ পুল পেরিয়ে
রোদের সাথে/ বুক মিলিয়ে
পাখ্‌না-ভরা/ রঙ বিলিয়ে
এখান থেকে/ অনেক দূরে
যদি আমি/ যেতাম উড়ে
প্রজাপতির/ মতো,
কেমন মজা/ হতো?

পাড়ার সবাই/ গোল থামালে,
বাবা বইয়ে/ চোখ নামালে
দুপটি করে/ ঘোর আঁধারে
যেতাম যদি/ বনবাদাড়ে
রাতটা হলে/ বেজায় কালো,
যদি আমি/ দিতাম আলো
জোনাক পোকার/ মতো,
কেমন মজা/ হতো?

রাতদুপুরে/ ঘুম পালালে,
তারার রাণী/ দীপ জ্বালালে,
দরজা খুলে/ এক নিমেষে
যেতাম ছুটে/ দেশ-বিদেশে,
যেতাম যদি/ ঘোড়ায় চড়ে
টগ্‌বগিয়ে/ তেপান্তরে
লাল কমলের/ মতো,
কেমন মজা/ হতো?

(যদি আমি/শামসুর রাহমান)


মাত্রাবৃত্ত ছন্দ

৭২। মূল পর্ব ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রার হয়। এই ছন্দে বদ্ধস্বর ২ মাত্রা এবং মুক্তস্বর ১ মাত্রা হিসাবে গণনা করা হয়। অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা, আর অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, এমনকি ‘য়’ থাকলেও, ২ মাত্রা ধরা হয়।

৭৩। “মাত্রাবৃত্তে যুক্তাক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিতে হবে, অর্থাৎ ২ মাত্রা দিতে হবে। অনেকেই তাই মাত্রাবৃত্তকে ‘যুক্তাক্ষর ভাঙা ছন্দ’ বলে অভিহিত করেন। ‘কষ্ট ’ শব্দটি অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা, কিন্তু মাত্রাবৃত্তে ভেঙে গিয়ে হবে ‘ক ষ্ ট’ – ৩ মাত্রা। ‘অক্ষর’ শব্দটিতে অক্ষরবৃত্তে ৩ মাত্রা আর মাত্রাবৃতে ৪ মাত্রা। ‘ছন্দ’ অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা, আর মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা (ছ ন্ দ )।” (সরদার ফারুক)

৭৪। অক্ষর=অক্‌+খর (ষর)=১+২=৩ মাত্রা (অক্‌ বদ্ধস্বর শব্দের শুরুতে থাকায় ১ মাত্রা। খর বদ্ধস্বর শব্দের শেষে থাকায় ২ মাত্রা)। এটা হলো অক্ষরবৃত্তের হিসাব। এখানে অক্‌ এবং খর ২টি বদ্ধস্বর; মাত্রাবৃত্তে বদ্ধস্বর ২ মাত্রা বহন করে। অতএব মাত্রাবৃত্তের হিসাবে অক্ষর শব্দে ৪ মাত্রা আছে।

৭৫। “তবে এখানেও একটা ব্যতিক্রম মনে রাখতে হবে। তা হচ্ছে শব্দের প্রথমে কোন যুক্তাক্ষর থাকলে সেটা ভাঙা সম্ভব নয়, সে কারণে মাত্রাবৃত্তেও সে ১ মাত্রাই পাবে। ধরুন ‘স্থাপন’ শব্দটি। এটি কিন্তু অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত দুই ছন্দেই ৩ মাত্রা পাবে। কারণ শব্দের শুরুতেই যুক্তাক্ষর স্থা-কে ভাঙা সম্ভব না।

৭৬। তাহলে সোজা কথায় আমরা জানলাম- শব্দের মাঝখানে অথবা শেষের যুক্তাক্ষরকে আমরা মাত্রাবৃত্তে ২ মাত্রার মর্যাদা দেব, আবারও বলি শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে ১ মাত্রা-ই দেব।

৭৭। রবীন্দ্রনাথই এই ছন্দের স্রষ্টা। ‘মানসী’ পর্বের কবিতা থেকেই এই ছন্দের সূচনা। ‘মানসী’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।” বোঝাই যায়, এখানে পূর্ণ মূল্য বলতে ২ মাত্রার মূল্য।

৭৮। যুক্তাক্ষরের বাড়তি বোঝা নিয়ে অক্ষরবৃত্ত যদি হাতির চালে চলে, মাত্রাবৃত্ত চলে তেজী ঘোড়ার মতো।” (সরদার ফারুক)

৭৯। “মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বাংলা কাব্যে ব্যবহৃত অন্যতম প্রাচীন ছন্দ। অক্ষরবৃত্তের প্রভাব থেকে রবীন্দ্রনাথ একে মুক্ত করে এতে এক নতুন রীতি প্রবর্তন করেন, যে কারণে মাত্রাবৃত্তকে কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথেরই সৃষ্টি বলে মনে করেন। এ ছন্দ চর্যাপদে প্রথম লক্ষিত হয়। মূলত মাত্রাবৃত্ত একটি সর্বভারতীয় ছন্দ এবং সংস্কৃত ও প্রাকৃতের সময় থেকেই এটি ভারতবর্ষে প্রচলিত। বাংলা ভাষায় এটি প্রবেশ করেছে প্রাকৃত ও অপভ্রংশ কবিতা এবং সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দম্-এর মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছেন যে, এ ছন্দের সৃষ্টি হয়েছে সংস্কৃত ছন্দকে বাংলায় ভেঙে নিয়ে।

৮০। অন্যান্য বাংলা ছন্দের তুলনায় মাত্রাবৃত্ত একটি দুর্বল ছন্দ; কেননা পর্বদৈর্ঘ্য অনুযায়ী ৪, ৫, ৬ বা ৭ মাত্রার এ ছন্দে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল উচ্চারণভঙ্গি ফুটে ওঠে এবং এতে শক্তি বা সুরের স্বাভাবিক প্রকাশ না হয়ে কেবল মাত্রারই প্রাধান্য প্রতিফলিত হয়। এজন্যই এ ছন্দকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বলা হয়।

৮১। বাংলা সাহিত্যে এ ছন্দকে ধ্বনিপ্রধান, বিস্তারপ্রধান, সরল কলামাত্রিক ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।

৮২। চর্যাপদে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রথম প্রকাশ পরিলক্ষিত হলেও সেখানে তা একেবারেই সাধারণ ও প্রাথমিক পর্যায়ের। এতে কেবল ৪ মাত্রার পর্বই ব্যবহৃত হয়েছে; ৫,৬ বা ৭ মাত্রার পর্ব অনুপস্থিত। আবার পর্বের দৈর্ঘ্য পূরণের জন্য যেহেতু চর্যাপদের মাত্রাবৃত্ত ছন্দে স্বরান্ত অক্ষরকেও ২ মাত্রায় প্রসারিত করা হয়েছে, সেজন্য এ ছন্দকে স্বরপ্রসারক মাত্রাবৃত্তও বলা হয়। যেমন:

কা-আ-/ তরুবর/ পঞ্চ বি/ ডা-ল-।
চঞ্চল/ চী-এ-/ পইঠো-/ কা-ল- [পদ-১]

৮৩। চর্যাপদের পরে ব্রজবুলিতে রচিত বিভিন্ন বৈষ্ণবপদে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। চর্যাপদের বিভিন্ন পদে এ ছন্দের যে সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতা ছিল, তা যেমন ব্রজবুলির ছন্দে বিদূরিত হয়েছে, তেমনি এতে চারমাত্রার পর্বের পাশাপাশি ৫, ৬ ও ৭ মাত্রার পর্বেরও বহুল প্রয়োগ লক্ষণীয়। গোবিন্দদাস, বলরামদাস, শশিশেখর প্রমুখ বৈষ্ণব কবির বিভিন্ন পদে এ ধরনের সার্থক প্রয়োগবৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া চরণশেষে খণ্ডপর্বের ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমেও ব্রজবুলির বিভিন্ন পদ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে একই সঙ্গে বৈচিত্র্য ও সার্থকতা আনয়ন করেছে।

৮৪। ব্রজবুলির পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত কালপরিসরে ব্যাপক মাত্রায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কাব্য সৃষ্টি হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম এ ছন্দে নতুনত্ব আনেন। তিনি তাঁর ‘মানসী’ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে হলন্ত অক্ষরকে দ্বিমাত্রিক হিসেব করে যেমন এক বিশিষ্ট রীতি উদ্ভাবন করেন, তেমনি অক্ষরবৃত্তের প্রভাব থেকে মাত্রাবৃত্তকে উদ্ধার করে এর স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন। তাঁর পূর্বে সকল কবিই লঘু ত্রিপদী, লঘু চৌপদী, একাবলী প্রভৃতি ছয় মাত্রার ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত বলে প্রতিপন্ন করলেও রবীন্দ্রনাথই প্রথম নিশ্চিত করেন যে, ধ্বনিধর্মে এগুলি মাত্রাবৃত্ত ছন্দোভুক্ত। ছন্দের ক্ষেত্রে এটি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ অবদান।” (ছন্দ, বাংলাপিডিয়া)

৮৫। কিছু উদাহরণ দেখা যাক।

তুমি যাবে ভাই/যাবে মোর সাথে/আমাদের ছোটো/গাঁয়,
গাছের ছায়ায়/লতায় পাতায়/উদাসী বনের/বায়;
মায়া মমতায়/জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি/রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে/বোনের আদরে/ভাইয়ের স্নেহের/ছায়,
তুমি যাবে ভাই/যাবে মোর সাথে/আমাদের ছোটো/গাঁয়?

উদ্ধৃত ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার প্রতি বড়ো পঙ্‌ক্তিতে ৬ মাত্রার ৩টি পর্ব এবং ২ মাত্রার একটি অতিপর্ব আছে। ছোটো পঙ্‌ক্তিতে ৬ মাত্রার ২টি পর্ব আছে। ব্যতিক্রম- ৫ম পঙ্‌ক্তিতে '‘ভাইয়ের স্নেহের’ পর্বে ‘ভাই’ বদ্ধস্বরটিকে ১ মাত্রা ধরা হয়েছে-ভাই(১)+য়ের(২)+স্নে(১)+হের(২)। ‘য়ের’ ও ‘হের’ বদ্ধস্বর, অতএব প্রতিটি ২ মাত্রা করে হবে। স্মর্তব্য, মাত্রাবৃত্তে ৪,৫, ৬ ও ৭ মাত্রা পর্যন্ত হতে পারে।

৮৬।

শুধু বিঘে দুই/ছিল মোর ভুঁই/আর সবই গেছে/ঋণে।
বাবু বলিলেন/'বুঝেছ উপেন?/এ জমি লইব/কিনে।'
কহিলাম আমি/'তুমি ভূস্বামী/ভূমির অন্ত/নাই
চেয়ে দেখো মোর/আছে বড়োজোর/মরিবার মতো/ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে/'বাপু, জানো তো হে/করেছি বাগান/খানা,
পেলে দুই বিঘে/প্রস্থে ও দিঘে/সমান হইবে/টানা
ওটা দিতে হবে।'/কহিলাম তবে/বক্ষে জুড়িয়া/পাণি
সজল চক্ষে,/'করুন রক্ষে/গরিবের ভিটে/খানি।
সপ্তপুরুষ/যেথায় মানুষ/সে মাটি সোনার/বাড়া,
দৈন্যের দায়ে/বেচিব সে মায়ে/এমনি লক্ষ্মী/ছাড়া!'

রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘে জমি’টিতেও প্রতি পঙ্‌ক্তিতে ৬ মাত্রার ৩টি পর্ব এবং ২ মাত্রার একটি অতিপর্ব রয়েছে।

তুমি ভূস্বামী=তু+মি ভূস্‌+সা+মী=৬। ‘ভূস্’ বদ্ধস্বর হওয়ায় ২ মাত্রা।
ভূমির অন্ত=ভূ+মির অন্‌+ত=৬ মাত্রা। ‘মির’ ও ‘অন্’ বদ্ধস্বর হওয়ায় প্রতিটি ২ মাত্রা হচ্ছে।

সপ্তপুরুষ=সপ্‌+ত+পু+রুষ=৬ মাত্রা
বক্ষে=বক্‌+খে (বক্‌+ষে)=৩ মাত্রা
যেথায়=যে+থায়=৩ মাত্রা
দৈন্যের=দৈন্‌+নের=৪ মাত্রা
দায়ে=দা+য়ে=২ মাত্রা
লক্ষ্মী=লক্‌+খী (লক্‌+ষ্মী)=৩ মাত্রা

৮৭।

স্বাধীনতা তুমি/
রবিঠাকুরের/অজর কবিতা,/ অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি/
কাজী নজরুল/ ঝাঁকড়া চুলের/ বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ,/ সৃষ্টিসুখের/ উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি/
শহীদ মিনারে/ অমর একুশে/ ফেব্রুয়ারির/ উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি/
পতাকা-শোভিত/ শ্লোগানমুখর/ ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি/
ফসলের মাঠে/ কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি/
রোদেলা দুপুরে/ মধ্যপুকুরে/ গ্রাম্য মেয়ের/ অবাধ সাঁতার।

এ কবিতায় প্রতি পর্বে ৬টি করে মাত্রা আছে। তবে, প্রতি পঙ্‌ক্তির পর্বসংখ্যা সমান নয়।

সৃষ্টিসুখের=সৃষ্‌+টি+সু+খের=৬ মাত্রা। ‘সৃষ্’ ও ‘খের’ বদ্ধস্বর হওয়ায় প্রতিটি ২ মাত্রা করে হবে।

উল্লাসে কাঁপা=উল্‌+লাসে কাঁ+পা=৬ মাত্রা
ফেব্রুয়ারির=ফেব্‌+রু+য়া+রির=৬ মাত্রা
গ্রাম্য মেয়ের=গ্রাম+ম (য) মে+য়ের=৬ মাত্রা
শ্লোগানমুখর=শ্লো+গান+মু+খর=৬ মাত্রা

৮৮।

আজ / সৃষ্টি সুখের/ উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে/ মোর চোখ হাসে/ মোর/ টগবগিয়ে/ খুন হাসে
আজ / সৃষ্টি-সুখের/ উল্লাসে।

আজকে আমার/ রুদ্ধ প্রাণের/ পল্ললে–
বান ডেকে ঐ/ জাগল জোয়ার/ দুয়ার-ভাঙা/ কল্লোলে।
আসল হাসি,/ আসল কাঁদন
মুক্তি এলো,/ আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ/ বুক ফাটে মোর/ তিক্ত দুখের/ সুখ আসে।
ঐ/ রিক্ত বুকের/ দুখ আসে –
আজ /সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

১ম পঙ্‌ক্তিতে ২ মাত্রার ‘আজ’ শব্দটি ১টি উপপর্ব। নজরুলের কবিতায় উপপর্বের ব্যবহার অনেক বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে ‘অগ্নিবীণা’র কবিতাগুলোতে।

সৃষ্টি সুখের= সৃষ্‌+টি সু+খের=২+১+১+২=৬ মাত্রা
উল্লাসে=উল্‌+লা+সে=৪ মাত্রা

২য় পঙ্‌ক্তির পর্ববিভাজন এভাবেও করা যেতে পারেঃ

মোর/ মুখ হাসে/ মোর/ চোখ হাসে/ মোর/ টগবগিয়ে/ খুন হাসে। কারণ, পাঠ বা আবৃত্তির জন্য পাঠক এভাবেই বিরতি দিয়ে পড়বেন। সেই হিসাবে ২ মাত্রার ‘মোর’ শব্দটি উপপর্ব হিসাবে বিবেচিত হবে।

৮৯।

বল বীর–
বল/ উন্নত মম শির!(বল-উপপর্ব)
শির নেহারি/ আমারি, নত-শির/ ওই/ শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর–
বল/ মহাবিশ্বের/ মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য্য/ গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক/ গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন/ ‘আরশ” ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-/বিস্ময় আমি/ বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম/ ললাটে রুদ্র-/ভগবান জ্বলে/ রাজ-রাজটীকা/ দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর–
আমি/ চির-উন্নত শির!

বল বীর= ব+ল+বীর=৪ মাত্রা
উন্নত মম শির=উন+ন+ত+ম+ম+শির=৮ মাত্রা
শির নেহারি=শির+নে+হা+রি=৫ মাত্রা
আমারি নতশির=আ+মা+রি+ন+ত+শির=৭ মাত্রা
ওই=মাঝখানে ২ মাত্রার উপপর্ব
শিখর হিমাদ্রীর=শি+খর+হি+মাদ্‌+রির=৮ মাত্রা
মহাবিশ্বের=ম+হা+বিশ্‌+শের=৬ মাত্রা
দীপ্ত জয়শ্রীর=দীপ্‌+ত+জ+য়শ্‌+রীর=৮ মাত্রা

৯০। ৮ মাত্রার পর্ব থাকলে সেটা আর মাত্রাবৃত্ত ছন্দ থাকে না, অক্ষরবৃত্ত হয়ে যায়। আমার কাছে ‘বিদ্রোহী’ একটি আশ্চর্য ছন্দের কবিতা। মাত্রাবৃত্তের নিয়মানুযায়ী হিসাব করলে এখানে কোনো কোনো পর্ব ৮ মাত্রায় উন্নীত হয়ে যায়; আবার অক্ষরবৃত্তের নিয়মে হিসাব করলে উদ্ধৃত অংশে কোনো ৮ মাত্রার পর্ব পাওয়া যাবে না।

৯১। সন্দেহ দূর করার জন্য বিষয়টি এখানেই খোলসা করা হচ্ছে। অক্ষরবৃত্তে মুক্তস্বর সর্বদাই এক মাত্রা হবে; বদ্ধস্বর যদি শব্দের শেষে থাকে তাহলে ২ মাত্রা, আর শব্দের শুরুতে বা মাঝখানে থাকলে ১ মাত্রা ধরা হবে; স্মরণ করুন, দুই বর্ণ বিশিষ্ট শব্দ যদি বদ্ধস্বর হয়, তবে তা ২ মাত্রা হবে। এবার, এ নিয়ম মোতাবেক ‘বিদ্রোহী’র উদ্ধৃতাংশ আবার হিসাব করা যাক।

উন্নত মম শির=উন+ন+ত (৩ মাত্রা, ‘উন’ শব্দের শুরুতে থাকায় ১ মাত্রা) ম+ম+শির=৪ মাত্রা। অতএব, এ পর্বে ৩+৪=৭ মাত্রা আছে
শির নেহারি=শির+নে+হা+রি=৫ মাত্রা
আমারি নতশির=আ+মা+রি+ন+ত+শির=৭ মাত্রা
ওই=মাঝখানে ২ মাত্রার উপপর্ব
শিখর হিমাদ্রীর=শি+খর+হি+মাদ্ (‘মাদ্’ ১ মাত্রা, শব্দের মাঝখানে থাকায়)+রির=৬ মাত্রা
মহাবিশ্বের=ম+হা+বিশ্ (বিশ্‌ ১ মাত্রা, শব্দের মাঝখানে হওয়ায়)+শের=৫ মাত্রা
দীপ্ত জয়শ্রীর=দীপ্‌+ত+জ+য়শ্ (য়শ্‌ ১ মাত্রা, শব্দের মাঝখানে হওয়ায়)+রীর=৭ মাত্রা

৯২। আশ্চর্য ঘটনাটি হলো, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ হিসাবে বিবেচনা করলে মাত্রা গণনার পর কোনো ৮ মাত্রার পর্ব পাওয়া যাচ্ছে না; আর ৮ মাত্রার পর্ব না থাকলে সেটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দ হবে না। অন্যদিকে, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ হিসাবে মাত্রা গণনা করলে কোনো কোনো পর্বে ৮ মাত্রাও পাওয়া যাচ্ছে। অথচ, মাত্রাসংখ্যা ৮ হলে সেটি আর মাত্রাবৃত্ত ছন্দ থাকে না, হয়ে যায় অক্ষরবৃত্ত। এজন্যই এ কবিতাটিকে আমার কাছে খুব আশ্চর্য ছন্দের কবিতা মনে হচ্ছে।

৯৩। উপপর্ব, পর্ব ও অতিপর্বের মাত্রাসংখ্যা সমান থাকে না, কিংবা সমান রাখার বাধ্যবাধকতাও নেই। কিন্তু, উপপর্ব বা অতিপর্বের মাত্রাসংখ্যা বাড়িয়ে-কমিয়ে যদি পর্বের মাত্রাসংখ্যার সমান করা হয়, তাহলে কোনো উপপর্ব বা অতিপর্বের অস্তিত্ব থাকবে না, ওগুলোও মূল পর্ব হয়ে যাবে।

৯৪। আরো কিছু উদাহরণ দেখুন।

৬ মাত্রার পর্ব এবং ৪ মাত্রার অতিপর্ব:

“কবি বন্ধুরা/ হতাশ হইয়া/ মোর লেখা পড়ে/ শ্বাস ফেলে
বলে কেজো ক্রমে/ হচ্ছে অকেজো/ পলি টিক্সের/ পাশ ঠেলে।
(আমার কৈফিয়ৎ/ কাজী নজরুল ইসলাম)

মাত্রাসংখ্যা=৬+৬+৬+৪

ছয় মাত্রার পর্ব এবং তিন মাত্রার অতিপর্ব:

৯৫।

সই পাতালো কি/ শরতে আজিকে/স্নিগ্ধ আকাশ/ ধরণী?
নীলিমা বহিয়া/ সওগাত নিয়া/ নমিছে মেঘের/ তরণী !
(রাখী বন্ধন/ কাজী নজরুল ইসলাম)

মাত্রাসংখ্যা=৬+৬+৬+৩

৯৬।

দুর্গম গিরি/ কান্তার মরু/ দুস্তর পারো/ বার
লঙ্ঘিতে হবে/ রাত্রি নিশিতে/ যাত্রীরা হুশি/ য়ার।
(কাণ্ডারী হুশিয়ার/ কাজী নজরুল ইসলাম)

মাত্রাসংখ্যা=৬+৬+৬+২

৯৭।

সব কবিতায়ই যে অতিপর্ব থাকবে, তা নয়। অতিপর্বের মাত্রাসংখ্যা বেড়ে মূল পর্বের সমান হয়ে যাওয়ায় অতিপর্ব লোপ পেয়েছে। দেখুন নীচে, পাঁচ মাত্রার পর্ব কিন্তু অতিপর্ব নেই:

