রাতে দ্রুত ঘুমাতে যাওয়ার কল্যাণেই খুব ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেল। ফাঁকা হোটেলে আমি ছাড়া কেউ নেই, বিশাল বাগান নিয়ে ছড়ানো কম্পাউন্ড, ভোরের আলো আঁধারির মাঝে হালকা কুয়াশার চাঁদর অদ্ভুত সুন্দর রহস্যের বৃথা জাল বুনতে চাওয়া কোন লেখকের কাগজের ক্যানভাস যেন। ছয়টা নাগাদ ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয়ে নিলাম, আজকে অনেকগুলো জায়গা কাভার করে রাতের গাড়ীতে রওনা হবো উটির উদ্দেশ্যে। মূল রাস্তা হতে যে সড়ক নীচের দিকে নেমে আমার হোটেলের দুয়ার ছুঁয়ে আরও নীচে নেমে গেছে সেই পথে দুই কিলোমিটার দূরত্বে একটা জলপ্রপাত আছে, নাস্তার আগেই তা দেখে এসে নাস্তা করে কোদাইকানাল হতে উটি যাওয়ার বাসের টিকেট করতে হবে; এরপর বের হয়ে যাবো সারাদিনের সাইটসিয়িং এর উদ্দেশ্যে।




হোটেল থেকে বের হয়ে ০২ কিলোমিটার ডাউনহিলে অবস্থিত "বিয়ার শোলা ফলস" দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে রাস্তায় পা দিয়ে পড়লাম দ্বিধায়, এই ভোরবেলা অচেনা ঘন জঙ্গল দুই কাঁধে নিয়ে সরু পিচঢালা যে পথ চলে গিয়েছে সেই পথে একা একা যাবো কি না, পথে কোন মানুষের নামগন্ধ নেই। এই দ্বিধা কাটাতেই বুঝি হোটেল হতে উপরের দিকে কিছুটা হেঁটে এসে মূল রাস্তার দিকে পা বাড়ালাম, মূল রাস্তার ঠিক শুরুতেই একটা মোটরসাইকেল রাইডার এর দেখা পেলাম। তাকে বিয়ার শোলা ফলস এর কথা জিজ্ঞাসা করতে সে বললো, সোজা যে রাস্তা নেমে গেছে, তার শেষ প্রান্তে দেখা মিলবে কাঁচাপথ পায়ে হাঁটার পথ, সেই পথ ধরে কিছুটা হেঁটে গেলেই ফলস এর দেখা মিলবে। আমার জিজ্ঞাসায় সে জানালো ১০০ রুপী ভাড়া দিলে সে তার মোটর সাইকেল নিয়ে আমাকে সেখান হতে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে আবার এখানে নামিয়ে দিবে। রাজী হয়ে গেলাম, কিন্তু হতাশ হতে হলো ফলসে গিয়ে দেখি পানি নাই, তবে আশেপাশের পরিবেশটা ছিলো খুবই চমৎকার, মন ভালো করে দেয়ার মতো।



সেখান হতে ফিরে চলে গেলাম হোটেলে, লাগেজ গুছিয়ে কাউন্টারে জমা দিয়ে বের হয়ে এলাম সাড়ে আটটার পরপর। প্রথমেই চলে গেলাম হোটেল শিভাপ্রিয়ায়, আজকের ডে-ট্রিপের টিকেট বুক করে নিলাম। ঘড়িতে তখন সকাল নয়টা, দশটায় এই ডে-ট্রিপ শুরু হবে। এই ফাঁকে আমি হাটা শুরু করলাম কোদাই বাস স্ট্যান্ড এর দিকে, গতকাল রাতে কথা বলে গিয়েছিলাম "কুরিনজি ট্রাভেলস" এ বাসের টিকেট এর জন্য, কিন্তু গিয়ে দেখি বন্ধ। এ কি বিপদ! কি করবো বুঝতে না পেরে হোটেল শিভাপ্রিয়া'য় ফিরে এসে দেখি সেখানকার গেইটের বিপরীত পাশে থাকা একটা ট্রাভেল এজেন্সি খুলেছে, চলে গেলাম সেখানে। কোদাইকানাল থেকে উটি যাওয়ার বাসের খোঁজ করতে জানা গেল একটা গাড়ীই আছে, মিনিবাস সার্ভিস, রাত সাড়ে সাতটায় ছেড়ে যাবে কোদাইকানাল হতে উটির উদ্দেশ্যে। ২০০ রুপী দিয়ে বাসের টিকেট করে নিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম, এবার দ্রুত নাস্তা করে নেয়ার পালা। অন্য কোন অপশন না ভেবে হোটেল শিভাপ্রিয়ার রেস্টুরেন্ট এ লুচিপুরি-ভাজি আর চা দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। এর মাঝেই আমাদের সাইট সিয়িং এর গাড়ী চলে আসলো, একে একে সবাই চড়ে বসার পর বেলা দশটার কিছুটা পরেই ছেড়ে দিলো আজকের ডে লং ট্যুরের মিনিবাসটি।




