somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্যরচনা : পুরনো প্রেম--আশি বা নব্বই দশক

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ৮:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা সময় "দাদা/দিদির বিয়ে" প্রায় একটা উৎসব ছিল যে কোন যৌবনে পা রাখা তরুণ, তরুণীর জন্য। বিশেষ করে গ্রামে বা মফঃস্বলে। আর সেই উৎসব "মহোৎসবে" পরিণত হত যদি দাদার একটি সুন্দরী "ছোট শালি" কিংবা দিদির একটি "তরুণ দেওর" থাকত।

তাহলে তো দাদা বা দিদিটির বিয়ের দিনই আরেকটি বিবাহের বীজ বপন হয়ে যেত। একই বাড়িতে দুই "জা" দুই "বোন", এই গল্প আগে আকছার দেখা যেত। সে সময় অনেকটা গেছে। এখন তো দাদা/দিদির বিয়েতে এমবিএর সেমিস্টারের চাপে থাকা ভাই/বোনটি ছুটিও পায় না। যদিও বা পায়, বেশিরভাগের ততদিনে আড়াইটা প্রেম আর তিনটে ব্রেকআপ হয়ে গেছে। ফলে মন্ডপে কনেপক্ষর সাইডে চেয়ার আলো করে বসে থাকা "দাদার শালি"টিকে দেখে সেই ঘোরলাগা ব্যাপারটা আসে না অনেকক্ষেত্রেই।

শেষ একটা বিয়েবাড়িতে গিয়ে এক প্রায় সমবয়স্ক ভদ্রমহিলার থেকে অ্যাপ্রোচ পেয়েছিলাম "লেটস ডু ইট নাউ অর নেভার"। কলকাতায় আমার এক বন্ধুর দাদার বিয়েতে আমন্ত্রিত ছিলাম মাস ছ'য়েক আগে। লজে বিয়ে হচ্ছিল। নীচের ফ্লোরে আগুনের সামনে যখন বন্ধুটির দাদা ও বৌদি হাতে হাত রাখছিল, ঠিক তখনই লজের খালি ছাদে লিপস্টিকের স্বাদ তেতো না মিষ্টি সেই গবেষণায় গভীরভাবে রত ছিল বন্ধুটি। বৌদির যে বান্ধবীটি ওকে নিজের লিপস্টিক খেতে দিয়ে সাহায্য করছিল গতকাল ফেসবুকে দেখলাম তার বিয়ে হয়ে গেল! বন্ধুকে বললাম আরে সেই মেয়েটা না? বিয়ে করে নিল যে?
উত্তরে বন্ধুটি জানাল - সি ইজ অ্যা গুড কিসার...
তো এই "রাত গয়ি বাত গয়ি"র জমানা ছেড়ে একটু পেছনে হাঁটলে, মনের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে আমাদের শৈশবের সেই বিয়েবাড়িগুলো। যেখানে ছোটকাকুদের দেখে এসেছি মেজকাকুর শালির জন্য দিওয়ানা হয়ে কবিতা লিখতে। কিংবা দেখে এসেছি পিসিমণিদের রাধা হয়ে যাওয়া...

ফেলে আসা সেই সময়ে বিশেষ করে গ্রামের দিকে যেখানে দুমদাম করে প্রেমে পড়া যেত না। যেখানে দাদার জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে বাড়ির ছোট ছেলেটি নিজের কিছু একটা হারিয়ে আসত হবু বৌদির বাড়িতে। দরজার সামনে হবুবৌদির গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো ছটফটে নূপুর পায়ে, কিংবা কাজল চোখে। ওখান থেকে ফিরে এসে দাদারই মতো তারও দিন গোনা শুরু হত, ২২শে অঘ্রাণ কিংবা ১৪ই ফাগুনের জন্য!

