somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- সাতাশ)

১১ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কুড়ি

‘কাকাশ্রী, দেখ দেখ আমার মাথায় কেশ নেই! হা হা হা……..! কী মজা, ছোট্ট বাবুদের মতো আমার মাথায় কেশ নেই, হা হা হা……! কাকাশ্রী, দেখ দেখ, আমার ডানহাতের তর্জনী আর মধ্যমা নেই, আমি আর কখনো তীর নিক্ষেপ করতে পারব না কাকাশ্রী, আর আর কখনো কন্যাদের অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারব না, ব্রাহ্মণরা তো তাই চেয়েছিল যে আমি যেন কন্যাদের অস্ত্রশিক্ষা না দেই, কন্যাদের তীরন্দাজ না বানাই। কন্যারা সুশিক্ষত হয়ে পুরুষের সমান যোগ্য হয়ে উঠুক তা কখনো চায়নি ব্রাহ্মণরা। তাই আমার আঙুল দুটো কেটে নিতে পেরে আজ ওরা ভীষণ খুশি, ওরা উল্লাস করছে! কিন্তু আমি জানি কাকাশ্রী তুমি খুশি হওনি, ওরা যখন আমার আঙুল দুটো কেটে নেয় তোমার খুব কষ্ট হয়েছে আমার জন্য। কাকাশ্রী আমি আর কখনো তীর নিক্ষেপ করতে পারব না, কন্যাদের অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারব না, আমি শেষ হয়ে গেছি কাকাশ্রী, আমি শেষ হয়ে গেছি….. !’

‘অনূকা’ বলে চিৎকার দিয়ে ধড়মর করে শয্যায় উঠে বসেন বেণ, বাতায়ন দিয়ে বাইরে তাকান, কোথায় অনূকা, কোথায় ওর কেশহীন মাথা আর আঙুল কাটা হাত! বাইরে বেলে জ্যোৎস্নায় আবছায়া বৃক্ষলতা, অনূকা কোথাও নেই! অথচ অনূকা কথা বলতে বলতে প্রচণ্ড আর্তনাদ করে এমনভাবে কেঁদে ওঠে যেন জীবন্ত! এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি? বেণের চিৎকার শুনে হংসপাদার ঘুম ভেঙে যায়, তিনি স্বামীর শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? মন্দ স্বপ্ন দেখেছ?’

উত্তর দিতে গিয়েও কথা বলতে পারেন না বেণ, কান্নায় তার কণ্ঠ রোধ হয়ে থাকায় তিনি কোনোরকমে কেবল শব্দ করেন, ‘হু।’
হংসপাদা আবার প্রশ্ন করেন, ‘জল পান করবে?’

প্রচণ্ড তৃষ্ণা জেগেছে বুকে, পাহাড়ী ভূমির মতোই তাঁর বুক শুকিয়ে রুক্ষ হয়ে আছে, নিদ্রা ভাঙার পর তৃষ্ণা অনুভব করলেও জলের কথা মনে পড়েনি তাঁর, হংসপাদা জলের কথা বলতেই তাঁর মনে হয় যে জল পান করা দরকার। তিনি আবারও শব্দ করেন, ‘হু।’

হংসপাদা অন্ধকারে হাতরে জলের বড় পাত্র থেকে ছোট পাত্রে জল ঢেলে এনে বেণের সামনে ধরেন, ‘নাও।’
বেণ হংসপাদার হাত থেকে জলের পাত্র নিয়ে এক চুমুকে পাত্র শূন্য করে পাত্রটি হংসপাদার হাতে ফিরিয়ে দেন। হংসপাদা আবার বলেন, ‘আরো দেব?’

জল পান করার পর বেণের কণ্ঠটা পরিষ্কার হয়, বলেন, ‘না।’
‘শুয়ে পড়ো।’
‘তুমি শুয়ে পড়ো। রাত্রি আর বেশি অবশিষ্ট নেই, আমার আর নিদ্রা আসবে না। আমি একটু বাইরে গিয়ে বসি।’
‘এখন বাইরে যেও না।’

‘গৃহের অভ্যন্তরে আমার দম আটকে আসছে! তুমি শুয়ে পড়ো, আমি বাইরে গিয়ে একটু হাঁটি।’

