এই সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০১)
মাশালাজাদে মাশালাদার… বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০২)
বিরিয়ানি'র বাহারি রকমফের - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৩)
বিরিয়ানিনামা’র আজকের আয়োজন বিরিয়ানি’র রন্ধনশিল্পীদের নিয়ে। যে কোন সুস্বাদু খাবারের রন্ধন উপাদানের চাইতে অগ্রে থাকে রন্ধনশিল্পী; কেননা সুদক্ষ রন্ধনশিল্পী’র হাতেই তৈরী হয়ে মুখরোচক সুস্বাদু খাবার। আর বিরিয়ানি’র মত মুখরোচক খাবার রান্না করা চাট্টিখানি কথা নয়। আর তাইতো পুরাতন ঢাকার বিরিয়ানিগুলো রন্ধনশিল্পীদের নামেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেঃ হাজী বিরিয়ানি, নান্না বিরিয়ানি, ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি, ঝুনুর মোরগ পোলাও, হানিফ বিরিয়ানি সহ আরও অনেক নাম বলা যেতে পারে। আর বিরিয়ানির রন্ধনশিল্পী’রা মূলত “বাবুর্চি” বলেই পরিচিত। বাবুর্চি শব্দটি তুর্কি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে তার মানে ‘মুসলমান পাচক’। আসলে আদিকালে ভুভারতে যে সমাজ জীবন প্রচলিত ছিল সেখানে রান্নার লোকদের বলা হত “বামুন ঠাকুর”, হিন্দু প্রতিষ্ঠিত পরিবারে রান্নার জন্য তারা বাবুর্চি হিসেবেই কাজ করতো। পরবর্তী সময়ে যখন মোঘল শাসন আমলে হেঁশেলে মুসলমান রন্ধনশিল্পীদের জায়গা হল, তাদের উপাধি পাল্টে গিয়ে হল বাবুর্চি। ও হ্যাঁ, যারা আগে খাবার হোটেলে রান্না করতেন তাদের বলা হত “পাকর্শী” হালের জমানায় যাদের পরিচিতি “শেফ” হিসেবে।
আসলে মুসলমান বাবুর্চিদের উঠে আসার পেছনে অন্যতম কারণ ছিলো ঢাকায় মোগল সুবেদারি প্রতিষ্ঠার পর তাদের খাবারে মুরগি-খাশি সহ যে সকল খাবারের প্রচলন ছিলো তা নিয়ে তৎকালীন হিন্দু সমাজে ছিলো বাছবিচার এবং তার সাথে খাওয়াদাওয়াতে ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটায় খুব ছিল কড়াকড়ি। আর এসব কারণেই ধীরে ধীরে মোঘল হেঁশেলে আস্তানা গড়ে উঠতে থাকে মুসলমান রন্ধনশিল্পীদের তথা বাবুর্চিদের। ঢাকার আদি এবং ঐতিহাসিক যত খাবারের কথা শোনা যায়, তার প্রায় সব কয়টাই মোঘল হয়ে নবাব-জমিদার পরিবারের হেঁশেল হতে সময়ের সাথে সাথে নানান বাবুর্চিদের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পরিবর্ধিত-পরিবর্তিত হয়ে আজকের রূপ পেয়েছে।
ড. আবদুল করিম ‘মোগল রাজধানী ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ব্রিটিশ আমলে ঢাকা কুঠিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম বাবুর্চি নিয়োগ করেছিল ১৭২৩ সালে। তবে তাঁদের নামের তালিকা পায়া যায় না। ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের বাবুর্চিদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েক বাবুর্চির নাম আছে এশিয়াটিক সোসাইটির ‘ঢাকাই খাবার’ বইতে যেখানে উল্লেখ আছে পিয়ারু বাবুর্চি, কালু বাবুর্চি, সামিরউদ্দিন বাবুর্চি প্রমুখদের নাম। এর বাইরে ঢাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন সাহেব-সুবেদার’দের বাড়ীতে অনেক হান্ডি বাবুর্চিরা কাজ করেছেন আঠারো থেকে উনিশ শতকের দিকে যাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা যায় নানান বইপত্তর ঘেটে। এদের মধ্যে “রেলি ব্রাদার্স” এর দীন মোহাম্মদ, শেখ আলী মোহাম্মদ; বংশীবাজারের জুম্মন মিয়া, ব্রিটিশ সাহেবদের বড়দিনের কেক তৈরির জন্য শেখ আলী আমজাদ, স্যার সলিমুল্লাহ’র নবাববাড়ীর প্রধান বাবুর্চি হাসান জান, সহযোগী গুলকান বাবুর্চি, হাফিজ উদ্দিন বাবুর্চি অন্যতম ছিলেন। না। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে ঢাকার অন্য খ্যাতিমান বাবুর্চিদের মধ্যে ছিলেন বংশীবাজারের ইদু খলিফা ও জানু খলিফা; এঁরা ইউরোপীয় রান্নায় দক্ষ ছিলেন। ঈদ বা বড় মজলিশে রান্না করতেন রহমান বাবুর্চি, শুক্কুর বাবুর্চি, চামু বাবুর্চি, সিকিম বাবুর্চি প্রমুখ। আর অতি অবশ্যই ডেজার্ট তথা মিষ্টি’র জন্য ঢাকার প্রাচীন হালুইকরদের মধ্যে নাম আসবে কালাচাঁদ, গন্ধবণিক, সীতারাম’দের। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মরণ চাঁদ, মোহন চাঁদ, যাদব ঘোষ এবং অতি অবশ্যই মিষ্টিতে মুসলিমদের পথিকৃৎ ভারতের লখনউ থেকে আগত আলাউদ্দিন হালুইকর।
