somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবিতার প্যাটার্ন; কবিতা ভাঙবার মজা, বা খেলা

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছন্দ নিরীক্ষণে রবীন্দ্রনাথ নিজের কবিতাকে বিভিন্ন ভাবে ভাঙতেন, সাজাতেন, এবং একই চরণকে বিচিত্র রূপে পঙ্‌ক্তিতে ভাগ করতেন। কীভাবে? চলুন, কিছু আলোচনা করি।

নীচের কবিতাটি আমার, যা গত বছরের জুলাইয়ে লিখেছিলাম। এর ভিন্নরূপটি শুরুতেই দেখা যাক।

***

সে এক ক্ষণজন্মা পাখি, প্রতিটা গোপন সাঁঝে অরূপ পাথারে নেমে এসে অলৌকিক সুর তোলে গানে। তারপর রাত্রি শেষে ফিরে যায়, পেছনে রেখে যায় একগুচ্ছ পদছাপ, ও কয়েকটা পালক। মাটিতে করুণ দাগ কেটে একধ্যানে চেয়ে থাকে বিবাগী বালক।

***

উপরে কবিতাটিকে খাঁটি গদ্যাকারে সাজানো হয়েছে। এরূপ টানা গদ্যের কবিতাকে ‘ফ্রি ভার্স’ বলা হয়। ফ্রি-ভার্সের বাংলা অর্থ ‘অমিত্রাক্ষর’ , যাকে অধুনা ব্লগে কেউ কেউ ‘মুক্তগদ্য’ হিসাবে নতুনভাবে নামকরণ করছেন।

‘ফ্রি ভার্স’ হলো এক প্রকার ছন্দের নাম, অন্য কিছু না। অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত বা এদের সংমিশ্রণের প্রভাব থেকে ছুটে আসার প্রবণতা থেকে ধীরে ধীরে ‘ফ্রি ভার্স’ সৃষ্টি হয়েছে। এটা গদ্য নয়- (ভার্স অর্থ কবিতা, বা ছড়া, বা কবিতার লাইন)। অবয়বে গদ্যের মতো, গদ্যের সাথে সাদৃশ্য এটুকুই। উন্মুক্ত কবিতা, বা মুক্ত কবিতা, বা মুক্তচ্ছন্দ। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ‘ফ্রি ভার্স’-এর চেয়ে সহজতর ও অধিক উপযুক্ত কোনো উপায় নেই। এখানে আপনার উন্মুক্ত ভাবনাকে উন্মুক্তভাবেই প্রকাশ করার স্বাধীনতা পাচ্ছেন।

নীচে আরও দুটি ফ্রি-ভার্স দেখুন।

***

আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ। এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি- তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি, মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে- (ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)

আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক। ঘামে ছিল না এমন গন্ধক যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পারি। নিখিলেশ, তুই একে কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা; আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না। আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম, আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে জীবন বদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একই নদীর তরঙ্গে ছেলেবেলার মতো ডুবসাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই, আমার ঘরের দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি …, ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার; ইচ্ছে ছিল না জানাবার এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাতড়ে টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায় আছে অদূরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায় কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।

***

প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী প্রমীলা, পতি-বিরহে-কাতরা যুবতী। অশ্রুআঁখি বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে কভু, ব্রজ-কুঞ্জ-বনে, হায় রে যেমনি ব্রজবালা, নাহি হেরি কদম্বের মূলে পীতধড়া পীতাম্বরে, অধরে মুরলী। কভু বা মন্দিরে পশি, বাহিরায় পুনঃ বিরহিণী, শূন্য নীড়ে কপোতী যেমতি বিবশা! কভু বা উঠি উচ্চ-গৃহ-চূড়ে, এক-দৃষ্টে চাহে বামা দূর লঙ্কা পানে, অবিরল চক্ষুঃজল পুঁছিয়া আঁচলে!— নীরব বাঁশরী, বীণা, মুরজ, মন্দিরা, গীত-ধ্বনি। চারি দিকে সখী-দল যত, বিরস-বদন, মরি, সুন্দরীর শোকে! কে না জানে ফুলকুল বিরস-বদনা, মধুর বিরহে যবে তাপে বনস্থলী?