আজকের প্রথম গন্তব্য কুকার'স ওয়াক। ইংরেজ আমলে বিলেতি সাহেব-মেম'রা প্রাতঃভ্রমণ করতেন এই পথে। ১৮৭২ সালে লেফটেন্যান্ট কুকার এই ওয়াকওয়েটি নির্মান করেন এখানে নগরীর গোড়াপত্তনের পরপরই। কোদাইলেক হতে আধ কিলোমিটার দূরত্বে চমৎকার ভ্যালী ভিউ এবং সাথে কোদাই সিটি ভিউ নিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা এই ওয়াকওয়েটি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষন। আমি কানে হেডফোনে প্রিয় সব গান ছেড়ে দিয়ে চমৎকার মেঘলা আবহাওয়ায় হাঁটতে লাগলাম, সাথে থেমে থেমে চললো ছবি তোলা। আধঘন্টার মাঝেই পুরো ওয়াকওয়ে ঘুরে আমি ফিরে এলাম যথাসময়ে আমারদের গাড়ির কাছে। এখান হতে গাড়ি আমাদের নিয়ে গেলো কোদাইলেক আপার ভিউ পয়েন্টে। সাত কিলোমিটার লম্বা এই প্রাকৃতিক লেকটির ভিউ সত্যি সুন্দর এখান থেকে। ইচ্ছে হচ্ছিলো অনেকটা সময় চুপচাপ এখানে বসে থেকে চেয়ে থাকি দিগন্ত রেখা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই কোদাই লেক এর দিকে।



এরপরের গন্তব্য ছিলো মাইয়র পয়েন্ট এবং গ্রীণ ভ্যালী ভিউ নামক দুটি স্থান, সেখানকার ভিউ নাকি চমৎকার। কিন্তু ঘন মেঘ-কুয়াশার দাপটে কিছুই দেখা যায় না। এই মাইয়র পয়েন্ট কোদাইকানাল এর অন্যতম দ্রষ্টব্যগুলোর একটি। এটি বেরিজাম লেক এর আগে অবস্থিত বনের প্রবেশমুখে অবস্থিত। এখানে একটি স্থম্ভ রয়েছে যা ১৯২৯ সালে স্যার থমাস ময়র এর দ্বারা নির্মিত সড়ক Goschen Road এর নির্মানের সময়কার সাক্ষ্য বহন করছে, এই সড়কটি মূলত বেরিজাম লেক এর সাথে কোদাইকানাল এর সংযোগ স্থাপন করেছে। এখানে রয়েছে একটি অবজারভেশন টাওয়ার, সম্মুখের চমৎকার ভিউ দেখার জন্য, যদিও কুয়াশার কারনে আমরা তেমন ভালো ভিউ পেলাম না। এখান হতে কিছু এগিয়ে একটা জায়গায় ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে দেখালো, এখন বাউন্ডারি দেয়া। বছর দুয়েক আগে এখান হতে একজন পরে যেতে নিলে তাকে বাঁচাতে আরেকজন হাত বাড়িয়ে দেয়। এভাবে সাতজন একে অপরকে সাহায্য করতে গিয়ে গভীর খাদে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারায়।






