কোদাইকানাল হতে উটি যাওয়ার একমাত্র প্যাসেঞ্জার ছিলাম আমি, তাই শিডিউল মিনিবাসটি তার আজকের ট্রিপ ক্যান্সেল করেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাস কাউন্টারের বারান্দায় দাঁড়ানো আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এর কারণ আমাকে আজকে অবশ্যই উটির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়তে হবে, শিডিউল অনুযায়ী কোথাও একটা দিন বেশী খরচ করার উপায় নাই। কোদাইকানালে শেষদিন বলে সকালবেলা হোটেল হতে চেক আউট করে ফরমালিটিস শেষ করে লাগেজ কাউন্টারে জমা দিয়েছিলাম। সারাদিন টুরিস্ট বাসে ডে-লং সাইটসিয়িং শেষে রাতের বাসে রওনা দিবো উটির উদ্দেশ্যে, পরদিন ভোরে পৌঁছে যাবো দক্ষিণ ভারতের সবচাইতে জনপ্রিয় হিলস্টেশন “উটি”। উটিতে দুদিন থেকে এরপর ব্যাঙ্গালোর, মাইসুর দু’রাত তিনদিনে ঘুরে বেঙ্গালুরু থেকে ঢাকা ফিরবো, ইকোনোমিক ক্লাসে এয়ার টিকেট করা। ফলে প্ল্যান কোন মতেই কোন পরিবর্তন করা যাবে না। তার উপর করছি সলো ট্রিপ এবং আমার ভারত ভ্রমণের এটি ছিলো একমাত্র ট্রিপ যেখানে আমার মোবাইল সিম ছিলো না, হোটেলে ফিরে হোটেলের ওয়াইফাই হতে নেটে কানেক্ট হলেই আমি আমার পরিচিত জনের সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। ফলে সম্পূর্ণ একাকী সেই ট্রাভেল এজেন্সির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মাঝে আমি যেন গভীর অতলের কোন খাঁজে পড়ে গেলাম, আগের দিন দেখা সেই গুনা কেইভ এর মতো….
আমার অসহায় চেহারায় হতাশা দেখেই কি না হয়তো মায়া হলো সেই ট্রাভেল এজেন্সির লোকটির। উনি আমাকে তার দোকানের ভেতরে বসতে বললেন, জানালেন চেষ্টা করে দেখা যাক কি করা যায়। সমস্যা হচ্ছিলো ভাষা, দক্ষিণ ভারতে সাধারণ মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে অভ্যস্থ, হিন্দি খুব অল্প লোকই বলে। আমার পুরো সমস্যা তাকে বুঝিয়ে বললাম, কেন আমাকে যে কোন উপায়ে আজকে রাতের গাড়ীতে উটি যেতে হবে। আমার পুরো কথা শুনে উনি মোবাইলে কাউকে কল করে স্থানীয় ভাষায় কিছু বললেন অনেকটা সময় নিয়ে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভাঙ্গাচোরা হিন্দিতে বললেন, “বসো, আমার এক বন্ধুকে ফোন দিয়েছি, ও আসলে একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে”। মিনিট পনেরো পরে যে লোকটি মোটর সাইকেল করে আসলো তাকে দেখে আমি ভরসা পাওয়ার বদলে পুরো ঘাবড়ে গেলাম। ব্লু জিন্সের উপর খাকি জ্যাকেট, মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ স্টাইলের টুপি পরিহিত মোটা গোঁফের ক্লিন শেভড কৃষ্ণ বর্ণের লোকটিকে দেখে দক্ষিণের সিনেমায় দেখা ভিলেনদের একজন মনে হলো। সে এসে আমার সাথে পরিচিত হয়ে বললো, “আমার সাথে চলো মোটর সাইকেলে করে, লাগেজ এখানেই রেখে যাও; দেখি করা যায়….”। আমার দ্বিধান্বিত চেহার দেখে সে তার সবকয়টি ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে দিয়ে বললো, “আরে চলো, একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে”।