তোমারে পাছে/ সহজে বুঝি/ তাই কি এতো/ লীলার ছল
বাহিরে যবে/ হাসির ছটা/ ভিতরে থাকে/ আখির জল।
(ছল/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

মাত্রাসংখ্যা=৫+৫+৫+৫

৯৮।

তখনো ছিলো/ অন্ধকার/ তখনো ছিলো/ বেলা
হৃদয় পুরে/ জটিলতার/ চলিতেছিলো/ খেলা
ডুবিয়াছিলো/ নদীর ধার/ আকাশে আধো/ লীন
সুষমাময়ী/ চন্দ্রমার/ নয়ান ক্ষমা/ হীন
(হৃদয়পুর/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

মাত্রা=৫+৫+৫+২

৯৯। ৭ মাত্রার দুই পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:

তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়/
লুটিয়ে দিতে পারি/ পিতার তরবারি/
বাগান জোত জমি/ সহজে সস্তায়/
তোমার মুখ আঁকা/ একটি দস্তায়;/
(শোণিতে সৌরভ/ আল মাহমুদ)

মাত্রা=৭+৭

১০০। সাত মাত্রার তিন পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:

উগ্র ঢাল, তার/ তীক্ষ্ণ শরমুখ/ রঙিন, কোপনীয়/
রেখেছে সঞ্চিত/ যা-কিছু মায়াময়,/ মধুর, গোপনীয়
(সুন্দর জাহাজ/ অনুবাদ- বুদ্ধদেব বসু)

মাত্রা=৭+৭+৭

১০১। সাত মাত্রার চার পর্ব বিশিষ্ট কবিতা:

অন্ধ রেল গাড়ি/ বধির রেলগাড়ি/ অন্ধ রেল বেয়ে/ চলছে দ্রুত বেগে/
দু-চোখে মরা ঘুম/ আকাশে মরা মেঘ/ সঙ্গে মরা চাঁদ/ অন্ধ আছি জেগে/
অন্ধ বগিগুলো/ ক্লান্ত হয়ে গেছে/ এগিয়ে চলে তবু/ অন্ধ প্রতিযোগী/
চলছে ট্রাগ বেয়ে/ জানে না কোথা যাবে/ নষ্ট রেলগাড়ি/ অন্ধদূর বোগী।/
(অন্ধ রেলগাড়ি / হুমায়ুন আজাদ)

মাত্রা=৭+৭+৭+৭

১০২। সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার অতিপর্ব ব্যবহার:

ফসল অন্যের,/ তোমার শুধু
অন্য কোনো দূর/ অরণ্যের
পন্থহীনতায়/ স্বপ্নে কেঁপে ওঠা/
কোন অসম্ভব/ আকাঙ্ক্ষায়।
(অসম্ভবের গান/বুদ্ধদেব বসু)

মাত্রা=
৭+৫
৭+৫
৭+৭
৭+৬

উপরের চার লাইনে অতিপর্বে কোথাও পাঁচ কোথাও ছয় মাত্রা রাখা হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় লাইনে কোনো অতিপর্ব নেই। ফলে, তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন মিলে একটি পঙ্‌ক্তি তৈরি করেছে।

১০৩।

নিমেষে ভুলি সাধ/ অতল মোহে।
মোহিনী ও-মুখের/ মিথ্যা বুলি
সত্য সার ভাবি,/ এবং আমি
ধারি না ধার কোনো/ মহোদয়ের।
(কবর খোড়ার গান/শামসুর রাহমান)

মাত্রা=
৭+৫
৭+৫

১০৪। নীচের কবিতাটিতে ৪ মাত্রার অতিপর্ব রাখা হয়েছে।

যেখানে লেজবস/ প্রণয় ঝর্ণায়/ উলঙ্গ
শান্ত বয়ে যায়/ গভীর শেষমেশ/ সমুদ্রে
ভাসিয়ে প্রান্তর/ যায় সে আঁকাবাঁকা/ খলখল
ঝঞ্ঝা গোপনীয়,/ দেবতা ভূমিতলে/ অসংখ্য
যেখানে লেজবস/ প্রণয় ঝর্ণায়/ উলঙ্গ।
(লেসবস/অনু: হাসানআল আব্দুল্লাহ)

মাত্রা=
৭+৭+৪
৭+৭+৪

বোদলেয়ার রচিত এই কবিতাটি অনুবাদে অতিপর্বে চার মাত্রা রাখা হয়েছে। দুটি করে পর্ব দিয়ে কবিতার লাইন গঠিত।” (হাসানআল আব্দুল্লাহ)


অক্ষরবৃত্ত ছন্দ

১০৫। মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়। মুক্তস্বর, অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা ধরা হয়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধস্বর কখনো ১ মাত্রা এবং কখনো ২ মাত্রা গোনা হয়। বদ্ধস্বরটি, অর্থাৎ, অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জন ধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা, আর শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা গোনা হয়। তবে, দুই বর্ণ বিশিষ্ট শব্দ যদি বদ্ধস্বর হয়, তা ২ মাত্রা বহন করবে।

১০৬। অঘটনঘটনপটিয়সী=অ+ঘ+টন+ঘ+টন+প+টি+য়+সী=৯ মাত্রা। ২টি ‘টন’ শব্দের মাঝখানে থাকায় তা ১ মাত্রা হিসাবে গোনা হয়েছে।

১০৭। পরশপাথর=প+রশ্‌+পা+থর=৫ মাত্রা। ‘রশ্’ মাঝখানে থাকায় ১ মাত্রা; ‘থর’ শব্দের শেষে থাকায় ২ মাত্রা।

১০৮। আকিঞ্চন=আ+কিন্‌+চন=৪ মাত্রা। ‘কিন্’ শব্দের মাঝখানে থাকায় ১ মাত্রা, ‘চন’ শব্দের শেষে থাকায় ২ মাত্রা।

১০৯। সূর্যালোক=সূর্‌+যা+লোক=৪ মাত্রা। ‘সূর’ শব্দের শুরুতে থাকায় ১ মাত্রা; ‘লোক’ শব্দের শেষে থাকায় ২ মাত্রা।

১১০। “অক্ষরবৃত্তে মাত্রা গণনার জন্য বিনয় মজুমদারের সহজ ফর্মুলাঃ ‘বাংলা অক্ষরের উপরে যে মাত্রা দেয়া আছে আমি তাকেই মাত্রা বলি। যথা, ‘অ’ অক্ষরের উপর মাত্রা দেয়া আছে, সুতরাং অ অক্ষরে একটি মাত্রা। ‘ত’ অক্ষরে মাত্রা দেয়া আছে সুতরাং ত অক্ষরে একটি মাত্রা। ‘স্ক’, ‘ল্ল’ ইত্যাদিতেও একটি মাত্রা। অর্থাৎ অক্ষরবৃত্তে যুক্তাক্ষরেও একটিই মাত্রা। ‘ৎ’ তে মাত্রা নেই, তাই ‘উৎফুল্ল’ অক্ষরবৃত্তে ৩ মাত্রা, ‘হঠাৎ’ ২ মাত্রা। তিনটি অক্ষরও যদি যুক্ত থাকে যেমন ‘উজ্জ্বল’ –‘জ্জ্ব’ কে ১ মাত্রা গণনা করে মোট ৩ মাত্রা হবে।’

১১১। এটাই নির্ভুল ও প্রাথমিক নিয়ম। অবশ্য এর পরেও অল্প কিছু ছোটো নিয়ম আছে।

১১২। স্বরবর্ণে ‘এ’ অক্ষরে, ‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই। কিন্তু ‘এ’ অক্ষরে সর্বদাই এক মাত্রা ধরতে হবে, যেমন ‘এসো’ ২ মাত্রা। ‘এখন’ ৩ মাত্রা ।

১১৩। ‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই। তবে অধিকাংশ শব্দেই ‘ও’ অক্ষরে ১ মাত্রা ধরতে হবে। অল্প কয়েকটি শব্দে ‘ও’ অক্ষরে শূন্য মাত্রা। ‘ওঠ’ ২ মাত্রা, কিন্তু ‘হাওয়া, যাওয়া, খাওয়া, চাওয়া (অর্থাৎ, শব্দের শেষে ‘ওয়া’ থাকলে) ‘ও’ শূন্য মাত্রা। এগুলোকে ২ মাত্রা বলেই গণ্য করতে হবে।

১১৪। ব্যঞ্জনবর্ণে প্রকৃত প্রস্তাবে ‘ঙ’ এবং ৎ এই দুটি অক্ষরের উপরে মাত্রা আঁকা হয় না। বাঙ্ময়, কঙ্কাল, অঙ্ক এবং অনুরূপ সব শব্দে ‘ঙ’ অক্ষরের সঙ্গে অন্য অক্ষর যুক্ত হয়ে যুক্তাক্ষর তৈরি হবার ফলে এই যুক্তাক্ষরে ১ মাত্রা। অর্থাৎ ‘কঙ্কাল’ ৩ মাত্রা, ‘অঙ্ক’ ২ মাত্রা।” (সরদার ফারুক)

১১৫। আমরা শুরুতে যা শিখেছি সেই হিসাবে দেখা যাক কঙ্কাল-এ কয় মাত্রা আছে।

কঙ্কাল=কঙ্‌+কাল=১+২। কঙ্‌ বদ্ধস্বর এবং শব্দের শুরুতে হওয়ায় ১ মাত্রা; কাল বদ্ধস্বর এবং শব্দের শেষে হওয়ায় ২ মাত্রা। অতএব, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সব হিসাবেই কঙ্কাল-এ আমরা ৩ মাত্রাই দেখতে পাচ্ছি।

১১৬। “তবে শব্দের শেষে ‘ঙ’ থাকলে ‘ঙ’ অক্ষরে সর্বদাই ১ মাত্রা ধরতে হবে। যেমন- ‘রঙ’ ২ মাত্রা।

১১৭। ‘ৎ’ শব্দের মাঝে থাকলে শূন্যমাত্রা। যেমন ‘উৎপ্রেক্ষা’ ৩ মাত্রা। আবার শব্দের শেষে থাকলে ‘ৎ’ ১ মাত্রা দাবি করে, যেমন ‘প্রদোৎ’ ৩ মাত্রা, ‘হঠাৎ’ ৩ মাত্রা।” (সরদার ফারুক)

১১৮। পুনরাবৃত্তিঃ পর্বে মাত্রা গণনারীতি কোথাও স্বরবৃত্ত, কোথাও আবার মাত্রাবৃত্তের মতো। বদ্ধস্বর যদি শব্দের প্রথম বা মাঝে থাকে, তবে তা ১ মাত্রা, কিন্তু শব্দের শেষে অবস্থান করলে ২ মাত্রা হবে।

১১৯। “অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বাংলা কাব্যের প্রধান ছন্দ। অন্য দুটির তুলনায় এ ছন্দের উচ্চারণ অধিকতর স্বাভাবিক এবং গদ্য উচ্চারণভঙ্গির অনুসারী বলেই এটি বাংলা কাব্যের প্রধান ছন্দে পরিণত হয়েছে।

