হাঁসির কলজে ঠাণ্ডা করা আর্তনাদে, বড়ইডাঙ্গা গ্রামের শান্ত সকাল ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল।
পাশের বাড়ির লেকু আর লেকুর বউ সকাল সকাল এমন চিৎকারের হেতু জানতে, দৌড়ে হাঁসিদের বাড়িতে এসে যা দেখলো! তাতে তাঁদেরও মূর্ছা যাওয়ার যোগার। হাঁসির মা বিছানায় রক্তের সাগরের মধ্যে ডূবে আছে। মাথাটা ধর থেকে আলাদা। আর হাঁসি মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। বড়ইডাঙ্গা ছোট গ্রাম। লেকু আর লেকুর বউয়ের কল্যানে কিছুখনের মধ্যেই লোমহর্ষক খবরটা গ্রামে চাউর হয়ে গেলো। গ্রামে এমনতেই কিছু ঘটলে বাতাসের বেগে ছড়ায়। তাই এরকম একটা খবর গ্রাম হবার পর, হাঁসিদের ছোট্ট বাড়িটা লোকারণ্যে পরিনত হতে বেশি সময় নিল না।
এটা তো আর সাধারন মৃত্যু না যে, চাইলেই দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা যাবে। এরকম একটা খুন হয়েছে। থানা পুলিশকে তো জানাতে হবে। থানা পুলিশ মানেই ব্যাপক ঝাক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। কে করবে এসব ঝাক্কি ঝামেলা! হাঁসির বাপ থাকে বিদেশে। আসে দুই তিন বছর পর পর। আর, ওর বড় চাচাও বেশ বয়স্ক লোক। উনিও তো এসব পারবে না। শেষমেশ গ্রামের মেম্বার ই থানায় ফোন করে, খুনের কথাটা ইনফরম করল।
পুলিশকে সকালে ফোন করা হলেও, পুলিশের আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেলো। পুলিশের কি আর কম কাজ! তারা কিভাবে এত সময়মত আসবে। পুলিশ দেড়ি করে আসলে কি হবে। গ্রামের পর গ্রাম থেকে ঠিকই মানুষ এসে বড়ইডাঙ্গায় ভির করেছে। এতো যেন গলা কাটা লাশ না, যাত্রাপালা দেখতে এসেছে। সবার একবার হলেও দেখা চাই। পুলিশ ভাবছিলো সাধারন খুন খারাবি বোধহয়, কিন্তু একি! লাশের দিকে তাকানো দুষ্কর। এতই বীভৎস। মেম্বার সাহেব অবশ্য ফোনে এতকিছু ডিটেইলসে বলে নাই। তদন্তকারী এস আই, দুইজন কন্সটেবল কে তাড়াতাড়ি লাশ ব্যাগে ভরে গাড়িতে তুলতে বলল। এখন ই যেমন গন্ধ বের হচ্ছে। কিছুখন পর এই লাশ সুরতহালের জন্য জেলা সদরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর আসলে এখানে দেখার ও তেমন কিছু নেই। বাড়ির ভিতরে বাইরে মানুষ গিজগিজ করছে। যদি কোন এভিডেন্স থেকেও থাকে সেটাও, মানুষের ভিরে এতখনে গায়েব হয়ে যেতে বাধ্য। আমাদের দেশে এই এক সমসসা। কোন ক্রাইম সিন যেন যাত্রাপালার চেয়ে ইন্টেরেস্টিং কিছু। পুলিশ আসার আগেই এসব অতি উৎসাহি লোকজন এভিডেন্সের বারোটা বাজিয়ে দেয়। রক্ত প্রায় জমাট বেঁধে গেসো। পুর বিছানা থক থকে রক্তে ভরে আছে আর সেই রক্তে মাছি মনের সুখে উরে বেড়াচ্ছে। আর খুন যেই ই করুক না কেন, সে তো আর কোন প্রমান এখানে রেখে যাবে না। তাই লাশ সুরতহালের জন্য জেলা সদরে পাঠিয়ে দিয়ে, এস আই সাহেব মামলা লিখলেন। আসামি দিলেন অজ্ঞাত।
