আসলে বিরিয়ানির কথা আসলে উপমহাদেশের কথা চলে আসে, আর সবার আগে আসে ভারতবর্ষের নানান ধরনের বিরিয়ানির কথা। বিরিয়ানিনামা'র আজকের পর্ব "ভারতীয় বিরিয়ানি"। বোকা মানুষের ভারত দর্শনে এই পর্যন্ত ভারতের নানান প্রদেশে প্রায় ২০টির মত শহরে বিরিয়ানি চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আজকের পর্বে থাকবে সেই অভিজ্ঞতার কথাও। এর আগের দুটি পর্বেও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে এসেছিলো ভারতের নানান বিরিয়ানির কথা। আজ সেগুলোর অনেক কথাই হয়তো পুনরাবৃত্তি হতে পারে, তাই আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সংক্ষেপে দেখে নেই ভারতের কিছু প্রসিদ্ধ বিরিয়ানির নাম, বিস্তারিত পাবেন এই পোস্টেঃ বিরিয়ানি'র বাহারি রকমফের - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৩)
(০১)আম্বুর/ভানিয়াম্বাদি বিরিয়ানি
(০১)ভাতকলি/নববতী বিরিয়ানি
(০২)বোহরি বিরিয়ানি
(০৩)চেট্টিনাদ বিরিয়ানি
(০৪)দেহ কি বিরিয়ানি
(০৫)দিল্লি বিরিয়ানি
(০৬)ডিন্ডিগুল বিরিয়ানি
(০৭)হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি
(০৮)মেমনি/কচি বিরিয়ানি
(০৯)কল্যাণী বিরিয়ানি
(১০)কলকাতা বিরিয়ানি
(১১)রাওথার বিরিয়ানি
(১২)সিন্ধি বিরিয়ানি
এখন শুরু করা যাক আমার খাওয়া বিরিয়ানিগুলোর গল্পঃ
কাশ্মীরি বিরিয়ানিঃ কাশ্মীর ভ্রমণের শুরু আমরা করেছিলাম পাহেল্গাও থেকে, শেষ করেছিলাম শ্রীনগর থেকে। তো পাহেল্গাও এর দ্বিতীয় দিন ছিলো সারাদিনের সাইট সিয়িং। প্রায় সন্ধ্যের আগে আগে আমরা পাহেল্গাও শহরের 'হিনা রেস্টুরেন্ট' নামক একটা ভালো মানের রেস্টুরেন্ট ঢুঁকে এই অবেলায়ও লাঞ্চ করার সুযোগ পেয়ে যাই। রেস্টুরেন্ট সরগরম, ভারত দক্ষিণ আফ্রিকা খেলা হচ্ছে; অবাক কান্ড সবাই দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাপোর্ট করছে। আমরা খুব মজা পেলাম কান্ড থেকে স্থানীয়দের, তারা সবাই আবার বাংলাদেশ আর সাকিব আল হাসানের বড় ফ্যান। যাই হোক, এর মাঝেই অর্ডার করা হলো যার যার পছন্দ মতো খাবার। আমি অর্ডার করলাম কাশ্মীরি বিরিয়ানি। স্বাদ তেমন আহামরি না, আবার মন্দও না। আমার ভারতে খাওয়া বিরিয়ানির মধ্যে এটার রেটিং হবে ৬/১০।
কাশ্মীরি ওয়াজওয়ানঃ কাশ্মীরের অতি বিখ্যাত খাবার এটি, কাশ্মীর ভ্রমণে গেলে মাস্ট টেস্ট এর তালিকায় দুই এ থাকে, একে ওদের লোকাল চা 'খাহওয়া'। আমরা আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণে ওয়াজওয়ান খেয়েছিলাম কাশ্মীরের বিখ্যাত মোঘল রেস্টুরেন্টে। দারুন ছিল স্বাদ, পরিবেশন। সবকিছু মিলে এটার রেটিং যাবে ৮/১০। ওয়াজওয়ান হচ্ছে অনেকগুলো বিশেষ খাবারের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া একটি 'মাল্টি-কোর্স মিল', যাতে চৌদ্দ থেকে ছত্রিশ পদের খাবার থেকে। এটি সাধারণত কোনো উপলক্ষে রান্না করা হয়। সাধারণত কোনো উৎসব, বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা পার্টি থাকলে এই খাবার বিশেষভাবে রান্না করা হয়। উল্লেখযোগ্য পদগুলো হলঃ রিশতা, রোগান যোশ, তাবাক মাজ, ওয়াজা পালাক, আব গোশ, গুস্তাবা, লাহবি কাবাব, তাসির ই গুস্তাব ইত্যাদি।