উতরিলা নিশা-দেবী প্রমোদ-উদ্যানে। শিহরি প্রমীলা সতী, মৃদু কল-স্বরে, বাসন্তী নামেতে সখী বসন্ত-সৌরভা, তার গলা ধরি কাঁদি কহিতে লাগিলা,— “ওই দেখ, আইল লো তিমির যামিনী কাল-ভুজঙ্গিনী-রূপে দংশিতে আমারে, বাসন্তি! কোথায়, সখি, রক্ষঃ-কুল-পতি, অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ, এ বিপত্তি কালে? এখনি আসিব বলি গেলা চলি বলী; কি কাজে এ ব্যাজ আমি বুঝিতে না পারি। তুমি যদি পার, সই, কহ লো আমারে।”

কহিলা বাসন্তী সখী, বসন্তে যেমতি কুহরে বসন্তসখা,— “কেমনে কহিব কেন প্রাণনাথ তব বিলম্বেন আজি? কিন্তু চিন্তা দূর তুমি কর, সীমন্তিনি! ত্বরায় আসিবে শূর নাশিয়া রাঘবে। কি ভয় তোমার সখি? সুরাসুর-শরে অভেদ্য শরীর যাঁর, কে তাঁরে আঁটিবে
বিগ্রহে? আইস মোরা যাই কুঞ্জ-বনে। সরস কুসুম তুলি, চিকণিয়া গাঁথি ফুলমালা। দোলাইও হাসি প্রিয়গলে সে দামে, বিজয়ী রথ-চূড়ায় যেমতি বিজয়পতাকা লোক উড়ায় কৌতুকে।”


***

‘ফ্রি ভার্স’-কে দুই প্যাটার্নে লেখা যায় :

১) কোনোরূপ অন্ত্যমিল না রেখে, এবং
২) পুরোটাই একটা গদ্যের মতো করে লিখে।

Free Verse-এর উপর আমেরিকান সমালোচক জন লিভিংস্টোনের একটি পর্যবেক্ষণলব্ধ মন্তব্য দেখুন, যা তিনি ১৯১৬ সালে বলেছিলেনঃ

“চমৎকার গদ্যে আপনি একটি অনবদ্য কবিতা লিখে ফেলতে পারেন; কবিতার ভাষায়ও একটা উৎকৃষ্ট গদ্য লিখে ফেলা সম্ভব।”

তাহলে গদ্য আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

জন লিভিংস্টোনের কথাটি ফেইসবুকে স্টেটাস আকারে প্রকাশ করা হলে এর উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমেন্ট পাওয়া যায়। নীচে দেখুন।

কবি মজনু শাহ : হয়ত পার্থক্য তেমন কিছু নাই। আবার আছেও। গদ্য একটা যুক্তিকাঠামো চায়, তা হয়ে উঠতে চায় পরিণতিময়। সুনির্দিষ্ট অর্থ আরোপ করতে চায় সে। কবিতা প্রায়শ এই যুক্তিশৃঙ্খলা পেরিয়ে গিয়ে চায় শব্দাতীত কোনো অনুভব। বা নৈঃশব্দ্য। এই জন্যে ভালো কবিতাগুলো অনন্ত অর্থময়, দৃশ্যত গদ্য তা নয়, গদ্য তেমন হয়ে উঠলে তা তার উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে এগোয়।

ত্রিশোনকু মল্লিক : শব্দ চয়নে আর ভাবের গভীরতায়।

Maximus Millius : নিদ্রা আর তন্দ্রায় যে পার্থক্য- আমার কাছে কাব্য নিদ আর গদ্য ঘোর।

John Livingston Lowes-এর কথাটা আমি সামান্য ঘুরিয়ে বলেছি। ঐ সময়ে যেসব Free Verse রচিত হতো তা দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘Free verse may be written as very beautiful prose; prose may be written as very beautiful free verse.’ টি এস এলিয়ট বলেছেন, ‘No verse is free for the man who wants to do a good job’.

‘ফ্রি ভার্স’ কী সে-সম্পর্কে টি. এস. এলিয়ট বলেছেন :

১) এর কোনো প্যাটার্ন বা রূপকল্প থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্তকল্প।
২) এতে কোনো অন্ত্যমিল থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্ত মিল।
৩) এতে কোনো ছন্দ থাকবে না, অর্থাৎ এটি হবে মুক্ত ছন্দ।