তার নির্মল হাসি দেখেই বুঝি আমি এবার স্বাভাবিকভাবে তাকে গ্রহণ করতে পারলাম, লাগেজ সেই কাউন্টারে রেখে তার সাথে মোটর সাইকেলে করে মাথায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নিয়ে প্রায় আধঘন্টার মতো সময়ে একটি বড় সহ মোট চার পাঁচটি ছোটখাটো বাসস্ট্যান্ড এর মত এলাকা ঘুরেও কোথাও কোন উটিগামী যানবাহনের খোঁজ পাওয়া গেল না। কয়েক জায়গায় সে স্থানীয় কয়েকজনকে কিছু বললো, বুঝতে পারলাম এখান থেকে উটি যাওয়ার কোন গাড়ীর খোঁজ পেলে যেন তাকে জানানো হয়, সে বিষয়য়েই কিছু বলছে; কেননা কথা বলার সময় তারা কিছুটা দূরে মোটর সাইকেলে বসে থাকা আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। আবার ফিরে এলাম সেই ট্রাভেল এজেন্সির দোকানে। তারা বললো হতাশ হয়ো না, দেখা যাক কি হয়, আসো চা খাওয়া যাক। পাশের চায়ের দোকান থেকে চা আসলে পরে চা’য়ে চুমুক দিতে দিতেই সেই মোটরসাইকেলওয়ালা লোকটির মোবাইলে কল আসলো একটি, কল রিসিভ করতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কথা শেষ করে জানালো, উটির গাড়ি না পাওয়া গেলেও কোদাইকানাল হতে কোয়িম্বেতুর যাওয়ার একটা প্রাইভেট কারের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাকে পরামর্শ দিলো, কোয়িম্বেতুর গিয়ে রাতটা কোন হোটেলে কাটিয়ে সকালের প্রথম বাস ধরে উটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলে তিন চার ঘন্টার মধ্যে উটি পৌঁছে যাবো। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। রওনা হয়ে গেলাম তার মোটর সাইকেল করে ছোট্ট একটা বাসস্ট্যান্ড এলাকার দিকে।
সেখানে গিয়ে দেখি একটা ফোর হুইলার ইন্ডিগো এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে। পরিচিত হলাম গাড়ীর ড্রাইভার আকবর এর সাথে, মধ্য চল্লিশের আশেপাশে বয়স হবে। গাড়ীতে আরেকজন যাত্রী রয়েছে, বয়স পনেরোর স্থানীয় একটা ছেলে। আরও দুজন যাত্রী হলে গাড়ী ছেড়ে দিবে। রাত সাড়ে সাতটা পেড়িয়ে গেলেও আর যাত্রী না পাওয়ায় সিদ্ধান্ত হলো আর দশ পনেরো মিনিট দেখে গাড়ী ছেড়ে দিবে। এর মাঝেই বছর পঞ্চাশের আরেকজন যাত্রী পাওয়া গেলে আমরা রওনা হয়ে গেলাম রাত পৌনে আটটার দিকে কোদাইকানাল হতে, প্রথম গন্তব্য “পালানি”, সেখান থেকে “উটি”।
