ইভটিজিং
একটি মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একদল ছেলে তাকে দেখেই ছুড়ে দিল অশ্লীল মন্তব্য, কটূক্তি। রাস্তাঘাট, বাস স্টপেজ, গার্লস স্কুল কলেজের সামনে, মহল্লার গলির ধারে এটি খুব পরিচিত একটি দৃশ্য। স্বপ্না, সিমি, মহিমা, তৃষা, তিথির করুণ আর্তচিৎকার এখনও বাতাসে ভাসে। এরা প্রত্যেকেই আমাদের পরিচিত। আর যে বিষের ক্রিয়ায় এইসব সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলগুলো অকালে ঝরে গেছে তার আভিধানিক নাম ইভটিজিং। একবুক যন্ত্রণা নিয়ে মহিমা, তৃষারা ছেড়ে গেছে আমাদের। ডুবিয়ে দিয়ে গেছে সীমাহীন লজ্জায়। কিন্তু এরপরেও অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? আমরা যদি ইভটিজারদের এই বিপথ থেকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে না পারি তবে ধ্বংস হয়ে যাবে সমাজ, দেশের ভবিষ্যৎ।
সর্বনাশা ইভটিজিং
যারা ইভটিজিং করে তাদের এক বিশাল অংশ তরুণ। তবে অনেক মধ্যবয়সী পুরুষও ইভটিজিং করেন। তরুণদের তুলনায় তাদের যেহেতু বয়স বেশি, অভিজ্ঞতার ঝুলি বড়, তাই তাদের থেকে এ ধরনের আচরণ যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ। ইভটিজিংয়ের মানসিকতা বা এর উৎপত্তি সম্পর্কে প্রায় সকলেই পারিবারিক শিক্ষা ও পরিবেশকে দায়ী করেন। পরিবারে নারীর অবমূল্যায়ন দেখে যে শিশুটি কিশোর থেকে তরুণ হয়েছে তার মধ্যে মেয়েদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক মনোভাব সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এছাড়াও সঙ্গদোষ, বাবা-মার অতি আদরও অনেক সময় তরুণদের মানসিক বিকৃতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আরেকটি কারণ পরিবারের অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা। তরুণরা সব সময়ই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ছেলেদেরকে মেয়েদের সাথে মিশতে না দেয়া থেকে তাদের মধ্যে মেয়েদের সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। এই কৌতূহল নিবারণই অনেক সময় ইভটিজিংয়ের জন্ম দেয়। যার ফল হয় ভয়াবহ।
মন্তব্য মেয়েদের মুখেঃ
এই দৃশ্য আমি ধান্মন্ডি লেকের পাড়ে অহরহ দেখি। আমার বাসার সামনেই পানশী রেস্টুরেন্ট। বিভিন্ন সময়ে ওখানেই আমি কথা বলেছিলাম পাঁচজন তরুণীর সাথে। তারা বলেছেন ইভটিজিং সম্পর্কে। সিটি কলেজের ছাত্রী বাবলী বললেন, ইভটিজিং ছেলেদের বিকৃত রুচির প্রকাশ। তারা নিতান্তই মজা করার জন্য এরকম অশালীন আচরণ করে। কিন্তু মেয়েদের মনে এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। টিজাররা মাঝে মাঝে সীমা অতিক্রম করে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তরুণীটির পক্ষে তা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা আনিকা বললেন, মাঝে মাঝে কষ্ট হয় মেয়ে হয়ে জন্মেছি ভেবে। মেয়ে বলেই পাড়ার উঠতি মাস্তান থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালার কটূক্তি মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়। প্রতিবাদ করেন না কেন? একই প্রশ্নের জবাবে মিরপুর কমার্স কলেজের ছাত্রী যুথী বললেন, রাস্তায় যদি প্রতিবাদ করতে যাই লোকজন জড়ো হয়। তখন নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। ও লেভেলের ছাত্রী ইভা বললেন, ইভটিজিংয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে পরিবার থেকে সতর্কবাণী থাকা উচিত। অর্থাৎ ছোট্ট ছেলেটিকে শৈশবেই শেখানো উচিত মেয়েদের সম্মান করো। ইডেন কলেজের ছাত্রী তানিয়া বললেন, তরুণরা মূলত আবেগ থেকে এ ধরনের কাজ করে। তারা বোঝে না এর ভয়াবহতা কতটা মারাত্মক। তাদের করণীয় আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সমস্যার উত্তরণ ঘটানো।
উদ্বিগ্ন অভিভাবকঃ
পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া একটি মেয়েকে শিশুই বলা যায়। কিন্তু তাকেও যে রাস্তাঘাটে ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয় তা বুঝলাম আমার নিজের মেয়েকে দিয়েই। বললেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আবুল কালাম। অভিভাবকরা সবসময় তাদের মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত থাকেন। উৎকণ্ঠায় ভোগেন যতক্ষণ না মেয়েটি বাসায় পৌঁছায়। এই উৎকণ্ঠাই মাঝে মাঝে জন্ম দেয় অতি রক্ষণশীলতার। তবে অতি রক্ষণশীলতার ফলাফলও আমাদের সমাজে আছে। ঠিক বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো।
