somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ nnএক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

কলিকাতা থেকে কোলকাতা........

২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কলিকাতা থেকে কোলকাতা........

প্রায় এক যুগ আগে- 'ঢাকা নামের উতপত্তি এবং ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন', 'বাকেরগঞ্জ(বরিশাল) নামের উতপত্তি এবং গোড়াপত্তন' নিয়ে একটা ধারাবাহিক লিখেছিলাম। 'ঢাকা নামের উতপত্তি এবং ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন' নিয়ে লিখতে যেয়ে উল্লেখ করেছিলাম- 'ঢাকার বয়স কোলকাতার চাইতে প্রায় একশত বছর বেশী'- তখন এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মন্তব্য করেছিলেন। তখন থেকেই কলিকাতা নাম এবং এর গোড়াপত্তন বিষয়ে বিভিন্ন জার্নালে বেশ কিছু নিবন্ধ এবং বই পড়েছি। সম্প্রতি পড়েছি- অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর লেখা- "কলিকাতা নামের ব্যুৎপত্তি"। এছাড়াও পড়েছি- F.W Simms: Report on the Survey of Calcutta. এবং "কলকাতার কড়চা"- লেখক- বিনয় ঘোষ। উল্লেখিত তিনটি বইয়ে কলিকাতা নামের যেসব তথ্য পেয়েছি তার একটা সমন্বয় করে এই লেখাঃ-

১৬৯৮ খ্রীঃ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি, আওরংগজেবের পৌত্র আজিম-উস-শানের কাছ থেকে সুতানুটি, গোবিন্দপু্‌র ও কলিকাতা বা ডিহি কলিকাতা নামের তিনটি গ্রাম কেনার অনুমতি পেলো। উল্লেখিত তিনটি গ্রামের মালিক ছিলেন জমিদার সাবর্ন চৌধুরী। তাদের কাছ থেকে এই তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে আজকের এই কোলকাতা শহরের সূচনা হয়।

ইংরেজ আমলের অনেক আগে কলিকাতা ছিল নদীয়া জেলার অন্তর্গত একটি জলাভূমি অধ্যুষিত গণ্ডগ্রাম।

* সুতানুটি গ্রামের পত্তন করেন বসাক পরিবার। তাদের ছিল সুতোর কারবার। সপ্তগ্রাম থেকে সুতানুটিতে ষোড়শ শতকের শেষে কিংবা সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে এসে তাঁরা এখানে সুতা বিক্রির হাট বসাতেন। সুতা বিক্রি হতো নুটি বা লুটি হিসেবে। সেই থেকে নাম সুতানুটি।

* গোবিন্দপুর গ্রাম পত্তন করেছিল শেঠ পরিবার। তাঁদের গৃহ-দেবতা গোবিন্দ জীউ এর নামে গ্রামের নাম গোবিন্দপুর। এইসব নামকরণ নিয়ে খুব একটা বিবাদ-বিতর্ক না থাকলেও কলিকাতা নাম নিয়ে আছে নানান বিতর্ক এবং বিভ্রান্তিও। কেউ বলে কিলকিলা থেকে তো কেউ আবার বলে কালীঘাট থেকে। কিন্তু ভাষাতত্ত্ববিদরা জানাচ্ছেন যে, ভাষার বিকৃতিও একটা ব্যকরণ মেনে চলে। কিলকিলা বা কালীঘাট থেকে কলিকাতা নাম আসাটা কষ্ট-কল্পনা। তেমন জোরালো যুক্তিও নেই কিছু।

তার থেকে বরং অনেক বেশি যুক্তি আর তথ্য-প্রমাণ আছে সুনীতি চ্যাটার্জির বক্তব্যে। সুনীতিবাবুর সাফ কথা- “কলিকাতা” একটা খাঁটি বাংলা শব্দ। 'কলি' মানে চুন, কলিচুন। আর 'কাতা' মানে একদম পাতি গ্রাম্য বাংলায় শামুকপোড়ার আড়ত। সুতার নুটির হাট থেকে যেমন সুতানুটি হয়েছে, কলিচুনের জন্য শামুকের আড়ত কিংবা শামুক পোড়ানোর কারখানা থেকেই হয়েছে ‘কলিকাতা’ নাম।