আমি বসলাম সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে, পেছনে আমার বাকী দুই সহযাত্রী। তখনও কেমন নার্ভাস লাগছিলো, কারণ সম্পূর্ণ একা, সাথে নাই কোন মোবাইল ফোন, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাতের বেলা এই পাহাড়ি পথে সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা তিনজন মানুষের সাথে রওনা হয়েছি নতুন গন্তব্যে। আমার এই নার্ভাসকে ভয়ে রূপান্তর করতেই যেন, মিনিট বিশেক গাড়ী চালানোর পর একটা পাহাড়ি রাস্তার শুরুর মুখে হুট করে গাড়ী সাইড করে গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ করে ড্রাইভার আকবর গাড়ী হতে নেমে দ্রুত হেঁটে চলে গেল পাহাড়ি একটা হাঁটাপথে, দূরে টিমটিম করে জ্বলা একটা হলদে বাতি বাতাসে দোল খাচ্ছে, সেদিকে। আমি তো ভয়ে জমে গেলাম, নিশ্চয়ই লুটেরার দলের খপ্পরে পড়েছি; আমার পেছনের দুই সাথী স্থানীয় ভাষায় ফিসসিফ করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। মনে মনে দোয়া দুরূদ পড়তে থাকলাম। মিনিট দু’তিন পরে তাদের হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, গাড়ী এখানে থামলো কেন? উত্তর এলো, “নেহি জানতা”। প্রায় মিনিট পাঁচেক আমাকে অজানা ভয়ের জলে ডুবিয়ে রেখে ফিরে আসতে দেখা গেল ড্রাইভার আকবর’কে। হাস্যমুখে গাড়ীর ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খুলে গাড়ীতে বসতে বসতে আমাকে জানালো, “ঘারওয়ালিকো বোলকে আয়া, শাহেরকে বাহার যা রাহাহু সাওয়ারি লেকার…”। মনে মনে গালি দিয়ে মনে মনেই বললাম, “আরে ব্যাটা আমাকে একটু বলে নামবি তো, হারামজাদা... ভয়ে আমি কাহিল….”।
এই ঘটনার পরপরই আমি মনে হয় স্বাভাবিক হয়ে গেলাম, সেই সন্ধ্যার শুরু হতে যে অজানা একটা চোরা উৎকণ্ঠা সাথে অজানা ভয় মনে কাজ করছিলো, তার আর রইলো না। গাড়ি এখন চলছে পাহাড়ি পথ দিয়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে সাত হাজার ফিট উঁচু কোদাইকানাল শহর হতে গাড়ী পাহাড়ি রাস্তায় নামতেই শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তার তীব্র সকল বাঁক; ২০০ মিটারও রাস্তা সোজা থাকে না, আর বেশীরভাগ বাঁকই প্রায় ইউটার্ন টাইপ, পুরাই যেন সাপলুড়ু! আমি বরাবরই পাহাড়ি রাস্তার এই ড্রাইভ এঞ্জয় করি। এর আগে একবার সিমলা-মানালি ট্রিপে দিল্লি থেকে রওনা দিয়ে সিমলা পৌঁছেছিলাম রাত দুইটায়। সেদিনের সেই শীতের রাতে পাহাড়ি রাস্তায় জার্নির কথা মনে পড়ে গেল। যাই হোক রাত ০৭:৪৫ এ রওনা দিয়ে ড্রাইভার আকবর জী'র কল্যাণে রাত ০৯:৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম পালানি। আমি এর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, হিমাচল, কেরালা বিভিন্ন এলাকার পাহাড়ি পথে ভ্রমণ করেছি, তবে এমন বাঁকানো দীর্ঘ পথ পাড়ি দেই নাই। তার উপর রাতের বেলা! তবে সাত হাজার ফিট উপর থেকে নীচের পালানি শহরের আলোকবিন্দু গুলোর ধীরে ধীরে স্পষ্ট আর বড় হয়ে ওঠার এই রাত্রিকালীন দৃশ্য অবর্ণনীয়।
It's a horrible n terrific but charming n thrilling journey indeed. Loved it..