বড়ইডাঙ্গা।। মফস্বলের গ্রাম বলতে যা বুঝায় তাই ই। এখনও বিদ্যুতের ছোয়া লাগেনি। গ্রামের বেশীরভাগ মানুষই চাষবাস করে। তবে অতিসম্প্রতি কিছু কিছু লোকজন ভাগ্যের অন্বেষণে বিদেশে পাড়ি দিসে। তাঁদের বদৌলতেই গ্রামের চেহারায় কিছুটা জৌলুস ফিরে এসেছে। এই মফস্বলে এমন একটা ভয়ংকর খুন কেন হবে, সেটা অনেক গ্রামবাসীর কাছেই বোধগম্য হচ্ছে না। যেমন বোধগম্য হচ্ছে না এস আই জমীরউদ্দীন মোল্লার কাছে। ভিক্টিমের চাচা শ্বশুরের ভাষ্যমতে তার ভাতিজা সাত বছর ধরে কুয়েত থাকে। এর মধ্যে সে দুইবার ছুটিতে দেশে আসছে। কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ তো ছিলো না। তাইলে কে এই সর্বনাশটা করলো। ভিক্টিম খুন হওয়ার সময় তার মেয়ে অবশ্য পাশের রুমেই ঘুমিয়ে ছিলো সে নাকি কিছু টের পায়নি। অবশ্য ভালোমত মেয়েটার জবানবন্দীও নেয়া যায়নি। মেয়েটার মা খুন হয়েছে এরকম অবস্থায় জবানবন্দী নেয়াটাও অমানুষিক মনে হবে। জমীরউদ্দীন ভাবল আগে মেয়েটা এক্টূ সুস্থ হোক পরে জবানবন্দী নিলে হয়ত গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য পেলেও পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু খুনের মোটিভ টা কি হতে পারে? থানায় বসে এসব ভেবেই নিজের চাঁদি গরম করছিলো এস আই জমীরউদ্দীন মোল্লা।
একমাস হয়ে এলো। এই থানায় জয়েন করেছে জমীরউদ্দীন মোল্লা। এরমদ্ধেই একটা কেস সল্ভ করে দারোগা সাহেবের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছে। তাই গতকাল খুনের কথা শুনে দারোগা সাহেব জমীরউদ্দীনকে ডেকে, খুনের বাপ্যারটা তদন্ত করার দায়িত্ব দেয়। জমীরউদ্দীন ও কেসটাকে হালকা ভাবেই নেয়। ভাবছে গ্রামে খুন হয়ত হবে জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ। যাবে আসামি ধরে নিয়ে আসবে। কিন্তু কিসের কি। একদম বিধিবাম। এরকম একজন নিরীহ মহিলা কে কেই ই বা খুন করতে যাবে। কি মোটিভ থাকতে পারে? ডাকাতি করতে এসে কেউ খুন করছে? সেক্ষেত্রে ডাকাতরা কিছু না নিয়েই চলে গেল কেন! বা মেয়েটা ও তো বাড়িতে ছিলো তাকেই বা কেন কিছু বলল না। নাকি কেউ পূর্ব শত্রুতার জের ধরে খুন করল? পরকীয়া ও হতে পারে। আপাতত কোন মোটিভ ই খাটছে না। খুনের মোটিভ বের করতে গিয়ে জমীরউদ্দীনের যেন ঘেমে নেয়ে উঠলো।
থানার দারোগার ডাকে সৎবিত ফিরলো, “কি মোল্লা সাহেব। লাশটা কি বরইডাঙ্গাতে দিয়ে আসবেন নাকি কন্সটেবলদের দিয়েই কাজ সারবেন।“ গতকাল অমন লাশ দেখে ইচ্ছা করে নাই, সুরৎহালের জন্য এই লাশের সাথে জেলা সদর যাই। ব্যাপারটা দারোগা সাহেব পছন্দ করে নাই। তাই আজকে এমন খোচা মেরে কথাটা বললেন। জমীরউদ্দীন একটু হাসি দিয়ে,”না স্যার এইতো এক্টূ পর বের হব।“ জমীরউদ্দীন ভাবল, লাশ জেলা সদর থেকে আনতে যাওয়ার আগে স্যারের সাথে একটু পরামর্শ করে নেওয়া যাক। স্যার অভিজ্ঞ মানুষ হয়ত তার চোখে কোন সুত্র ধরা পরলেও পড়তে পারে।
দারোগা সাহেব নিজের রুমে ঢুকতে তার পিছন পিছন জমীরউদ্দীন হাজির। ওকে দেখে দারোগা বলে উঠলো, মোল্লা সাহেব কি কিছু বলতে চান?”