এরপরের গন্তব্য ছিল, হিন্দি চলচ্চিত্রে বহুল ব্যবহৃত, চিত্রায়িত, বিশেষ করে "কেয়ামাত সে কেয়ামাত তাক" সিনেমার 'আকেলে হ্যায়' গান চিত্রায়িত হয়েছিল যেই পাইন বনে, সেই একশত একরের উপর জায়গা জুড়ে আকাশছোঁয়া সব পাইন গাছের সারি। বেশ কিছু ছবি তুললাম, অনেকে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে বানরদের বাঁদরামি ছিল দেখার মত। আমি কিছুটা সময় পাইন বনে ঘুরে পার্কিং এরিয়ার কাছে এসে চা পাণ করছিলাম আমাদের গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে। এমন সময় একটা লোক তার ভেসপা টাইপের মোটর সাইকেল একপাশে পার্ক করে কোথাও গেল, মোটর সাইকেলের সামনে একটা বক্স টাইপ ডিকি রয়েছে। কিছুক্ষণ পর একটা বিশালাকার বানর একটা গাছ হতে লাফিয়ে এসে বসল মোটর সাইকেল এর উপর। চারিপাশে তাকিয়ে নিয়ে দেখি সে ডিকি খুলে সেখান হতে একটা ব্যাগের চেইন টেনে খুলে ফেললো! এরপর সেখান হতে একটা ঠোঙ্গা বের করে কিছু পাকোড়া টাইপ ভাঁজাপোড়া খাবার কিছু নিল মুখে, কিছু একহাতে নিয়ে ডিকি ফের বন্ধ করে দৌড়ে গাছের উপর গিয়ে বসে পড়লো। পুরো ঘটনা এতো দ্রুত ঘটলো যে আমি শুধু দেখে গেলাম…. কিছুটা সময় পরে সেই লোক ফিরে আসলে তাকে ঘটনা জানালাম। সে কিছুটা বিরক্ত হলো বানরের উপর, বললো এখানে বানরের খুব উৎপাত, এদের জ্বালায় কোন খাবার রেখে কোথাও গেলেই এই ঘটনা ঘটে, এদের ঘ্রাণশক্তি বুঝি খুব বেশি।





এরপর গেলাম "গুনা কেইভ" দেখতে, তামিল সুপারহিরো রজনীককান্ত এর ১৯৯১ সালে নির্মিত “গুনা” ছবি এখানে চিত্রায়িত হয়েছে। পরবর্তীতে আরও কিছু মুভি চিত্রায়িত হয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় হাজার দুয়েক ফুটের গভীর খাঁদ, অনেকেই দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। তাই এখন চারিধার গ্রিলে বন্দী, নিরাপত্তার খাতিরে। সম্প্রতি Manjummel Boys নামক সুপারহিট মালায়ালাম মুভি এই গুনা কেইভ’কে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়। ২০০৬ সালে Mezhumkunnath, Oorakam, Kerala’র কিছু যুবকের দল এখানে বেড়াতে আসলে তাদের একজন এই খাঁদে পড়ে যায় এবং তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় তারা যা এখন পর্যন্ত একমাত্র উদ্ধার হওয়ার ঘটনা এই গুনা কেইভ হতে; সেই সত্য ঘটনা নিয়ে সিনেমাটি নির্মিত। এর আগে ১৯৯৬ সালে এক কেন্দ্রিয় মন্ত্রীর ভাতিজা এখানে পড়ে গিয়ে মারা যায়, সরকারী সকল বাহিনীর চেষ্টায়ও তার মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।