শুরুতে আমার নিজের কবিতাটিসহ অন্য যে দুটি কবিতা উদ্ধৃত করেছি, সেটি টি. এস. এলিয়টের বেঁধে দেয়া বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অর্থাৎ, এটি হবে একটি খাঁটি গদ্যের মতো। খাঁটি গদ্য আর কবিতার মধ্যে কি তাহলে কোনো পার্থক্য নেই? পার্থক্য অবশ্যই আছে- কবিতার ভাষাই বলে দেবে এটি দেখতে গদ্যের মতো হলেও এটি একটি কবিতা। বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ গ্রন্থের ২য় পর্বে অধ্যাপক পবিত্র সরকারের একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত হয়েছে এ শিরোনামে- ‘কাব্যভাষার ব্যাকরণ’। সেটি পড়লে গদ্য ও কবিতার ভাষা যে এক নয় তার কিছু ব্যাখ্যা মেলে।

‘মেঘনাদ বধ’ -এ কোনো অন্ত্যমিল নেই, এটা ফ্রি ভার্স, যা মূলত ১৪ অক্ষরের পয়ারে রচিত; অমিত্রাক্ষর পয়ার এর নাম। কিন্তু বাক্যগঠন এমন যে সাধারণ পয়ারের মতো সর্বত্রই এক পঙ্‌ক্তিতে একটি বাক্য গঠিত হয় নি, অর্থৎ, পঙ্‌ক্তির মাঝখানে ‘দাঁড়ি’, সেমি-কোলন দেখা যায়, এবং আবৃত্তির সময় এটিকে অবিকল গদ্যের মতোও পাঠ করা যায়। সেই হিসাবে এটি খাঁটি অমিত্রাক্ষর পয়ার নয়, এটিও ফ্রি-ভার্স-এর বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। পয়ারে ৮+৬ অক্ষরের দুটি পর্ব থাকে, যা ১ম পর্বে অর্ধ বিরতি, ২য় পর্ব শেষে পূর্ণ বিরতি লাভ করে থাকে।

আমাদের ছোটো নদী | চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার | হাঁটুজল থাকে

এখানে একটা পঙ্‌ক্তিতে বাক্য সম্পন্ন হচ্ছে।

কিন্তু অন্যত্র দেখুনঃ

“এই কি সেই আগ্রা, হায় আকবর যাহারে
সাজায়েছে দিবানিশি?” (আগ্রা – কায়কোবাদ)

কিংবা,

“কি ভয় তোমার সখি? সুরাসুর-শরে
অভেদ্য শরীর যাঁর, কে তাঁরে আঁটিবে
বিগ্রহে?” (মেঘনাদ বধ – মধুসূদন)

আগ্রা বা মেঘনাদ বধ থেকে উদ্ধৃত অংশে পঙ্‌ক্তি শেষে বাক্য শেষ হচ্ছে না, প্রলম্বিত হয়ে পরের পঙ্‌ক্তিতে যাচ্ছে।

***

রবীন্দ্রনাথ ছন্দের প্রয়োজনে একই কবিতা এভাবে ভেঙে ভেঙে দেখিয়েছেন যে, এভাবে ভাঙবার ফলে আবৃত্তির ঢংটাই পালটে যায়।

ইংরেজিতে যেটাকে ‘ফ্রি-ভার্স’ বলা হয়, আমি তার সাথে পরিচিত বেশ আগে থেকেই, এবং আমি নিজের অজান্তেই ‘ফ্রি-ভার্স’-এর প্রতি ঝুঁকে পড়ি মূলত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে। ব্লগে কোনো এক সময় কবিতার প্রচলিত ফরম্যাট উপেক্ষা করে আপনা-আপনিই ‘ফ্রি-ভার্স’ লিখতে থাকি। ‘ফ্রি-ভার্স’ লিখতে লিখতেই খেয়াল করি- এটা গল্প নয়, কিন্তু গল্পের মতো, কবিতা নয়, তবে কবিতা বলে ভ্রম হতে পারে, এবং প্রবন্ধ বা রম্যও নয়। তখন আমি নিশ্চিত হই যে, আমি আদতে ‘ফ্রি-ভার্স’ লিখছি না, লিখছি এমন কিছু যার কোনো সঠিক ক্যাটাগরি নেই।

