প্রথম পর্ব পোষ্ট করার পর আবার আমাকে ব্লকড করা হয়। আজকে মুক্তি পেলাম। জানিনা আবার ব্লকড করবে কিনা !! যাই হোক , ২য় পর্ব পোষ্ট করে দিলাম।
পর্ব: দুই
আগের পর্বে আমরা দেখলাম আগুনের নিয়ন্ত্রণ আদিম মানুষের এক অসাধারণ আবিষ্কার হলেও তা বাস্তুতন্ত্রের রাজকীয় প্রাণীদের খাদ্য শৃঙ্খলে স্থানচ্যূত করার উপযুক্ত হতে পারেনি। সেকারণেই নিয়ানডার্থাল আর হোমোইরেকটাসরা নিয়মিত বাঘ-সিংহের শিকার হতে থাকে। আবার আগুনের ব্যবহার জানা একাধিক মানব প্রজাতির ইন্ট্রা ও ইন্টারস্পিসিস সংঘর্ষে আগুন বিরাট কিছু সহায়ক শক্তি ছিলনা। চরম শীতে উষ্ণতা প্রদান, অন্ধকারে পথ চিনে নেওয়া, গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে রাত্রিতে হায়না কিম্বা শেয়ালের উপদ্রব থেকে খানিকটা মুক্তিলাভ আর মাংস পুড়িয়ে খাওয়া ছাড়া আগুন বিশেষ কিছু সাংঘর্ষিক সুবিধা প্রাইমেটদের দেয়নি। এছাড়া আগের পর্বে উল্লেখ করেছি এক লাখ কুড়ি হাজার বছর আগে আর সত্তর হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া দু' দুটো ভয়ঙ্কর যুদ্ধের কথা। প্রথমটাই অপেক্ষাকৃত অধিক বুদ্ধিধর নিয়ানডার্থালদের হাতে হোমোস্যাপিয়্যান্সরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পশ্চাদগমন করতে বাধ্য হয় কিন্তু দ্বিতীয় টাতে এই হোমোস্যাপিয়্যান্সরাই নতুন বলে বলীয়ান হয়ে নিয়ানডার্থালদের বিরুদ্ধে রীতিমতো এথেনিক ক্লিনজিং চালায়। কিন্তু কিভাবে? হঠাৎ করে নিয়ানডার্থালদের স্বাস্থ্যের অধঃপতনও ঘটেনি কিম্বা হোমোস্যাপিয়্যান্সরা এই পঞ্চাশ হাজার বছরে ব্রেনের ক্র্যানিয়াল ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করতেও সমর্থ হয়নি। তবে? এই হোমোস্যাপিয়্যান্সের নিরঙ্কুশ বিজয়ের রহস্যটি উন্মোচন করার আগে আমরা আগুনের সাংঘর্ষিক সুবিধার অল্প পরিসরের সমান্তরালে এর অন্য এক সুবিশাল বিবর্তনীয় সুবিধাটি আলোচনা করে নিই।
একটা চারপেয়ে জীবের যখন কুড়ি থেকে পঁচিশ লাখ বছর আগে মস্তিষ্কটা বড় হতে শুরু করে তখন থেকেই তাদের দু'পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু এতে বিবর্তনীয় সুবিধার পাশাপাশি বহুবিধ অসুবিধার সামনে পড়ে এই নব্য বাইপ্যাড প্রাইমেটরা। মস্তিষ্ক বড় হবার অর্থ তাকে অধিক শক্তির যোগান দেওয়া। বিশ্রামের সময় মানুষের মোট আরোহিত শক্তির শতকরা পঁচিশ ভাগ মস্তিষ্ককে সচল রাখতে খরচ হয়। আর মস্তিষ্কের এই দানবীয় শক্তি ক্ষুধার জোগান দিতে আদিম মানুষদের খাদ্য সংগ্রহের সময় গেলো বেড়ে এবং সেইসঙ্গে পেশীর ক্ষয় হওয়া শুরু হয়। ফলে মানুষের দৈহিক সক্ষমতা গেলো কমে। দু'লাখ বছর আগের বৃহৎ মস্তিষ্কের এরকম ছোটখাটো চেহারার এক আদিম মানুষ অবশ্যই একটা শিম্পাঞ্জিকে বিতর্কে হারিয়ে দিতে পারতো কিন্তু সম্মুখ সমরে ঐ শিম্পাঞ্জির কাছে খুন হওয়া তার কয়েক মূহুর্ত্তের খেলা ছিল এবং সেকারণেই শিম্পাঞ্জিরা তাদের সহজলভ্য খাদ্যের সাথে তর্কে জড়াতে রাজি হতোনা কখনোই। মস্তিষ্কের এই ক্রমাগত বৃদ্ধি আর বাড়তে থাকা রাক্ষুসে ক্ষুধা এই শিকারী ও সংগ্রাহক মানুষদের সুবিধার থেকে অসুবিধায় দিয়েছে বেশী। দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে মানুষের অন্ত্র ছোট ও কোমর সরু হওয়া শুরু