ছয়.
আমি যখন দেশ ছাড়ি তখন আর্ট কলেজের উল্টা দিকে ছবির হাট বলে কিছু ছিল না। ছিলেন মোল্লা চাচা আর তার চা খানা। ১৯৮৭ এ ভিডিওতে প্রজন্ম নামে একটা শর্ট ফিল্ম বানাইবার ব্যার্থ চেষ্টা করে ছিলাম। মোল্লার চা দোকানের একটা সিকোয়েন্স ছিল। ছিল অপরাজেয় বাংলার কিছু ফুটেজ। ক্যাছেট টা খোয়া গেছে মন্ট্রিয়লের বাড়ীতে। বহু দিন পর সেই চেনা যায়গা, একটি দু'টি চেনা মুখ। পাল্টে যাওয়া সময়, পরিবেশ, আর রয়েছে পাল্টানো সময়ের ঝাক ঝাক মানুষ! কাঠের মানুষ ভন্ডুলের মত ভবঘুরে মৃনাল'দাকে দেখেও কথা বললাম না। ইচ্ছে হলো না কথা বলতে। কে বলবে আড়ং এর লগো'র নক্সাবিদ চীফ ডিজাইনার এখন কাকের গু মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান কপর্দ হীন!
ছবির হাটের যাদের সাথে পরিচয় হলো তাদের কাউকে ২২ বছর আগে মোল্লায় দেখে ছিলাম কিনা মনে করতে পারলাম না। তুহীন পরিচয় করিয়ে দিল দু'এক জনের সাথে। সেই দু'এক জনের সুবাদে পরিচয় হতে থাকলো আরো ক'এক জনের সাথে। যার সাথেই পরিচয় হই তার কাছেই খোজ চাইতে লাগলাম শিল্পী বদরুল আলম বেনুর। কেউ কোন খোজ দিতে পারল না!
খালাত ভাই ইমরুলের চারুকলায় একটা পিচ্চি বাহিনী আছে, টি এস সিতে নাটকের রিহার্সেলের ফাকে ফাকে সেও ছবির হটে ঢু মারে। এক দিন সে এসে আমায় বুদ্ধি দিল, চলেন ভাইয়া রেজিস্ট্রি বিল্ডিংএ গিয়া খোজ লাগাই। এই সব নিয়ম তান্ত্রিক জটিল পদ্ধতিতে আমার বরাবরের অনীহা। আমি ইমুরে বলি, ভাই দেয়ার ইজ অলওয়েজ এ ইজি ওয়ে। আমাদের সেই পথের সন্ধান করতে হবে। ঐ দরখাস্ত ফরখাস্ত করতে আমি পারব না।
ছবির হাটের পোলাপাইন কেউ ই বেনু নামের চারুকলার কোনো ছাত্র কোনো কালে ছিল কিনা তাই আমাকে বলতে পারল না! ওরা আমাকে ম.হামিদ ও আবদুল্লাহ খালিদের সরনাপন্ন হতে বল্ল। ম. হামিদের কাছে খোজ পাওয়া যায়নি আর আবদুল্লাহ খালিদ ও ঢাকায় আসবেন সেই ঈদের পর। সেত আরো ২০/২৫ দিনের কথা। এর মাঝে কি করি তাহলে? ফোন ঘুরালাম আবারো সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে কে। এইবার ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে সাড়া মিলল। আমি ত বেজায় খুশী! ঊনি তখন ঢাকার বাইরে ফিরবেন আরো দু'দিন বাদে। আমি এপয়েন্টমেন্ট চাইলাম উনি আমাকে দুই দিন পর ফোন করতে বললেন। আমি দুই দিন পর ফোন করলাম, উনি আমাকে সময় দিলেন পনর মিনিট। আমি বললাম তাতেই চলবে।
দশটায় এপয়েন্টমেন্ট ধানমন্ডিতে বাড়ী খুজে পেতে পেতে বিশ মিনিট দেরী হয়ে গেল। দড়জায় পৌছুতেই বুঝলাম দেরীকরার জন্য কথা শুনতে হবে। তিনি কিছু বললেন না কিন্তু জায়নামাজ হাতে বাইরে যাবার জন্য বসে আছেন দেখলাম। রোজার দিন উনাকে পাঁচমিনিটও বেশী বিরক্ত করা যাবে না সেটা বুঝলাম পরিষ্কার। ঘরের ভেতর তেমন কোনো আলোর বন্দবস্ত নেই টিউবলাইট জলে ফ্যান চলে ছবি তুলতে যেয়ে বারবারই মাথা চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল। অগত্যা শুরু করলাম। আমি সাখারনত আমার উদ্দেশ্যটা সবাইকে একটু বলেনি প্রথমে তার পর আমার সাবজেক্টরাই হরহর করে বলা শুরু করেছেন এ পর্য্যন্ত। কিন্তু এই বেলায় তেমনটি হলো না ফজলে সাহেবকে যাই জিজ্ঞেস করি তিনি এক শব্দে উত্তর করে ফেলেন আর ঘড়ি দেখেন। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
দৌড়া দৌড়ি করে ক্যামেরা ট্রাইপড টেনে দস্তুর মত আলোহীন একটা ঘরে জানালার পর্দা বন্ধকরে ক্যামেরা চোখে আমি সর্ষে ফুল দেখা শুরু করলাম। তবুও এর মাঝে যেটুকু পারা যায় ওনার কাছ হতে জানবার চেষ্টা করলাম। ফজলে সাহেব বাক পটু নন। তিনি ১৯৭৩ সালের সেই সুঠাম দেহের তেজদীপ্ত যুদ্ধ ফেরত কোন ছাত্র ও আর নন। গাল ভর্তি দাড়ি নিয়ে সাদা পাজামা, পাঞ্জাবী পরিহিত সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে ক্যামেরার সামনে কিছুটা বিব্রতও বোধকরছেন কেন জানিনা।
সেই মুহুর্তে আমি শুধু একটি কথাই তার কাছ হতে পরিস্কার হতে চাইলাম। সেটা হল আজ এতবছর পর তার ভাবতে কেমন লাগে যে ঐ তেজদীপ্ত তারুন্যের প্রতিনিধি হয়ে তারই একটি প্রতি মুর্তী দাড়িয়ে আছে কলাভবনের সামনে। সৈয়দ হামিদ মকসুদের কথায় ফুটে উঠল গর্বিত এক আবেগ। আমি মনে মনে বললাম ব্যাস এই টুকু হলেই চলবে কমরেড। আপনি ভালো থাকুন।
পরে তিনি রাস্তায় নেমে হাসি মুখে ক্যামেরার জন্য বার কয় হাটলেন তার ধানমন্ডির এপার্টমেন্টের সামনে। আমি বুঝলাম এই লোকটি একজন প্রচার বিমুখ সাদাসিধা সাধারণ মানুষ। যিনি একদা ইতিহাসের একটি অসাধারণ কর্মের সাথে নিজেকে যুক্ত করে ছিলেন এই দেশ ও এর স্বাধীনতাকে ভালোবেসে।
স্যালুট আপনাকে।
(চলিবেক)
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ১: অপরাজেয় বাংলা
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ২: অপরাজেয় বাংলা
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৩: অপরাজেয় বাংলা
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৪: অপরাজেয় বাংলা
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৫: অপরাজেয় বাংলা
ওয়েব ঠিকানা, অপরাজেয় বাংলা
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০০৯ রাত ১১:৫৭