যতই পুরনো হোক- আজীবন 'নিউ মার্কেট' হয়েই থাকবে......
নিউমার্কেট সম্পর্কে বলার আগে বউ বাজার সম্পর্কে একটু বলি- দেশে সব জেলায়তো বটেই, অনেক শহরের অলিগলিতেও বউ বাজার নামে একটা বাজার পাওয়া যায়। যে বাজারে বহুকিছু পাওয়া যায়, যে বাজারের বেশীরভাগ ক্রেতা এলাকা/পাড়া ভিত্তিক মা-বোনেরা, কিম্বা গৃহবধূরা, সেই বাজারগুলোই 'বউ বাজার' নামে পরিচিত। বউ বাজাররে নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু কিছু পাওয়া যায়, সেখান থেকেই বৃটিশ বাংলা কলকাতায় প্রথম গড়ে উঠেছিলো 'বহুবাজার'। বর্ধিষ্ণু শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির ফলে গৃহ কর্তার অনুপস্থিতিতে সেই সেইবব বাজারের বেশীরভাগ ক্রেতা এমনকি অনেক বিক্রেতাও ছিলেন নারীরা। সেই বহু বাজার নাম বিকৃত হয়ে 'বউবাজার' নাম নেয়। ঢাকা নিউমার্কেট হচ্ছে ষাট সত্তর দশকের আধুনিক বউ বাজার!
আধুনিক নগর সভ্যতায় কেনাকাটার গুরুত্ব যেভাবে বেড়েছে সে হারে বেড়েছে মার্কেটের গুরুত্ব। যদিও এখন ঢাকা শহর মানেই মার্কেটের শহর। পাড়া মহল্লা সর্বত্রই এখন বিশাল বিশাল শপিং কম্পলেক্স, চেইন সুপার শপ। এমনতরো অজস্র শপিং কম্পলেক্স থাকা সত্যেও ঢাকা নিউ মার্কেটের আবেদন এতোটুকু কমেনি! বরং নির্দ্বিধায় বলা যায়, রাজধানীর কেনাকাটার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের প্রথম পছন্দই হচ্ছে- নিউমার্কেট এবং তৎসংলগ্ন গাউছিয়া মার্কেট।
নিউমার্কেটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ ১৯৫২ সালে ৩৫ একর জায়গা নিয়ে এ মার্কেটের নির্মাণ কাজ শুরু হলেও এর পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৫৪ সালে। একদা বিকিকিনির জন্য নিউমার্কেটকে বলা হতো এ-ওয়ান। অবশ্য রাজধানীতে আয়েশী অবকাশ কাটাতে ঘুরে ঘুরে প্রশস্ত চত্বরে শপিং করার সাথে সাথে জম্পেশ আড্ডা এবং খানাপিনার জন্য অনেক মার্কেট এবং শপিং মলে ক্রেতাসাধারণ আকর্ষণীয় সেবা পেলেও নিউমার্কেট তার ভিন্নতর আকর্ষণ ঠিকই বজায় রেখেছে। ত্রিকোণী কেন্দ্রভূমি নিউমার্কেটের দোকানে আপনি এমন কিছু নেই যা পাবেন না। অভিজাত বেনারসী শাড়ি থেকে শুরু করে শাটিং-স্যুটিং, অলংকার, লেদার আইটেম, বই-পুস্তক, ফটো স্টুডিও, রেস্টুরেন্ট- সবকিছুই পাচ্ছেন নিউমার্কেটে। ৫০ এবং ৬০ এর দশকে ঢাকার নিউমার্কেট শপিং এবং চমৎকার সময় কাটাবার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিল। ঢাকা রক্ষণশীল শহর হলেও উঠতি যুবকদের বান্ধবী নিয়ে ঘোরার জন্য নিউমার্কেট ছিল নিরাপদ স্থান। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একে অপরকে কিছু গিফট করতে সান্ধ্য ভ্রমণটা নিউমার্কেটেই সেরে থাকে।