করে। মানুষের চারপেয়ে কঙ্কালটা এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ছিলনা বলেই ঘাড় ও পিঠের স্থায়ী ব্যথা শুরু হয়। কোমরের শক্তি যায় কমে। সবচেয়ে অসুবিধায় পড়ে নারী প্রাইমেটরা। কখনো ভেবে দেখেছেন একটা বাছুর জন্মের পরেই দৌড় শুরু করে, একটা বিড়াল শাবকের জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নিজস্ব স্বাধীন জীবন শুরু হয়ে যায় আর একটা মানব শিশু এক-দেড় বছরের আগে ঠিকঠাক হাঁটতেই শেখেনা কেন? কারণ ঐ মস্তিষ্কের বড় হওয়ার মাশুল। দু'পায়ে দাঁড়াতেই প্রাইমেট নারীদের কোমরের গঠন পুরোদস্তুর বদলে যায়। কোমর সরু হয় এবং নিতম্ব ভারী। দেহাভ্যন্তরে জন্মনালি ক্রমশঃ সরু হতে থাকে আবার এমন সময়ই গর্ভে রক্ষিত শিশুর মাথাটা বেঢপ মোটা হতে থাকে। ফলস্বরূপ সেইসময় আদিম মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির পূর্বপুরুষদের মা ও শিশুমৃত্যুর হার ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। সেসব শিশুরাই জীবিত থাকতে পারতো যাদের মা দের প্রি ম্যাচুওরড্ ডেলিভারী হতে থাকলো। ফলে অপুষ্ট, দুর্বল ও অপরিণত শিশুর জন্ম হওয়া শুরু হলো যাদের মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ পরিপুষ্ট নয়। এবং এই নতুন ট্রেন্ডই বিবর্তনীয় সুবিধা পেয়ে গেলো। তাই আজো আধুনিক মানবীও যে শিশু র জন্ম দেয় সেগুলি সবই প্রি ম্যাচুওরড্। এদিকে ক্রমশঃ বাড়তে থাকা মস্তিষ্কের রাক্ষুসে ক্ষুধার জোগান দিতে আগুন এখানেই এক বিশাল ভূমিকা পালন করলো। এবং নিশ্চিত ভাবে বলা যায় তা হলো "রান্না"। আগুনের ব্যবহার করে পোড়া মাংস খেতে খেতেই মানুষের খাদ্য তালিকা বিবর্ধিত হলো। আলু আর গম কাঁচা অবস্থায় মানুষ হজম করতে পারতোনা কিন্তু রান্না করে নিলে সহজেই এগুলো হজম হয়। রান্না করা খাবারে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ভয় কম থাকে ফলে রোগের প্রকোপও গেলো কমে। সবচেয়ে বড় কথা হলো রান্না করা খাবারে হজম সময় লাগে অনেক কম। আমাদের নিকটতম আত্মীয় শিম্পাঞ্জিরা দিনে পাঁচঘন্টা খাবার চিবোতে ব্যয় করে, সেখানে আমরা মোটামুটি একঘন্টা। আগুন ব্যবহার করে রান্না আয়ত্ত হতেই মস্তিষ্কের বিকাশ আরো সহজতর হবার সুযোগ পেলো। ফলে আদিম মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি গুলির বুদ্ধি হলো আরো প্রবল। ক্র্যানিয়াল ক্যাপাসিটিতে সব থেকে এগিয়ে ছিল নিয়ানডার্থালরা । তাদের মস্তিষ্কের আয়তন (১৬০০সিসি) আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের(১৪০০সিসি) থেকেও বড় ছিল। এমনটা কি তাহলে বলা যেতে পারে যে হোমোস্যাপিয়্যান্সের বদলে নিয়ানডার্থালরা পৃথিবীর বুকে টিকে থাকলে আরো উন্নততর মানুষ পৃথিবীর বুকে শাসন করতো? অথবা সাধারণ নিয়ানডার্থালরা সকলেই হতো আইনস্টাইন কিম্বা হকিংয়ের মতো মেধাবী আর তাদের আইনস্টাইন অথবা হকিং হতো আরো অনেকবেশী সৃজনশীল বিজ্ঞানী। আমরা জানিনা। বিবর্তনের যাত্রাপথ কত যে চড়াই উৎরাই বেয়ে , কত যে মোড় আর প্যাঁচানো রাস্তা পেরিয়ে অগ্রসর হয় তার কতটুকুই বা আমরা আরোহণ করতে পেরেছি?
.
(পরের পর্ব আসছেে ....)
কৃতজ্ঞতা....জয়ন্ত সিনহা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১০:৩০