আর কতদিনঃ
দিন পরিক্রমায় ইভটিজিং রীতিমতো ক্রাইমে রূপ নিচ্ছে। ইভটিজিংয়ের কারণে কোমলমতি মেয়েরা মানসিক নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। নিজেদের ধাবিত করছে আত্মহত্যার মতো জীবননাশের দিকে। আমরা সিমি, স্বপ্না, তৃষা, তিথির মতো হাতেগোনা কয়েকজনের কষ্টকাহন প্রকাশ করি। এরা চূড়ান্ত পরিণতিতে পড়েছিল বলেই এদের ঘটনা গুরুত্ব পেয়েছে সংবাদ মাধ্যমের কাছে। কিন্তু এরকম হাজারো সিমি, স্বপ্না, তিথি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের শহরে, গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আর অপরাধী মুখগুলো থাকে সব সময়ই লোকচক্ষুর অন্তরালে। এ পর্যন্ত এরকম অপরাধের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি যা থেকে বাড়তে পারে টিজারদের সচেতনতা।
শিকার শুধু তরুণীরাই নয়ঃ
ইভটিজিংয়ের শিকার যে শুধু কিশোরী তরুণীরা তা নয়। এই ঘৃণ্য অপরাধের শিকার হচ্ছেন মধ্যবয়সী নারীরাও। কিন্তু এখানেও ফলাফল একই রকম। মুখ বুঝে সহ্য করা। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে প্রাণ বিসর্জন। টিজারদের নতুন টার্গেট নির্ধারণ।
আইনগত বিধানঃ
২০০০ সালে শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইনে অশ্লীল মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি, কটূক্তি করলেই শাস্তির বিধান ছিল। কিন্তু এর অপব্যবহারে অনেক সাধারণ মানুষ নাজেহাল হয়েছেন। ফলে ২০০৩ সালে এই আইন সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইনে শরীর স্পর্শ করে টিজিং না করা পর্যন্ত শাস্তির কোনো বিধান রাখা হয়নি। শরীর স্পর্শের পরই কেবল অপরাধী কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন। কিন্তু শুধু মৌখিক কটূক্তিও যে একটি মেয়েকে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে পারে তার চাক্ষুষ প্রমাণ সিমি। বাংলাদেশ পেনাল কোডের ২৯৪ ধারায় ইভটিজিংয়ের শাস্তি হিসেবে ৩ মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে যা অপরাধের তুলনায় অতি নগণ্য। ডিমপি অ্যাক্ট-এর ৭৬ ধারায় ইভটিজিংয়ের শাস্তি হিসেবে ১ বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় শাস্তির কথা বলা আছে। পেনাল কোডে আরও আছে প্রভোগ করার কারণে যদি কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় তবে অপরাধীর শাস্তি দশ বছরের জেল। কিন্তু আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অসহযোগিতার কারণে বেশিরভাগ সময়ই বিচারহীনভাবে ধামাচাপা পড়ে যায় ঘটনাগুলো।
কখনও দায়ী তরুণীরাওঃ
ইভটিজিংয়ের জন্য ছেলেরাই দায়ী শতকরা ৯৮ ভাগ। তবে কখনও কখনও মেয়েরাও দায়ী হয়। কিছু কিছু মেয়েদের অশালীন আচরণ বখাটে ছেলেদের টিজ করতে আরো বেশী প্রলুব্ধ করে। সেক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় তরুণীর উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা, অরুচিশীল পোশাক এসবও অনেক সময় ইভটিজিংয়ের সহায়ক কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আজকাল অতি আধুনিক কিছু তরুণীর মধ্যে ছেলেদের টিজ করার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। যার কারণে ছেলেরা আরও উতসাহি কিম্বা তিক্ত হয় তাদের উত্তক্ত করে।
চাই নির্মল বন্ধুত্বঃ
ইভটিজিং বন্ধ করার জন্য দরকার ছেলে-মেয়ের মধ্যে নির্মল বন্ধুত্বের পরিবেশ। বন্ধুত্বের মাধ্যমে একে অপরকে জানবে। বাড়বে শ্রদ্ধাবোধ, উন্নত হবে মন মানসিকতা। তার জন্য প্রয়োজন তরুণদের নিয়ে কাউন্সেলিং! তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বন্ধ হবে মহিমা, তিথিদের করুণ আর্তি। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাই হাতে হাত রেখে কাজ করবে দেশের স্বার্থে। বাংলাদেশের নাম জানবে পৃথিবীর সবাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




