somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প--ধ্বজভঙ্গ

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বসন্ত আমাদের ক্লাসে টপার ছিল না। দারুণ গান গাইত না, গিটার, কবিতা আবৃত্তি, কোনটাই করতে দেখিনি ওকে। ক্রিকেটটা খেলে নিত, তবে এমন আহামরি নয় যে ওকে মনে রাখা যায়। তবুও ওর নামটা মনে রাখার অন্য একটা কারণ আছে। ছেলেটা আমাদের থেকে অন্যরকম ভাবত, মানে একেবারে অন্যরকম। তখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ি, টিফিন চলছে, সব বন্ধুরা মিলে স্কুলের ছাদের ফাঁকা রুমে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখনও এই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আসেনি। তাই টিফিনে আড্ডা আর স্কুল ছুটি হলে ক্রিকেটটা মাস্ট ছিল একপ্রকার। যে রুমটায় আমরা আড্ডা দিতাম তার জানলায় গরাদ বসলেও প্লাস্টার হয়নি। ওটার নীচ দিয়ে মেয়েদের টিফিন আনতে যাওয়া, কাবাডি খেলা দেখা যেত। আমরা সবাই মিলে জানলা দিয়ে মেয়ে দেখতাম। বসন্তও যে দেখত না তা নয়, কিন্তু ওকে আমাদের মতো "বলগুলো দেখেছিস" টাইপ কমেন্ট পাস করতে দেখিনি কোনদিন। ও এক অদ্ভুত কথা বলত, ওই বয়সে যেটা হাস্যকর ছাড়া অন্যকিছু মনে হয়নি।

বসন্ত বলত ও না কি কোন মেয়েদের ঠোঁটের নিচের দিকে তাকায় না, মেয়েদের আসল সৌন্দর্য নাকি চোখে! শরীরে নয়। আমাদের এক বন্ধু রজত এটা শুনে ধ্বজভঙ্গ নাম দিয়েছিল ওর। ধ্বজভঙ্গটাকে ছোট করে নিয়ে আমরা ওকে ধ্বজ বলে ডাকতাম। পরিচিত বা অপরিচিত বান্ধবীদের জন্য আর একটা ফ্রেজ ব্যবহার করতাম আমরা "সেকেন্ড হ্যান্ড মাল"। সেকেন্ড হ্যান্ড মালের ব্যাপারে একটু ভালো করে বলি, নাহলে মজা পাবেন না পাঠকবন্ধুরা। ধরুন আমারই এক বান্ধবী আমার এক বন্ধু বা দাদার সাথে প্রেম করছিল, কিন্তু কোন কারণে ব্রেকআপ হয়ে গেলে। ব্যস সেই বান্ধবীটি আমাদের কাছে হয়ে গেল "সেকেন্ড হ্যান্ড মাল"। কিন্তু অবাক ভাবে সেই বন্ধু বা দাদাটি কিন্তু তখনও ফ্রেস থাকত, একদম হাতে গরম ফার্স্ট হ্যান্ড! যাই হোক একদিন হঠাৎ বসন্ত টিফিনরুমের সেই জানলা দিয়ে একটি মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিল,
-দেখ কি সুন্দর না মেয়েটা।
সঙ্গে সঙ্গে রজত বলে উঠেছিল
-কে ওই নীল চুড়িদার? ও তো রূপা, সেকেন্ড হ্যান্ড মাল একটা।
বসন্ত কেমন যেন গুম মেরে শুনেছিল, উত্তর দেয়নি। দাঁড়ান গল্পটা বড় বোর হয়ে যাচ্ছে, বেশ তাত্ত্বিক টাইপ। এতে একটু ট্যুইস্ট আনি, এই গল্পের নায়িকাকে নিয়ে আসি।

(২)

একাদশ শ্রেণীতে আমাদের এই গল্পের তথা স্কুলের নায়িকা আসেন। অমৃতা সরকার, কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। পুরনো পুকুরের মত গভীর নেশাতুর চোখ। কথাবার্তায় আভিজাত্য গড়িয়ে পড়ত। আমরা ছেলেরা হুমড়ে পড়লাম ওর সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য। অমৃতা ফ্রেন্ডলি নেচারের হওয়ার জন্য সবার সাথে বন্ধুত্ব করেও নিল। তারপর চলল আমাদের পালা করে প্রপোজ, আর প্রতিশ্রুতি। একদিন অমৃতাকে নোটস বোঝানোর সময় বেশ কায়দা করে বলেছিলাম, যাই হয়ে যাক, তোর পাশে এইভাবে থাকব, সুযোগ দিবি?