১২০। অক্ষরবৃত্ত শ্বাসাঘাতপ্রধান নয়, তানপ্রধান ছন্দ। তান হচ্ছে স্বরধ্বনি বা সাধারণ উচ্চারণের অতিরিক্ত টান, যা এ ছন্দে পর্বগত দীর্ঘতার জন্য প্রযুক্ত হয়। ৮/৬ বা ৮/১০ মাত্রার সর্বাধিক দীর্ঘ পর্বে অক্ষরবৃত্ত রচিত হয়। এ ছাড়া মধ্যযুগে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সুর একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। পনেরো শতকে বাংলা সাহিত্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদের কারণেই এতে সুর সংযোজিত হয়। অবশ্য উনিশ শতকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে এ ছন্দের সুরমুক্তি ঘটে। ফলে এ শতক থেকে রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি কাব্যের ‘গান’ ব্যতিরেকে শুধু ‘পাঠ’ প্রচলিত হলেও পর্বগত দীর্ঘতার কারণে তান আজও বজায় আছে।

১২১। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উৎস হিসেবে অনুষ্টুপ্ (বৈদিক), বসন্ততিলক (বৃত্তছন্দ), পাদাকুলক (মাত্রাছন্দ), পারনি (তামিল ছন্দ) কিংবা ফারসি বয়েৎ ছন্দকে মনে করা হয়। মূলত এসব ছন্দ থেকে নানা উপাদান সংযোগে সমৃদ্ধ হলেও অক্ষরবৃত্ত বাংলা ভাষারই নিজস্ব ছন্দ, যা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ধামালি বা স্বরবৃত্ত ছন্দ থেকে জন্ম লাভ করেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত চরণের কোনো কোনো পর্বের শ্বাসাঘাত বিলুপ্ত হয়ে পূর্ববর্তী পর্বের সঙ্গে একীভূত হওয়ার মাধ্যমেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ গঠিত হয়েছে। আর পরবর্তীকালে এ ছন্দ বিভিন্ন কবির প্রতিভাস্পর্শে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

১২২। বাংলা সাহিত্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ একটি স্থিতিস্থাপক ছন্দ, যা মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে পর্বগত সংকোচন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন কবির হাতে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে। পয়ার হচ্ছে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ৮/৬ মাত্রার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি শ্রেণীবিভাগ। এটি মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের প্রধান ছন্দোরীতিও বটে। পয়ারের পর্ব-সম্মতি প্রকাশিত নয়, বরং অন্তর্গূঢ় বলে দ্রুততা ও চাপল্য বর্জিত এবং তা গুরুগম্ভীর মহাকাব্য ও বস্তুনিষ্ঠু জগৎ-জীবন রূপায়ণে অধিক উপযোগী। তাই মধ্যযুগে পয়ার ছন্দেই রামায়ণ ও মহাভারতের বঙ্গানুবাদ এবং মঙ্গলকাব্যসমূহ রচিত হয়েছে।

পয়ার ছন্দের উদাহরণ, যেমন:

মহাভারতের কথা/ অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস ভণে/ শুনে পুণ্যবান।

১২৩। এভাবে এ ছন্দ বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত কাব্যসমূহ রূপায়ণের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে শ্রেষ্ঠ ছন্দে। পয়ার ছন্দেরই একটি বিবর্ধিত রূপের নাম হচ্ছে মহাপয়ার। এতে পয়ারের ৬ মাত্রার অন্ত্যপর্বের পরিবর্তে ১০ মাত্রা হয়। এ ছন্দের প্রথম উদাহরণ পরিলক্ষিত হয় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মিনী উপাখ্যান কাব্যে। এ ছাড়া ষোল শতকে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর কাব্যে ভঙ্গপয়ার নামে এক ধরনের ছন্দের প্রবর্তন করেন, যাতে পয়ারের প্রথম ৮ মাত্রা বাদ দিয়ে ৬ মাত্রার অন্তপর্বে ২ মাত্রার অতিপর্ব যোগ করা হয় এবং একে পুনরুক্ত করে অন্য একটি পূর্ণ পয়ার-চরণের সঙ্গে অন্ত্যমিল তৈরি করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের বিদ্যাসুন্দর কাব্যেও এ ভঙ্গপয়ারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। তাছাড়া সপ্তদশ শতকে কাশীরাম দাস তাঁর মহাভারতে এবং কবি রামপ্রসাদ তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যে পয়ার ছন্দের পর্বমধ্যে একাধিক অনুপ্রাস প্রয়োগে বৈচিত্র্য এনে যথাক্রমে তরল পয়ার ও মালঝাঁপ পয়ার ছন্দের উদ্ভাবন করেন।

১২৪। এভাবে আঠারো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যের কবিরা পয়ার ছন্দের প্রচলিত রীতি ভেঙে সৃষ্টি করেন একাবলী, দীর্ঘ ত্রিপদী, দীর্ঘ চৌপদী, লঘু ত্রিপদী ইত্যাদি ছন্দ।” (বাংলাপিডিয়া, ছন্দ)

১২৫। নীচে কিছু উদাহরণ দেয়া হলো।

সতত হে নদ তুমি/ পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা/ ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক/ নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্রধ্বনি/ তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি/ ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি/ বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা/ মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতোরূপী তুমি/ মাতৃভূমি স্তনে।
(কপোতাক্ষ নদ/মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

মাত্রাবিন্যাস= ৮+৬

১২৬।

"হে কবি, নীরব কেন/ ফাগুন যে এসেছে ধরায়, (৮+১০)
বসন্তে বরিয়া তুমি/ লবে না কি তব বন্দনায়?"(৮+১০)
কহিল স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-/(১০)
"দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি? (১০)
বাতাবি নেবুর ফুল/ ফুটেছে কি?/ ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার/ গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি/ অধীর আকুল?"

৫ম পঙ্‌ক্তি=৬+৪+৮
৬ষ্ঠ=৬+৮+৬

৫ম ও ৬ষ্ঠ পঙ্‌ক্তির বিভাজন এভাবেও হতে পারে, আবৃত্তির উপর নির্ভর করেঃ

বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি?/ ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার /গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?

৫ম=১২+১০
৬ষ্ঠ=৮+১৪

কিন্তু কোনো পর্বে মাত্রাসংখ্যা ১০-এর উপর হয় না; এজন্য উপরে যেটি দেখানো হয়েছে সেটিই যুক্তিসঙ্গত।

১২৭।

“হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/ পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে/ নিশীথের অন্ধকারে/ মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ;/ বিম্বিসার অশোকের/ ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;/ আরো দূর অন্ধকারে/ বিদর্ভ নগরে;
(বনলতা সেন/ জীবনানন্দ দাশ)

মাত্রাবিন্যাস=৮+৮+৬

এখানে সিংহল, “সমুদ্র,অন্ধকার” এবং “বিম্বিসার” শব্দ ৪টি লক্ষ করা যায়। প্রথম শব্দ দু’টি তিনটি করে এবং শেষের শব্দ দু’টি চারটি করে মাত্রা বহন করছে।

এদের স্বর ও মাত্রা বিন্যাস নিম্নরূপ:
সিংহল=সিং +হল=১+২=৩
সমুদ্র=স + মুদ +র=১+১+২=৩
অন্ধকার=অন্+ধ+কার=১+১+২=৪
বিম্বিসার=বিম+বি+সার=১+১+২=৪

১২৮। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গণনার এই রীতি কবি ইচ্ছে করলে বদলে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে সব বদ্ধস্বরকে দিতে হবে ২ ’মাত্রা বহন করার ক্ষমতা। তবে, সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যাতে পুরো কবিতায় একই নিয়ম প্রতিফলিত হয়। এক কবিতায় দুরকম নিয়ম অনুসরণ করলে একদিকে পাঠক যেমন বিভ্রান্ত হবেন, অন্যদিকে কবিরও ছন্দে অদক্ষ হাতের প্রমাণ থেকে যাবে।
সকল বদ্ধস্বরকে ২ ’মাত্রা বহন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এমন একটি কবিতা:

বহুদিন থেকে আমি/ লিখছি কবিতা
বহুদিন থেকে আমি/ লিখি না কবিতা
(বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা/ সৈয়দ শামসুল হক)
মাত্রাবিন্যাস=৮+৬

এখানে ‘লিখছি’ শব্দটির 'লিখ্' বদ্ধস্বরটি শব্দের প্রথমে বসেও ২ মাত্রা বহন করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রম। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, এটা কবির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।” (হাসানআল আব্দুল্লাহ)

১২৯। জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটিতেও বদ্ধস্বরকে সর্বত্র ২ মাত্রা ধরা হয়েছে।

আবার আসিব ফিরে/ ধানসিড়িটির তীরে-/এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-/হয়তো বা শঙ্খচিল/ শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে/এই কার্তিকের/ নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে/ একদিন আসিব এ/ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো-/কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে/ লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে/ কলমির গন্ধচরা/ জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি/ বাংলার নদী মাঠ/ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলায়/ এ সবুজ করুণ ডাঙায়;

উপরে যেভাবে পর্ববিন্যাস দেখানো হলো, তা অন্যভাবেও করা যেতে পারে। এটা নির্ভর করবে কবিতাটি কীভাবে পাঠ বা আবৃত্তি করা হচ্ছে, তার উপর।

১৩০। “শব্দের প্রথম ও মাঝের বদ্ধস্বরকে একমাত্রা দেয়া হয়েছে এমন আরো দু’টি কবিতা:

…রহে বলী; রাজদণ্ড/ যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্বলতা,/তত তার ক্ষয়।
একা সকলের উর্ধ্বে/ মস্তক আপন
যদি না রাখিতে রাজা,/ যদি বহুজন
(গন্ধারীর আবেদন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

মাত্রাবিন্যাস=৮+৬

১৩১।

হে দারিদ্র্য তুমি মোরে/ করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়েছ/ খ্রীস্টের সম্মান।
কণ্টক-মুকুট শোভ!/ ─দিয়াছ, তাপস
অসঙ্কোচ প্রকাশের/ দুরন্ত সাহস:
(দারিদ্র্য / কাজী নজরুল ইসলাম)

মাত্রাবিন্যাস=৮+৬

১৩২।

ক্রূর ঝড় থেমে গেছে,/ এখন আকাশ বড়ো নীল/
গাছের সবুজ পাতা/ কেঁপে কেঁপে অত্যন্ত সুষম/
বিন্যাসে আবার স্থির/
(বাজপাখি / শামসুর রাহমান)