মূলত ‘মুক্তগদ্য’ বা ‘ফ্রি-ভার্স’ বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন মধ্যগগনে, তখন থেকেই তিনি এই অবয়বের কবিতা লিখতে শুরু করেন, এবং প্রচুর লিখেছেন। কবি আবিদ আজাদের ‘মুখবন্ধ’, ‘বৃষ্টির ফোঁটা ও পাতাবাহার গাছ নিয়ে’, ‘ভোরবেলা’, ‘৪ঠা অক্টোবর’, ‘১৯৮৭’, ‘ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল’, ‘পারা না-পারা’, ‘তারা ও মানুষ’, ‘স্ক্রু’, ‘২৭-১১-৯০-এর ৪-৩০ মিনিটে লেখা’, ‘তোমার ছবির সামনে’, ‘নন্দনতত্ত্ব’, ‘ভূত ও পেতনিদের নিয়ে আরো একটি কবিতা’, ‘জাদু এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বপ্ন’, ইত্যাদি কবিতাগুলো সার্থক ‘ফ্রি-ভার্সের’ উদাহরণ।

শামসুর রাহমান শেষের দিকে দীর্ঘকায় ‘ফ্রি-ভার্স’ লিখেছেন। ‘মেঘলোকে মনোজ নিবাস’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘রাত আড়াইটার পঙ্‌ক্তিমালা’, ‘স্বপ্ন জাগরণের সীমানায়’, ‘সারা জীবনই গোধূলি আকাশ’, ‘ডাকহরকরা বিলি করলেও’, ‘পাস্তারনাকের কাব্যগ্রন্থের নিচে’, ইত্যাদি বৃহদাকার কবিতাগুলো উল্লেখযোগ্য।

আমি যতদূর পাঠ করেছি, বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কবিদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান হলেন এরূপ কবিতার পথিকৃৎ। এগুলোর বাহ্যিক অবয়ব দেখলে গদ্য বলে ভ্রম হবে। কিন্তু পাঠ করলেই ধীরে ধীরে আপনি এক নতুন জগতে প্রবেশ করবেন। সৈয়দ আলী আহসানের ‘সহসা সচকিত’ কাব্যগ্রন্থের সিকোয়েল নম্বর ৯, ১০, ১১, ১২, ১৫, ১৬, ১৮, ২০, ২১, ৩২, ৩৩, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৯, ৪২, ৪৩, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫৩, ৬০, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৮৩, ‘সমুদ্রেই যাব’ কাব্যগ্রন্থের ‘জানালায় সমুদ্র’, ‘সৌরভ’, ইত্যাদি কবিতাগুলোও অনুরূপ ‘মুক্তগদ্য’ অথবা ‘ফ্রি ভার্স’।

উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও ‘ফ্রি-ভার্স’ ছিল। ফ্রি ভার্স আদতে গদ্য নয়, কবিতা বা কবিতার মতো। ছন্দ সমীক্ষণে যেটাকে মুক্তক অক্ষরবৃত্ত বা গদ্যছন্দ বলা হয়, ফ্রি-ভার্স বা মুক্তগদ্যে তা থেকে ভিন্ন কিছু দেখা যায় না। মুক্তগদ্যকে ‘অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’ ছন্দের কবিতা বলাই উত্তম। ‘অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’ কী? এই যে আমি এই আর্টিকেলটি লিখছি, এর যে-কোনো টানা গদ্যের অনুচ্ছেদ বা অনুচ্ছেদসমগ্রই হলো ‘অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’। কিন্তু গদ্যাকারে লিখলেই সেটা কবিতা হয় না, তা নতুন কোনো কথা নয়। লেখা পাঠের পর যে উপলব্ধি, তা থেকেই বুঝবো- হয় কবিতা পড়লাম, অথবা নিছক গদ্য।

কবি মুজিব মেহদী সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘উভলিঙ্গ’ অভিধায় প্রচুর পোস্ট লিখেছেন, যা আমার কাছে উৎকৃষ্ট মানের কবিতা মনে হয়েছে। এগুলো ‘অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’ বা ‘ফ্রি-ভার্স’ বা ‘মুক্তগদ্য’ থেকে ভিন্নতর কিছু নয়- কেবল নামকরণটাই ভিন্ন মনে হয়েছে আমার কাছে। কবি মুক্তি মণ্ডল, দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু, টোকন ঠাকুর, ইমরান মাঝি, গেওর্গে আব্বাস, লাবণ্যপ্রভা, অক্ষর, (খুব সম্ভবত মাহবুব লীলেন ও ছন্নহারার পেনসিলও), নির্ঝর নৈঃশব্দ্য এই আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। আরেকজন ব্লগারের নাম আমি ভুলে গেছি, মৃন্ময় আহমেদ কিংবা কাছাকাছি কেউ- যাঁকে সর্বপ্রথম ব্লগে এ আঙ্গিকে কবিতা লিখতে দেখেছি। কিন্তু তিনি এগুলোকে হয় গল্প অথবা কবিতা নামে ট্যাগ করতেন বলে আমার মনে পড়ে। অনেক দিন আগের কথা- কিছু তথ্য ভুলও হতে পারে। আমি ব্লগে এ আঙ্গিকের প্রচুর পোস্ট লিখেছি- কিন্তু আমি স্বীকার করছি (উপরে একবার উদ্ধৃত করেছি), ওগুলো হয়তো কবিতা হয় নি, বা গদ্যও নয়, কিন্তু এগুলো লিখবার জন্য আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। উৎসাহী বন্ধুরা সময় পেলে পোস্টগুলো ঘুরে আসতে পারেন। এগুলো কিছুই না হোক, কবিতার প্যাটার্ন হিসাবে এটাই আমার স্বকীয়তা।

