কলাবাগানের বিশাল এপার্টমেন্টে খালিদ ভাই'র স্টুডিও। সারা বাড়ী শুধু ছবি ছবি আর ছবি! সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের সারা জীবনের কর্ম। নিজের চোখে এসব দেখতে পাওয়াও এক জীবনের ভাগ্য। শান্ত নিয়ে এসেছে ল্যাপটপ স্ক্যনার আমার হাতে ফ্রাইড চিকেন আর কবির্স থেকে কেনা তিন বতল রেড ওয়াইন। লুঙ্গি আর ফতোয়া পরা খালিদ ভাই দরোজা খুললে পোলাপাইনের মত বললেন কি ব্যাপার হেলাল, এ্যাতো দেরী! চাইনীজ রেস্তোরায় ফ্রাইড চিকেন আর চিলি বীফ বানাইতে এতক্ষন লগবে কে জানত!
আজকের এপয়েনমেন্টের উদ্দেশ্য হলো দুইটা, ১. বদরুল আলম বেনুর খোঁজ। ২. খালিদ ভাই এর কাছ থেকে পুরোনো পত্রিকা ও ছবির'র কপি সংগ্রহ করা। দুপুরে লাঞ্চ করব আমরা কাজ করতে করতে। ধুলো ঝেড়ে খালিদ ভাই বের করলেন কবেকার এক জীর্ণ কাগজের ফাইল। যার ভেতর থরে থরে গোছানো রয়েছে ইতিহাস। আমি স্বচক্ষে দেখছি ১৯৭৩ সালের ২২ জুলাই দৈনিক বাংলায় ছাপা হওয়া সালেহ চৌধুরীর সেই নিবন্ধ "অপরাজয় বাংলা" যার অনুসারে স্বাধীনতার এ অমর স্মারকের নামকরন হয় অপরাজেয় বাংলা। দেখছি অপরাজেয় বাংলা নিয়ে সচিত্র সন্ধানী, বিচিত্রার সকল কভার স্টোরী। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৯ এ অপরাজেয় বাংলা উদ্বোধনের দিন প্রকাশিত দৈনিক বাংলার ঐতিহাসিক সেই সম্পাদকীয় । সকল কিছু চোখের সামনে, অবাক বিস্ময়ে ছুতে পারছি ইতিহাস!
মুক্তিযুদ্ধের সময় একেবারেই শিশু থাকলেও আমি স্পষ্ট স্মরন করতে পারি ১৯৭১ কে। এটা আমার মনের নিভৃতে থাকা এক গর্ব আমি বিজয় দেখেছি। যত অবোধই হোক সে দেখা, তবুও গর্ব দেখেছিতো! তেমনি অপরাজেয় বাংলা নিয়ে যখন কাজ করবার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম তখন মনের ভেতর একটা ব্যাপারই শুধু কাজ করছিল আর তা হলো মুক্তিযুদ্ধ। আমরা যারা প্রজন্ম একাত্তর, তাদের চোখের সামনে মঞ্চস্থ হয়েছে একাধারে পালাবদলের অসম্ভব সব নাটক! আমার মনে হলো, বাংলাদেশের অপরাজেয় ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে যে ভাস্কর্য আমি সেই ইতিহাসের খুব আশপাশ দিয়ে ঘুরবার একটা সুযোগ পেয়েছি। কাজেকাজেই এ আমার জীবনের এক পরম সৌভাগ্য ও দায়িত্ব আমি যেনো অন্তত এই মুক্তিযুদ্ধের স্মারকটির নির্মাণ কিম্বা জন্ম ইতিহাস, অনুপ্রেরণা কথা গুলো ঠিকঠাক ধারন করে রাখতে পারি।
সৌভাগ্যবসত এ স্মারকটির নির্মানের সাথে জড়িত প্রতিটি মানুষই আজ সহিসালামতে জীবিত আছেন, সুস্থ্য আছেন। মনে হলো এ আমার বুঝি একান্ত কর্তব্য তন্ন তন্ন করে এই মানুষ গুলোকে খুজে বেরকরা, তাঁদের আবেগ অনুভূতির কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা তাঁদেরই মুখের ভাষায় মানুষের কাছে সাধ্যমত নিয়ে যেতে চেষ্টা করা। যে অপরাজেয় চেতনা এক সময়ের সেই সময়ের তরুণদের যুথবদ্ধ করেছিল মুক্তির মন্দির সোপান তলে আজ এ ক্ষয়ে পড়া সময়ে সেই সকল প্রেরণার কথা আমি যদি আগামী দিনের কারো জন্য তুলে রাখতে পারি তাতেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।
লাঞ্চের শেষে খালিদ ভাই পুরোনো একটা ডায়রী হাতরে এটি ফোন নম্বর বের করলেন। বললেন, 'দুই বছর আগে বেনুর ছেলে একবার ফোন করে এন নাম্বারটা দিয়ে ছিল। জানি না ঠিক আছে কি না! বেনুর সাথে আমার দীর্ঘ দিন আর কোন যোগাযোগ নাই।' আমি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকি।
সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ ডায়াল করলেন। বুঝলাম ঐ প্রান্ত থেকে কেউ এক জন ফোন ধরেছেন। সাময়িক কুশল বিনিময়ের পর খালিদ ভাই ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের নাম আশিক ইমরান। পেশায় আর্কিটেক্ট। বদরুল আলম বেনুর ছোট ছেলে। বাংলাদেশের একটি বড়সর ডেভলাপিং ফার্মের স্থপতি হিসেবে কর্মরত আশিক ইমরান আমার কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। আমি আমার উদ্দেশ্য বিধেয় নিয়ে আর সবাইকে যা বলি তাকেও সেই কথা গুলো শোনালাম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্মারক অপরাজেয় বাংলার মধ্যমনি গ্রেনেড হাতে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার মডেল শিল্পী বদরুল আলম বেনু। যার খোজ পাওয়া এক সময় মনে হয়ে ছিল এক প্রকার দুঃসাধ্য প্রায়, তাঁর খোজ পাওয়া গেছে! হাসিনা আহমেদ, সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলের পর আমি নিজের চোখে দেখতে পাবো জীবন্ত আরেক কিংবদন্তিকে! ভাবতেই যেনো আমার কেমন লাগছিল। এক জন সেই সুদূর টরন্টো শহরে একজন ঢাকায় আর আর একজন বর্তমানে বসবাস করেন দিনাজপুরের এক গ্রামে! বেনু সাহেবের ছেলের কাছে জানলাম তিনি সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। আমি নিজের আবেগ আর সংবরন করতে পারছিলাম না। যে মূর্তি গুলোকে একদা কেবল মূর্তি হিসেবে দেখেছিলাম দূর থেকে আজ জীবনের এই এক পর্যায়ে এসে এক মূল্যহীন পাগলামী আমাকে ঠেলতে ঠেলতে কোথায় নিয়ে এসেছে! যে ইতিহাস হয়ত কখনো বইয়ে পুস্তকে পড়তাম আজ আমার ভাগ্য হয়েছে সেই ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বদের নিজের চোখ দিয়ে দেখবার কান দিয়ে শুনবার!
বেনু সাহেবের সাথে দেখা করব কিভাবে জানতে চাইতেই ওনার ছেলে আশিক ইমরান বললেন তিনি আগে আমার সাথে একদিন একটু কথা বলতে চান। আমি বললাম কোন অসুবিধা নেই ভাই, কবে কোথায় কখন দেখা করতে হবে আমাকে বলেন আর আপনার ঠিকানাটা দিন আমি সময়মত হাজির থাকবো। তিনি আমাকে দিন ক্ষন ঠিক করে বনানীতে তার অফিসে এক দিন কফির নেমন্তন্ন করলেন, আমি সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম।
(ছলিবেক)
* হাতের লেখা অপরাজেয় বাংলা নেয়া হয়েছে ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর অপরাজেয় বাংলার উদ্বোধনী স্মারক গ্রন্থের প্রচ্ছদ থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সংসদের পক্ষে সংকলনটি প্রকাশক ছিলেন আলী রীয়াজ।
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ১: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ২: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৩: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৪: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৫: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৬: অপরাজেয় বাংলা
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৭ : অপরাজেয় বাংলা
ওয়েব ঠিকানা, অপরাজেয় বাংলা
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৬ ভোর ৫:০৯