অমৃতা হেসে বলেছিল তুইসহ শুধু আজই এই কথাটা ২৫ জন বলল। আমি জানতাম অমৃতা এতটুকু বাড়িয়ে বলছে না! রজত থেকে আমি সবাই ওর জন্য জীবন দেওয়ার কথা মুখে বলতাম। তবে বসন্ত আমাদের এই ভিড়ে ছিল না, ও এসবে কেমন উদাসীন ছিল। যাই হোক স্কুল, কলেজ শেষ করে কাজের জগতে ঢুকলাম আমরা। কিন্তু অমৃতার সাথে মোটামুটি সবাই যোগাযোগটা রাখতাম, কে জানে কখন কোন বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। চলত পালা করে নতুন নতুনভাবে প্রপোজ এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পালা, " অমৃতা এখনও বিয়ে না করে বসে আছি, তুই বুঝিস না কেন? এভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকার মানে কী? তুই কি কখনও আমাকে বুঝবি না! না বোঝ, তুই অধিকার না দে, আমি এভাবেই তোর পাশে পাশে হাঁটব।" জবাবে অমৃতার চোখধাঁধানো হাসি পেতাম শুধু।

(৩)
একদিন সকালে অফিস বেরবো, রজতের ফোন, হ্যালো শেখর, খবর শুনেছিস?
-কি খবর?
-আরে অমৃতার খবর?
-কি হয়েছে অমৃতা? তোকে হ্যাঁ বলেছে?
- না রে, কিছুটা থেমে, ওকে কারা যেন কাল রাত্তিরে..
পুলিশ উলঙ্গ অবস্থায় ওর বেহুঁশ শরীরটা তুলে নিয়ে যায় হাসপাতালে। এখন খুব খারাপ অবস্থা।

না সেদিন আর অফিস গেলাম না, হাসপাতালে গেলাম সোজা। কাকিমা কাঁদছেন, কাকু পাথর, ওর ভাই ছুটোছুটি করছে। আমরা কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে এলাম। নিতে পারছিলাম না, হ্যাঁ নিজের ড্রিমটাকে চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখে কান্না পাচ্ছিল। তাই বেরিয়ে গেলাম, বিশ্বাস করুন তিনদিন অফিসে মন বসেনি, খালি মনে হয়েছে অমৃতাকে বিয়ে করা হল না।

না, অমৃতা মারা যায়নি। বছর দেড়েক পরের কথা। ও তখন সুস্থ। একটা স্কুলে পড়ায়, কিন্তু আমরা ওকে আর সেরকম পাত্তা দিইনা। ও এখন "সেকেন্ড হ্যান্ড মাল", অ্যাচিভ করে কোন লাভ নেই। আমি আর রজত এবং আমরা অনেকেই যে যার কাজে ব্যাস্ত। এখন আর অমৃতার বাড়ির দিকে ভুলেও পা বাড়াই না। এখন যদি বিয়ে করতে বলে! কে নেবে বাওয়া ওসব উটকো ঝামেলা! এই বেশ ভালো আছি। একদিন বসে আছি অফিসে, হঠাৎ ব্ল্যাক শার্ট, ডেনিম জিন্স, চোখে চশমা, হাতে ব্রেসলেট, জিম করা পেটাই চেহারার এক হ্যান্ডসাম ছেলে আমার চেম্বারে ঢুকল। বেশ কিছুটা সময় লাগল বসন্তকে চিনে নিতে...
- শালা কি করছিস? তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না।
ভোল পাল্টে ফেলেছিস যে! কোথায় এখন?
জানতে পারলাম বসন্ত WBCS পাশ করে জলপাইগুড়িতে একটা জায়গায় বি ডি ও।
মনটা ভরে উঠল ছেলেটাকে এতদিন পরে দেখে। একথা-সেকথার পর, লাজুক মুখে পি সি সরকারের ম্যাজিক দেখানোর মতো প্যান্টের পকেট থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করল। তবে রে শালা, বিয়ের জন্য নেমন্তন্ন করতে এসেছিস। অবাক হয়ে গেলাম, কিন্তু আমার অবাক হওয়ার তখনও ঢের বাকি। কার্ড খুলে পড়তে পড়তে চমকে গেলাম। পাত্রের জায়গায় বসন্ত আর পাত্রীর নামের জায়গায় অমৃতা সরকার!
আমি বলতে যাচ্ছিলাম,
-তুই কি জানি....
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ও বলল ও সব জানে। অমৃতা রাজি হচ্ছিল না, অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-কিন্তু কেন? তুই তো ওকে ভালবাসতিস বলে মনে হয়নি কোনদিন!
বসন্ত হেসে বলল
-বিয়ের পর বাসবো, বেশ করে ভালোবাসবো।
বলেই মিষ্টি হেসে বেরিয়ে গেল...

(শেষ)

কেউ যেন গালে দুটো থাপ্পড় মেরে গেল। রজত কলেজের প্রফেসর। প্রায় ওর মুখে শুনি ছাত্রীদের কাছ থেকে ওর সুযোগ নেওয়ার গল্প। বেশ রসিয়েই বলে সেগুলো। আমিও অফিসের টাইপিস্ট মেয়েটিকে নিয়ে দীঘা যাওয়া প্রায় রেডি করেই ফেলেছি। না বললেই চাকরি থেকে ঘ্যাচাং ফু করে দেবো। এ বাজারে ১৪০০০ এর চাকরি ছাড়তে চাইবে না কেউই। তাই দীঘা ট্যুরটা কনফার্মই প্রায়!
কিন্তু বসন্তটা একটা বিয়ের কার্ড দিয়ে আজ গালে চড় মেরে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, "ধ্বজ"টা শক্ত হওয়ার চেয়ে "শিরদাঁড়াটা" শক্ত হওয়া বেশি জরুরী। না, আজও আমাদের বসন্তের ছোঁয়া পাওয়া হল না। সবার জীবনে তো আর বসন্ত আসে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:২৪
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×