এ শহর ছেড়ে তোর চলে যাবার কথা শুনে

আমরা ভাগ হয়ে যাচ্ছি; ভেঙে যাচ্ছি

কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে মেয়েটি বসে ছিল

আমরা মেয়েদের কথা মনে রাখি, মেয়েরা ভুলে গেছে

শৈশবের দুঃখগুলো

প্রিয় বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেলে

বিতণ্ডা অথবা তোর অভিমান; আমি কোনোটাই মেনে নিই নি

আটলান্টিকা

একটা কবিতার গোড়াপত্তন ও এর অর্থবোধকতার পর্যায় সমূহ

কী কী কারণে বউ বা প্রেমিকাকে ভালোবাসেন!!

ক্ষণজন্মা-২০

ক্ষণজন্মা- ১৮

মৃত সরোবর

শাপলাশালুকডাহুকের শৈশব

স্বাক্ষর

অহনাঃ সাকারে; নিরাকারে

পশ্চিম বাংলার কবিরা এ আঙ্গিকের কবিতাকে অনেক আগে থেকেই ‘নতুন কবিতা’ বলে আখ্যা দিয়ে আসছিলেন। এটার আবিষ্কারক কবি বারীণ ঘোষাল। তবে কবিতার প্রচলিত ফরম্যাট ও গদ্য ফরম্যাট দুটোতেই ‘নতুন কবিতা’ লিখতে দেখেছি। ঐ ‘নতুন কবিতা’র দেখাদেখি বাংলাদেশে ‘নতুন ধারা’ শুরু হতে দেখেছিলাম কোনো একটা ওয়েব্লগে। পশ্চিম বাংলার কবিরা বর্তমানে ‘নতুন ধারা’ থেকে সরে এসে ‘মুক্তগদ্য’ লিখছেন কিনা তা আমি জানি না। হতে পারে যে তাঁরা ‘নতুন কবিতা’ ও ‘মুক্তগদ্য’ দুটোই লিখছেন। তবে ২০০২-২০০৭ সালে কবিতা-মুক্তমঞ্চে এ নিয়ে অনেক আলোচনা-বিতর্ক করেছি, যার কিছু অংশ পরে সামহোয়্যারইন ব্লগে শেয়ার করেছিলাম।

কোনো লেখা সাবলীল নাকি জটিল, একটানে পড়ে শেষ করা যায় নাকি বোরিং- তা হলো লেখকের দক্ষতার ব্যাপার। আপনার কবিতা একনিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, আপনার গদ্য গতিশীল। আমার গদ্য গতিশীল না, তাই একনিশ্বাসে শেষ করা যাবে সেটা আশা করা যায় না।

নতুন যে-কোনো কিছুর প্রতিই মানুষের আগ্রহ খুব বেশি হয়ে থাকে। ‘মুক্তগদ্য’ নামটা খুব জুতসই ও শ্রুতিমধুর। কিন্তু নামটা নতুন ও আকর্ষণীয় মনে হলেও ‘মুক্তগদ্য’র ভিতরে আমি এ যাবত যা দেখেছি, তা হলো আমার পূর্ব-পরিচিত গদ্য-আঙ্গিকের কবিতামাত্র। এগুলো আমাদের পূর্বসূরিরা লিখে আমাদের পথ প্রশস্ত করে দিয়ে গেছেন।

কবিতার এতসব ফরম্যাট দেখে বিচলিত হয়ে একবার লিখলাম ‘৪০০০ সালের কবিতা।’

***

আমার কবিতাটিতে অন্ত্যানুপ্রাসের ব্যবহার রয়েছে, এবং এটা মূলত সমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্তে রচিত। সমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্তের স্টাইলে আমার কবিতাটিকে সাজালে এর আঙ্গিক কীরূপ হয়, দেখুন নীচে :

