somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আহমেদের প্রকৃত ভক্ত তারাই, যারা......

২৮ শে জুলাই, ২০১২ রাত ৮:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথমেই একজন সুরাসক্ত যুবকের ডায়েরী থেকে কিছু অংশ -
(প্রথম তিন প্যারা স্কিপ করে গেলেও পড়তে সমস্যা হবে না)

জুলাই ১৯, ২০১২ বৃহস্পতিবার

‘‘সপ্তাহে দুইটি বা একটি সন্ধ্যায় বারে বসে 'সংযত' মদ্যপান করাটা ইদানিং অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাচ্ছে। 'সংযত' মানে হচ্ছে বেহেড মাতাল না হওয়া (অনেকেই এটাকে 'সোশ্যাল ড্রিংকিং' নামে অভিহিত করে থাকে), যাতে অন্ততঃপক্ষে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে যাওয়া যায়। অসংযমী মদ্যপানও করা হয় বটে; তবে সেগুলো বরাদ্দ থাকে বিশেষ দিনগুলোতে - ঈদের দিন, থার্টি ফার্স্ট, কারো ব্যাচেলর পার্টি, গায়ে হলুদ ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাই আজকেও এই সোশ্যাল ড্রিংকিং করতে কয়েকজন বন্ধু বসেছি লা ডিপ্লোম্যাটে। চিয়ার্সের পরপরই একজন মনে করিয়ে দিল, কাল বাদে পরশু শনিবার থেকেই কিন্তু শুরু হয়ে যাচ্ছে মাহে রমজান। একমাসব্যাপী সুকঠিন সংযম করতে হবে এটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই ঘোষনা করলাম ‘আজকে সংযমী মদ্যপানের গুষ্টি কিলাই’! ধূমপান ত্যাগের আগের দিন যেমন অনেকে মাত্রাতিরিক্ত সিগারেট খায়, সেরকম ব্যাপার আর কি। শুরু হয়ে গেল অর্ডারের পর অর্ডার, বিরামহীন!

অসংলগ্ন, মাতাল অবস্থায় বার থেকে বের হয়ে এক গিটারিস্ট বন্ধুর বাসার সামনে খোলা বাতাসে অনেকক্ষন ধরে চললো আড্ডা-গান, সাথে পাঁড় মাতলামী! কয়েকজন এরই মধ্যে বাসায় চলে যাচ্ছে; তবে আমি ইচ্ছে করেই খানিকটা দেরী করছি। প্রথমত এখনো গাড়ী চালানোর মত সুস্থ অবস্থায় আসি নাই; দ্বিতীয়ত রাত বারোটা-সাড়ে বারোটার পরে বাসায় যেতে চাই যাতে আব্বা-আম্মার মুখোমুখি পড়তে না হয়! কিন্তু বিধি বাম, কোন আযান না দিয়ে হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল দুনিয়া ওলট-পালট করা বমি! অসম্ভব শরীর খারাপ করলো, প্রচন্ড অসুস্থ বোধ করছি, চোখে সবকিছুই কেমন অন্ধকার ঠেকছে! আমার এহেন অবস্থা দেখে গাড়ীসহ ডেকে আনা হলো সুস্থ এক জুনিয়র বন্ধুকে। ধরাধরি করে আমাকে তোলা হলো তার গাড়ীতে, আর আমারটা রেখে দেওয়া হলো গিটারিস্ট বন্ধুর বাসায়।

গাড়ীর সিটে যখন বসছি তখন আমার চেতনা বলতে গেলে প্রায়-শূন্য অবস্থায়, এবং হেলান দেয়া মাত্রই এলিয়ে পড়ে যাবো ঘুমে, ঠিক তখনি বেজে উঠলো ফোন। অনেক কসরত করে ফোন বের করে দেখি প্রিয় মা-জননী! সময়টা স্পষ্ট মনে আছে - রাত ১১টা বেজে ৫০ মিনিট।
আমার এহেন দূরবস্থায় ফোনটা না ধরাই উত্তম ছিল, তারপরও সিটে হেলান দেয়ার ঠিক আগমুহুর্তে কোনরকমে উচ্চারন করতে পারলাম ‘হ্যালো’; এবং সাথে সাথেই হারিয়ে গেলাম ঘুমের অতল গভীরে!

মনে হলো মুহুর্তখানেক বাদেই বন্ধুটি ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাংগালো; ক্ষেপে গিয়ে ঝাড়ি মারতে যাবো, সে হেসে বললো ‘ভাই, আপনার বাসায় পৌঁছে গেছি’। কঠঠিন অবস্থা দেখা যাচ্ছে, এক মুহুর্তের ঘুমেই চলে এলাম বাসায়! কিছুটা সুস্থবোধ করছি, তথাপি বাসায় ঢুকে আর দেরি না করে চুপচাপ হারিয়ে গেলাম ঘুমের গহীন রাজ্যে।

ভোর ছয়টার সময় সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে ভয়াবহ এক কান্নার স্রোতে ঘুম ভেঙ্গে গেল! কি হলো ঠিক বুঝতে পারছি না, চেতনা কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্ত - অবচেতন অংশ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে, অপরদিকে অর্ধ-সচেতন অংশ সেই কান্না দেখে হতবিহবল!
সম্পূর্ন সচেতনতা ফিরে পাওয়া মাত্রই যেন পুনরায় দৃশ্যায়িত হল স্বপ্নটি - আর শুনতে পাচ্ছি আম্মার কন্ঠঃ ‘অ্যাই শুনছিস, হুমায়ুন আহমেদ একটু আগে মারা গেছে’!

