এক ‘অশ্লীল’ সংস্কৃতিঃ ঘেঁটু বা ঘাঁটু গান.....
"গাহিয়া ঘাটু গান নৌকা দৌড়াইতাম আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম" প্রখ্যাত বাউল শিল্পী সর্বজন শ্রদ্ধেয় শাহ আবদুল করিম এর এই বিখ্যাত গানে ঘাটু গানের কথা বলা হয়েছে সেই ঘাটু গানের এলাকা/অঞ্চল ভিত্তিক অনেক নাম আছে। অঞ্চলভেদে ‘ঘাটু’ শব্দটির উচ্চারণগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এই শব্দটি "ঘাঁটু", "ঘেটু", "ঘেঁটু", "ঘাডু","গাড়ু", "গাঁটু", "গাডু" প্রভৃতি বলা হয়। নেত্রকোনা অঞ্চলে এটি ‘গাডু’ নামেই পরিচিত, তবে শিক্ষিতজনরা ‘ঘাটু’ বলেন; আবার, সুনামগঞ্জ অঞ্চলে একে ‘ঘাডু’ বলে।
বাঙালির সমকামিতা ও ঘেটুপুত্রের ইতিহাসঃ
অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট প্রভৃতি অঞ্চলে এক ধরনের লোকগানের প্রচলন হয়েছিল, তার নাম ঘেটুগান। এই গানের দলে নদীর বুকে নৌকো নিয়ে ভাসতে ভাসতে ঘাটে ঘাটে নেমে বায়না নিয়ে নাচ দেখাত ও গান শোনাত বলেই এর নাম ‘ঘেটুগান’। ‘ঘাট’ থেকে ‘ঘেটু’। ‘ঘেটুগান’ আসলে কৃষ্ণের বিরহে রাধার গান। এই গান নেচে নেচে রাধা সেজে পরিবেশন করত কিশোরেরা। তাদের পরনে থাকত রাধার পোশাক, অলঙ্কার, পায়ে আলতা, চোখে কাজল। অভাবী ঘরের দেখতে সুন্দর কিশোরদেরই এ-সব দলে নেওয়া হত, তালিম দেওয়া হত নাচগানের। সবসময় তাদের সাজিয়ে রাখা হত মেয়ের সাজে। লোকে এদের বলত ‘ঘেটুপুত্র’। সেকালের অভিজাতশ্রেণির মানুষেরা বাড়িতে ঘেটুগানের আসর বসাতেন। রাধারূপী ঘেটুপুত্রকে মনে ধরলে, তাকে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে রেখে দিতেন; বিশেষত পুরো বর্ষার সময়টা। এই সময়টায় তাদের নিয়মিত শয্যাসঙ্গী হতে হতো সেই অভিজাত মানুষটির। এক সময় এটাই প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। তখন এই প্রথার বিপক্ষে সমাজ কোন প্রশ্ন তোলেনি। তুলবার সাহস করেনি। বাড়ির স্ত্রীরাও এটা মেনে নেন বা মেনে নিত বাধ্য হন। ঘেটুপুত্রদের সতীনের চোখে দেখতে থাকেন এবং ‘সতীন’ বলে ডাকতো। ষাট-সত্তর বছর আগেও এই প্রথার বেশ চল ছিল। প্রথার সঙ্গে এখন অবশ্য লুপ্ত হয়েছে এ গানের ধারাও। বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ুন আহমেদের শেষ পরিচালিত ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। ছবিটিতে ঘেটুগানের সূত্র ধরে বাঙালির সমকামিতার ইতিহাসের এই অধ্যায়টি তিনি তুলে ধরেছেন। ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রতেও ফুটে উঠেছে কিশোরদের এই যন্ত্রণাকাতর জীবনের ছবি।

নদনদীর দেশ বাংলা। নদীকে ঘিরেই এখানে গড়ে উঠেছে মানুষের আলো-আঁধারি জীবন। তখনও মানুষ নিজেদের ঘরের মধ্যে বিনোদনের হাজার উপকরণ নিয়ে হাজির হয়নি। তাই সবটাই ছিল সামাজিক। তাতে সম্প্রীতির আহ্বান যেমন ছিল, তেমনি ছিল নানান সামাজিক ব্যাধি। এদেশে তখন সদ্য ফিরিঙ্গি জাহাজ এসে ভিড়তে শুরু করেছে। তখনও বর্ষায় কূল ছাপিয়ে যখন নদীর জল হাওরে জমা হত, তখন সেই এলাকার মানুষের কাজ বলতে কিছুই থাকত না। দিন কাটত আমোদে-আনন্দে। আর সেই আনন্দকে উস্কে দিতে ঘাটে ঘাটে নৌকো ঘুরে বেড়াত। নৌকোয় থাকত একদল নারীবেশী সদ্য-কিশোর। ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়াত বলে তাদের নাম হয়েছিল ঘাঁটু ছোকরা। আর এই ঘাঁটু ছোকরাদের নাচই ছিল ঘাঁটু নাচ।