কারিম'স দিল্লী'র বিরিয়ানিঃ প্রথমবার দিল্লী ভ্রমণে আমার মাস্ট টু ডু লিস্টে ছিলো কারিম'স এর বিরিয়ানির স্বাদ নেয়া। স্বাদ নিয়ে যারপরনাই হতাশ হয়েছি। আমাদের পুরাতন ঢাকার যে কোন অখ্যাত হোটেলের বিরিয়ানিও আমার কাছে বেটার মনে হয়েছে। হয়তো আমার জিহবার স্বাদ নষ্ট ছিলো, নইলে এদের নিয়ে টাইমস ম্যাগাজিন প্রচ্ছদ করে! রেটিং ৪/১০।
কেরালার বিরিয়ানিঃ এটি আমার ভারতে খাওয়া অন্যতম সেরা বিরিয়ানি। আমরা যেদিন কোচিন শহরে সারাদিন কাটিয়ে বিকেল থেকে অবসর, প্ল্যান মুভি দেখার, সেদিন লাঞ্চ করতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড বিপিন কেরালার অবস্থাসম্পন্ন আমেরিকা ফেরত শখের ড্রাইভার। কেরালায় বিশাল বাংলো টাইপ বাড়ীর মালিক এই ভদ্রলোক আগের দিন আমাদের একটা মার্কেট এলাকার ভেতরে এক দোকানে চিক্কু শেক ড্রিকংস খাইয়েছিলো। আজও সেখানে গিয়ে দেখি সেই দোকানের সাথেই কলাপাতায় মোড়ানো চিকেন বিরিয়ানি বিক্রি হচ্ছে। ভালোই হলো, লাঞ্চ করেই ড্রিংকস পাণ হবে। কলাপাতার মোড়ক খুলতেই দারুন সুবাস আর মুখে দিতেই দারুন স্বাদ, আহ লাজাওয়াব। আমি একে ৮/১০ রেটিং দিবো।
কোদাইকানালের বিরিয়ানিঃ কর্ণাটক ভ্রমণের সময় কোদাইকানাল দিয়ে ট্যুর শুরু করেছিলাম। তো সেখানে হোটেল শিভাপ্রিয়ার ডাইনিং এ বিরিয়ানি দেখে কেরালার বিরিয়ানির কথা মনে পরে গিয়েছিলো। দিলাম অর্ডার, খেয়ে হতাশ হলাম। সাধারণ মানের বিরিয়ানিতে হায়দ্রাবাদি স্টাইলে কিছু বাদাম দিয়ে গার্নিশ করা হয়েছে, আর কিছুই না। এটি অবশ্য ছিলো মোঘলাই ভেজ বিরিয়ানি। এই বিরিয়ানি রেটিং পাবে ০৫/১০।
ঊটি বিরিয়ানিঃ মানুষ ধরা খায় একবার, আমি সেবার ধরা খেয়েছিলাম আরেকবার ঊটি'তে এসেও বিরিয়ানি চেখে দেখার শখ গেল না। অর্ডার করলাম, মোটামুটি ছিলো এটির মান। রেটিং পাবে ০৫.৫/১০।
ব্যাঙ্গালোর এর বিরিয়ানিঃ সেই ট্রিপের শেষে ছিলাম ব্যাঙ্গালোর এর খুব নামকরা হোটেল ম্যাজিস্টিক এর পাশে। তো ফেরার আগের রাতে সেখানে গেলাম ডিনার করতে। সেটা ছিলো আমার সলো ট্যুর, কোদাইকানাল-উটি-কুনুর-ব্যাঙ্গালোর-মাইসুর ছিলো রুট। ফেরার আগে একটা ভালো মানের কিছু না খেলে অপূর্ণতা রয়ে যাবে। হোটল হতে বলল, তুমি ম্যাজিস্টিক এর বিরিয়ানি চেখে দেখ। সেখানে গিয়ে কাউন্টারে বললাম, তোমাদের সবচেয়ে ভালো বিরিয়ানি কোনটা, আমি গত কয়েকদিনে দুইবার বিরিয়ানি খেয়ে হতাশ হয়েছি। তারা বললো হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি টেস্ট কর। আসলেই ভালো ছিলো বিরিয়ানিটা, রেটিং পাবে ০৭.৫/১০।
