somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষা আন্দোলনের "ঘোষক" শেখ মুজিব!!!!!!!!!!!!

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব- জাতির জনক। স্বাধীনতার ঘোষক। খালি তাই- নয়, তিনি "ভাষা আন্দোলনেরও ঘোষক"। আমাগো ধারণা আওয়ামিলীগই এই ব্যক্তিটিরে সবচেয়ে বেশী পচাইছে- অহনও পচাইতেছে .....
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক, গবেষক এবং "পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি" ইতিহাস গ্রন্থের লেখক বদরুদ্দিন উমরের প্রবন্ধটা সবাইরে পড়ার আহবান জানাইতাছি.......

একুশে ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর বইমেলা উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রীতি অনুযায়ী এক ভাষণ দিয়েছেন। সেই ভাষণে তিনি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী পিতার গৌরব বর্ণনা করেছেন অনেকক্ষণ ধরে। কোনো ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। পিতৃ বন্দনাও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষত, শেখ মুজিবুর রহমান যখন শুধু পিতা নন, এ দেশের একজন কীর্তিমান মানুষ, একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তার প্রসঙ্গ নিয়ে সর্বত্র এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিকভাবে, নানা কথা বলা হলে এর ফলে তার মর্যাদা বৃদ্ধি হয় না, উপরন্তু যারা এসব শোনেন তাদের অনেকেরই মনে বিরক্তি উত্পাদিত হয়। এই অভ্যাস যে শুধু শেখ হাসিনার তা-ই নয়, এটা এখন এমনভাবে আওয়ামী সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়েছে যাতে আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রী, কর্মী থেকে নিয়ে তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত এই অভ্যাসের দাসত্ব করেন।

বাংলা একাডেমীর উপরোক্ত ভাষণের কথা প্রসঙ্গে এসব কথা বলার কারণ, এই ভাষণে এমনসব কথা বলা হয়েছে যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে এবং সুবিধাবাদী চাটুকার পরিবৃত হয়ে এ ধরনের কথাবার্তা অনায়াসে বলা যায়। চাটুকারদের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কাজেই ভাষণ দানকারী বা বক্তা এ ক্ষেত্রে নিরাপদ থাকেন। কিন্তু আসল ও স্থায়ী নিরাপত্তা তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদের অভাব থেকে আসে না। বক্তব্য ব্যক্ত করে নিরাপদ থাকার জন্য প্রয়োজন নিজের বক্তব্যকে সত্যের ওপর দাঁড় করানো। কারণ, ঐতিহাসিক সত্য কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। তার চরিত্র সামাজিক, সমাজের কালপ্রবাহের সঙ্গেই তার সম্পর্ক।

প্রধানমন্ত্রী বাংলা একাডেমীর ভাষণে নানা বিষয়ে যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তার ওপর আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। ভাষা আন্দোলন ও তাতে তার পিতার ভূমিকা সম্পর্কিত যেসব কথা তিনি বলেছেন, তার
মধ্যেই আমি আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। বাসস কর্তৃক প্রচারিত সংবাদ হ্যান্ড আউটে দেখা যায় তিনি বলেছেন, "১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন আইন পরিষদে ঘোষণা দেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে। তার এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগসহ গোটা ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।"

শেখ মুজিবের এই ভূমিকা সম্পর্কে হাসিনার বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। কিন্তু তার আগে বলা দরকার, "পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে, একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্র ভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে" খাজা নাজিমুদ্দীনের এই বক্তব্য তিনি প্রদান করেন ঢাকায় আইন পরিষদে নয় করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে। নাজিমুদ্দীনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলন চলতে থাকে। এ সময় তমদ্দুন মজলিস, গণআজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন ছাত্রাবাসের যৌথ উদ্যোগে ২রা মার্চ ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ইত্যাদি ছাত্রাবাস ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, প্রত্যেকটি থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে এই সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। (তাজউদ্দীনের ডায়েরি ২.৩.১৯৪৮)। শেখ মুজিব এই সভার ধারে-কাছেও ছিলেন না। কারণ, তিনি তখন ছিলেন কলকাতায়। সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কয়েকদিন পর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় থাকলে তিনি ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে এই পরিষদের দু'জন সদস্যের মধ্যে একজন হতে পারতেন, নাও হতে পারতেন। কারণ, ঢাকায় ছাত্র রাজনীতি না করার ফলে এখানে তার সে রকম কোনো অবস্থান সে সময়ে সংগঠনের মধ্যে ছিল না। কাজেই তার "প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে" সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল, এ বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা। মিথ্যা যদি না হয় তাহলে এটা সম্পূর্ণভাবেই এক অজ্ঞতাপ্রসূত বক্তব্য।

এরপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, "১৯৫২ সালের ১৫ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই আবারও ঘোষণা দেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।" নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ১৫ জানুয়ারি নেননি। এ দায়িত্ব তার ওপর বর্তেছিল ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী নিহত হওয়ার ঠিক পর। ভাষা বিষয়ে খাজা নাজিমুদ্দীনের যে বক্তব্যের পর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নবপর্যায়ে শুরু হয়, সেটা তিনি দিয়েছিলেন ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ২৭শে জানুয়ারি। অনেক কিছুর পরোয়া না করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য দিতে পারেন, কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্যের পরোয়া না করে পার পাওয়ার উপায় কারও নেই। যতদিন ক্ষমতা আছে তার জোরে অনেক রকম ভ্রান্তি অবলীলাক্রমে বিস্তার করা যায়। কিন্তু এ কাজের মাধ্যমে কারও মর্যাদা অথবা ইতিহাসের পণ্ডিত হিসেবে যশ বৃদ্ধি হয় না।

নাজিমুদ্দীনের বক্তব্য উল্লেখ করার পর শেষ হাসিনা তার ভাষণে বলেন, "এ সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। চিকিত্সার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি ছাত্রদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন এবং আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন।" প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য যে, শেখ মুজিবকে নভেম্বর মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিত্সার জন্য আনা হয়। তখন থেকেই ছাত্রলীগের কর্মীরাসহ অনেকেই মাঝে মাঝে সেখানে তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। এটা যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। ফেব্রুয়ারি মাসেও শেখ মুজিবের সঙ্গে ছাত্রদের অনেকের দেখা হতো। এর মধ্যে কোনো "গোপন" ব্যাপার ছিল না এবং তারা আন্দোলন সম্পর্কিত বিষয়ে স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেও তার "নির্দেশের" জন্য সেখানে যেত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাসিনা তার ভাষণে বলেন, "তারই (অর্থাত্ সেইসব "গোপন" বৈঠকের) প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দাবি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।"
একুশে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেটা হয়েছিল অনেক ধরনের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া এবং তত্কালীন ঢাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের যৌথ উদ্যোগের ফলে। তার সঙ্গে হাসপাতালে কিছু ছাত্রের "গোপন বৈঠকের" কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাছাড়া শেখ মুজিব তো বটেই, এমনকি আওয়ামী লীগ অথবা ছাত্রলীগের এমন কোনো রাজনৈতিক অবস্থান তখন ছিল না, যে কারণে শেখ মুজিবের "গোপন" বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি নির্ধারিত হতে পারত।