মাত্রাবিন্যাস=৮+১০=১৮

এই কবিতাটির প্রতিটি লাইনের প্রথম পর্ব ৮ মাত্রা এবং দ্বিতীয় পর্ব ১০ মাত্রা বহন করছে। যদি পর্বের আলোচনার আলোকে এটা বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বলা যায় শেষের ১০ মাত্রার পর্বটি অতিপর্ব। কিন্তু তা কী করে হয়? অতিপর্বের মাত্রা তো পর্বের মাত্রা সংখ্যা থেকে কম হওয়ার কথা। তবে কি এক্ষেত্রে মন্তব্য করা যাবে যে কবিতাটি লেখা হয়েছে ৮+৮+২ কাঠামোতে অর্থাৎ আট মাত্রার দু’টি পর্ব এবং দুই মাত্রার অতিপর্ব রেখে। কিন্তু তাও ঠিক নয়। কারণ, প্রথম লাইনের “নীল” শব্দটি ২ মাত্রা বহন করায় এটাকে ২ মাত্রার অতিপর্ব ধরলেও ধরা যায়। কিন্তু সমস্যা হয় দ্বিতীয় লাইনের “সুষম” শব্দটিকে নিয়ে। ২ মাত্রার অতিপর্ব বের করতে হলে “সুষম” থেকে “সু” স্বরটিকে পূর্বের পর্বের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, এবং “ষম” কে অতিপর্ব ধরতে হয়। অর্থাৎ ৩ অক্ষরের এই শব্দটিকে ভেঙে দিয়ে কবিতার পর্ব বিন্যাস করতে হয়। এক্ষেত্রে যা যুক্তিপূর্ণ নয়। তাই এই কবিতাটিকে ৮-১০” মাত্রার বা ৮-১০” চালের কবিতা বলা প্রয়োজন, যা অক্ষরবৃত্তে কবিতা লেখার অন্য একটি নিয়ম হিসেবে বেশ কয়েক যুগ ধরে বাংলা কবিতায় প্রচলিত এবং এটাই হচ্ছে ১৮ মাত্রার সনেট গঠনের নির্ভরযোগ্য কাঠামো।

১৩৩। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আলোচনায় অগ্রসর হলে মনে হতে পারে যে এর অঙ্গন অনেক প্রশস্ত এবং কিছুটা খোলামেলা।

১৩৪। আসলেই তাই। বাংলা কবিতার ত্রিশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিরা অক্ষরবৃত্তের উপর প্রচুর কাজ করেছেন এবং একে একটা মুক্ত রূপ দিয়েছেন; যা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়মকে ঠিক রেখে পর্বে মাত্রা বাড়িয়ে কমিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্ব ভেঙেচুরে ছন্দকে শাসন করে সজোরে আছাড় মেরে কবিতাকে সোজা করে দাঁড় করা হয়েছে। উঁকি দিয়েছে অক্ষরবৃত্তের নতুন ধারা। অক্ষরবৃত্তের এই নতুন রূপকে অনেকে “মুক্ত ছন্দ” বলেন। কিন্তু আমরা একে “নঞ ছন্দ” বলবো। নাই অর্থে নঞ। অর্থাৎ সাধারণ ভাবে দেখলে কবিতায় ছন্দ নেই, কিন্তু বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করলে ছন্দের দৃঢ় বন্ধন দৃষ্টিগোচর হয়। নঞ ছন্দের উদাহরণ লক্ষ করা যাক:

আকাশ জানে না,/
প্রকাশ রাস্তায় একী/ কুড়ানো স্বাক্ষর,/
নক্ষত্র সমাজ খোঁজে/ শেষ পরিচয়/
ওরা পরস্পর/
নূতন বিরহে পায়/ অভিন্ন বিচ্ছেদে দীপ্তিময়/
উদ্ভাসিত দূরে দূরে/ অনন্ত বাসর।/
(যুগ্মদূর/ অমিয় চক্রবর্তী)

মাত্রাবিন্যাস:

৮+৬
৮+৬

৮+১০
৮+৬”

(হাসানআল আব্দুল্লাহ)

১৩৫। হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি দেখুন।

এখন যৌবন যার/ মিছিলে যাবার তার/ শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার/ যুদ্ধে যাবার তার/ শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত/
কণ্ঠ/
পা/ এক নয়।

সেখানে সংসারী থাকে,/ সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে/ সাজাতে সংসার।
কেউ আসে জ্বালিয়ে/ বা/ জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা/ তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয়/ মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,/
কেউ আবার/ যুদ্ধবাজ হয়ে যায়/ মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে/ প্রেমিককে খুনি হতে হয়।

যদি কেউ ভালোবেসে/ খুনি হতে চান
তাই হয়ে যান/
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ/ বয়ে যায়।

এখন যৌবন যার/ মিছিলে যাবার তার/ শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার/ যুদ্ধে যাবার তার/ শ্রেষ্ঠ সময়।

এ কবিতাটিতেও যেভাবে পর্ববিন্যাস দেখানো হয়েছে, আপনার আবৃত্তির স্টাইল/মাত্রা/উচ্চারণ অনুযায়ী সেভাবে পর্ববিন্যাস করা যেতে পারে। পর্ববিন্যাস মূলত পাঠ বা আবৃত্তির উপরই নির্ভর করে।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা এ বিখ্যাত কবিতাটি মূলত গদ্যছন্দে লেখা হলেও এর পর্ববিন্যাসে অক্ষরবৃত্তেরই ছাপ পাওয়া যায়। কিছু কিছু শব্দ বাদ দিলে একে মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা বলেই মনে হয়। এরকম হেলাল হাফিজের আরো দুটি কবিতার উদাহরণ দেয়া যাক :

১৩৬।

‘মানব জন্মের নামে / হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে / আমি যদি মিছিলে না যাই
উত্তর পুরুষে ভীরু / কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে / এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।
[দুঃসময়ে আমার যৌবন]

কিংবা,

১৩৭।

আমি কোনো পোষা পাখি নাকি?/
যেমন শেখাবে বুলি/
সেভাবেই ঠোঁট নেড়ে যাবো,/ অথবা প্রত্যহ
মনোরঞ্জনের গান/ ব্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায়/ অনুকূলে খেলাবো আকাশ,
আমি কোনো সে রকম/ পোষা পাখি নাকি?

আমার তেমন কিছু/ বাণিজ্যিক ঋণ নেই,
কিংবা সজ্ঞানে/ এ বাগানে নির্মোহ ভ্রমণে
কোনোদিন ভণিতা করি নি।/ নির্লোভ প্রার্থনা
শর্ত সাপেক্ষে কারো/ পক্ষপাত কখনো চাবো না।
[রাখাল]

১৩৮। “শামসুর রাহমানের ‘একটি দুপুরের উপকথা’ কবিতাটি একটি টানা গদ্যচ্ছন্দের কবিতা।

সজীব সকালে চোখ মেলি, প্রতিদিনের পৃথিবী
আমাকে জানায় অভিবাদন। টাটকা রোদ
পাখিদের উড়াউড়ি, গাছের পাতার দুলুনি, বেলফুলের গন্ধ
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে।

কিন্তু এটাকেও নীচের মতো করে অক্ষরবৃত্তের পর্ব/মাত্রাবিন্যাসে সাজানো যায়ঃ

সজীব সকালে চোখ মেলি,/ প্রতিদিনের পৃথিবী/
আমাকে জানায় অভি/ বাদন। টাটকা রোদ
পাখিদের উড়াউড়ি,/ গাছের পাতার দুলুনি,/ বেলফুলের গন্ধ/
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে/

মাত্রাবিন্যাস:
১০+৮
৮+৮
৮+৮+৮
১৩

১৩৯। হুমায়ুন আজাদের ‘রাজনীতিবিদগণ’ কবিতাটিও ‘একটি দুপুরের উপকথা’ কবিতার অনুরূপঃ

যখন তাদের দেখি/ হঠাৎ আগুন লাগে/ চাষীদের মেয়েদের/
বিব্রত আঁচলে;/ সমস্ত শহর জুড়ে/ শুরু হয় খুন, লুঠ,/ সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
ভেঙে পড়ে শিল্পকলা,/ গদ্যপদ্য;/ দাউদাউ পোড়ে/ পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে/ গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে/ ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল
আর্তনাদ করে বাঁশি/ যখন ওঠেন মঞ্চে/ রাজনীতিবিদগণ।

মাত্রাবিন্যাস:
৮+৮+৮
৬+৮+৮+১০
১০+৪+৬+৮
৪+৮+১০
৮+৮+৮

১৪০। এসব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, পর্বে মাত্রাসংখ্যা অসমান; কিন্তু জোড় মাত্রার পর্ব গঠিত হয়েছে।


মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সহজ উপায়

১৪১। এখন প্রশ্ন হলো মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার নিয়ম কী? এ ছন্দে লেখা কবিতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যা ধরা পড়বে তা হলো:

ক. অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনার নিয়ম ঠিক থাকবে।
খ. প্রতিটি পর্বে জোড়সংখ্যক মাত্রা থাকতে হবে।
গ. পর্বে মাত্রাসংখ্যা ২ থেকে শুরু করে ৪, ৬, ৮, ১০ যে-কোনো সংখ্যক রাখা যেতে পারে।

১৪২। মুক্ত বা নঞ ছন্দে কবিতা লেখার সময় যদি একটা বিশেষ নীতি মেনে চলা হয় তবে উপরের ৩টি শর্তই একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব। নীতিটি হলো:

জোড়ে জোড়, বিজোড়ে বিজোড়।

তার মানে জোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি জোড় মাত্রার শব্দ এবং বিজোড় মাত্রার শব্দের পাশাপাশি বিজোড় মাত্রার শব্দ বসানো। এরপর ইচ্ছেমতো পঙ্‌ক্তি তৈরি করা হলেও ছন্দের কোনো বিচ্যুতি ঘটে না।” (হাসানআল আব্দুল্লাহ)


ফ্রি-ভার্স, মুক্তচ্ছন্দ, গদ্যচ্ছন্দ, সমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত, অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত

১৪৩। ছন্দ নিরীক্ষণে রবীন্দ্রনাথ নিজের কবিতাকে বিভিন্ন ভাবে ভাঙতেন, সাজাতেন, এবং একই চরণকে বিচিত্র রূপে পঙ্‌ক্তিতে ভাগ করতেন। কীভাবে? চলুন, কিছু আলোচনা করি।

১৪৪। নীচের কবিতাটি আমার। কিন্তু এটি প্রকৃত রূপ নয়; ভিন্নরূপটি শুরুতেই দেখা যাক।

সে এক ক্ষণজন্মা পাখি, প্রতিটা গোপন সাঁঝে অরূপ পাথারে নেমে এসে অলৌকিক সুর তোলে গানে। তারপর রাত্রি শেষে ফিরে যায়, পেছনে রেখে যায় একগুচ্ছ পদছাপ, ও কয়েকটা পালক। মাটিতে করুণ দাগ কেটে একধ্যানে চেয়ে থাকে বিবাগী বালক।

১৪৫। উপরে কবিতাটিকে খাঁটি গদ্যাকারে সাজানো হয়েছে। এরূপ টানা গদ্যের কবিতাকে ‘ফ্রি ভার্স’ বলা হয়। ফ্রি-ভার্সের বাংলা অর্থ ‘অমিত্রাক্ষর’ , যাকে অধুনা ব্লগে বা ফেইসবুকে কেউ কেউ ‘মুক্তগদ্য’ হিসাবে নতুনভাবে নামকরণ করছেন।

