somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা লাস্ট ডেইজ অফ মিস্টার হাসান (একজন ব্যর্থ মানুষের শেষ জীবন এবং একটি সত্য-কঠিন বাস্তবতা)

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব

সময়টা বিকেল।

বিকেলের মিষ্টি আলোয় হেসে উঠেছে শহরটা। চারদিকে প্রাণোচ্ছলতার উৎসব। শহর চলছে তার আপন গতিতে। রাস্তায় হাজার রকমের যানবাহন। রিক্সা, ট্যাক্সি কিংবা বাসের একটানা হর্নের শব্দ কেন জানি বিরক্তিকর লাগছে না। রাস্তায় রাস্তায় অসংখ্য মানুষ। সবার মাঝেই আনন্দময় ব্যস্ততা। দিন শেষে কেউ ফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে, কেউ আবার বিকেলের অবসর সময়টুকুতে বের হয়েছে সোনালী রোদে স্নান করার জন্য। বেশ কোলাহল চারদিকে। দোকানপাঠগুলোতেও কেনাকাটার হিড়িক। চায়ের দোকান আর হোটেলগুলোতে চলছে বাকবিতন্ডা, তর্ক বিতর্ক। মাঠগুলো ভরপুর শিশু কিশোর আর তরুণদের ক্রিকেট- ফুটবল খেলার বাঁধভাঙা আনন্দে। ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে রাস্তা- দোকানপাটের উজ্জ্বল বাতিগুলো। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার অবসান ঘটছে শহরের প্রতিটি চিত্রে।

বিকেলের এই প্রাণোৎসব সবসময় চুম্বকের মতো কাছে টেনেছে হাসান সাহেবকে। যৌবনে বিকেলের সময় কখনো ঘরে বসে ছিলেন বলে তার মনে পড়ে না। বার্ধক্য জেঁকে বসার পর বিকেলে বের হওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু প্রাণপণে অনুভব করেছেন প্রিয় সময়টাকে। এখন তিনি জীবন মৃত্যুর সীমারেখায়। বিকেলের সৌন্দর্যের মতো তুচ্ছ বিষয় খেয়াল করার কোন সামর্থ্য তার নেই।

এতক্ষণ আমাদের গল্পের স্থান ছিল হাসান সাহেবের বাসা। এখন আমরা আছি শহরের অন্যতম আধুনিক হাসপাতালের সুসজ্জিত আলোকময় পরিবেশের নিষ্ঠুরতায়।

হাসপাতালের দোতলা জুড়ে বিশাল দুটো স্পেশাল ইউনিট। একটিকে বলা হয় সি সি ইউ, অন্যটি আই সি ইউ। কাছেই অনেকগুলো চেয়ার বিশিষ্ট বিশালাকার ওয়েটিং রুম। হাসান সাহেবের অবস্থা জানার আগে ওয়েটিং রুমে বসে থাকা কয়েকজন মানুষের দিকে চোখ দেওয়া যাক।
দ্বিতীয় সারির বাম দিক থেকে তৃতীয় চেয়ারে বসে আছেন একজন সুবেশী ভদ্রলোক। হাতে নকিয়া এন সিরিজের দামি মোবাইল। প্রচণ্ড গতিতে পা নাচাচ্ছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তাকে কিছুটা হতবিহ্বল মনে হচ্ছে। একটু পরপর ক্রিং ক্রিং করে মোবাইল বেজে উঠছে। গম্ভীর মুখে মোবাইলে কথা বলছেন। আশপাশে তাকাচ্ছেন চিন্তিত ভঙ্গিতে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে "ক্রিয়াশীল সিস্টেম" তার ভাল লাগছে না। ইনি পারভিন আক্তারের মেজ ভাইয়ের ছেলে। ফুফা ফুফুর প্রতি তার বেশ টান আছে।
তার পাশে বসে আছেন আরেকজন সুবেশী ভদ্রলোক। কড়া পারফিউম মেখে এসেছেন তিনি। চেহারায় উদ্বেগের চেয়ে বিরক্তির ছাপ বেশি। বেশ অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে তার আচরণে। সম্পর্কে এই ভদ্রলোক হাসান সাহেবের ছোট ভাই। দীর্ঘ সাত বছর পর তিনি আপন অসুস্থ মৃতপ্রায় ভাইকে দেখতে এসেছেন। এর মধ্যে বহুবার হাসান সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেও তার দেখা পাওয়া যায় নি।
একটু দূরে বসে আছেন পারভিন আক্তারের সেজো মেয়ে। হাতে তসবিহ। মনোযোগের সাথে যিকির করছেন। একটু পরপর চোখ মুছছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় মোটামুটি বিধ্বস্ত তিনি।
তার পাশে বোরখা পরিহিত এক মধ্যবয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে। চেহারা দেখে তাকে বিচলিত মনে হচ্ছে না। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তােক খুব একটা স্পর্শও করছে না। অন্য কিছু নিয়ে তিনি চিন্তিত। তবে একটু পরপর চেহারায় উদ্বেগ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ইনি হাসান সাহেবের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী।
আই সি ইউ ইউনিটের সামনে প্রায় স্থির হয়ে পারভিন আক্তার দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টি শূণ্য। বর্তমান এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তায় তিনি বিদ্ধস্ত। তার সবচেয়ে বড় চিন্তা সাইফের ম্যাট্রিক পরীক্ষা। মাত্র কয়েক সপ্তাহ সময় আছে। ছেলেটা এরকম দু:সময়ে পড়াশোনা করবে কিভাবে? পরীক্ষাটা দেওয়া হবে তো?