সে এক ক্ষণজন্মা পাখি, প্রতিটা গোপন সাঁঝে অরূপ পাথারে নেমে এসে
অলৌকিক সুর তোলে গানে। তারপর রাত্রি শেষে
ফিরে যায়, পেছনে রেখে যায় একগুচ্ছ পদছাপ, ও কয়েকটা পালক
মাটিতে করুণ দাগ কেটে একধ্যানে চেয়ে থাকে বিবাগী বালক

আমার কবিতাটির মূল স্ট্রাকচার ওটাই। ওটাকে অন্যভাবেও সাজানো যায়, যেমন :

সে এক ক্ষণজন্মা পাখি, প্রতিটা গোপন সাঁঝে
অরূপ পাথারে নেমে এসে অলৌকিক সুর তোলে গানে।
তারপর রাত্রি শেষে ফিরে যায়, পেছনে রেখে যায়
একগুচ্ছ পদছাপ, ও কয়েকটা পালক। মাটিতে করুণ
দাগ কেটে একধ্যানে চেয়ে থাকে বিবাগী বালক

***

এবার উপরে উদ্ধৃত বাকি গদ্য দুটোকে আমরা কবিতার মতো সাজাই। দেখুন এর প্রকৃত রূপ কেমন হয়।

***

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ।
এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি- তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-
(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)
আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পারি। নিখিলেশ, তুই একে
কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে
বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কি না;
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবন বদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একই নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো ডুবসাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত
দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই, আমার ঘরের
দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি …, ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাতড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদূরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে
বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।

***

প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী
প্রমীলা, পতি-বিরহে-কাতরা যুবতী।
অশ্রুআঁখি বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
কভু, ব্রজ-কুঞ্জ-বনে, হায় রে যেমনি
ব্রজবালা, নাহি হেরি কদম্বের মূলে
পীতধড়া পীতাম্বরে, অধরে মুরলী।
কভু বা মন্দিরে পশি, বাহিরায় পুনঃ
বিরহিণী, শূন্য নীড়ে কপোতী যেমতি
বিবশা! কভু বা উঠি উচ্চ-গৃহ-চূড়ে,
এক-দৃষ্টে চাহে বামা দূর লঙ্কা পানে,
অবিরল চক্ষুঃজল পুঁছিয়া আঁচলে!—
নীরব বাঁশরী, বীণা, মুরজ, মন্দিরা,
গীত-ধ্বনি। চারি দিকে সখী-দল যত,
বিরস-বদন, মরি, সুন্দরীর শোকে!
কে না জানে ফুলকুল বিরস-বদনা,
মধুর বিরহে যবে তাপে বনস্থলী?
উতরিলা নিশা-দেবী প্রমোদ-উদ্যানে।
শিহরি প্রমীলা সতী, মৃদু কল-স্বরে,
বাসন্তী নামেতে সখী বসন্ত-সৌরভা,
তার গলা ধরি কাঁদি কহিতে লাগিলা,—
“ওই দেখ, আইল লো তিমির যামিনী
কাল-ভুজঙ্গিনী-রূপে দংশিতে আমারে,
বাসন্তি! কোথায়, সখি, রক্ষঃ-কুল-পতি,
অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ, এ বিপত্তি কালে?
এখনি আসিব বলি গেলা চলি বলী;
কি কাজে এ ব্যাজ আমি বুঝিতে না পারি।
তুমি যদি পার, সই, কহ লো আমারে।”
কহিলা বাসন্তী সখী, বসন্তে যেমতি
কুহরে বসন্তসখা,— “কেমনে কহিব
কেন প্রাণনাথ তব বিলম্বেন আজি?
কিন্তু চিন্তা দূর তুমি কর, সীমন্তিনি!
ত্বরায় আসিবে শূর নাশিয়া রাঘবে।
কি ভয় তোমার সখি? সুরাসুর-শরে
অভেদ্য শরীর যাঁর, কে তাঁরে আঁটিবে
বিগ্রহে? আইস মোরা যাই কুঞ্জ-বনে।
সরস কুসুম তুলি, চিকণিয়া গাঁথি
ফুলমালা। দোলাইও হাসি প্রিয়গলে
সে দামে, বিজয়ী রথ-চূড়ায় যেমতি
বিজয়পতাকা লোক উড়ায় কৌতুকে।”