এরপর ছিল লাঞ্চের বিরতি। সেখান হতে তিনটার পর রওনা হলাম কুরিঞ্জি টেম্পল এর উদ্দেশ্যে। কুরিঞ্জি একটি ফুলের নাম, এক যুগ পরপর ফোটে, ২০১৮ তে ফুটবে, আমার ট্যুর ছিলো ২০১৭ সালে। মন্দিরের নাম, এই ফুলের নামে কেন? মূলত কোদাইকানাল লেক থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কুরিঞ্জি আন্দাভার মন্দিরটি হিন্দু ধর্মের প্রভু মুরুগাকে উত্সর্গীকৃত। হিন্দু ধর্ম মতে, প্রভু মুরুগাকে 'পাহাড়ের ঈশ্বর' বলা হয়। তামিল ভাষায় কুরিঞ্জি শব্দের অর্থ 'পার্বত্য অঞ্চল' এবং আন্দাভার অর্থ 'ঈশ্বর'। এইভাবে নামটি নিজেই পাহাড় এবং পাহাড়ের ঈশ্বরের সাথে এর সংযোগের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কুরিঞ্জি ফুলে ছাওয়া পাহাড়ের ঢাল (নেট থেকে সংগৃহীত)
মন্দিরটির সাথে কুরিঞ্জি ফুলেরও সম্পর্ক রয়েছে যা এক যুগ পরপর একবার ফোটে, শুরুতেই বলেছি। কথিত আছে যে ফুলটি শেষবার ২০০৪ সালে ফুটেছিল। সে হিসেবে ২০১৬ সালে ফুটার কথা থাকলেও, তেমনটা হয় নাই। এই বছরও (২০১৭) ফোটে নাই, তাই সবার ধারণা আগামী বছরই ফুটবে "কুরিঞ্জি ফুল"। কারো কারো মতে, কুরিঞ্জি ফুল ফোটার সময় এই স্থান থেকে প্রাপ্ত মধুতে অতি উচ্চ মাত্রায় ঔষধি গুণ রয়েছে। এর পাশাপাশি, আপনি এই কুরিঞ্জি মন্দির এর চত্বরের বাম পাশ হতে "পালানি" শহরের অপূর্ব ভ্যালী ভিউ আর ডান পাশ হতে পাবেন "কোদাই" শহরের বার্ডস আই ভিউ, যা এখানে আগত পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এখানে প্রবেশ করে ক্যামেরা বের করতে করতে সেই মেঘ-কুয়াশা'র হানা, চমৎকার ল্যান্ডস্কেপকে ক্যামেরাবন্দী করতে পারলাম না।




এখান হতে দুটি পার্ক ভ্রমণ দিয়ে কোদাইকানাল সাইট সিয়িং শেষ হল, একটি "চেতিয়ার পার্ক", অন্যটি কোদাই লেকের তীরবর্তী "ব্রায়ান্ট পার্ক"। ছোট পরিবেশে রঙবেরঙের নানান ফুল আর গাছগাছালিতে সাজানো পার্ক পর্যটকদের ভ্রমণ ক্লান্তি দূর করতে চমৎকার, সাথে বিকেলবেলাটা আনন্দঘন পরিবেশে কাটানো যায় আড্ডাবাজি আর ইতিউতি হাঁটাহাঁটি করে।



সন্ধ্যের পরে ফিরে এলাম কোদাইকানাল শহরে, দ্রুত হোটেলে চলে গেলাম। ম্যানেজার কাম কেয়ারটেকার থেকে বিদায় নিয়ে আমার ব্যাগ নিয়ে যখন বাসস্ট্যান্ড এর দিকে রওনা হলাম তখন আকাশ হতে হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছোঁয়া পাচ্ছিলাম। কিন্তু বাসস্ট্যান্ড গিয়ে মাথায় হাত আমার, আজকের কোদাইকানাল থেকে উটির একমাত্র গাড়ীটিও প্যাসেঞ্জারের অভাবে বাতিল হয়েছে। আমিই নাকি সেদিনের একমাত্র প্যাসেঞ্জার!!! আমি হোটেল হতে চেক আউট করেছি, পুরো ট্যুরের টাইট শিডিউল, একটা দিন অতিরিক্ত খরচ করা যাবে না, বেঙ্গালুরু থেকে ঢাকার ফেরার এয়ার টিকেট করা আছে…. সম্পূর্ণ একাকী সেই ট্রাভেল এজেন্সির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মাঝে আমি যেন গভীর অতলের কোন খাঁজে পড়ে গেলাম, সেই গুনা কেইভ এর মতো…



আবার দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ -TDTK (Tour D Tamilnadu & Karnataka)
পর্ব - ০৫
ভ্রমণকালঃ জুন-জুলাই, ২০১৭
এই সিরিজের সকল পোস্টঃ
* আবার দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ - শুরুর গল্প
* চলে এলাম কোদাইকানাল
* কোদাইকানাল "ফরেস্ট ডে ট্রিপ"
* কোদাইকানাল শহর ভ্রমণ
* কোদাইকানালের শেষদিন এর শেষটা আর ভালো হলো না...
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


