somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমেরিকান ডাক্তার দম্পতির ছবিতে নিউজফিড সয়লাব

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমেরিকান ডাক্তার দম্পতির ছবিতে নিউজফিড সয়লাব। পজিটিভ, নেগেটিভ এবং অতি দুর্গন্ধময় পোস্টের ছড়াছড়ি। সেই পোস্টগুলো নিয়েই কিছু মন্তব্য করতে চাই।

১. দুইজন মার্কিন নাগরিক, তাও আবার ডাক্তার (যাদের বার্ষিক গড় আয় তিন লাখ ডলার) বাংলাদেশের মতন গরিব দেশের গ্রামে গিয়ে একদম মাটির মানুষ হয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করছেন, এই ব্যাপারটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এইসব দেশে ডাক্তার হওয়া অনেক যন্ত্রণার বিষয়, আট দশ বছরের অমানুষিক পরিশ্রমের পড়াশোনা, যার খরচ কয়েক লাখ ডলারের স্টুডেন্ট লোন, তারপরে রেসিডেন্সি নেয়া ইত্যাদি জ্বালাতন শেষে তাঁরা আয় করতে শুরু করেন। এইসব পরিশ্রম শেষে যখন তাঁদের সুখ স্বাচ্ছন্দের সময় এসেছে, তখন দুইজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন পৃথিবীর অপর প্রান্তের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন। শুধু নিজেরাই না, বাচ্চাদেরও নিয়ে গেছেন সেখানে। বুঝতে পারছেন কতটা বড় মনের মানুষ হলে এটা সম্ভব? কাজেই, এই দুইজনের সাথে দেখা হলে অবশ্যই তাঁদের দুই হাত জড়িয়ে ধরে চুমু খাবেন। পুণ্যবান মানুষের দেখা পাওয়া সহজ কথা না।

কেউ কেউ একে আমাদের দেশের সেনাসদস্যদের শান্তিরক্ষা মিশনের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। এখানে বড় একটি পার্থক্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সেনা সদস্যরা যখন আন্তর্জাতিক মিশনে যান, তখন তাঁদের বেতন ভাতা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক স্কেলে হয়। লাখ লাখ টাকা আয় হয়। টাকা অবশ্যই একটি বড় মোটিভেশন। আমার পরিবারের গিজগিজ করছে সেনা সদস্যে। তাঁরা একেকজন মিশন থেকে ফিরেই ফ্ল্যাট বা বাড়ির মালিক হয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার দম্পতির ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটছে। তাঁরা নিজের দেশে থাকলে অনেক কিছু পেতে পারতেন, বাংলাদেশে যা পাচ্ছেন তা তাঁদের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর বেতনের চেয়েও কম। বাকিটা বুঝে নেন। নিজের ডিফেন্সে কোন অবস্থাতেই অন্যদের অবদানকে ছোট দেখানোর চেষ্টা করবেন না প্লিজ।