***

ফ্রি ফার্স বা অমিত্রাক্ষর ছন্দকে অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত বলা যায়। কিন্তু যখন মুক্তক অক্ষরবৃত্তের মধ্যে অন্ত্যানুপ্রাস পাবেন, তখন ওটিকে ‘সমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত’ বলা হবে। উদ্ধৃত কবিতা দুটির প্রথমটি সমিল এবং পরেরটি অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্তের উদাহরণ।


৪-৮ মে ২০১৪ তারিখে আমি ফেইসবুকে নীচের কবিতাংশ উদ্ধৃত করে কবির নাম জানতে চেয়েছিলাম। কেউ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কেউ মাইকেল মধুসূদনের নাম বলেছিলেন।


ক্ষণে ক্ষণে তরঙ্গের ’পরে গগনের
স্নিগ্ধ শান্ত আলোখানি বিচ্ছুরিত হয়ে
যেন লাগে; ফুটে ওঠে সোনার কমল
ক্ষণিক সৌরভে তার নিখিলেরে করিয়া
বিহ্বল। সেই পদ্মখানি এনে দেয় মোর
পরিচয় পল্লবসম্পুটে। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ
হয়ে পড়ি আমি লিখন তাহার, ‘হে তরুণ,
দস্যু নহো, পশু নহো, নহো তুচ্ছ কীট-
শাপভ্রষ্ট দেব তুমি।’

শাপভ্রষ্ট দেব আমি! আমার নয়ন
তাই বন্দি যুগ-বিহঙ্গের মতো দেহের
বন্ধন ছিড়ি শূন্যতায় উড়ি যেতে চায়
আকণ্ঠ করিতে পান আকাশের উদার
নীলিমা। তাই মোর দুই কর্ণে অরণ্যের
পল্লবমর্মর প্রেমগুঞ্জনের মতো
কী অমৃত ঢালে মর্ম-মাঝে। রবির
গভীর স্নেহে, শিশিরের শীতল প্রণয়ে
শুষ্ক শাখে তাই ফোটে ফুল, দক্ষিণপবন
তারে মৃদু হাস্যে আন্দোলিয়া যায়। রাত্রির
রাজ্ঞীর বেশে পূর্ণচন্দ্র কভু দেয় দেখা,
আঁধারের অশ্রুকণা আঁধারের মাণিক্য
হয়ে জ্বলে ত্রিযামার জাগরণ-তলে।
স্তব্ধ চিত্তে চেয়ে থাকি; অন্তরের নিরুদ্ধ
বেদনা। সযত্নে সাজাই নিত্য উৎসবের
প্রদীপের মতো আনন্দের মন্দির সোপানে।
সুধায় নির্মিত মোর দেহসৌধখানি,
ইন্দ্রিয় তাহার বাতায়ন- মুক্ত করি
রাখি তারে আকাশের অকূল আলোকে
অন্ধকার-অন্তরালে অন্তরের মাঝে
বিনিঃশেষ করি যে গ্রহণ। অক্ষম,
দুর্বল আমি নিঃস্বমূল নীলাম্বর-তলে,
ভঙ্গুর হৃদয়ে মমবিজড়িত সহস্র পঙ্গুতা-
জীবনের দীর্ঘ পথে যাত্রা করেছিনু
কোন স্বর্ণরেখাদীপ্ত ঊষাকালে- আজ
তার নাহিকো আভাস। আজ আমি ক্লান্ত
হয়ে পথপ্রান্তে পড়ে আছি নীরব ব্যথায়
শান্ত মুখে ঝরে-পড়া বকুলের গন্ধস্নিগ্ধ
বিজন বিপিনে। সেই মোর গোধূলীর
সুরভি আঁধারে যার সাথে দেখা, যার
সাথে সঙ্গোপনে প্রণয়গুঞ্জন, যার
স্পর্শে ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়ের বেদনার
মেঘে চমকিয়া খেলি যায় হর্ষের বিজলি,-
নেত্রের মুকুরে তার দেখেছি আপন
প্রতিচ্ছবি, দেখিয়াছি দিনে-দিনে, ক্ষণে-ক্ষণে
আপনার ছায়া, দেখিয়াছি কান্তি মম
দেবতার মতো অপরূপ, ভাস্করের
মতো জ্যোতির্ময়,- তখন বুঝেছি প্রাণে,
আমি চিরন্তন পুণ্যচ্ছবি, নিষ্কলঙ্ক রবি।