কলকাতার বিরিয়ানিঃ সেই কর্ণাটক ট্রিপের শুরু হয়েছিলো অদ্ভুত অভিজ্ঞতায়। রাত দশটায় এয়ারপোর্ট হতে বের হয়ে হোটেলে গিয়ে শুনি আমার বুকিং করা রুম ফাঁকা নাই, সেই গল্প যথাসময় শোনাবো একদিন। তো নানান ঘটনা করে রাত দেড়টায় আরেক হোটেল যেটা হাওড়ার ওপারে সেখানে যাওয়ার পথে খিদিরপুর এর "ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্ট এন্ড ক্যাটারিং" হতে রাত একটার দিকে বিরিয়ানি কিনে নিয়ে হোটেলে গিয়ে গোসল সেরে রাত দুটোয় খেয়েছিলাম। সুস্বাদু ছিলো, আর তাই তো এতো রাতেও সেখানে কাস্টমার এর ভিড় ছিলো। রেটিং দেব ০৭/১০। কলকাতার আরসলান এর বিরিয়ানি খেয়েছি, আমার কাছে ততটা ভালো লাগে নাই, এদেরটা ঢের ভালো ছিলো। আরসলান রেটিং পাবে ০৬/১০।
আসামের বিরিয়ানিঃ নাগাল্যান্ড থেকে কলকাতা হয়ে দেশে ফেরার পথে আসামে একরাত ছিলাম। সারাদিন সাইট সিয়িং করে বিকেলবেলা খোঁজ করলাম ভালো রেস্টুরেন্ট এর, সবাই সাজেস্ট করলো "মোঘল রেস্টুরেন্ট" এর নাম। বহুপথ পাড়ি দিয়ে সেই রেস্টুরেন্টে যাওয়া সার্থক ছিলো তাদের খাবারে। রেটিং পাবে ০৮/১০। তাদের আফগানি কাবাবটাও দারুন ছিলো।
কলকাতার সানঝা চুলাহঃ মেঘালয় ট্রিপে ছিলাম আমি আর বাল্যবন্ধু মনা। মেঘালয় ঘুরে আসাম হয়ে বাই এয়ারে এলাম কলকাতা। সেখানে মনার কিছু কাজ ছিলো, আর আমি ঘোরাঘুরি আর মুভি দেখে সময় পার করলাম। কলকাতার এক দাদা এলো মনার সাথে দেখা করতে, তার পূর্ব পরিচিত। হোটেল রুমে তিনজন আড্ডা দিতে দিতে লাঞ্চের সময় পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেলে বের হলাম খাবার খোঁজ করতে, পেয়ে গেলাম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট টাইপ এই রেস্টুরেন্টটি। এটিতে খাওয়া মুরগ টিক্কা বিরিয়ানি আমার ভারতে খাওয়া সেরা তিন বিরিয়ানির একটি। রেটিং ০৯/১০।
জয়পুর রোড সাইড বিরিয়ানিঃ রাজাস্থান ভ্রমণে জয়পুরের তৃতীয় দিন সকালে ইচ্ছে জাগলো পরাটা খাবো। খোঁজ করতে করতে পেয়ে গেলাম একটা মুসলিম হোটেলের সামনে ভ্যানগাড়ীতে করে বিক্রি করা এই বিরিয়ানি। স্বাদ মোটামুটি ভালই ছিলো, সকালের নাস্তা আর দামের হিসেবে। হাফ ৩০ রুপি আর ফুল ৫০ রুপি, ফুলের পরিমাণ আমাদের রেস্টুরেন্টের হাফের সমান। রেটিং ০৬/১০।
লাখনৌ বিরিয়ানিঃ লাখনৌ বিরিয়ানি খাওয়ার লোভে রেল স্টেশন থেকে বের হয়ে গুগুলে ৪.৪/৫ রেটিং পাওয়া রেস্টুরেন্ট দেখি বন্ধ, তার পাশেই আরেকটা বিরিয়ানির দোকান। শেষ বিকেলে সেখানকার বিরিয়ানি ক্ষুধা পেটও মজা লাগেনি, জঘন্য ছিলো স্বাদ। রেটিং ০৪.৫/০৫।
লাখনৌ টুন্ডা বিরিয়ানিঃ বিকেলের অপূর্ণতা লাখনৌ এর বিখ্যাত টুন্ডে কাবাব এর বিরিয়ানি খেয়ে মিটে গিয়েছিলো। দারুন সুঘ্রানে সত্যিকারের লাখনৌ বিরিয়ানির স্বাদ, আমাদের প্রচলিত বিরিয়ানি থেকে ভিন্ন, অনেকটা ওয়েলি, ভালো সুগন্ধী যুক্ত। রেটিং পাবে ০৭/১০।