শয্যা থেকে উঠে পড়েন বেণ, হাতরে রজ্জুতে ঝুলিয়ে রাখা ভেড়ার লোমের কুঞ্চক পরিধান করে দ্বারের বন্ধন খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকান, পশ্চিম আকাশে চাঁদের শেষ চিহ্নটুকু ক্রমশ লীন হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই প্রভাতের আলো ফুটতে শুরু করবে। বেণ আঙিনার সর্ব দক্ষিণের পাথরটির ওপর উপবেশন করেন, তাঁর মনটা বড় অস্থির লাগে অনূকার জন্য। কন্যাটিকে নিয়ে তিনি বরাবরই গর্ব করেছেন, ওর সাহস আর দৃঢ়তার প্রশংসা করেছেন। দণ্ড নিশ্চিত জেনেও গতকাল সবার সামনে নিজের সম্পর্কে অকপটভাবে দৃঢ়চিত্তে সত্য উচ্চারণ করেছে, মাথা উঁচু করে নিজের ভালোবাসার কথা জানিয়েছে সবাইকে, ভীরুর মতো অস্বীকার করেনি! সত্যিই তো বলেছে সে, সে মানুষ খুন করেনি, মানুষকে বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করেনি, লুষ্ঠন করেনি। সে কেবল কন্যা হয়ে আরেকটি কন্যাকে ভালোবেসে। ভালোবাসা পাপ কিংবা অপরাধ কেন হবে?

নিজের ওপর রাগ হয় বেণের, ক্ষোভ হয় এই জন্য যে তিনি নৃপতি হয়েও অনূকার জন্য কিছুই করতে পারেননি। কিন্তু তিনি কি কিছু করতে পারতেন না? তিনি কি মনুর বিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অনূকাকে দণ্ড থেকে রক্ষা করতে পারতেন না? নিশ্চয় পারতেন; তবে মনুর বিধানের বিরুদ্ধে গেলে মনু, ব্রাহ্মণগণ, ঋষিগণ এবং সমাজের কিছু মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত নিশ্চয়, দেবতাগণও তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন, তিনি হয়ত নৃপতি হিসেবে টিকে থাকতে পারতেন না। ধনুশের সেই কথাটি মনে পড়ে বেণের, ধনুশ তাঁকে বলেছিল- ‘পুতুল নৃপতি’। কিন্তু আর কতদিন, আর কতকাল তিনি দেবগণ, মনু, ঋষি এবং ব্রাহ্মণদের হাতের পুতুল নৃপতি হয়ে থাকবেন?

গতকাল মনু বিধান দেবার পর তাঁকেই অনূকার দণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দিতে হয়েছে, নির্দেশ দেবার পর তাঁর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি দিয়েছিল অনূকা, সেই হাসি তো কেবল হাসি ছিল না, ছিল তাঁর প্রতি তীব্র কটাক্ষ, ধনুশ মুখে বলে বুঝিয়েছিল যে তিনি পুতুল নৃপতি, আর অনূকা ম্লান হাসি দিয়ে বুঝিয়েছে! তাঁরই নির্দেশে দণ্ড কার্যকরকারীরা তাঁর স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী অনূকাকে দণ্ডপর্বতে নিয়ে গিয়ে ওর অমন সুন্দর মসৃণ কেশ ফেলে দিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে আর অমন সুন্দর আঙুল দুটি কর্তন করেছে। না, অনূকাকে দণ্ড প্রদানের সময় তিনি সেখানে ছিলেন না, কিন্তু ওর ব্যথা আর আর্তচিৎকার তিনি মর্মে অনুধাবন করেছেন। মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে পাথরে আঘাত করে আর্তনাদ করে ওঠেন বেণ, ‘উঃ অনূকা, তোর মুণ্ডিত মস্তক আর আঙুল কর্তন করা হাত আমি দেখতে চাইনি মাতা, তুই কেন আমায় স্বপ্নে দেখা দিলি! এ কী দণ্ড দিলি আমায়!’

আঙুল কর্তনের পর বৈদ্য’র চিকিৎসায় যখন অনূকার হাতের রক্ত পড়া বন্ধ হয়, তখন ওকে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হয় বহির্ষ্মতীর পথে। তখন কিছু ব্রাহ্মণ যুবক উল্লাস করছিল, সেই উল্লাস ধ্বনি বেণের কানে এসেছিল, তখন তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল, তীর ছোঁড়ার জন্য হাত নিশপিশ করছিল!

উঃ কী তীব্র অপমান সহ্য করে বেঁচে আছে কন্যাটি! ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল, এই অপমান সয়ে সারাটি জীবন কী করে বেঁচে থাকবে ও!