সটান করে বসে পড়লাম বিছানায়। অর্ধ-মাতাল অবস্থা, কিন্তু চেতনা সম্পূর্ন জাগ্রত! কি শুনলাম এটা? স্বপ্নটা যেন মিথ্যা হয় -পরম করুনাময়ের কাছে এই প্রার্থনা করতে করতে 'অন' করলাম কম্পিউটার। মাতালের প্রার্থনায় কাজ হলো না, আমাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে সর্বত্র জ্বলজ্বল করছে কেবল একটাই স্ট্যাটাস - RIP হুমায়ুন আহমেদ!’’

জুলাই ২৩, ২০১২ মঙ্গলবার

‘‘প্রিয় মানুষটিকে আজকে সমাহিত করা হলো। সেদিন ভোরে সেই যে ঘুম থেকে ডুকরে উঠেছিলাম, সে শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারি নাই; বরং শোকের মাত্রা বেড়ে গেছে আরো কয়েকগুন! অবশ্য এই মাত্রা কমানো কোন ব্যাপারই ছিল না - এ কয়টি দিন টিভি-মিডিয়ার টকশো, সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট, ব্লগে আর ফেসবুকে শাওন-নোভা-শীলা-নুহাশ-গুলতেকিন চর্চা, নুহাশপল্লী-কবরস্থান বিতর্ক ইত্যাদি বিষয়ে এত মুখরোচক গল্প ছিল যে, সেগুলোর প্রচন্ডতায় মৃত্যুশোকের আরো দূরে গিয়ে মরার কথা!
তবে দূর্ভাগ্যই বলতে হবে আমার, কেননা এইসব গসিপ বা গোয়েন্দাগিরি কোনটাই আমাকে টানে নাই। আমাকে বরং টেনেছে আমার শেলফের দুই তাক ভর্তি তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিসমূহ, যেগুলোর মাধ্যমে শৈশবেই পরিচয় হয়েছিল এই মহান ঔপন্যাসিকের সাথে।

সেদিন ভোর থেকে তাই শুধু পাতা উল্টেই যাচ্ছি। মাঝে মাঝেই অতি পরিচিত কোন দৃশ্য অথবা মজাদার কোন ডায়লগ চোখে পড়লে থমকে দাঁড়াচ্ছি। এতগুলো বছর এই দৃশ্যগুলো কতই না আনন্দ দিয়ে গেছে, অথচ আজ সেগুলো থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে কেবলই বেদনার রশ্মি! যে ডায়লগ পড়ে আগে হাসতে হাসতে মারা যাওয়ার দশা হতো, আজ সেটা দিচ্ছে শুধুই কান্না! যতই পাতা উল্টাচ্ছি, আমার শোকের মাত্রা তত বেড়েই চলেছে। কবে যে এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবো!

............আচ্ছা, টিভির সামনে বসে নাইটশো বা এক্সক্লুসিভ রিপোর্টগুলিতে শীলা-শাওন-নোভাদের কান্না দেখার কোন প্রয়োজন আছে কি? হুমায়ুন আহমেদের মাধ্যমে আমি তো কোন শীলা-শাওন-নুহাশদের চিনি নাই; আমি যদি কাউকে চিনে থাকি তবে তারা হচ্ছে মিসির আলী, শুভ্র এবং হিমু! পাতা উল্টালেই চোখের সামনে শুধু দেখতে পাচ্ছি - দু'হাতে মুখ ঢেকে অঝোর ধারায় কান্না করছে হিমু, অথবা বিমর্ষ চিত্তে বারবার চশমার কাঁচ পরিষ্কার করছে শুভ্র, অথবা ইজিচেয়ারে বসে আকাশপানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মিসির আলী! হায় ঈশ্বর, মিসির আলীর চোখেও দেখতে পাচ্ছি অশ্রুকনা! ওরা সবাই কাঁদছে, সাথে আমাকেও কাঁদাচ্ছে।
হুমায়ুন আহমেদ চলে গেছেন না-ফেরার দেশে, ওদেরও সময় চলে এসেছে চিরপ্রস্থানের। আরে, ওই তো দেখতে পাচ্ছি হলুদ পাঞ্জাবী পড়া হিমুকে - খালি পায়ে এতিমের মত সে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে অচিনপুরের উদ্দেশ্যে! ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে তার অপসৃয়মান অবয়ব......ক্রমশঃ যা বিন্দুতে পরিনত হচ্ছে!’’

---------------------------------------------------------------------
-----------------------------------

হুমায়ুন আহমেদের প্রকৃ্ত ভক্ত তারাই, উনাকে কোথায় সমাহিত করা হবে সেটা নিয়ে যারা চিন্তিত নয়!

হুমায়ুন আহমেদের প্রকৃত ভক্ত তারাই, যারা শাওন-শীলা-নোভাদের কান্না দেখার প্রয়োজন বোধ করে না, বরং হিমু-মিসির আলী-শুভ্রদের অব্যক্ত কান্না উপলব্ধি করে!
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×