জয়সালমির এর ভেজ পোলাওঃ জয়সালমির এ যে হোস্টেলে ছিলাম সেটা সোনারকেল্লার ঠিক বিপরীতে। তো রাতের বেলা কিচেনে বলে রেখেছিলাম দেরী করে খাবো, প্রায় এগারোটার পর কিচেন হতে জানালো কিচেন বন্ধ করবে, আমি আমার বিরিয়ানি ছাঁদে নিয়ে গেলাম। খোলা আকাশে সামনে সোনার কেল্লা হলুদ আলোয় আলোকিত, আকাশ ভরা তাঁরা, এর মাঝে মুম্বাইয়ের পর্যটক ওয়াসিম এর সাথে গল্প করতে করতে খাওয়া ভেজ পোলাও স্বাদের জন্য না হলেও পরিবেশের জন্য আজীবন মনে থাকবে। রেটিং ০৫/১০।
যোধপুর রোড সাইড বিরিয়ানিঃ যোধপুর পৌঁছে প্রথম রাতেই খুঁজে পেয়েছিলাম একটা মুসলিম এলাকা, আমার হোস্টেল হতে প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটা পথ মাড়িয়ে আগের রাতে খাওয়া মাটন আর নান এর স্বাদ মনে করতে করতে পরদিন দুপুরে হাজির হলাম সেখানে, তেমন কোন বিরিয়ানির দোকান পেলাম না। একটা সাধারণ মানের দোকানে সিঙ্গেল প্লেট বিরিয়ানি নিলাম চেখে দেখার জন্য, একটুও মজার ছিলো না। রাজাস্থানি খাবারে কেন যেন লবন অতিরিক্ত ব্যবহৃত হয়। রেটিং ০৪/১০।
যোধপুর চিকেনঃ এটি একটি রেস্টূরেন্ট এর নাম, যোধপুর রেলস্টেশন রোডে অবস্থিত। উপরের রোড সাইড রেস্টূরেন্ট হতে প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে গেলাম সেখানে, মাথায় বেরাম ছিলো বিরিয়ানি খাইতেই হবে। যোধপুর চিকেন খুব নামকরা রেস্টুরেন্ট যোধপুরে, রেটিং অনেক ভালো। কিন্তু সেই অতিরিক্ত লবন আর উদ্ভট মসলার ব্যবহারের কারণে এখানকার চিকেন বিরিয়ানি কোনমত ধনেপাতার চাটনি আর পেয়াজ দিয়ে মুখে তুলে থাম্বসআপ দিয়ে পেটে চালান করেছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় সেই রেস্টুরেন্টে প্রায় বিশ জনের একটা দল, দক্ষিণ ভারতে কোন বয়সভিত্তিক ক্রিকেট দল, লাঞ্চ সারছিলো যোধপুর চিকেনের নানান পদ দিয়ে। এইটার বিরিয়ানি রেটিং পাবে ০৫/১০।
উদয়পুরের জমজম রেস্টুরেন্ট এর বিরিয়ানিঃ উদয়পুরেও খুঁজে পেয়েছিলাম মুসলিম এই নামকরা হোটেলটি। দ্বিতীয় রাতে সেখানে বিরিয়ানি চেখেছিলাম, সেই একই সমস্যা, তবে মান যোধপুরের দুইটার চেয়ে ভালো ছিলো। যদিও পরের দিন রুটি আর মাটন এর একটা আইটেম খেয়েছিলাম, খুব সুস্বাদু ছিলো। বিরিয়ানির রেটিং ০৬/১০।
আপাতত ভারতীয় বিরিয়ানিনামা এখানেই শেষ করছি, আগামী পর্বে আসছি আমাদের ঢাকার নানান বিরিয়ানির গল্প নিয়ে, সাথেই থাকুন, পাশেই থাকুন।
শুভরাত্রী।
এই সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০১)
মাশালাজাদে মাশালাদার… বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০২)
বিরিয়ানি'র বাহারি রকমফের - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৩)
বিরিয়ানির অমর সব রন্ধনশিল্পীরা - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৪)
বিশ্ব জুড়ে বিরিয়ানি (বিরিয়ানি নামা – পর্ব ০৫)