নিজের মাথার কেশ খাঁমচে ধরেন বেণ, ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, তাঁর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।

একটু একটু করে আকাশ পরিস্কার হতে থাকে, দূর হতে থাকে চারিদিকের অন্ধকার। বেণ ভাবেন, এখন একবার অনূকার সংবাদ নিতে যাবেন কি না। অনূকা এখন ওর শ্বশুরবাটীতেই আছে, গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানোর পর ওকে মুক্তি দিলে ও নাকি আশ্রমেই যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আঙুল কাটা অবস্থায় ওকে আশ্রমে একা থাকতে দিতে চায়নি ওর পিতা-মাতা আর সত্যবাক। ওর পিতা-মাতা চেয়েছিলে কন্যাকে নিজেদের বাটীতে নিয়ে যেতে, কিন্তু সত্যবাক যেতে দেয়নি, সে নিজের বাটীতেই নিয়ে গেছে অনূকাকে। সত্যবাকের পিতা-মাতা গতকালই সত্যবাককে আদেশ করেছে অনূকার মতো অমন কলঙ্কিনী স্ত্রীর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক না রাখতে, কিন্তু সত্যবাক পিতা-মাতার কথা শোনেনি, অনূকার দুঃসময়ে ওকে আগলে রাখতে নিজের কাছে নিয়ে গেছে। সত্যবাকের মনটা বড় কোমল, আর ভীষণ ভালোও বাসে অনূকাকে। কাল যখন অনূকার আঙুল কর্তন করা হয় তখন নাকি হাউমাউ করে কেঁদেছে সে।

গতকাল বেণ ভয় পেয়েছিলেন এই ভেবে যে দুটো আঙুল কর্তনের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অনূকার জীবনাশঙ্কা দেখা দেয় কি না, কিন্তু আঙুল কর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্য মশাই নানা রকম ঔষধির মিশ্রণ লাগিয়ে কবলিকা বেঁধে দেওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। তবু রাত্রে বেণ বৈদ্য মশাইয়ের বাটীতে গিয়ে তাকে অনুরোধ করে অনূকাকে দেখতে পাঠান এজন্য যে যদি কাটা স্থানের ব্যাথার বেগে অনূকার গাত্রতাপ বৃদ্ধি পায় কিংবা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বৈদ্য মশাইকে পাঠিয়ে বেণ বৈদ্য মশাইয়ের বাটীতেই অপেক্ষা করেছেন যতক্ষণ না বৈদ্য মশাই ফিরে আসেন। অনেক রাত্রে বৈদ্য মশাই ফিরে এসে জানান যে ব্যথার বেগে অনূকার গাত্রতাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, আর সে কারণে তার জ্ঞান কিছুটা লোপ পেয়েছে, প্রলাপ বকছে। তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই, তিনি নতুন ঔষধ সেবন করিয়ে দিয়ে এসেছেন আর সত্যবাকে বলে এসেছেন মাঝে মাঝে মাথায় জলপট্টি দিতে।

অনেক রাত্রে বৈদ্যমশাইয়ের বাটী থেকে ফিরে শয্যায় যান বেণ, নিদ্রা ভালো হয়নি, তার ওপর স্বপ্নে অনূকাকে দেখে নিদ্রা ভেঙে যায়। রাত্রে অনূকার গাত্রতাপ কমেছে কি না কে জানে! কন্যাটিকে একবার দেখার জন্য তাঁর চিত্ত চঞ্চল হয়, চিত্তকে আর প্রবোধ দিয়ে রাখতে না পেরে উঠে প্রবেশ দ্বারের রজ্জু খুলে বাইরে গিয়ে হাঁটতে শুরু করেন সত্যবাকদের বাটীর উদ্দেশ্যে। মানুষ এখনো ঘুমিয়ে থাকায় চারিদিক সুনসান। ফ্যাকাসে অন্ধকারে কিছুদূর হাঁটার পরই ডানদিকের একটি ঢালু সরু পথের দিক থেকে তাঁর কানে ভেসে আসে ঘোড়ার খুঁড়ের শব্দ। তিনি দ্রুত পথের বামদিকের একটি বৃক্ষের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন, অল্পক্ষণ পরই অশ্বারোহী মুল পথটিতে উঠে আসলে অশ্বারোহীকে তিনি চিনতে পেরে ডাকেন, ‘কুথান, কোথায় চললে?’

কুথান বুঝিবা কিছুটা চমকে ওঠেন, পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে প্রথমে কাউকে দেখতে পান না, পরক্ষেণেই বৃক্ষের আড়াল থেকে বের হয়ে তার দিকে এগোতে থাকা বেণকে দেখতে পেয়ে অশ্বের গতি রোধ করেন। বেণ দেখেন কুথানের পিছনে অশ্বের পিঠের দু-দিকে মাঝারি আকৃতির দুটি বোঁচকা, তিনি অশ্বের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কুথানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আবার যাচ্ছো কোথায়?’
কুথান বলেন, ‘আমার কী যাবার স্থানের কোনো ঠিক আছে! তবে এই বহির্ষ্মতীতে আর কখনো ফিরবো না, বাকি জীবন পাতাল-অতল-বিতলে-সুতল পরিভ্রমণ করেই অতিবাহিত করব।’

‘এভাবে কেন বলছ সখা, কেন আর বহির্ষ্মতীতে ফিরবে না?’