সুনীতি বাবুর বক্তব্য কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। জোরালো যুক্তি এবং তথ্য-প্রমাণ আছে এর পেছনে। কলিকাতার সংগে কলিচুন বা চুনের সম্পর্কের একটা প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে মিঃ সিমস প্রকাশিত একটি সার্ভে রিপোর্ট থেকেও। মিঃ ফেড্রিক উইলিয়াম সিমস ছিলেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বৃটিশ সার্ভেয়ার, যিনি ভারত বর্ষে বৃটিশ উপনিবেশ এলাকার চীফ সার্ভেয়ার নিয়োজিত ছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন যে, সেইসময়ের ডিহি কলিকাতার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অন্তত তিনটি রাস্তা এবং এলাকার সংগে যোগ ছিল এই চুন এর। ডিহি কলিকাতার উত্তরের দু নম্বর ব্লকে ৭২২ ফুট বাই ১৭ ফুট একটি রাস্তা, যার নাম ছিল চুনাপুকুর লেন। ব্লক নম্বর তিন এ ৭৭০ ফুট বাই ২৩.৪ ফুটের রাস্তা চুনাগলি। আর ব্লক নম্বর চার এ ৯২০ ফুট বাই ১৪ ফুট এর রাস্তা চুনারপাড়া লেন। এখন যেখানে স্ট্র্যাণ্ড রোড, তখন এই জায়গার ওপর দিয়েই বইতো হুগলী নদী। আর চুনারপাড়ার অবস্থান ছিল এর খুব কাছেই।

এই তিনটি ব্লকের সীমানা ছিল উত্তরে আজকের কলুটোলা স্ট্রীট, দক্ষিণে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি বা বহুবাজার স্ট্রীট, পূর্বে সার্কুলার রোড আর পশ্চিমে লালবাজার। আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগেও এই অঞ্চলে চুনারীদের বসবাস ছিল। কলিকাতা যেহেতু এক সময়ে সমুদ্রের তলায় ছিল, আর কলকাতার প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক রূপ অন্যরকম ছিল তাই কলিচুন তৈরির প্রধান উপাদান শামুকও পাওয়া যেত প্রচুর কলকাতা আর তার আশেপাশে। দুই বাংলার কোথাও তখন পাথুরে চুনের প্রচলন শুরু হয়নি। তাই এই কলিচুনের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। পরবর্তীকালে সস্তা পাথুরে চুনের সংগে প্রতিযোগিতায় ধ্বংস হয়ে যায় কলিচুন তৈরির এই কুটিরশিল্প। চুনারীরাও জীবিকার্জনে কোনঠাসা হয়ে বেছে নেয় অন্য পেশা। সুনীতিবাবুর এই কলিচুন এর কাতা থেকেই কলিকাতা- এই মত কে সমর্থন জানিয়েছে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ বিনয় ঘোষ।



এর স্বপক্ষে বিনয়বাবু যা প্রমাণ দেখালেন,
১৯৫২ সালে তিনি (বিনয় ঘোষ) এই শহর থেকে ৫০/৬০ কিমি দূরে একটি পাখি ডাকা ছায়াঘেরা গ্রাম আবিষ্কার করেন, যার নাম- কলিকাতা। বিনয়বাবু খোঁজখবর শুরু করে দলিল-দস্তাবেজ, সেটেলমেন্টের কাগজেও দেখেন- এই গ্রামের নাম লেখা কলিকাতা। আড়াইশো বছরের বেশি পুরানো একটি মন্দির আছে এই গ্রামে। সেই মন্দিরের গায়েও কলিকাতা নামটি লেখা। দোকান টোকানের সাইনবোর্ডেও বেশিরভাগ জায়গাতেই তখন লেখা ছিল কলিকাতা। হাওড়া জেলার পশ্চিমদিকে দামোদরের গা-ঘেঁষা একটি সমৃদ্ধ জনপদের নাম রসপুর। সেই জনপদেরই একটি গ্রামের নাম কলিকাতা। এই ছোট্ট গ্রামটিকে আজ ও ছোট কলিকাতা নামেই ডাকে আশেপাশের মানুষ। হাওড়ায় ও চব্বিশ পরগনায় খুব কাছাকাছি এলাকার মধ্যেই কলিচুনের কাতার এর নামে কলিকাতা পরিচয়ে অন্ততঃ দুটি গ্রামের নামকরণ হয়েছিল। হাওড়ার কলিকাতা গ্রামটি আজও তার নীরব সাক্ষী হিসেবে টিঁকে রয়েছে। ‘কলিকাতা’ নামের উৎস সম্পর্কে সুনীতিবাবু যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, এই কলিকাতা গ্রামের নামের সংগেও হুবহু মিলে যায় সেই ব্যাখ্যা।