১৪৬। ‘ফ্রি ভার্স’ হলো এক প্রকার ছন্দের নাম, অন্য কিছু না। অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত বা এদের সংমিশ্রণের প্রভাব থেকে ছুটে আসার প্রবণতা থেকে ধীরে ধীরে ‘ফ্রি ভার্স’ সৃষ্টি হয়েছে। এটা গদ্য নয়- (ভার্স অর্থ কবিতা, বা ছড়া, বা কবিতার লাইন)। অবয়বে গদ্যের মতো, গদ্যের সাথে সাদৃশ্য এটুকুই। উন্মুক্ত কবিতা, বা মুক্ত কবিতা, বা মুক্তচ্ছন্দ। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ‘ফ্রি ভার্স’-এর চেয়ে সহজতর ও অধিক উপযুক্ত কোনো উপায় নেই। এখানে আপনার উন্মুক্ত ভাবনাকে উন্মুক্তভাবেই প্রকাশ করার স্বাধীনতা পাচ্ছেন।

১৪৭। নীচে আরও দুটি ফ্রি-ভার্স দেখুন।

১৪৮।

আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ। এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি- তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি, মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে- (ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)

আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক। ঘামে ছিল না এমন গন্ধক যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পারি। নিখিলেশ, তুই একে কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা; আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না। আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম, আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে জীবন বদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একই নদীর তরঙ্গে ছেলেবেলার মতো ডুবসাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই, আমার ঘরের দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি …, ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার; ইচ্ছে ছিল না জানাবার এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাতড়ে টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায় আছে অদূরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায় কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।

১৪৯।

প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী প্রমীলা, পতি-বিরহে-কাতরা যুবতী। অশ্রুআঁখি বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে কভু, ব্রজ-কুঞ্জ-বনে, হায় রে যেমনি ব্রজবালা, নাহি হেরি কদম্বের মূলে পীতধড়া পীতাম্বরে, অধরে মুরলী। কভু বা মন্দিরে পশি, বাহিরায় পুনঃ বিরহিণী, শূন্য নীড়ে কপোতী যেমতি বিবশা! কভু বা উঠি উচ্চ-গৃহ-চূড়ে, এক-দৃষ্টে চাহে বামা দূর লঙ্কা পানে, অবিরল চক্ষুঃজল পুঁছিয়া আঁচলে!— নীরব বাঁশরী, বীণা, মুরজ, মন্দিরা, গীত-ধ্বনি। চারি দিকে সখী-দল যত, বিরস-বদন, মরি, সুন্দরীর শোকে! কে না জানে ফুলকুল বিরস-বদনা, মধুর বিরহে যবে তাপে বনস্থলী?

উতরিলা নিশা-দেবী প্রমোদ-উদ্যানে। শিহরি প্রমীলা সতী, মৃদু কল-স্বরে, বাসন্তী নামেতে সখী বসন্ত-সৌরভা, তার গলা ধরি কাঁদি কহিতে লাগিলা,— “ওই দেখ, আইল লো তিমির যামিনী কাল-ভুজঙ্গিনী-রূপে দংশিতে আমারে, বাসন্তি! কোথায়, সখি, রক্ষঃ-কুল-পতি, অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ, এ বিপত্তি কালে? এখনি আসিব বলি গেলা চলি বলী; কি কাজে এ ব্যাজ আমি বুঝিতে না পারি। তুমি যদি পার, সই, কহ লো আমারে।”

কহিলা বাসন্তী সখী, বসন্তে যেমতি কুহরে বসন্তসখা,— “কেমনে কহিব কেন প্রাণনাথ তব বিলম্বেন আজি? কিন্তু চিন্তা দূর তুমি কর, সীমন্তিনি! ত্বরায় আসিবে শূর নাশিয়া রাঘবে। কি ভয় তোমার সখি? সুরাসুর-শরে অভেদ্য শরীর যাঁর, কে তাঁরে আঁটিবে
বিগ্রহে? আইস মোরা যাই কুঞ্জ-বনে। সরস কুসুম তুলি, চিকণিয়া গাঁথি ফুলমালা। দোলাইও হাসি প্রিয়গলে সে দামে, বিজয়ী রথ-চূড়ায় যেমতি বিজয়পতাকা লোক উড়ায় কৌতুকে।”


১৫০। ‘ফ্রি ভার্স’-কে দুই প্যাটার্নে লেখা যায় :

ক। কোনোরূপ অন্ত্যমিল না রেখে, এবং
খ। পুরোটাই একটা গদ্যের মতো করে লিখে।

১৫১। Free Verse-এর উপর আমেরিকান সমালোচক জন লিভিংস্টোনের একটি পর্যবেক্ষণলব্ধ মন্তব্য দেখুন, যা তিনি ১৯১৬ সালে বলেছিলেনঃ

১৫২। “চমৎকার গদ্যে আপনি একটি অনবদ্য কবিতা লিখে ফেলতে পারেন; কবিতার ভাষায়ও একটা উৎকৃষ্ট গদ্য লিখে ফেলা সম্ভব।”

তাহলে গদ্য আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

১৫৩। জন লিভিংস্টোনের কথাটি ফেইসবুকে স্টেটাস আকারে প্রকাশ করা হলে এর উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমেন্ট পাওয়া যায়। নীচে দেখুন।

১৫৪। কবি মজনু শাহ : হয়ত পার্থক্য তেমন কিছু নাই। আবার আছেও। গদ্য একটা যুক্তিকাঠামো চায়, তা হয়ে উঠতে চায় পরিণতিময়। সুনির্দিষ্ট অর্থ আরোপ করতে চায় সে। কবিতা প্রায়শ এই যুক্তিশৃঙ্খলা পেরিয়ে গিয়ে চায় শব্দাতীত কোনো অনুভব। বা নৈঃশব্দ্য। এই জন্যে ভালো কবিতাগুলো অনন্ত অর্থময়, দৃশ্যত গদ্য তা নয়, গদ্য তেমন হয়ে উঠলে তা তার উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে এগোয়।

১৫৫। ত্রিশোনকু মল্লিক : শব্দ চয়নে আর ভাবের গভীরতায়।

১৫৬। Maximus Millius : নিদ্রা আর তন্দ্রায় যে পার্থক্য- আমার কাছে কাব্য নিদ আর গদ্য ঘোর।

১৫৭। John Livingston Lowes-এর কথাটা আমি সামান্য ঘুরিয়ে বলেছি। ঐ সময়ে যেসব Free Verse রচিত হতো তা দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘Free verse may be written as very beautiful prose; prose may be written as very beautiful free verse.’ টি এস এলিয়ট বলেছেন, ‘No verse is free for the man who wants to do a good job’.

১৫৮। ‘ফ্রি ভার্স’ কী সে-সম্পর্কে টি. এস. এলিয়ট বলেছেন :

ক। এর কোনো প্যাটার্ন বা রূপকল্প থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্তকল্প।
খ। এতে কোনো অন্ত্যমিল থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্ত মিল।
গ। এতে কোনো ছন্দ থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্ত ছন্দ।

১৫৯। শুরুতে আমার নিজের যে কবিতাটিসহ অন্য যে দুটি কবিতা উদ্ধৃত করেছি, সেটি টি. এস. এলিয়টের বেঁধে দেয়া বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অর্থাৎ, এটি হবে একটি খাঁটি গদ্যের মতো। খাঁটি গদ্য আর কবিতার মধ্যে কি তাহলে কোনো পার্থক্য নেই? পার্থক্য অবশ্যই আছে- কবিতার ভাষাই বলে দেবে এটি দেখতে গদ্যের মতো হলেও এটি একটি কবিতা। বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ গ্রন্থের ২য় পর্বে অধ্যাপক পবিত্র সরকারের একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত হয়েছে এ শিরোনামে- ‘কাব্যভাষার ব্যাকরণ’। সেটি পড়লে গদ্য ও কবিতার ভাষা যে এক নয় তার কিছু ব্যাখ্যা মেলে।

১৬০। ‘মেঘনাদ বধ’ -এ কোনো অন্ত্যমিল নেই, এটা ফ্রি ভার্স, যা মূলত ১৪ অক্ষরের পয়ারে রচিত; অমিত্রাক্ষর পয়ার এর নাম। কিন্তু বাক্যগঠন এমন যে সাধারণ পয়ারের মতো সর্বত্রই এক পঙ্‌ক্তিতে একটি বাক্য গঠিত হয় নি, অর্থৎ, পঙ্‌ক্তির মাঝখানে ‘দাঁড়ি’, সেমি-কোলন দেখা যায়, এবং আবৃত্তির সময় এটিকে অবিকল গদ্যের মতোও পাঠ করা যায়। সেই হিসাবে এটি খাঁটি অমিত্রাক্ষর পয়ার নয়, এটিও ফ্রি-ভার্স-এর বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। পয়ারে ৮+৬ অক্ষরের দুটি পর্ব থাকে, যা ১ম পর্বে অর্ধ বিরতি, ২য় পর্ব শেষে পূর্ণ বিরতি লাভ করে থাকে।

আমাদের ছোটো নদী | চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার | হাঁটুজল থাকে

এখানে একটা পঙ্‌ক্তিতে বাক্য সম্পন্ন হচ্ছে।

কিন্তু অন্যত্র দেখুনঃ

“এই কি সেই আগ্রা, হায় আকবর যাহারে
সাজায়েছে দিবানিশি?” (আগ্রা – কায়কোবাদ)

কিংবা,

“কি ভয় তোমার সখি? সুরাসুর-শরে
অভেদ্য শরীর যাঁর, কে তাঁরে আঁটিবে
বিগ্রহে?” (মেঘনাদ বধ – মধুসূদন)

আগ্রা বা মেঘনাদ বধ থেকে উদ্ধৃত অংশে পঙ্‌ক্তি শেষে বাক্য শেষ হচ্ছে না, প্রলম্বিত হয়ে পরের পঙ্‌ক্তিতে যাচ্ছে।

১৬১। রবীন্দ্রনাথ ছন্দের প্রয়োজনে একই কবিতা এভাবে ভেঙে ভেঙে দেখিয়েছেন যে, এভাবে ভাঙবার ফলে আবৃত্তির ঢংটাই পালটে যায়।

১৬২। ইংরেজিতে যেটাকে ‘ফ্রি-ভার্স’ বলা হয়, আমি তার সাথে পরিচিত বেশ আগে থেকেই, এবং আমি নিজের অজান্তেই ‘ফ্রি-ভার্স’-এর প্রতি ঝুঁকে পড়ি মূলত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে। ব্লগে কোনো এক সময় কবিতার প্রচলিত ফরম্যাট উপেক্ষা করে আপনা-আপনিই ‘ফ্রি-ভার্স’ লিখতে থাকি। ‘ফ্রি-ভার্স’ লিখতে লিখতেই খেয়াল করি- এটা গল্প নয়, কিন্তু গল্পের মতো, কবিতা নয়, তবে কবিতা বলে ভ্রম হতে পারে, এবং প্রবন্ধ বা রম্যও নয়। তখন আমি নিশ্চিত হই যে, আমি আদতে ‘ফ্রি-ভার্স’ লিখছি না, লিখছি এমন কিছু যার কোনো সঠিক ক্যাটাগরি নেই।