‘বহির্ষ্মতীতে ফিরলে আমার হৃদয়ের পীড়া বেড়ে যায়। এখানে আইনের শাসনের নামে নিরপরাধ মানুষকে অন্যায়ভাবে যেরূপ দণ্ড দেওয়া হয়, তা দেখে আমার হৃদয়ের পীড়া বেড়ে যায়। তাই আমি আর কখনো এখানে ফিরব না।’

‘তুমি অশ্ব থেকে নামো, তুমি এখন যেতে পারবে না। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।’
‘আমাকে বাঁধা দিও না সখা, যেখানে আমার হৃদয়ের শান্তি হয় না, সেখানে আমি থাকি না। কেবল ব্রহ্মাবর্ত আমার জন্মন বলেই আমি বারবার এখানে ফিরে এসেছি, কিন্তু আর নয়।’
‘বিশ্বাস করো, যা তোমার হৃদয়কে পীড়া দেয়, তা আমার হৃদয়কেও পীড়া দেয়।’

‘কিন্তু নৃপতি হয়েও তুমি তা সহ্য করছো দিনের পর দিন; ধর্মের নামে, শাস্ত্রের নামে মানুষের উপর যে নিপীড়ন চলছে তা তুমি বন্ধ করতে পারছ না! তুমি আমায় বলো তো, কী অপরাধ করেছে অনূকা? একজন কন্যা হয়ে আরেকজন কন্যাকে ভালোবেসেছে, ভালোবাসা তো অপরাধ নয় সখা। শুধু আজ নয়, সেই পুরাকাল থেকেই সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা প্রচলিত; পুরুষ পুরুষকে ভালোবেসে একসঙ্গে থেকেছে, নারী নারীকে ভালোবেসে একসঙ্গে থেকেছে। অতীতে কোনো একজন মনু আর্যদের দ্রুত বংশ বিস্তারের কথা চিন্তা করে হোক কিংবা নিজের সংকীর্ণ চিন্তার কারণেই হোক আবহমানকাল থেকে প্রচলিত সেই ভালোবাসার স্রোতে শাস্ত্রের বাঁধ দিয়েছেন। তাতেও কি এই ব্রহ্মাবর্তে মানবদের মধ্যে সমলিঙ্গে ভালোবাসা বন্ধ হয়েছে? হয়নি, পূর্বে যে ভালোবাসা প্রকাশ্য ছিল, তা এখন অন্তরালে চলছে। যে ভালোবাসায় স্বাধীনতার আনন্দ ছিল, উদযাপন ছিল, সেই ভালোবাসা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে, উদযাপন পরিণত হয়েছে ভীতিতে! যারা সমলিঙ্গপ্রেমী তাদের দুঃখ-কষ্ট বেড়েছে। তবু সমলিঙ্গপ্রেমীরা একে-অপরকে ভালোবাসছে, যাদের ভালোবাসা গোপন থাকছে তারা রক্ষা পাচ্ছে, আর যাদের ভালোবাসা প্রকাশ হয়ে পড়ছে তারা অনূকার মতো দণ্ডের মুখোমুখি হচ্ছে। ভালোবাসায় পাপের কলঙ্ক লগিয়ে অপরাধীর ন্যায় নিরপরাধ মানুষকে অন্যায়ভাবে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে। শুধু সমলিঙ্গে ভালোবাসা নয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্যার সৃষ্টি করেছে শাস্ত্র, দিন যাচ্ছে আর সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করছে। বিবাহ বিধায়ক শাস্ত্রে বিধবার পুনরায় বিবাহের কথা উল্লেখ নেই দেখে বিধবারা পুনরায় বিবাহ করতে পারছে না, কিন্তু বিপত্নীক পুরুষরা ঠিকই একাধিক বিবাহ করছে! বিধবারা বিবাহ করতে না পারায়, যারা অল্প বয়সে বিধবা হচ্ছে তারা গোপনে পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে, গর্ভবতী হচ্ছে, লোকলজ্জার ভয়ে বৈদ্য’র কাছ থেকে ঔষধি খেয়ে অনেকে গর্ভের বাচ্চা নষ্ট করছে, অনেকে নষ্ট করতে গিয়ে মারা যাচ্ছে। এর চেয়ে কি ভালো নয় বিধবাদের বিবাহ প্রথা পুনরায় চালু করা? কিংবা নিয়োগ প্রথার কথাই ধরো, নিয়োগ প্রথা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ থাকলেও সমাজে কি এর প্রচলন নেই? আছে, পূর্বে যা প্রকাশ্যে ছিল, এখন তা পুত্রেষ্টি যজ্ঞের নামে হচ্ছে! শুধু পুত্রেষ্টী যজ্ঞের পায়েস আহার করলে নারী গর্ভবতী হয় না, নারী গর্ভবতী হয় পুরুষের ঔরসে; সে-কথা আমি যেমনি জানি, তুমিও জানো, ব্রাহ্মণরাও জানে, সমাজের আরো অনেকেই জানে। তারপরও নিয়াগপ্রথা নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে! একজন বিধবা কিংবা একজন নিঃসন্তান নারী সন্তান কামনায় যদি স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষের সঙ্গ লাভ করে গর্ভবতী হয়, তাতে সমাজের কী ক্ষতিটা হয় বলো? অন্যদিকে ব্রাহ্মণরা একের পর এক অন্যায় করেও শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, আর লঘু পাপে গুরু দণ্ড হচ্ছে অব্রাহ্মণদের। তোমাকে নৃপতি করে নিজেদের স্বার্থে সমস্ত অন্যায় কার্য তোমাকে দিয়ে সাধন করিয়ে নিচ্ছে ওই দেব আর ব্রাহ্মণরা। শাস্ত্র দিয়ে দেব, মনু এবং ব্রাহ্মণরা তোমার চিন্তা, বিবেক, বুদ্ধি বন্দী করে রেখেছে; নৃপতি হয়েও তুমি একজন পরাধীন মানুষ সখা!’