আশির দশকে নিউমার্কেটের উত্তর মুখে গড়ে ওঠে ক্রোকারিজ সামগ্রীর জন্য নিউ সুপার মার্কেট, কিচেন সামগ্রীর জন্য বনলতা মার্কেট, বিবিধ জিনিসের জন্য চন্দ্রিমা মার্কেট এবং ডি ব্লকে গড়ে ওঠে গ্রোসারিজ মার্কেট। মসজিদের পাশে মনোরম পার্ক এবং নতুনভাবে বরাদ্ধ দেয়া দোকান দ্রব্যসামগ্রীর পসরা খুলে বসেছে- যার জন্য পরিবেশ অসহনীয় পর্যায়ে গিয়েছে। সত্তুর বছর পেরিয়ে এর অনেক পরিবর্তন-বিবর্তন এবং অন্তর্ভুক্তি ঘটলেও নিউমার্কেট সকলের কাছে এখনোর “নিউ”। সময়ের প্রয়োজন মেটাতে নিউমার্কেট তার পরিধি বাড়িয়েছে, সাথে সাথে প্রাচ্য সভ্যতা ও ঐতিহ্যের ধারক নিউমার্কেট মানুষের চাহিদার কথাও ভোলেনি। গ্রোসারি থেকে শুরু করে বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন, জুয়েলারি, চশমা, লোকাল এবং ওয়েস্টার্ন ক্রোকারিজ এবং গৃহসজ্জার যাবতীয় সামগ্রী অর্থাৎ আপনার সম্ভাব্য সব প্রয়োজন মেটাতে নিউমার্কেট সদা প্রস্তুত। গৃহিণীরা অনেকেই জানে নিউমার্কেটের কোন দোকানে তার কাঙিক্ষত দ্রব্যটি মিলবে। ছাত্র থেকে শুরু করে বাবা-মারা তাদের প্রয়োজনীয় স্টেশনারী জিনিসের সবটাই পেয়ে যায় নিউমার্কেটে।
প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ এবং সহনীয় দামের প্রশ্নেও নিউমার্কেট তার অবস্থান ধরে রেখেছে। একদা নিউমার্কেট শহরের ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু থাকলেও এখন সম্প্রসারিত রাজধানী ঢাকায় নিউমার্কেট অনেকটাই আগের অবস্থান হারিয়েছে। তবু্ও তার তোরণ এবং টাওয়ার ধ্রুপদী ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিউমার্কেটের ছোট ছোট কর্নারেও মিলবে আপনার প্রত্যাশিত সামগ্রী। ঢাকাবাসীরা নিউমার্কেটের জন্য রীতিমত গর্ববোধ করে। নিউমার্কেটের বিশাল ছাদের নিচে রয়েছে বাহারি পোশাকের বিপুল সমাহার। টি-শার্ট, ট্রাউজার, গরম কাপড়ের তো কথাই নেই। সপ্তাহ শেষের ছুটির দিনে পিক আওয়ারে যিনি নিউমার্কেটে মার্কেটিং এর প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন তিনি বুঝতে পারবেন নিউমার্কেটের বিপুল সম্ভারের আভিজাত্য। নিউমার্কেটের জনপ্রিয়তা বুঝতে যদি কেনাকাটা করতে যান তাহলে ভীড়ের চাপ, কটাক্ষ বা কনুইয়ের গুঁতোই বাস্তবতা প্রমাণ করবে সেইসাথে সেইসব বিড়ম্বনাও আপনাকে কবুল করে নিতে হবে।
বিপুল সমাহার বড় কথা নয়, নিম্ন-মধ্যবিত্ত সাধারণ ক্রেতাদের নিউমার্কেট এখনো প্রথম পছন্দ। একটু দরদাম করে মোটামুটি মানসম্পন্ন একটা পোশাক ৩০০ থেকে ১০০০ টাকায় পেয়ে যাবেন। নিউমার্কেট শুধু শপিং’র জন্যই নয়, ঢাকার গর্বের সাথে নিজেকে অংশীদার করারও একটা সুযোগ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৩০