১৬৩। মূলত ‘মুক্তগদ্য’ বা ‘ফ্রি-ভার্স’ বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন মধ্যগগনে, তখন থেকেই তিনি এই অবয়বের কবিতা লিখতে শুরু করেন, এবং প্রচুর লিখেছেন। কবি আবিদ আজাদের ‘মুখবন্ধ’, ‘বৃষ্টির ফোঁটা ও পাতাবাহার গাছ নিয়ে’, ‘ভোরবেলা’, ‘৪ঠা অক্টোবর’, ‘১৯৮৭’, ‘ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল’, ‘পারা না-পারা’, ‘তারা ও মানুষ’, ‘স্ক্রু’, ‘২৭-১১-৯০-এর ৪-৩০ মিনিটে লেখা’, ‘তোমার ছবির সামনে’, ‘নন্দনতত্ত্ব’, ‘ভূত ও পেতনিদের নিয়ে আরো একটি কবিতা’, ‘জাদু এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বপ্ন’, ইত্যাদি কবিতাগুলো সার্থক ‘ফ্রি-ভার্সের’ উদাহরণ।

১৬৪। শামসুর রাহমান শেষের দিকে দীর্ঘকায় ‘ফ্রি-ভার্স’ লিখেছেন। ‘মেঘলোকে মনোজ নিবাস’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘রাত আড়াইটার পঙ্‌ক্তিমালা’, ‘স্বপ্ন জাগরণের সীমানায়’, ‘সারা জীবনই গোধূলি আকাশ’, ‘ডাকহরকরা বিলি করলেও’, ‘পাস্তারনাকের কাব্যগ্রন্থের নিচে’, ইত্যাদি বৃহদাকার কবিতাগুলো উল্লেখযোগ্য।

১৬৫। আমি যতদূর পাঠ করেছি, বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কবিদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান হলেন এরূপ কবিতার পথিকৃৎ। এগুলোর বাহ্যিক অবয়ব দেখলে গদ্য বলে ভ্রম হবে। কিন্তু পাঠ করলেই ধীরে ধীরে আপনি এক নতুন জগতে প্রবেশ করবেন। সৈয়দ আলী আহসানের ‘সহসা সচকিত’ কাব্যগ্রন্থের সিকোয়েল নম্বর ৯, ১০, ১১, ১২, ১৫, ১৬, ১৮, ২০, ২১, ৩২, ৩৩, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৯, ৪২, ৪৩, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫৩, ৬০, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৮৩, ‘সমুদ্রেই যাব’ কাব্যগ্রন্থের ‘জানালায় সমুদ্র’, ‘সৌরভ’, ইত্যাদি কবিতাগুলোও অনুরূপ ‘মুক্তগদ্য’ অথবা ‘ফ্রি ভার্স’।

১৬৬। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও ‘ফ্রি-ভার্স’ ছিল। ফ্রি ভার্স আদতে গদ্য নয়, কবিতা বা কবিতার মতো। ছন্দ সমীক্ষণে যেটাকে মুক্তক অক্ষরবৃত্ত বা গদ্যছন্দ বলা হয়, ফ্রি-ভার্স বা মুক্তগদ্যে তা থেকে ভিন্ন কিছু দেখা যায় না। মুক্তগদ্যকে ‘অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’ ছন্দের কবিতা বলাই উত্তম। ‘অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’ কী? এই যে আমি এই আর্টিকেলটি লিখছি, এর যে-কোনো টানা গদ্যের অনুচ্ছেদ বা অনুচ্ছেদসমগ্রই হলো ‘অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’। কিন্তু গদ্যাকারে লিখলেই সেটা কবিতা হয় না, তা নতুন কোনো কথা নয়। লেখা পাঠের পর যে উপলব্ধি, তা থেকেই বুঝবো- হয় কবিতা পড়লাম, অথবা নিছক গদ্য।

১৬৭। কবি মুজিব মেহদী সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘উভলিঙ্গ’ অভিধায় প্রচুর পোস্ট লিখেছেন, যা আমার কাছে উৎকৃষ্ট মানের কবিতা মনে হয়েছে। এগুলো ‘অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’ বা ‘ফ্রি-ভার্স’ বা ‘মুক্তগদ্য’ থেকে ভিন্নতর কিছু নয়- কেবল নামকরণটাই ভিন্ন মনে হয়েছে আমার কাছে। কবি মুক্তি মণ্ডল, দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু, টোকন ঠাকুর, ইমরান মাঝি, গেওর্গে আব্বাস, লাবণ্যপ্রভা, অক্ষর, (খুব সম্ভবত মাহবুব লীলেন ও ছন্নহারার পেনসিলও), নির্ঝর নৈঃশব্দ্য এই আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। আরেকজন ব্লগারের নাম আমি ভুলে গেছি, মৃন্ময় আহমেদ কিংবা কাছাকাছি কেউ- যাঁকে সর্বপ্রথম ব্লগে এ আঙ্গিকে কবিতা লিখতে দেখেছি। কিন্তু তিনি এগুলোকে হয় গল্প অথবা কবিতা নামে ট্যাগ করতেন বলে আমার মনে পড়ে। অনেক দিন আগের কথা- কিছু তথ্য ভুলও হতে পারে। আমি ব্লগে এ আঙ্গিকের প্রচুর পোস্ট লিখেছি- কিন্তু আমি স্বীকার করছি (উপরে একবার উদ্ধৃত করেছি), ওগুলো হয়তো কবিতা হয় নি, বা গদ্যও নয়, কিন্তু এগুলো লিখবার জন্য আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। উৎসাহী বন্ধুরা সময় পেলে পোস্টগুলো ঘুরে আসতে পারেন। এগুলো কিছুই না হোক, কবিতার প্যাটার্ন হিসাবে এটাই আমার স্বকীয়তা।

এ শহর ছেড়ে তোর চলে যাবার কথা শুনে

আমরা ভাগ হয়ে যাচ্ছি; ভেঙে যাচ্ছি

কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে মেয়েটি বসে ছিল

আমরা মেয়েদের কথা মনে রাখি, মেয়েরা ভুলে গেছে

শৈশবের দুঃখগুলো

প্রিয় বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেলে

বিতণ্ডা অথবা তোর অভিমান; আমি কোনোটাই মেনে নিই নি

আটলান্টিকা

একটা কবিতার গোড়াপত্তন ও এর অর্থবোধকতার পর্যায় সমূহ

কী কী কারণে বউ বা প্রেমিকাকে ভালোবাসেন!!

ক্ষণজন্মা-২০

ক্ষণজন্মা- ১৮

মৃত সরোবর

শাপলাশালুকডাহুকের শৈশব

স্বাক্ষর

অহনাঃ সাকারে; নিরাকারে

১৬৮। পশ্চিম বাংলার কবিরা এ আঙ্গিকের কবিতাকে অনেক আগে থেকেই ‘নতুন কবিতা’ বলে আখ্যা দিয়ে আসছিলেন। এটার আবিষ্কারক কবি বারীণ ঘোষাল। তবে কবিতার প্রচলিত ফরম্যাট ও গদ্য ফরম্যাট দুটোতেই ‘নতুন কবিতা’ লিখতে দেখেছি। ঐ ‘নতুন কবিতা’র দেখাদেখি বাংলাদেশে ‘নতুন ধারা’ শুরু হতে দেখেছিলাম কোনো একটা ওয়েব্লগে। পশ্চিম বাংলার কবিরা বর্তমানে ‘নতুন ধারা’ থেকে সরে এসে ‘মুক্তগদ্য’ লিখছেন কিনা তা আমি জানি না। হতে পারে যে তাঁরা ‘নতুন কবিতা’ ও ‘মুক্তগদ্য’ দুটোই লিখছেন। তবে ২০০২-২০০৭ সালে কবিতা-মুক্তমঞ্চে এ নিয়ে অনেক আলোচনা-বিতর্ক হতে দেখেছি।

১৬৯। কোনো লেখা সাবলীল নাকি জটিল, একটানে পড়ে শেষ করা যায় নাকি বোরিং- তা হলো লেখকের দক্ষতার ব্যাপার। আপনার কবিতা একনিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, আপনার গদ্য গতিশীল। আমার গদ্য গতিশীল না, তাই একনিশ্বাসে শেষ করা যাবে সেটা আশা করা যায় না। অতএব, কোন ক্যাটাগরির কবিতা বেশি গতিশীল, তা ঐ ক্যাটাগরির নয়, ব্যক্তির নৈপুণ্যই দক্ষতার দাবিদার।

১৭০। আমার কবিতাটিতে অন্ত্যানুপ্রাসের ব্যবহার রয়েছে, এবং এটা মূলত সমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্তে রচিত। সমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্তের স্টাইলে আমার কবিতাটিকে সাজালে এর আঙ্গিক কীরূপ হয়, দেখুন নীচে :

সে এক ক্ষণজন্মা পাখি, প্রতিটা গোপন সাঁঝে অরূপ পাথারে নেমে এসে
অলৌকিক সুর তোলে গানে। তারপর রাত্রি শেষে
ফিরে যায়, পেছনে রেখে যায় একগুচ্ছ পদছাপ, ও কয়েকটা পালক
মাটিতে করুণ দাগ কেটে একধ্যানে চেয়ে থাকে বিবাগী বালক

আমার কবিতাটির মূল স্ট্রাকচার এটাই। এটাকে অন্যভাবেও সাজানো যায়, যেমন :

সে এক ক্ষণজন্মা পাখি, প্রতিটা গোপন সাঁঝে
অরূপ পাথারে নেমে এসে অলৌকিক সুর তোলে গানে।
তারপর রাত্রি শেষে ফিরে যায়, পেছনে রেখে যায়
একগুচ্ছ পদছাপ, ও কয়েকটা পালক। মাটিতে করুণ
দাগ কেটে একধ্যানে চেয়ে থাকে বিবাগী বালক

১৭১। এবার উপরে উদ্ধৃত বাকি গদ্য দুটোকে আমরা কবিতার মতো সাজাই। দেখুন এর প্রকৃত রূপ কেমন হয়।

১৭২।

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ।
এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি- তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-
(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)
আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পারি। নিখিলেশ, তুই একে
কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে
বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কি না;
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবন বদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একই নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো ডুবসাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত
দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই, আমার ঘরের
দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি …, ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাতড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদূরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে
বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।
(আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