২. একদল তাঁদের প্রশংসা করার পাশাপাশি বাঙালি ডাক্তারদের গালাগালি করে শেষ করে দিচ্ছেন। ডাক্তাররা কসাই, ডাক্তাররা অমানুষ, রক্তচোষা, অর্থলোভী, খুনি ইত্যাদি সব ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট।
"**কির পোলারা গ্রামে যাইবো ক্যান? গেলেতো ট্যাকা পাইবো না।" - এই হচ্ছে তাদের মর্মবাণী। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মানবসেবায় ব্রত হবার দায়িত্ব কী কেবল ডাক্তারদেরই দেয়া হয়েছে? আপনার আমার কী কোনই দায়িত্ব নেই? এই যে যারা যারা ডাক্তারদের অর্থলোভী বলে গালাগালি করে পোস্ট করছেন, আপনি নিজের পেশায় থেকে কী করছেন সেটা কী একটু বলবেন প্লিজ? আপনি হতে পারেন শিক্ষক, আপনি হতে পারেন একাউন্ট্যান্ট, আপনি হতে পারেন ক্লার্ক। আপনি কী আপনার শহরের চাকরি ছেড়ে গ্রামে ছুটে গেছেন? গ্রামের মানুষেরও কিন্তু আপনার সাহায্য দরকার। আপনি তাঁদের একাউন্টিং শেখাতে পারেন, পারেন কিভাবে ফাইলপত্র ঘাটাঘাটি করতে হয় ইত্যাদি ট্রেনিং দিতে। আপনি কী সেসব করেছেন? আপনি যদি না করে থাকেন, তাহলে কোন অধিকারে অন্য কেউ কেন করলো না তা নিয়ে তাঁদের গালাগালি করছেন? যুক্তিটা কী?
একই ক্যাটাগরিতে পরে যারা প্রবাসীদের গালাগালি করছেন। "দেশকে ফেলে ওরা বিদেশে পড়ে আছে, আর বিদেশিরা এসে দেশের সেবা করছে।"
আমি বুঝিনা, যারা এমন কথা বলে, তাদের কী মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু নেই নাকি? দেশের জনসংখ্যা ষোল কোটি, এত চাপ নিতে পারছে না। এর মধ্যে প্রবাসী বাঙালিরা যদি এসে থাকতে শুরু করেন (চার পাঁচ কোটিতো হবেই) আমাদের বিস্ফোরণ ঘটবে। তাছাড়া এত স্কিল্ড লেবারের চাকরি কে দিবে? উল্টো দেশের লোকালদের চাকরির বাজার নষ্ট হয়ে যাবে। দেশের উন্নয়নের বদলে একটা মহা দুর্যোগের সৃষ্টি হবে। গ্লোবাল সিটিজেনশিপ কনসেপ্টই এদের মাথায় ঢুকে না। এদিকে নিজেরা কিন্তু গ্রামে ফিরে যাচ্ছেনা। অদ্ভুত! সত্যিই অদ্ভুত!

৩. একজন ডাক্তার লিখেছেন, "ওরা যে আমাদের দেশে এসে প্র্যাকটিস শুরু করে দিল, ওরা কী মেডিকেল বোর্ডের কোন অনুমতি নিয়েছে? ওদের দেশে আমাদের গিয়ে লাইসেন্স পেতে যেমন ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়, তাঁদের কী তেমন পেতে হয়েছে?"
ওদের দেশে (আমেরিকায়) কিছু মিনিমাম কোয়ালিটি মেইনটেইন করেই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়াশোনা করানো হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই যেটা হয়না। ওদের দেশে এই ফিল্ডে দুই নম্বরির সুযোগ কম। উল্টো দুই নম্বরি করতে গিয়ে জেনুইন ডক্টরের লাইসেন্স ক্যানসেল হয়েছে এমন উদাহরণ ভরপুর।
কিভাবে আমেরিকা নিশ্চিত হবে যে যেই লোকটা ডাক্তারির দাবি করছে, সে আসলেই চিকিৎসা করতে সক্ষম? টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনেনি? বা ভুয়া সার্টিফিকেট ছাপিয়ে প্র্যাকটিস করেনি? আমাদের দেশেইতো অসংখ্য ভুয়া ডাক্তারের ছড়াছড়ি। ওরা কেন রিস্ক নিবে?
তেমনি বাংলাদেশেও একটা পরীক্ষা হওয়া জরুরি যে বিদেশ থেকে যারা এসে দাবি করছেন তাঁরা ডাক্তার, তাঁরা আসলেই ডাক্তার কিনা। দেশের নাগরিকদের জীবন মরনের প্রশ্ন এটি। আসলেই কী তাঁরা প্রমান দিয়েছেন যে তাঁরা জেনুইন ডাক্তার? আমি নিজে এমন কিছু মানুষকে চিনি যারা ডেন্টিস্টের চেম্বারে কম্পাউণ্ডারি (ইন্সট্রুমেন্টস এগিয়ে দেয়া হেল্পারগুলিকে কী বলে?) করতে করতে এক সময়ে নিজেই চেম্বার খুলে বসে দাঁতের চিকিৎসা করেছেন। কেউ কেউতো বিদেশে গিয়ে বছরখানেক নার্সিং করে দেশে ফুল টাইম ডক্টর বনে আছেন। দেশি লোকেদেরই এই অবস্থা, এরাতো সাদা চামড়া! আমরা সাদা চামড়া দেখলেই চোখ বন্ধ করে অন্ধ হয়ে যাই। কিছুটা সাবধানতা নিলে দোষের কিছু নেই।

