somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাহাজভাঙা শিল্পঃ বিপন্ন পরিবেশ

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাহাজভাঙা শিল্প এমন একটি বিধ্বংসী শিল্প যা পরিবেশ ও মানুষের মারাত্নক ক্ষতিসাধন করে। বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্পের যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৯৬০ সালে। সেই সময় ঝড়ের কবলে পড়ে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ‘এম ভি আলপাইন’ নামের একটি জাহাজ চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের উপকূলবর্তী এলাকায় আটকে পড়ে। কোনভাবেই এটিকে আবার সমুদ্রে ভাসানো সম্ভব হচ্ছিল না। মূলত ওই জাহাজটিকে সৈকতে টেনে এনে খন্ডিত করার মাধ্যমে শুরু হলেও বাণিজ্যিকভাবে জাহাজভাঙা শুরু হয় স্বাধীনতার পর। সত্তরের দশকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহযোগিতায় কেটে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে জাহাজ আমদানি শুরু করা হয়। আশির দশকের শেষের দিকে এ অঞ্চলের জাহাজভাঙা শিল্পের সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ টিতে উন্নীত হয়।

জাহাজভাঙা শিল্প পরিবেশের ভয়ানক ক্ষতি করে। ভাঙার জন্য আমদানি করা জাহাজগুলোতে থাকে কালো তেল, অ্যাসবেসটস, ক্ষতিকারক রঙ ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। অ্যাসবেসটসকে ধুয়ে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করায় প্রচুর পরমিাণ দূষিত পানি নির্গত হয়। জাহাজ কাটতে গিয়ে সৃষ্টি হয় পুনর্ব্যবহারের অনুপযোগী লোহার গুঁড়া। এসব বর্জ্যের শেষ গন্তব্য হয় সমুদ্র। ফলে জাহাজভাঙা শিল্প এলাকার সমুদ্র আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রের পানির রং ঘোলাটে, কালো হয়ে যায়। সীতাকুন্ডের সমুদ্র উপকূলে মৎস্য আহরণ ৮০ শতাংশের মতো কমে গেছে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে পাওয়া যেত প্রচুর রূপালী ইলিশ, যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া, সমুদ্রের পানির ওপরে যে তেল ও বর্জ্য জমা হয়, তা সূর্যের আলোকে পানির নিচে পৌঁছাতে বাধা দেয়। এতে পানির নিচের উদ্ভিদ জগতের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এসব উদ্ভিদ ছোট ছোট মাছ ও ক্ষুদে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহ করে। সালোকসংশ্লেষণ বাধা পেলে উদ্ভিদের জন্ম ও বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ২১ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এক সময় সমুদ্র উপকূলে যেসব পাখির দেখা মিলত, তা এখন আর দেখা যায় না। জাহাজ ভাঙার ফলে উপকূলীয় এলাকার মাটিতে বিষাক্ত ধাতু ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে রয়েছে পারদ, সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম। শব্দদূষণ এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের অনেক ধরনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। এ শিল্প থেকে সৃষ্ট লোহা ও সীসার অতি মিহি ধুলো ওই অঞ্চলের বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং নিঃশ্বাসের সাথে মানবদেহে প্রবেশ করে। এছাড়া যেকোন ধরনের বিস্ফোরণজনিত ঘটনা ঘটতে পারে। তাই শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য মাস্ক, হেলমেট, নিরাপদ পোশাকের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কিন্তু কোন কোম্পানিই এগুলো সরবরাহ করে না এবং করলেও এর পরিমাণ খুবই কম। প্রায় প্রতি বছর বিভিন্ন শিপইয়ার্ডে বিস্ফোরণ অথবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে ছোট-বড় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া বিষ্ফোরণের কারণে বাতাসে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে শ্রমিকরা স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেযাদী রোগে আক্রান্ত হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের শরীরেও নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। গত ২০ বছরে জাহাজভাঙার কাজ করার সময় প্রায় ৫০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয়েছে আরো ছয় হাজার।
পৃথিবীতে ১৯৫টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৪টি দেশের নিজের লোহা আছে। বাকিরা বাইরে থেকে লোহা আমদানি করে। মাত্র ৫টি দেশ লোহার জন্য জাহাজ ভাঙে- তারা হচ্ছে চীন, তুরস্ক, বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান। চীন ভারী যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজ ভাঙে। তাদের প্রক্রিয়াটিকে সত্যিকার একটি শিল্পই বলা যায়। তুরস্ক তাদের জাহাজভাঙা খুব কমিয়ে এনেছে। শ্রীলঙ্কাকে জাহাজভাঙার প্রস্তাব দিয়েছিল, তারা রাজি হয়নি। থাইল্যান্ড আইন করে জাহাজভাঙা বন্ধ করেছে। অথচ বাংলাদেশে মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ আমদানি বাড়ছে। বাংলাদেশে মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ লোহা আসে জাহাজভাঙা শিল্প থেকে। বাকি চাহিদা পূরণ হয় লোহার ‘বিলেট’ আমদানি করে। তাতে খরচ পড়ে প্রতি মেট্রিক টনে ৬০০ ডলারের মতো। আর জাহাজ ভেঙে লোহা উৎপাদন করলে প্রতি মেট্রিক টনে এর চেয়ে মাত্র ১০০ ডলার (সাত হাজার টাকা) কম খরচ হয়। প্রতি মেট্রিক টন লোহায় মাত্র ৭০০০ হাজার টাকা বাঁচাতে গিয়ে আমরা আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবনকে যে ভয়াবহ দিকে নিয়ে যাচ্ছি তার মূল্য কে দেবে?
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৭ই মার্চ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের উপকূলে কোন জাহাজ আনতে হলে আগেই দূষণমুক্ত করে আনতে হবে। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজভাঙার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন আদালত। কিন্তু এরপরও পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি হয়নি। উল্টো উপকূলীয় বন কেটে একের পর এক নতুন শিপইয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে। অবিলম্বে এ শিল্প বন্ধে সরকারের উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। তা না হলে এ শিল্পের ভয়াবহতা থেকে আমাদের পরিবেশকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।
সূত্র: সংগৃহীত

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×