এরপর হাসিনা বলেন, "এ সময় তাঁকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি ১৪ ফেব্রুয়ারি অনশন শুরু করলে ১৬ ফেব্রুয়ারি তাকে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিত্সার জন্য আনা হয়। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধু একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার নির্দেশ দেন।"ঐতিহাসিক হিসেবে শেখ হাসিনার এ এক নতুন তথ্য আবিষ্কার! আসলে শেখ মুজিব ও বরিশালের মহিউদ্দীন আহমদকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর তিনি ও মহিউদ্দীন সেখানে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, নিজেদের মুক্তির জন্য অনশন শুরু করেন। (অলি আহাদ- জাতীয় রাজনীতি পৃ: ১৫১—৫২)। কয়েকদিন পর তাদের দু'জনকেই ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এ বিষয়ে মহিউদ্দীন আহমদ এক সাক্ষাত্কারে বলেন, "আমি জেল থেকে ছাড়া পাই ২৮শে ফেব্রুয়ারি এবং শেখ মুজিব ছাড়া পায় ২৪শে ফেব্রুয়ারি। এটা ঘটে আমরা ফরিদপুর জেলে অনশন আরম্ভ করার পর।" (ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল। বদরুদ্দীন উমর। বাংলা একাডেমী, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, ১৯৯৫। পৃষ্ঠা : ২৮৭)
ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরের কয়েকদিন পর শেখ মুজিবকে আবার ঢাকায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল, এমন তথ্য এর আগে কোথাও পাওয়া যায়নি। কিন্তু শেখ মুজিবই যে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত পরিকল্পনাকারী, পরিচালক ও নির্দেশ প্রদানকারী এটা "প্রমাণ" করার জন্যই এই তথ্য হাসিনাকে আবিষ্কার করতে হয়েছে। যাই হোক, শেখ মুজিবকে ফরিদপুর জেল থেকে ঢাকা তো আনা হয়ইনি, উপরন্তু তাকে সেখানেই জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ঢাকা আসেননি, সোজা গিয়েছিলেন গোপালগঞ্জে নিজের গ্রামের বাড়িতে এবং সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। ঢাকা এসেছিলেন এপ্রিলের শেষদিকে। ২৭শে এপ্রিল ঢাকা বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক আহূত কনভেনশনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। আমার মনে আছে, সে সময় বার লাইব্রেরিতে হলের বাইরে বাঁধানো জায়গায় বসে তার এবং অন্য কয়েকজনের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করেছিলাম। সে সময় ভাসানী, আবুল হাশিম, শামসুল হক, খয়রাত হোসেন, তর্কবাগীশ, অলি আহাদ, আবদুল মতিনসহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির প্রায় সব সদস্যই জেলে ছিলেন। হাসিনা বলেছেন, "১৬ ফেব্রুয়ারি তাকে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিত্সার জন্য আনা হয়। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধু একুশ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার নির্দেশ দেন।" এ ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারও লক্ষণীয়। শেখ মুজিব ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য "নির্দেশ" দিয়েছিলেন। এভাবে "নির্দেশ" ও হুকুম দেয়ার কথা বলা শেখ মুজিবেরও অভ্যাস ছিল। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বক্তৃতাতেও তিনি বলেছিলেন নিজেও "হুকুম" দেয়ার কথা। কোনো আন্দোলনই জগতে কারও "নির্দেশ" বা "হুকুম" মতো হয় না। কারণ, আন্দোলনে নেতৃত্ব থাকে ঠিক কিন্তু আন্দোলন কোনো জমিদার প্রজার ব্যাপার নয়। আন্দোলনের ক্ষেত্রে যৌথ সিদ্ধান্ত হয়, যৌথভাবে কাজ হয়। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও কারও নির্দেশ বা হুকুম ছিল না। এ আন্দোলনের কোনো একক নেতৃত্বও ছিল না, থাকার প্রশ্ন ছিল না। বাস্তব অর্থে ভাষা আন্দোলন ছিল প্রতিবাদী ও সংগ্রামী ছাত্র থেকে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত আন্দোলন। এখানেই এর মাহাত্ম্য। তবে এখানে ঐতিহাসিক সত্য বিবৃত করার উদ্দেশে অবশ্যই বলা দরকার ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কোনো সংগঠন ও ব্যক্তির একক নেতৃত্ব না থাকলেও সে সময় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের (এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক ছিল না) এবং তার সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদের। বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার, এমনকি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চার এমনই করুণ অবস্থা যে, এ প্রসঙ্গে যুবলীগ এবং অলি আহাদের কোনো উল্লেখই এখন দেখা যায় না!
শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেল থেকে এমন সময় মুক্তি দেয়া হয়, যখন ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হুলিয়া জারি করে দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে সবাইকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। শেখ মুজিবের সে রকম কোনো ভূমিকা থাকলে তাকে সে সময়ে জেল থেকে মুক্তি দেয়া কোনো সরকারের পক্ষে যে সম্ভব হতো না, এটা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কে যেসব কথা শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমীতে বলেছেন এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস বিকৃতকরণ করা হচ্ছে এটা বলা যায় না। এর দ্বারা ইতিহাসকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এই ধর্ষিত ইতিহাসকেই এখন স্কুল-কলেজের পাঠ্য তালিকায় প্রকৃত ইতিহাস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে দেশের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার সর্বনাশ করা হচ্ছে।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কীভাবে পূর্ববাংলার জনগণ ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে এক গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিলেন এ বিষয়টি বুঝলে কারও "নির্দেশ" বা "হুকুমে" ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এ চিন্তা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মাথায় আসা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য আমি এই পর্যায়ের ইতিহাসের ঘটনাবলীর সবিস্তার বর্ণনা ও পর্যালোচনা করে আমার তিন খণ্ডের বই "পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি" রচনা করেছি।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে শেখ মুজিব নিজে, ডক্টর মাযহারুল ইসলামের মতো তার অনুগত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা ইচ্ছাকৃতভাবে যেসব অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে এসেছেন এবং এখনও বলে যাচ্ছেন, সেগুলো খণ্ডন করে প্রকৃত ইতিহাস উপস্থিত করার চেষ্টা আমি যথাসাধ্য করেছি। কিন্তু বাংলাদেশে এখন ইতিহাস চর্চা বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু না থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীরাই "ঐতিহাসিক"। এখন এই "ঐতিহাসিকদের" মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাজেই তিনি আইনের জোরে ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কলকাতার "দেশ" পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের ওপর লিখিত একটি প্রবন্ধে তার পিতার ভূমিকা খর্ব করা হয়েছে, এই অভিযোগে তিনি তার পূর্ববর্তী সরকারের আমলে দেশ পত্রিকার সেই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়াও দেশে ও দেশের বাইরে লোক আছে। কাজেই আমার উপরোক্ত প্রবন্ধটি ঢাকার কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়ে তা লাখ লাখ পাঠকের হাতে এসেছিল। "দেশ" পত্রিকার যে প্রবন্ধ এখানে বিশ-পঁচিশ হাজার পাঠক পড়ত সেটাই পড়েছিল লাখ লাখ লোক। এছাড়া সরকারি এই দমননীতির বিরুদ্ধে অনেকেই বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছিলেন, মিটিং-মিছিলও হয়েছিল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল। 'উবুদশ' নামে একটি বামপন্থী মাসিক পত্রিকা এর বিরুদ্ধে বিশেষ সংখ্যা বের করে। তাতে পশ্চিমবঙ্গের বহু লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীর লেখা ও প্রতিবাদ-বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন।

ক্ষমতায় বসে গায়ের জোরে ইতিহাস বিষয়ে বিভ্রান্তি বিস্তার করলে, মিথ্যা কথা ইতিহাস হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে এবং সর্বোপরি আইনের হাতুড়ি মেরে যে সত্য ইতিহাস আড়াল করা যায় না, এটা এক ঐতিহাসিক সত্য। সত্যের "বদ অভ্যাসই" হচ্ছে মিথ্যাকে পরাস্ত করা।
১৯টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×