‘তোমার প্রতিটি কথা আমি সত্য বলে স্বীকার করে নিচ্ছি সখা, এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তুমি বিশ্বাস করো আমার বোধকে প্রথম ধাক্কা দেয় ধনুশের মৃত্যু, এ বিষয়ে আমি পিতাশ্রীর সঙ্গে অনেক কথা বলেছি। তখন পিতাশ্রী আমাকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমার বোধে দ্বিতীয় ধাক্কা লেগেছে গতকাল অনূকার আঙুল কর্তনের পর। বিশ্বাস করো সখা, আমি সারারাত্রি নিদ্রার সুখ পাইনি, শাস্ত্রের বন্ধন থেকে মানুষকে বাঁচাবার উপায় খুঁজেছি শুধু।’

কুথান উপহাসের স্বরে বলেন, ‘এই ভোরের আঁধারে আবেগপ্রবণ হয়ে কথা বলছ তুমি, প্রভাতের আলো ফুটলেই নিত্যদিনের মতো তোমার দিন শুরু হবে, শাস্ত্রের যে রজ্জুতে বাঁধা ছিলে সেই একই রজ্জুতে বাঁধা দেবগণ এবং ব্রাহ্মণদের পালিত নৃপতি-ই থাকবে তুমি!’
‘না থাকব না।’ ক্রুদ্ধস্বরে আকর্ষিক চিৎকার করে ওঠেন বেণ, যা শুনে কুথানও চমকে ওঠেন, চমকে ওঠে কুথানের অশ্বও।
বেণ দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘আজ থেকে শাসনের নতুন সূর্য উদিত হবে ব্রহ্মাবর্তে, শুরু হবে নতুন দিন, ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার দিন। পুরোনো শাস্ত্র জলাঞ্জলি দিয়ে আমিই তৈরি করব ব্রহ্মাবর্ত শাসনের নতুন শাস্ত্র।’

কুথান অশ্ব থেকে নেমে বেণের ঘাড়ে হাত রেখে বলেন, ‘নৃপতির দর্শন তো এমনই হওয়া উচিত, দেব-ব্রাহ্মণদের পোষ্য বিড়ালের মতো নয়, দৃঢ় চিত্তের ব্যাঘ্রসম সেই নৃপতিকেই তো আমি দেখতে চাই।’

এবার বজ্রকণ্ঠে বেণ বলেন, ‘সখা, আমাকে একটিবার সুযোগ দিয়ে তুমি ব্রহ্মাবর্তে থেকে যাও। আজকেই আমি প্রমাণ দেব আমি পোষ্য বিড়াল, নাকি ব্যাঘ্র। আজ থেকে আমিই ব্রহ্মাবর্তের সর্বেসর্বা, আমিই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, আমি ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীন নৃপতি।’



(চলবে.....)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:০৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×