বিনয়বাবুর সন্ধিৎসু পর্যবেক্ষণ আর খোঁজখবরে বেরিয়ে এলো এই গ্রামের নামকরণের ইতিহাস। একসময়ে নাকি খুবই সমৃদ্ধ ছিল রসপুরের এই কলিকাতা গ্রাম। দামোদরের তীরে এই অঞ্চলটি ছিল কলিচুন তৈরি আর তার বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। বয়স্ক বাসিন্দাদের কাছ থেকে বিনয়বাবু জেনে এসেছিলেন যে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষেও এই গ্রামে প্রচুর মানুষ যুক্ত ছিলেন এই কলিচুন তৈরি ও বিক্রির জীবিকার সংগে। বিনয় ঘোষের এই প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের ফলেই সুনীতিবাবুর ‘কলিচুন এর কাতা’ থেকেই কলিকাতা মতবাদটি দৃঢ় হয়। কালিঘাটের কালী থেকে নয়, কলিচুনের কাতা থেকেই নাম এই কলিকাতার। ইংরেজদের বদান্যতায় হুগলী নদীর পূর্বদিকের কলিকাতা আজ সিটি অভ জয় আর নদীর পশ্চিমপাড়ের কলিকাতা আজও অখ্যাত অবহেলিত একটি গ্রাম।

তথ্যসূত্রঃ-
(১) F.W Simms: Report on the Survey of Calcutta. 1851
(২) 'কলিকাতা নামের ব্যুৎপত্তি'- অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
(৩) 'কলকাতার কড়চা'- বিনয় ঘোষ।

ছবিঃ- 'কলিকাতা নামের ব্যুৎপত্তি' বই থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১০:৫১
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিছু "নতুন" ব্লগারের জন্মের কারণই হচ্ছে আমার ব্লগিং

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৪ শে মার্চ, ২০২৩ সকাল ৯:০৯



আমরা নতুন নতুন ব্লগারের আগমণের জন্য উৎগ্রীব; সম্প্রতি বেশ কয়েকজন এসেছেন; এদের ২/৪ জন, এসে ১টা শুভেচ্ছা পোষ্টও লেখেননি, তার আগেই আমার পোষ্টে ঝাপ দিয়ে পড়েছেন মন্তব্য করতে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

পুঁজিবাদের আত্মরক্ষায় নেটো গঠিত হয়েছে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৪ শে মার্চ, ২০২৩ সকাল ১০:০৭



সোস্যালিজম ও কমিউনিজম পুঁজিবাদীদেরকে তাদের শ্রেণী শত্রু ঘোষণা করে তাদেরকে খতম করার ঘোষণা প্রদান করে।তখন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সমূহ সোস্যালিজম ও কমিউনিজম এর হাত থেকে আত্মরক্ষায় নেটো গঠন করে।পুঁজিবাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিভ্রান্তি (কিঞ্চিৎ রম্য)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ২৪ শে মার্চ, ২০২৩ সকাল ১১:৩১


বয়স
সাবেক এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল জীবনের আয়-উন্নতি নিয়ে। কথা প্রসঙ্গে বয়সের বিষয়টা সামনে এল। জিগ্যেস করলাম, স্যার, আপনার বয়স এখন কত চলে?
উনি বললেন, ৩৬।
আমি একটু অবাকই হলাম। ৫ বছর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের একজন রোগীর জন্য কমপক্ষে পাঁচ জন ডাক্তার!

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৪ শে মার্চ, ২০২৩ দুপুর ২:৫০

বাংলাদেশের একজন রোগীর জন্য কমপক্ষে পাঁচ জন ডাক্তার!

বিশ্বাস হয়না?
তাহলে আপনার অফিসে, গলির কোনো টং দোকানে অর্থাৎ যেখানে অন্তত জনা পাঁচেক লোক আছে- সেখানে কাউকে বলবেন-'আমার মাথা ব্যথা করছে'/'আমার পেট খারাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বান্তনা

লিখেছেন জটিল ভাই, ২৪ শে মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৫:২৬


(ছবি নেট হতে)

আমি নতুন নতুন ব্লগারের আগমণের জন্য উৎগ্রীব; সম্প্রতি বেশ কয়েকজন এসেছেন; উহারা ২/৪ জন, এসে ১টা শুভেচ্ছা পোষ্টও লেখেননি, কারণ, উহারা আমার শিষ্যকে লইয়া জয়গান করিতে জানেনা বিধায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×