৪. একদল প্রচার করে বেড়াচ্ছেন হানিফ সংকেত ষড়যন্ত্র করেছেন। এই দুই ডাক্তার যে খ্রিষ্টান মিশনারি দলের সদস্য, এবং তাঁদের উদ্দেশ্য গরিব মানুষের সেবার মাধ্যমে ধর্মান্তর ঘটানো, এই বিষয়টা জনাব সংকেত চেপে গেছেন। এইগুলি হচ্ছে দুর্গন্ধময় পোস্ট। এতই যদি ধর্মের আশংকা থাকে, তাহলে নিজের ধর্মের লোকেরা কেন করছে না? কেন আমাদের দেশে "মুসলিম মিশনারি" নাই? যারা মসজিদের পক্ষ থেকে ফ্রীতে রোগীদের চিকিৎসা দিবেন? নিজের দেশের মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরছে, অন্য ধর্মের লোকেরা এসে চিকিৎসা দিচ্ছেন, এতেও আপত্তি? খ্রিষ্টান বানিয়ে ফেলবে, এই গুজবে চিকিৎসা নিতে দেব না? সিরিয়াসলি?

৫. নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের দেশেও অনেক চিকিৎসকের নেক নিয়্যত থাকে চ্যারিটি প্রোগ্রাম করার। স্পৃহার সাথে যুক্ত আছি বলে কয়েকজনকে চিনি যারা বিনা টাকায় গরিবদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া দেশে থাকতে আমার মায়ের স্কুলে মাঝে মাঝে চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা হতো। তাঁরাও বিনা পয়সায় বা অতি অল্প মূল্যে তা করতেন। তবে আরেকটি ঘটনাও বলি। আমরা একবার এক গ্রামে ফ্রী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাইলাম। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের গ্রামে হবে অনুষ্ঠান, সেখানে যাবেন পরিচিত দুই বড় ভাই ডক্টর। তা গ্রামে মাইকিং করে ঘোষণা দেয়া হলো অমুক দিনে গ্রামবাসী যেন নিজেদের সমস্যা নিয়ে হাজির হন। তখন এলাকার চেয়ারম্যান এসে দাবি করলেন অনুষ্ঠানের আয়োজক হিসেবে যদি তার নাম না দেয়া হয়, তাহলে ডাক্তারদের এলাকায় ঢুকতে দেয়া হবেনা। বাকিটা বুঝে নেন। হয়তো চেয়ারম্যানের মনে সন্দেহ ঢুকেছিল যে বড় ভাই ইলেকশন লড়তে চায়, তাই এই জনকল্যাণমূলক কাজ করছেন। নাহলে বিনা স্বার্থে কে এইসব চ্যারিটি করে? মাঝে দিয়ে এলাকাবাসী চিকিৎসা পেল না।
চ্যারিটির জন্য আমাদের পরিবেশ আছে? তাহলে দোষ দিচ্ছেন কাদের?

মোট কথা, কিছু ভাল মানুষের সন্ধান পেয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। প্রশংসা করুন, তাঁদের মতন হবার চেষ্টা করুন, তাঁদের ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করুন। কিন্তু তাই বলে অন্যদের গালাগালি করা, ছোট করার মানে কী? অন্যকে ছোট করলে আমি নিজে কী বড় হয়ে যাব?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৪১
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×