বিয়ের দিন আসত। ছেলেটি দাদার থেকেও বেশি মাঞ্জা দিয়ে বরযাত্রীদের সবার প্রথমে বিজয়ী বীরের মতো হবুবৌদির বাড়িতে পা রাখত। গাড়িতে আসতে আসতে বৌদিরা মজা করত,
-দেখছো বাবুর মাঞ্জা, যেন উনি বিয়ে করবেন।
পাশ থেকে বোন বা দিদি হাসতে হাসতে উত্তর দিত,
- বুঝছো না বৌদি, নতুন বৌদির বোনের জন্যই এই সব।
ছেলেটি মনে মনে রাঙা হয়ে গেলেও গম্ভীর থাকার চেষ্টা করত। বরযাত্রী হয়ে নতুন বৌদির বাড়িতে পা রেখেই ব্যস্ততা দেখাতে শুরু করত। যেন কাজ করার জন্যই বরযাত্রী আসা। যেন বাড়িতে সবচেয়ে কাজের একমাত্র ও। যে ছেলে জল গড়িয়ে খায় না তার হঠাৎ কাজের বহর দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত সবাই । আর ছেলেটি? তার চোখ উতলা হয়ে খুঁজে যেত সেই কাজল চোখ দুটোকে...

এরপর কী? এরপর বিয়েতে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে আসরে অবতীর্ণ হতেন "দাদার শ্যালিকা"! ছেলের যেটুক বাকি ছিল ওখানেই সম্পন্ন। তারপর বিভিন্নভাবে সারারাত ধরে একে অপরকে টিজ। দাদার জুতো চুরি, সেই জুতো উদ্ধারে রামভক্ত হনুমান হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। প্রথমে প্রচুর ঝগড়া, তারপর দুজনেরই ক্লান্ত হয়ে গিয়ে বন্ধু হয়ে যাওয়া। ঘনিষ্ঠতা বলতে মেয়েটির হাতের কব্জি চেপে ধরা।
উত্তরে ,
-আহ, লাগছে তো! ছাড়ো, তুমি অসুর নাকি!
- হ্যাঁ অসুর, তো?
মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার কপট চেষ্টা চালাতে থাকত। একটা সময় ছেলেটি হাত ছেড়ে দিত।

বিয়ে শেষ হয়। বরযাত্রী(অপভ্রংশে বজ্জাতি) ফিরে আসে, আসার সময় অনেক চেষ্টা করেও একা দাঁড়িয়ে দুজনে কোনও কথা বলতে পারে না। oppo সেলফি এক্সপার্ট তখন না থাকায় মেয়েটির সঙ্গে ছবি তোলা হয় না। বাড়ি ফিরে এসে আবার অপেক্ষা, তবে এবার হয়ত দু-তরফে। যারা এই অপেক্ষাটুকু করেছে তারা বুক ঠুঁকে বলতেই পারেন, "এক এক দিন অপেক্ষার তুমি কী বুঝবে চাঁদু? তুমি তো মেসেঞ্জারে পিং করে প্রেমে পড়ো। প্রতিটি প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়ের আভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন হল এই এক এক দিনের অপেক্ষা।"

সেই খাট ভাঙ্গতে শিখে তাতে ডুবে থাকা নতুন বৌদিটি, যে তখন প্রায় ভুলতেই বসেছে জগৎসংসার, তাকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া "তার একটি বোনও আছে" এবং তার জন্য বৌদির মন খারাপ হওয়া উচিৎ। এক রকম দেওরের ঠেলায় পড়েই নতুন বৌদি মেনে নেয় "সে বোনকে মিস করছে"। কথাটি সেই রাতেই দাদার কানে যায়। ব্যস কেল্লাফতে। সকালেই ভাইয়ের উপর দায়িত্ব পড়ে শ্যালিকাকে নিয়ে আসার।

এরপর কালিদাসের মেঘদূতের মেঘ হয়ে দাদার শ্বশুরবাড়ি ছুটে যাওয়া। চোখের সামনে নিজের প্রেমিকাকে দেখতে পাওয়া। ফেরার পথে ইচ্ছে করে ঘুর পথে বাইক নিয়ে আসা..

প্রথমবার একটি অল্প চেনা ছেলের সঙ্গে দিদির বাড়ির পথে বাইক সওয়ার হয়ে কী বলবে মেয়েটি?ছেলেটিই বা তার উত্তরে মধ্যে কীভাবে মিশিয়ে দেবে প্রেম? সেই প্রেমে পড়া দুটি তরুণ তরুণীর কথোপকথন যদি গানের রূপ পায় তাহলে?