পালানি শহরের রাতের দৃশ্য
পালানি’তে হালকা চা ব্রেক শেষে রওনা হলাম উটির উদ্দেশ্যে; পালানি হতে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ, এবার আর পাহাড়ি রাস্তা নয়, সমতলে যাত্রা। সারাদিনের ভ্রমণ, সাথে সন্ধ্যারাতের উদ্যেগ, সকল ক্লান্তি যেন চোখের পাতায় ভর করলো। পকেট হতে হেডফোন বের করে কানে গুঁজে দিলাম, প্রিয় কিছু গানের প্লেলিস্ট চালিয়ে দিয়ে চোখ বুজে গা এলিয়ে দিলাম। রাত ১১:৪৫ নাগাদ পৌঁছে গেলাম কোইম্বেতর, আর এখানে আমি করলাম একটা ভুল, নামলাম কোইম্বেতর রেল স্টেশন এলাকায়, অথচ সকালবেলা আমার বাস ধরতে হবে বাস স্টেশন হতে; সেই গল্প যথাসময়ে করা যাবে।
এর মাঝেই গাড়ি হতে নেমে পরিচিত হলাম বছর পনেরোর ছেলেটির সাথে, নাম “মাহেশ খালিফ”। অমায়িক মিষ্টি হাসি দিয়ে সেই ছেলে আমার সাথে গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগেও অপরিচিত যে ছেলেকে অন্য আরও দুইজনের সাথে ভয় পাচ্ছিলাম; এখন সেই হলো আমার সঙ্গী। যেহেতু শুধু রাতটা কাটাবো তাই একটা বাজেট হোটেল খুঁজতে শুরু করলাম। রেল স্টেশন এলাকা দেখেই বুঝি বেশীরভাগ হোটেলের রুমভাড়া বেশী চাইছে, তার সাথে অধিকাংশ হোটেলে ফরেইন গেস্ট রাখার অনুমতি নেই। হোটেল খোঁজাখুঁজির সময়টুকুতে মাহেশ আমার সাথেই রইলো, তাকে চলে যেতে বললে সে রাজী হলো না। বলল, “তুমি আমার এলাকার মেহমান, নতুন এসেছো ভিন্ন দেশ থেকে। তোমাকে হোটেল রুমে পৌঁছে না দিয়ে আমি যাই কিভাবে?”। বছর পনেরোর ছেলের মুখে এমন কথা শুনে নিজে ভীষণ লজ্জা পেলাম। কিছুক্ষণ আগেই ছেলেটি সম্পর্কে কত নেতিবাচক ধারণা ছিলো আমার। আসলে শহুরে যান্ত্রিক জীবনে নানান পদে নানান কিসিমের টাউট বাটপার দেখে দেখে আমাদের অন্তর হয়ে গেছে সন্দেহপ্রবণ। সেবারের এই ট্যুরে আমি বেশ কয়েকবার এই সন্দেহপ্রবণ মনের কারনে নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হয়েছি। দক্ষিণ ভারতের মানুষগুলো আসলেই অন্যরকম, ভারতের অন্য এলাকার মানুষদের চাইতে আলাদা।
হোটেলে চেকইন করে ফ্রেশ হতেই পেট জানান দিলো দুপুরের পর থেকে কোন কিছু খাওয়া হয় নাই। এই রাত একটায় কোথায় কি খাবার পাওয়া যাবে এই জানতে রিসিপশনে গেলে তারা জানালো এখন কোন খাবারের দোকান খোলা পাওয়া না গেলেও শুকনো খাবারের দোকান পাওয়া যাবে রেলস্টেশনের আশেপাশে। হোটেলে হতে মিনিট পাঁচেক এর হাঁটা দূরত্বে একটা দোকান পেয়ে সেখান হতে কিছু শুকনো খাবার কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। হালকা কিছু খেয়ে ঘুমাতে গেলাম, আগামীকাল যত সকালে উঠতে পারবো, ততো দ্রুত উটির উদ্যেশে রওনা হতে পারবো। আগামীকালকের দিনটি যেন নষ্ট না হয় এটাই আছে চিন্তায়….
বামের ছবিতে মাহেশ আর ডানে সেই মোটরসাইকেলওয়ালা ভাইটি
বিঃদ্রঃ এই পর্বে কোন ছবি নাই।
আবার দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ -TDTK (Tour D Tamilnadu & Karnataka)
পর্ব - ০৬
ভ্রমণকালঃ জুন-জুলাই, ২০১৭
এই সিরিজের সকল পোস্টঃ
* আবার দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ - শুরুর গল্প
* চলে এলাম কোদাইকানাল
* কোদাইকানাল "ফরেস্ট ডে ট্রিপ"
* কোদাইকানাল শহর ভ্রমণ
* কোদাইকানালের শেষদিন এর শেষটা আর ভালো হলো না...
* পাহাড়ি রাস্তায় রাতের যাত্রা - কোদাইকানাল টু কোয়িম্বেতুর
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:৫১