১৭৩।

প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী
প্রমীলা, পতি-বিরহে-কাতরা যুবতী।
অশ্রুআঁখি বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
কভু, ব্রজ-কুঞ্জ-বনে, হায় রে যেমনি
ব্রজবালা, নাহি হেরি কদম্বের মূলে
পীতধড়া পীতাম্বরে, অধরে মুরলী।
কভু বা মন্দিরে পশি, বাহিরায় পুনঃ
বিরহিণী, শূন্য নীড়ে কপোতী যেমতি
বিবশা! কভু বা উঠি উচ্চ-গৃহ-চূড়ে,
এক-দৃষ্টে চাহে বামা দূর লঙ্কা পানে,
অবিরল চক্ষুঃজল পুঁছিয়া আঁচলে!—
নীরব বাঁশরী, বীণা, মুরজ, মন্দিরা,
গীত-ধ্বনি। চারি দিকে সখী-দল যত,
বিরস-বদন, মরি, সুন্দরীর শোকে!
কে না জানে ফুলকুল বিরস-বদনা,
মধুর বিরহে যবে তাপে বনস্থলী?
উতরিলা নিশা-দেবী প্রমোদ-উদ্যানে।
শিহরি প্রমীলা সতী, মৃদু কল-স্বরে,
বাসন্তী নামেতে সখী বসন্ত-সৌরভা,
তার গলা ধরি কাঁদি কহিতে লাগিলা,—
“ওই দেখ, আইল লো তিমির যামিনী
কাল-ভুজঙ্গিনী-রূপে দংশিতে আমারে,
বাসন্তি! কোথায়, সখি, রক্ষঃ-কুল-পতি,
অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ, এ বিপত্তি কালে?
এখনি আসিব বলি গেলা চলি বলী;
কি কাজে এ ব্যাজ আমি বুঝিতে না পারি।
তুমি যদি পার, সই, কহ লো আমারে।”
কহিলা বাসন্তী সখী, বসন্তে যেমতি
কুহরে বসন্তসখা,— “কেমনে কহিব
কেন প্রাণনাথ তব বিলম্বেন আজি?
কিন্তু চিন্তা দূর তুমি কর, সীমন্তিনি!
ত্বরায় আসিবে শূর নাশিয়া রাঘবে।
কি ভয় তোমার সখি? সুরাসুর-শরে
অভেদ্য শরীর যাঁর, কে তাঁরে আঁটিবে
বিগ্রহে? আইস মোরা যাই কুঞ্জ-বনে।
সরস কুসুম তুলি, চিকণিয়া গাঁথি
ফুলমালা। দোলাইও হাসি প্রিয়গলে
সে দামে, বিজয়ী রথ-চূড়ায় যেমতি
বিজয়পতাকা লোক উড়ায় কৌতুকে।”
(মেঘনাদ বধ/ মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

১৭৪। ফ্রি ফার্স বা অমিত্রাক্ষর ছন্দকে অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত বলা যায়। কিন্তু যখন মুক্তক অক্ষরবৃত্তের মধ্যে অন্ত্যানুপ্রাস পাবেন, তখন ওটিকে ‘সমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’ বলা হবে। উদ্ধৃত কবিতা দুটির প্রথমটি সমিল এবং পরেরটি অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্তের উদাহরণ।


মিল বা অনুপ্রাস

১৭৫। একাধিক পদ, পর্ব বা পঙ্‌ক্তির শেষে একই রকম ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছের ব্যবহারকে মিল বলা হয়। এই মিল-করণ কোনো ছন্দ নয়, এটা কবিতার এক ধরনের অলঙ্কার, যার নাম অনুপ্রাস। পঙ্‌ক্তির শেষে এই মিল থাকলে তাকে অন্ত্যমিল বা অন্ত্যানুপ্রাস বলা হয়। ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় অনেকেই ছন্দ বলতে এই মিল বা অন্ত্যমিল বা অন্ত্যানুপ্রাসকে বুঝে থাকেন, যেটি তাঁদের একটি ভুল ধারণা। কবিতায় মিল বা অন্ত্যমিল থাকা অত্যাবশ্যক নয়, কিন্তু ছন্দ ছাড়া কোনো কবিতা হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গদ্যচ্ছন্দে আপাত দৃষ্টিতে ছন্দের উপস্থিতি বোঝা না গেলেও ছন্দ সম্পর্কে যাঁর সম্যক ধারণা রয়েছে, তিনি ঠিকই বুঝতে পারবেন যে একটা চমৎকার ছন্দের ভিতর দিয়ে কবিতাটি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে, কবিতা লিখবার জন্য ছন্দের উপর পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, একজন কবিকে কবিতার উপর অবশ্য প্রচুর জ্ঞান থাকতে হবে। যিনি কবিতা পড়েন, তিনি কোন ছন্দের কবিতা পড়ছেন সেটি তাঁর জানা না থাকলেও তিনি ঠিকই বোঝেন তিনি খুব দ্রুত ছুটছেন নাকি ধীর লয়ে হাঁটছেন, কোথাও হোঁচট খাচ্ছেন কিনা, ইত্যাদি; আর যখন তিনি কবিতা লিখতে বসেন, তখন অনুরূপ ছন্দে,কিংবা নিজ প্রতিভাবলে ও সৃজনীশক্তিতে সেই ছন্দে নানারূপ পরিবর্তন করে নতুন নতুন ছন্দ আবিষ্কার করে কবিতা লিখেন। যিনি জীবনে কোনো কবিতা পড়েন নি, কবিতা কী জিনিস, বা ছন্দ কাকে বলে তা জানেন না, তাঁর পক্ষে কবিতা লেখা সম্ভব নয়।

১৭৬। অন্ত্যমিল সৃষ্টির জন্য আগুন-এর সাথে ফাগুন, বেগুন-এর সাথে লেগুন, কিংবা ভাবালু-র সাথে গাবালু লেখা জরুরি নয়। এ কথাটা বলছি এ কারণে যে, আমাদের অনেকের মধ্যেই এভাবে লেখার প্রবণতা খুব প্রকট আকারে দেখা যায়; তাঁদের হয়ত এটাই বদ্ধমূল ধারণা যে, এভাবে লিখলেই ‘ছন্দ’ অধিক মাধুর্যময় হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি দেখেছি, এভাবে অন্ত্যমিল গঠন করতে গিয়ে অদ্ভুত অনেক শব্দের অবতারণা করছেন, কিংবা মিলের স্বার্থে অপ্রয়োজনীয় শব্দের আমদানি করছেন; ফলে, তা ছড়া বা কবিতা না হয়ে নিছক পদ্য হয়ে উঠছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা খুব একঘেঁয়ে এবং অর্থহীনও হয়ে যাচ্ছে।

১৭৭। আপনারা চাইলে অন্যভাবেও কিছু কাজ করতে পারেন অন্ত্যমিলের ব্যাপারে, যা আমি নিয়মিতই করি। অন্ত্যমিল সৃষ্টির জন্য বর্ণে বর্ণে মিল না করে সমোচ্চারিত ধ্বনিতে সৃষ্টি করতে পারেন। আমার নিজের লেখা থেকেই উদাহরণ দিচ্ছিঃ

‘ক্লান্ত শরীরে একটু ঘুমোবো
কাল খুব ভোরে উঠবো জেগে।
তোমরা রয়েছ শত ক্রোশ দূরে
অথচ পাশেই, আমি নিব ভেবে।’

এখানে ‘জেগে’র এ-ধ্বনি এবং ‘ভেবে’র এ-ধ্বনি সমরূপ অন্ত্য-ধ্বনি সৃষ্টি করেছে।

তদ্রূপঃ

‘দিস নি, তবু দূরে থেকেই
আমিই তোর কোল ছুঁয়েছি।’

‘আমরা বাবা ও কন্যা ছিলাম, কিংবা তুমি ছিলে মা
আমি তার অবাধ্য ছেলেটা।’

‘তুমি চলে গেছো সাথে নিয়ে গেছো
সকল আলো, সবখানি প্রেম
তুমি না থাকলে আমিও থাকি না
জ্বলেপুড়ে হই বিনিঃশেষ।’

‘বড্ড ক্ষুদ্র এ জীবন। এ জীবন আমাকে দিয়েছে অজস্র
মানুষের ভালোবাসা, অজস্র প্রাণের অর্ঘ্য
কীভাবে শোধ দিব এসবের ঋণ, আমার আছে কি সাধ্য?’

‘আমি ভালোবাসি ফুলের সুবাস,
যাতে নেই কোনো পাপ।’

‘বুকের পাশে শুয়ে তুমি
বুকেই তোমার বাস
তোমায় তবু যায় না ছোঁয়া
যায় না রাখা হাত।’

১৭৮। এ ছাড়া, নীড়ে’র সাথে তীরে/ফিরে না হয়ে ঘরে/ঝাড়ে এভাবেও হতে পারে, অর্থাৎ, অন্ত্যমিলে সচরাচর ন্যূনতম দুটো বর্ণের মিল থাকলেও খোদ রবীন্দ্রনাথেও মাত্র এক বর্ণের অন্ত্যমিল দেখা যায়; আর আজকের নঞ্‌-অন্ত্যমিলের যুগে এক বর্ণ বা সমরূপ ধ্বনিও যে মাধুর্য দ্যোতনা সৃষ্টি করে, তাও কম কীসে? আমি অবশ্য এগুলো বলছি মনের খেয়ালে, কারণ, আপনারা অনেকেই এসব জানেন এবং নিয়মিত চর্চাও করছেন। তবে,কোনো আগ্রহী পাঠক হয়ত এ লেখাটা পাঠ করে সামান্য উপকৃত হতেও পারেন, সে উদ্দেশ্যে এত কথা বলা।

১৭৯। আবার, একটা কবিতায় সবখানে অন্ত্যমিল না থাকলেও চলে, অর্থাৎ কোথাও অন্ত্যমিল থাকবে, কোথাও বা অমিত্রাক্ষর। আমি এগুলোও চর্চা করেছি; আসলে এরকম লিখবো শুরুতে সে-উদ্দেশ্য থাকে না, লিখতে শুরু করার পরই কবিতার প্রয়োজনে এমনটা হয়ে যায়।

১৮০। কবিতায় সাধু-চলিত মিশ্রণ কোনোকালেই দূষণীয় ছিল না, এমনকি আজকালও নয়। খাঁটি গদ্যচ্ছন্দেও আবেগের গভীরতা প্রকাশের জন্য হঠাৎ হঠাৎ ক্রিয়াপদের সাধুরূপ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, এমনই পুরাতন রীতিতে ব্যবহৃত ‘মম’, ‘তব’, ‘মোর’, ‘মোদের’ ইত্যাদি শব্দও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহার কবিতায় এমন ব্যবহার অনেক দেখা যায়। এটা বললাম এ কারণে, মাত্রাসংখ্যা ও ছন্দ রক্ষার্থে প্রয়োজনে আপনি এ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন।

একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে – জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।

(নির্মলেন্দু গুণ - স্বাধীনতা - এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো)


সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন।

ইদ মুবারাক।


সহায়ক লিংকসমূহঃ

১। ছন্দ কাকে বলে

২। বাংলা ছন্দ

৩। স্বরবৃত্ত ছন্দ

৪। কবিতা লেখার নিয়ম/ কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ ।। দ্বিতীয় সংস্করণ: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিতব্য, ফেব্রুয়ারী, ২০১১।। , পোস্ট করেছেন ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জি

৫। কবিতার কথাঃ তিন প্রকার ছন্দ,মুক্তমনা ব্লগ, হাসানআল আব্দুল্লাহ

৬। ছন্দ নিয়ে কিছু সহজ কথা, কবি সরদার ফারুক

৭। ছন্দ: ছড়া, পদ্য, কবিতা, মুক্তচিন্তা ব্লগ, ব্লগার যুক্তিযুক্ত। মূল উৎসঃ কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ ।। দ্বিতীয় সংস্করণ: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত, ফেব্রুয়ারী ২০১১। মূল রচয়িতা কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ।

৮। ছন্দ - বাংলাপিডিয়া

৯। হেলাল হাফিজের কবিতার ছন্দ, রাকিবুল রকি, ভোরের কাগজ, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

১০। সহজ ভাষায় বাংলা কবিতার ছন্দ শিক্ষা, সৌরভ

১১। ছন্দ, মকসুদা হালিম
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:৪৮
৫৪টি মন্তব্য ৫৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×