একটু পরেই সাইফ এল। একটা কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্ট দিচ্ছে সে। মাথা নিচু করে রেখেছে। সে মোটামুটি ঘোরের মধ্যে আছে। তার চেহারায় অনুভূতিহীনতার প্রতিচ্ছবি। আশপাশের সবকিছু দু:স্বপ্নের মতো লাগছে। কেউ নাড়া দিলে দু:স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে জানে এটা দু:স্বপ্ন না। তাই ভেঙে যাওয়ারও কোন সম্ভবনা নেই।

আই সি ইউ ইউনিটের সাত নাম্বার বেডে হাসান সাহেবের স্থান। তিনি অচেতন। সত্যি করে বললে তিনি কোমায় চলে গেছেন। মেডিকেল সাপোর্ট দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সেই মেডিকেল সাপোর্টও ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।
ডাক্তাররা কেউ কিছু বলেন নি। তাদের একটাই কথা - "দোয়া করেন সবাই।" আত্মীয় স্বজন সবাই বুঝতে পারছে হাসান সাহেবের অবস্থা। কিন্তু কেউ মুখে কিছু বলতে পারছে না। সত্য কখনো কখনো মারাত্মক নিষ্ঠুর হয়ে দাঁড়ায়। এর সহজ উদাহরণ হাসান সাহেব। তার বর্তমান অবস্থা।
কিছুক্ষণ পরে ঘন্টা বাজল। আইসিইউ ইউনিটে দর্শন প্রত্যাশীদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল। পারভিন আক্তার ছেলের দিকে তাকালেন। সাইফকে কি ঢুকতে দেওয়া উচিত হবে? বাবার দুরবস্থা দেখলে কি তার সমস্যা হবে কোন?

সাইফ আই সি ইউ ইউনিটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সিকিউরিটির লোকটা সামান্য চেক করে তাকে ভেতরে যেতে দেয়। ধীর পায়ে সে প্রবেশ করে নতুন এক জগতে। সুসজ্জিত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ আধুনিকতা পূর্ণ নিষ্ঠুর নির্মম এক জগতে।

হাসান সাহেব শুয়ে আছেন সাত নাম্বার বেডে। তার নাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার। বুকে পেটে কতগুলো তারের মতো যন্ত্র। বেডের পাশে মনিটর রাখা। মনিটরে কতগুলো ঢেউয়ের মতো রেখা। একটু পরপর রেখাগুলো প্রায় সমান হয়ে যাচ্ছে। আবার আঁকাবাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পাশে একটা বিশাল যন্ত্র। সেখান থেকে বের হয়ে আসা মোটা একটা নল ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তার মুখে। তার বুক আগের মতোই উঠানামা করছে। দেখে মনে হয় কেউ একজন ভিতর থেকে বুকটাকে জোর করে উপরে উঠাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিচ্ছে। তার মুখটা লাল টকটকে। চেহারায় ক্লান্তি অবসাদের চেয়েও বেশি কিছুর আভাস। চোখটা সামান্য খোলা। তবে চোখে কোন দৃষ্টি নেই। হাত- পায়ে পানি এসে ফুলে আছে। তিনি স্থির। সম্পূর্ণ স্থির। সময় বা কাল যেন তার চারপাশে এসে স্থির হয়ে আছে। তাকে ঘিরে রেখেছে নিষ্ঠুর মমতায়।

সাইফ ঘোলাটে দৃষ্টিতে চারপাশ তাকালো। সে তার পায়ের উপর দাঁড়াতে পারছে না। শক্ত করে বেডের কিনার ধরল। তার নিজের রুম, বুকশেলফ, কম্পিউটার আর পড়াশোনা নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট জগৎটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। জীবনটা এখন তার কাছে আর কোন অর্থ বহন করছে না। তার বাবার এই দুর্দশায় তার বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। আচ্ছা, বেঁচে থাকার অর্থ কি? সে কেন বেঁচে আছে? কি উদ্দেশ্যে বেঁচে আছে? তার বেঁচে থাকারই বা দরকার কি? সে তো বাবার জন্য কিছু করতে পারবে না। তাহলে পৃথিবীতে সে কোন অধিকারে টিকে থাকবে?

সাইফ কাঁপা হাত রাখল বাবার মাথায়। বেশ ঠাণ্ডা। মৃত মানুষের শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়। সাইফের বুকটা কেঁপে উঠল। তার বাবা কি তাহলে মারা যাবে?



So give me back to Death --
The Death I never feared
Except that it deprived of thee --
And now, by Life deprived,
In my own Grave I breathe
And estimate its size --
Its size is all that Hell can guess --
And all that Heaven was --

So give me back to Death -- by Emily Dickinson


চলবে.......
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:৫৬
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×