“না স্যার তেমন কিছু না। কালকের মার্ডারটা নিয়ে আরকি। মফস্বলে এরকম নিরীহ একজন মহিলাকে খুন! কি মোটিভ থাকতে পারে। ডাকাতির মামলা না সেটা বেশ বুঝা গেসে। আর আপাতত মাথায় কিছুই আসছে না।“
দারোগা সাহেব একটু হেঁসে,“খুন করতে আজকাল খুব বড় মোটিভ লাগে না মোল্লা সাহেব। তারপরও আমি বলি কি, চোখ কান খোলা রাখো। দেখো সুরৎহাল রিপোর্টে কি আসে। অবশ্য ভিক্টিমের প্রতিবেশীদের সাথে কথা বল। প্রতিবেশীরা কম বেশি সব খবর ই রাখে। হয়ত ছোট খাট কোন ব্যাপার থেকে, কোন মোটিভ পেলেও পেতে পারো।“
জেলার সদর হাসপাতালে ফরেনসিক এক্সপার্ট একজনই। প্রতিদিন জেলায় দুই চারটা মার্ডার কিংবা এক্সিডেন্টে কেউ না কেউ মারা যায়। একজন মানুষের পক্ষে সবার সুরৎহাল করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরও জেলার ফরেনসিক এক্সপার্ট বেশ উদ্যমী লোক। কখনই হাতের কাজ ফেলে রাখে না। সদর হাসপাতালের মর্গে যেতেই ফরেনসিক সাহেবের দেখা পাওয়া গেল। জমীরউদ্দীনকে দেখেই একটা হাসি দিয়ে, এইযে এস আই সাহেব যে। তা আছেন কেমন?”
ফরেনসিক সাহেব বেশ রসিক মানুষ। আগেরবার একটা কাজে হাসপাতালে এসে জমীরউদ্দীনের সাথে বেশ খাতির জমেছে। টুকটাক কুশলাদি বিনিময়ের পর জমীরউদ্দীন জিগ্যেস করল,“কি মশাই কিছু পেলেন?”
“হুম কিছু তো অবশ্যই পেয়েছি।“
জমীরউদ্দীন বেশ আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করল, “কি পেলেন বলেন তো?” এখন পর্যন্ত আমি যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি। যদি এখন সুরৎহাল রিপোর্ট কিছুটা কৃপা করে। তাহলে উৎরে যাই।
ফরেনসিক, জমীরউদ্দীনের হাতে ছোট একটা ট্রান্সপারেন্ট কৌটা ধরিয়ে দিলো। জমীরউদ্দীন কৌটাটা ভালোমত নেড়েচেড়ে পকেটে রেখে দিলো। ফরেনসিক বলল, “ভিক্টিমের হাতের মুঠে ছিল। ও আর একটা কথা ভিক্টিমকে জবাই করে খুন করা হয়নি। জবাই করার আগে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।“
জমীরউদ্দীন অবাক হয়ে,”বলেন কি!”
যদিও ছোট একটা ক্লু পাওয়া গেসে। তারপরও লাশ নিয়ে জেলা সদর থেকে বড়ইডাঙ্গার আসার পুরো পথটুকুতেই, খুনের মোটিভ নিয়ে ভেবেও জমীরউদ্দীন কোন কুল কিনারা করতে পারলো না। তার মধ্যে নাকি জবাই করার আগে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়! জমীরউদ্দীন ভাবল যে ক্লু পাওয়া গেসে সেটা দিয়ে অবশ্য খুব একটা কাজ হবে না। তারপরও স্যারের সাথে একটু আলাপ করতে হবে। এটা যে কোন ডাকাতি মামলা না সেটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার। ডাকাতদের তো আর কাজ নাই দুইবার খুন করার ঝামেলায় যাবে। ধুর! এইভাবে চিন্তা করলে কাজ হবে না। আপাতত লাশ আগে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেই। সময় নিয়ে ভাবতে হবে। এই কেস এত সহজে সমাধান হওয়ার না।
লাশ নিয়ে বড়ইডাঙ্গায় ঢুকতেই, যেন পুরো গ্রাম হুমড়ি খেয়ে পরল। ভিক্টিমের আত্মীয় স্বজনের আহাজারি দেখে, জমীরউদ্দীন ভাবল আজকে কারো জবানবন্দী নেয়া সম্ভব না। আজকে থাক। থানায় গিয়ে স্যারের সাথে পরামর্শ করে দুই একদিন পরে আসা যাবে।
চলবে..।।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ৭:০২