"-কৌন দিসা মে লেকে চলা রে বটুহিয়া/ ঠেহর ঠেহর, ইয়ে সুহানি সি ডগর, যরা দেখন দে, দেখন দে../

-মন ভরমায়ে নেয়না বাঁধে ইয়ে ডগরিয়া, কঁহি গয়ে যো ঠেহর, দিন যায়েগা গুজর/ গাড়ি হাঁকন দে../

-পহলিবার হম নিকলে হ্যায় ঘরসে কিসি অনজানে কে সঙ্গ হো

-অনজানে সে পহচান বড়েগি তো মেহক উঠেগি তেরা অঙ্গ হো

-মহক সে তু কহি বহেক না জানা, না করনা মোহে তঙ্গ...

-তঙ্গ করনে কা তোসে নাতা হ্যায় গুজরিয়া

-কিতনি দূর, অব কিতনি দূর হ্যায়, এ চন্দন তোরা গাঁও হো?

-কিতনা অপনা লগনে লাগে যব কোই বুলায়ে লেকে নাম হো।

-নাম না লে তো কেয়া কহকে বুলায়ে, কয়সে চালায়ে কাম হো?

-সাথী, মিতওবা ইয়া আনাড়ি কহো গোরিয়া..."

(গানটিতে ব্যবহৃত ভোজপুরী শব্দগুলির মানে:
বটুহিয়া - চালক, ঠেহর - দাঁড়াও, সুহানি সি ডগর - রাস্তার সৌন্দর্য্য, যরা দেখন দে - একটু দেখতে দাও, গাড়ি হাঁকন দে - গাড়ি চালাতে দাও, মন ভরমায়ে - আকৃষ্ট করে, নেয়না বাঁধে - চোখ আটকায়,
ডগরিয়া - রাস্তা, অনজানআ- অচেনা, মেহক - সুগন্ধ, তঙ্গ - দুষ্টুমি, গুজরিয়া - আইবুড়ো মেয়ে)

উপরের ভোজপুরী গানটি "নদীয়াকে পার" সিনেমার।
প্রকাশ সাল- ১৯৮২
মহিলা কণ্ঠ - ১৯৭০ এর অসাধারণ এক সঙ্গীত শিল্পী হেমলতা।
পুরুষ কণ্ঠ - জসপাল সিং
সুরকার - রবীন্দ্র জৈন।
সিনেমার গল্প - কেশব প্রসাদ মিশ্রর লেখা "কোহবর কি শরত" উপন্যাস।
অভিনয় - শচীন পিনগাঁওকর, সাধনা সিং।
গানটির লিঙ্ক : https://youtu.be/D61BvxAOxm0

এই সিনেমার আর একটি গান হল,

যব তক পুরে না হো ফেরে সাত, তব তক দুলহিন নেহি দুলহা কী/ করনি হোগি তপস্যা সারি রাত, তব তক দুলহিন নেহি দুলহা কী।

অর্থ - বিয়ের সাতপাক পূর্ণ না হওয়া অবধি প্রেমিকা তোমার নয়। প্রেমিকাকে সম্পূর্ণ রূপে পাওয়ার জন্য আজ সারারাত তোমাকে তপস্যা করতে হবে।

ডিসক্লেমার - নারীবাদীরা রে-রে করে তেড়ে আসবেন না। গানটির ভিডিও দেখুন, কোন সময়ে এই গানটি গাওয়া হচ্ছে এবং কে গাইছে। একটা সময় যখন বিয়েবাড়িতে ডিজের অত্যাচার বা গ্যাংনাম স্টাইল ছিল না। একটি গ্রাম্য বিবাহতে বিয়ের আসরে শালি এবং তার বান্ধবীরা জামাইবাবুর সঙ্গে রসিকতার ছলে এই গান গাইছে। আমি আদ্যোপান্ত গ্রামের ছেলে। আমার শৈশবে কাকু, দাদা, দিদি ও পরিচিতদের যে সব বিয়ে দেখেছি তা অনেকটাই এই গানটি মনে করিয়ে দেয়। সেই সময় বাড়ির শ্যালিকাস্থানীয় মেয়েরা বিয়ে করতে আসা জামাইবাবুর সঙ্গে গানের লড়াই খেলত। বাসরজাগা বলে একটি বিষয় হত, সেখানেও চলত গান বাজনা।
এই গানটিও ঠিক সেরকমই একটি ছবি তুলে ধরে।

এই গানটিও রবীন্দ্র জৈনের সুরে গেয়েছেন শিল্পী হেমলতা।

গানটির লিঙ্ক : https://youtu.be/C5yIJsC4nXg

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ৮:৫২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×