প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন

বন্দি করি রচেছো আমায়! নির্মম নির্মাতা মম-
এ কেবল অকারণ আনন্দ তোমার! মনে করি,
মুক্ত হবো; মনে ভাবি রহিতে দিব না মোর তরে
এ-নিখিলে বন্ধনের চিহ্নমাত্র আর।

***

সারাংশ নয়

আপনাদের কারো মনে কোনো সংশয় ছিল না প্রথমোক্ত কবিতা দুটি কার লেখা, কিন্তু পরেরটি কোনো সুপরিচিত কবিতা না, তবে একজন বিখ্যাত কবির কবিতা এটি। এখানে কবিতাটিকে যে আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে, বেসিক স্ট্রাকচার এটা নয়। কারো যদি কবিতাটি আগে পড়া না থাকে, তাহলে এ কবিতার ভাবগাম্ভীর্য, শব্দ-চয়ন, ইত্যাদি থেকে অনুমান করে কবির নাম নির্ণয় করা সুকঠিনই বটে। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো- কবিতাকে আমরা যে প্যাটার্নেই সাজাই না কেন, কবিতা তার নিজের জায়গাতেই থাকে, শুধু বাহ্যিক রূপটা আমরা বদলাতে থাকি- পয়ার, ফ্রি-ভার্স, উভলিঙ্গ, মুক্তগদ্য, সনেট- ইত্যাদি।

কবিতা যেভাবে গদ্যের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, তাতে একদিন রবীন্দ্রনাথের অনেক গদ্য বা প্রবন্ধকে কবিতা মনে হবে। আর আমরা অবাক হয়ে দেখবো যে, কাজী নজরুল ইসলামের সব গদ্য কবিতা কিংবা মুক্তগদ্য হয়ে গেছে।

নামে আর কী যায় আসে- এ কথাটা আমার মুদ্রাদোষ। যা লেখা হলো, যা পাঠ হলো- তা যদি নিজের গুণ ও গুরুত্বে কালের পাতায় ঠাঁই করে নিতে পারে- তাহলে সেটাই হবে উৎকৃষ্ট কবিতা, মুক্তগদ্য বা ফ্রি-ভার্স।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:০৫
৪৭টি মন্তব্য ৪৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেভাবে কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশ পরবর্তী নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করতে পারবে

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১৬ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৮:৪৩

আমি ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছু কিছু সাপোর্ট করি। যদিও জানি, ইমাম মাহদী (আঃ) আসার আগে পর্যন্ত কোন ইসলামী দলই পরিপূর্ন সমাধান হিসেবে আবিভূর্ত হতে পারবে না। তবে, আহলে বায়াত... ...বাকিটুকু পড়ুন

নির্বাচিত দেবদূত

লিখেছেন সাজিদ উল হক আবির, ১৬ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ১০:৫৩

ব্লগের শিরোনামে যে শব্দগুচ্ছ দেখলেন, সেটা আমার ১০ম বই (৫ম ছোটগল্পের সংকলন) এর নাম। অনুবাদ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আমার এই বইটি এ বছর মর্যাদাপূর্ণ কালি ও কলম তরুণ কথাসাহিত্যিক এর... ...বাকিটুকু পড়ুন

গোপালগঞ্জের ঘটনায় জাতি আরেকদফা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১৭ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:২০

জুলাই গনঅভ্যূত্থানের বর্ষপুর্তিতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈ্তিক দল এনসিপি জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসাবে গতকাল গোপালগঞ্জ যায়। গতকাল গোপালগঞ্জে দিনব্যপী সংঘর্ষের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধরনের বক্তব্য দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

গোপালগঞ্জে এটা দরকার ছিল!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৫৪


দফায় দফায় হামলা-সংঘর্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অ্যাকশনে উত্তপ্ত গোপালগঞ্জ। হামলা-সংঘর্ষের সময় অন্তত ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও অনেকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে জেলা শহরে ১৪৪ ধারা ও পরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

NCP'র গাড়ি বহর নিয়ে গোপালগঞ্জ পদ যাত্রা....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৭ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:০৪

NCP'র গাড়ি বহর নিয়ে গোপালগঞ্জ পদ যাত্রা....

সার্বিক অর্থে NCP তাদের পূর্ব ঘোষিত জেলায় জেলায় পদযাত্রা সফর হিসেবে (NCP নেতা সার্জিসের ভাষায় রোড মার্চ টু গোপালগঞ্জ) গোপালগঞ্জে সফল হতে পারেনি স্থানীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×