বাংলা সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া অনেক উপকরণের কথা বলতে গেলে ঘাঁটু গানের কথা এসেই পড়ে। কিন্তু তার ইতিহাসে ঐতিহ্যের উজ্জ্বল দিকটার তুলনায় যেন অন্ধকার দিকটাই বেশি। এই ইতিহাস মনে পড়িয়ে দেয় অসংখ্য কিশোরের উপর যৌন নির্যাতনের ছবি। তখনও চাইল্ড অ্যাবিউজ নিয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি পৃথিবীর কোথাও। তাই সেই ছেলেদের কান্নার খবর যে কেউ রাখেনি, সেকথা বলাই বাহুল্য। ঘাঁটু গানের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্ক আছে। তবে মোটামুটি মনে করা হয় ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে শ্রীহট্টের কাছে আজমিরিগঞ্জ এলাকার এক বৈষ্ণব আচার্য ও তাঁর কম বয়সী শিষ্যদের রাধাভাবকে আশ্রয় করে ঘাঁটু গানের সূত্রপাত। আর তাই শেষ সময় পর্যন্ত ঘাঁটু ছোকরাদের নাচের সঙ্গে যে চটুল গান ব্যবহৃত হত, তার বিষয়বস্তুও হতো রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, বিশেষ করে রাধাবিরহ।
তবে ক্রমশ এই ধর্মীয়-দার্শনিক সীমারেখা অতিক্রম করে ঘাঁটু গান হয়ে ওঠে এক ধরনের যৌনলিপ্সার প্রতীক। আর সেই লিপ্সার শিকার ঘাঁটু-ছোকরারাই। তাদের লম্বা চুল রাখা এবং মহিলাদের মতো সাজপোশাক করা বাধ্যতামূলক ছিল। এমনকি মহিলাদের মতো চালচলনও অভ্যেস করতে হত তাদের। আর এই নারীবেশী কিশোরদের মাঝখানে রেখে চটুল গানের তালে তালে রীতিমতো বাইজির মতো নাচতে হত। এতেই তৃপ্ত হত মানুষের আকাক্ষা।

একটি ঘাঁটু দলে একজন মূল ঘাঁটু ছোকরা ছাড়াও বেশ কয়েকজন সদস্য থাকত। তারা প্রত্যেকেই ছিল ঘাঁটু, অর্থাৎ তাদেরও মেয়ে সেজে থাকতে হত। আর থাকতেন একজন ‘সরকার’ বা ‘মরাদার’ (মহড়াদার>মরাদার)। এই সরকাররাই ঘাঁটুকে নাচে-গানে এবং তত্ত্বকথায় পারদর্শী করে তুলতেন। এছাড়া আরও যাঁরা থাকতেন তাঁরা হলেন দোহার বা পাইলদার। এঁরা ছিলেন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী, সময় সময় গানের দোহার ধরতেন। ঘাঁটুর সঙ্গে সমস্বরে উচ্চগ্রামে সুর তুলে তাঁরা দর্শকের মন মাতিয়ে তুলতেন। তখন ঢোল, খোল, করতাল বাঁশির পাশাপাশি হারমোনিয়াম এবং দোতারাও ব্যবহার করা হত।
একটি দলের একক অনুষ্ঠানের প্রচলন যেমন ছিল, তেমনই ছিল দুটি ঘাঁটু দলের প্রতিযোগিতার প্রচলনও। তখন একটি দল গানের কথায় অপর দলকে একটি প্রশ্ন করত, আর সেই দলকে উত্তর দিতে হত গানের মাধ্যমেই। খানিকটা কবিয়ালের মতো। তবে কবিয়ালের ক্ষেত্রে দার্শনিক উপসঙ্গ প্রধান হয়ে উঠলেও এখানে সেই অবকাশ ছিল না। এখানে চটুলতাই ছিল প্রধান। স্থানে স্থানে বিপক্ষ দলকে পরাজিত করতে অশ্লীল রসিকতার আশ্রয় নিত ঘাঁটুরাও। তবে তার থেকেও অন্ধকার ভবিষ্যত অপেক্ষা করে ছিল এই গানের ধারাটির জন্য। আর সেটা এলো সতেরো-আঠেরো শতক নাগাদ। সতেরো-আঠেরো শতক নাগাদ ঘাঁটু ছোকরাদের কিনে নেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। যাঁরা ছেলেদের কিনে নিতেন তাঁদের বলা হতো ‘সৌখিনদার’ বা ‘খলিফা’। এঁরা কিন্তু শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। ঘাঁটু ছোকরাদের তাঁরা ব্যবহার করতেন উপপত্নীর মতো।
ক্রমশ বিশ শতকে এসে যখন নাচগানের থেকে এই অশ্লীল যৌনাচারের দিকটাই প্রধান হয়ে ওঠে, তখন আর এই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার কোনো জায়গা ছিল না। ‘ঘাঁটু’ শব্দটি ক্রমশ অপভাষায় পরিণত হয়। আর সেইসঙ্গে ছোটদের নিরাপত্তার বিষয়টিও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলির রাধাভাবের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মুক্তির কথা লুকিয়ে ছিল বলে মনে করেন অনেকেই। অথচ সেই একই মূল থেকে জন্ম নিয়েছিল এমন একটি ঘৃণ্য প্রভাব। আমাদের সংস্কৃতিতে যেমন গর্ব করার মতো উপাদানেরও অভাব নেই, তেমনই ‘ঘাঁটু’ গান এক অব্ধকার ইতিহাসের কথাই মনে পড়ায়। যে ইতিহাসকে ফেলে আসতে পারা সত্যিই এক সামাজিক সাফল্য।৷
তথ্যসূত্রঃ
(১) Ghetu Gaan- Wakil Ahmed
(২) ঘেটু গানঃ উইকিপিডিয়া।
(৩) ছবিঃ হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত ঘেটুপুত্র কমলার ছবির দৃশ্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