হাজীর বিরিয়ানি'র হাজী মোহাম্মদ হোসেন বাবুর্চি
স্বাধীনতা পূর্বের পুরাতন ঢাকার ইসলামপুরের কাছে সাইনু পোলাও ওয়ালা’র নাম জানা যায় ইতিহাস হতে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বইতে এই সাইনু পোলাও ওয়ালা’র কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে দোকান চলছে এমন বাবুর্চিদের মধ্যে অন্যতম নাম “হাজী মোহাম্মদ হোসেন”। ১৯৩৯ সালে হাজী মোহাম্মদ হোসেন নামক বাবুর্চি পুরাতন ঢাকার নারিন্দায় শুরু করেন যে বিরিয়ানির দোকানটি সেটি আজকের পুরাতন ঢাকার আলাউদ্দিন রোডের বিখ্যাত হাজীর বিরিয়ানি। আরেকটি বিখ্যাত বিরিয়ানি ‘হানিফ বিরিয়ানি’র হানিফ বাবুর্চি ছিলেন হাজী মোহাম্মদ হোসেনের শিষ্য।
ফখরুদ্দিন বাবুর্চি
অপরদিকে বিখ্যাত ফখরুদ্দিন বাবুর্চি ১৯৫৬ সালে জীবিকার খোঁজে সুদুর পাটনা হতে ঢাকায় চলে আসেন যদিও উনার জন্মস্থান চট্টগ্রাম; কাজ নেন ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের নৈশপ্রহরী। পরবর্তীতে ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে স্কুল কম্পাউন্ডে একটি ক্যান্টিন তৈরী করেন। সেই ক্যান্টিন থেকেই আজকের ফখরুদ্দিন বিরিয়ানী ও রেষ্টুরেন্ট এর জন্ম।
হাজী নান্না মিয়া
পুরাতন ঢাকার আরেক বিখ্যাত নান্না বিরিয়ানির নান্না মিয়া বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু করেন ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে পুরাতন ঢাকার মৌলভীবাজারের বেচারাম দেউরিতে আরও বড় পরিসরে তার বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু করেন। পুরাতন ঢাকার চকবাজার শাহী মসজিদের বিপরীতে মার্কেটের ভেতরে সকাল ০৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বিক্রি হওয়া শাহ সাহেব এর বিরিয়ানির “শাহ সাহেব” এর আসল নাম আব্দুর রহমান যার পিতাও ছিলেন এই রন্ধন ব্যবসায় যার নাম ছিলো লতিফ পোলাও ওয়ালা। অপরদিকে নারিন্দার ঝুনু বিরিয়ানির যাত্রা বাবুর্চি নুর মোহাম্মদের হাত ধরে। ১৯৭০ সালে নারিন্দার দোকানে স্বল্প পরিসরে শুরু করেন যে বিরিয়ানির দোকান তা তার মেয়ের নামে নামকরণ করেন। খিলগাঁও এর মুক্তা বিরিয়ানিও প্রতিষ্ঠাতা নিজামউদ্দিন খান এর মেয়ের নামে শুরু হয় ১৯৮৭ সালের দিকে। এর আগে থেকেই খাবার হোটেল ছিল খান সাহেব এর গুলিস্থানে।
তো হালের অনেক অনেক বিরিয়ানি দোকান, তাদের বাবুর্চিদের আবির্ভাব বিরিয়ানির জগতকে করেছে আরও সমৃদ্ধ, তাদের সকলের নাম জানা-আজানা রইলেও তাদের বিরিয়ানির সুখ্যাতি কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আর অনলাইন এর কল্যাণে ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে তে। তো “বিরিয়ানিনামা”র আজকের আয়োজন এই পর্যন্তই, আগামী পর্বে কি নিয়ে লেখা থাকছে বলতে পারবেন কি?
এই সিরিজের সকল পর্বঃ
বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০১)
মাশালাজাদে মাশালাদার… বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০২)
বিরিয়ানি'র বাহারি রকমফের - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৩)
বিরিয়ানির অমর সব রন্ধনশিল্পীরা - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৪)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০২২ বিকাল ৪:৫৬